Nandita Misra

Classics

3.7  

Nandita Misra

Classics

প্রতিযোগী

প্রতিযোগী

5 mins
373


অর্ক অনেকক্ষণ থেকে দোয়েলকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। এই কাজটা সে গত তিনদিন যাবৎ সময় পেলেই সমানে করে চলেছে। দোয়েল যে, এমন কোনও কাজ করতে পারে, অর্কর মোটেই বিশ্বাস হয়না, আর তাই এই নজরদারী। কয়েকটা অর্থবহ লাইন তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। দোয়েল এমনিতে বেশ স্বাভাবিক। সে মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসে, অনর্গল কথা বলে, অথচ সেই মেয়ে, মনের ভেতর এমন ভয়ানক কিছু লালন করছে, কে জানতো। অর্ক'র রবিবারের জলখাবারটা বিস্বাদ লাগে। সে ঠিক করেছে দোয়েলের উপর ভালো করে নজরদারী চালাবে কয়েকদিন। তারপর সিদ্ধান্ত নেবে। তবে সেই চরম সিদ্ধান্ত নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। দিবারাত্রি বুকের ভেতর কষ্ট।


নিত্য প্রেমের ইচ্ছা নিয়ে তবুও চঞ্চল

পদ্মপাতায় তোমার জলে মিশে গেলাম জল,

তোমার আলোয় আলো হলাম, তোমার গুণে গুণ;

অনন্তকাল স্থায়ী প্রেমের আশ্বাসে করুণ ___


এর মানে কী? দোয়েলকে অর্ক ভালো বুঝতে পারে না। সে বরাবর দিল্লীতে বড় হয়েছে। দোয়েল কলকাতার মেয়ে। ম্যাট্রিমোনিয়াল দেখে বিয়ে হয়েছে তাদের। অর্ক বেশি গল্পের বই পড়েনি। ছোট থেকে তার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। দোয়েল তার উল্টো। বিভিন্ন ধরণের বই পড়তে সে খুব ভালোবাসে। দিল্লীতে বিয়ে হয়ে এসে, সে জহরলাল ইউনিভার্সিটিতে মাস কমিউনিকেশনসে এমএ তে ভর্তি হয়েছে। বিয়ের পর হানিমুন যাওয়া হয়নি তাদের। অর্ক'র অনেক স্বপ্ন ছিল এই নিয়ে, তখন দোয়েলের ভর্তির প্রসিডিওর চলছিল। দোয়েল হানিমুনে পরে যেতে চায়। সে পড়াশুনো নিয়ে খুব সিরিয়াস। অর্ক অফিস থেকে এসে প্রায়ই দেখে, ফ্ল্যাট ভর্তি ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী। তারা গ্রুপ স্টাডি করছে। বুকের ভেতরটা বাড়ি ফিরে এসে বিরক্তিতে ভরে গেলেও, বউয়ের কাছে উদারহৃদয় থাকতে চেয়ে, অর্ক এর প্রতিবাদ করেনা। এদের মাঝে কয়েকটি ছেলে আবার কবিতা লেখে। গা জ্বালা করে তার, যখন দেখে, দোয়েল ওদের কবিতার উত্তর দেয় কবিতাতে।

সেদিন রবিবারের সকাল। অর্ক এই দিনটা বেশ আমেজ করে কাটায়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনলাইনে সিনেমার টিকিট করেছে সে। এরপর যা ঘটলো, তা এরকম,


তুমি তা জান না কিছু, না জানিলে-

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক'রে!

যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে,

পথের পাতার মতো তুমিও তখন

আমার বুকের 'পরে শুয়ে রবে?

তুমি কি জানো না! আমার সত্ত্বার গভীরে বসবাসকারী কোনও কীটের মতো তোমার অস্তিত্ব। তুমি কি কেবল, এমন করে আমাকে ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত করে চলবে নিরন্তর?


চিঠিটা এখানেই শেষ। এ চিঠি ছোট, তবে একে প্রায় একটা ছোটখাটো পারমাণবিক বোমাই বলা চলে। অর্কর বুকের ভেতরটা চিঠিটা পড়ার পর থেকে খালি জ্বলছে। এর মানেটা কী? তাহলে বিয়ে করার মানে কী? সে তাহলে একজন থার্ড পার্সন? এটা হতেই পারে না। অর্কর নিজেকে এখন রীতিমতো অবাঞ্ছিত ও অপমানিত মনে হচ্ছে।

বরাবরের ভালো রেজাল্ট করা অর্ক জীবনে কোনওদিন কারুর কাছে হেরে যায়নি, কারুর পেছনেও থাকেনি প্রতিযোগিতায়। একটা বেসরকারী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর পদস্থ কর্মী অর্ক কয়েকদিন আগে বিয়ে করেছে। পড়াশুনো মন দিয়ে করতে গিয়ে, অর্কর নিজে থেকে বউ খোঁজা হয়নি।

বাবা মায়ের পছন্দের মেয়ে হলেও, অর্করও দোয়েলকে দেখে পছন্দ হয়েছে। দোয়েল অসম্ভব সুন্দর দেখতে। বিয়ে করে বেশ সুখে দিন চলছিল। দোয়েল বেশ মেধাবী। তার বই পড়ার নেশার কথা নিয়েও সে বন্ধুদের কাছে গর্ব করেছে। বলেছে,

আমার বউ এ জগতের বিরল প্রাণী। বাংলা বই খুব পড়ে। শখ নানা রকমের গল্প উপন্যাস ও প্রবন্ধের বই কেনার। সারাদিন বই নিয়েই সময় কাটায় সে।

অর্ক অফিস থেকে দেরী করে এলেও নো প্রবলেম। অর্ক দেখে বউ বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। ঘড়ির কাঁটার দিকে তার খেয়ালই নেই। মাঝে মাঝে তার দেরী করে আসার জন্য একটু রাগ করলেও পারে, তা নয়, বিটকেল বাংলা বইগুলো, অর্ডার মতো নিয়ে না এলেই দোয়েলের মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়।

আজ রবিবারের সকালে অর্ক বসে বসে, বাংলা খবরের কাগজগুলোই দেখছিল। বউয়ের আবদারে বেশ কয়েকটা বাংলা কাগজ আসে বাড়িতে। দোয়েল রান্নার লোককে কি রান্না হবে, বুঝিয়ে দিতে দিতে নিবিষ্ট মনে একটা কাগজ নিয়ে পড়ছিল। গল্পের পাতা। তারপর একটা ছোট্ট নোটবুকে কী যেন লিখছিল। অর্ক দোয়েলকে স্নানের তাড়া দিল। আজ তাদের একসঙ্গে আজ সিনেমা দেখার কথা।

দোয়েল উঠে যেতেই অর্ক, দোয়েলের নোটবুকটা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে, দেখতে পেয়েছে চিঠিটা। কবিতায় চিঠি লেখা হয়েছে। এবং চিঠিটা তার সামনে বসেই লুকিয়ে লুকিয়ে দোয়েল লিখছিল। কাকে লিখেছে এই চিঠি? কেন লিখেছে? দোয়েল কি কারুর প্রেমে পড়েছে? কোন ছেলেটা? সেই কলকাতার কেলানো ছেলেটা? যে একটু মেয়েলি ধরণের? নাকি দাঁড়িওয়ালা গম্ভীর ছেলেটা? বিয়ের পর দোয়েলের সারাদিন এই পড়াশুনো আর ছেলেদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা আর মোটেই সহ্য হচ্ছে না অর্কর।


এই তুমিটা কে, তাকে জানতেই হবে। না হলে আজই তাদের দাম্পত্য জীবনের শেষ দিন।

অর্ক মন খারাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সারাদিন ঘরেই আসে না। দোয়েল কয়েকবার তাকে মোবাইলে ফোন করেছিল। সন্ধ্যেবেলা ফেরার সময় মিসড্ কল এলার্ট দেখে বুঝলো অর্ক।

রাতে এক বিছানায় শুতেও তার খারাপ লাগে। অর্ক দেখে দোয়েল সেই নোট বইটা হাতে নিয়ে কী একটা লিখছে। অর্ক গম্ভীর ভাবে বলে,

কী লিখছো?

চিঠি লিখছি একজনকে।

বিশেষ কেউ?

হ্যাঁ, একজনকে বিশেষ কেউ তো বটেই। দোয়েল নোট বইটা তাড়াতাড়ি সাইড টেবিলে সরিয়ে রাখলো।

দোয়েল সকালে স্নান করতে গেলেই অর্ক নোট বইটা বের করে আনলো। এই নোট বই ডিভোর্স পেতে কাজে লাগবে। সে মোবাইলে ছবি তুলে নিল ফটাফট। চিঠিটা এইরকম,

তুমি কি বোঝো না? এত কাছের মানুষও যদি আমাকে না বোঝে, তবে তো বুঝবো, ঈশ্বরও আমাদের বোঝেন না! আমার মনের কত কাছে বাস করো তুমি। অথচ, দিল্লী বুক ফেয়ারে আমার দিকে হেসে তাকালেও, সারাক্ষণ অন্যদের সঙ্গেই সময় কাটালে তুমি। আমি কতকাল ধরে তোমার অপেক্ষা করছি তুমি জানো না? একবার আমাকে দেখে কলকাতায় তোমার বাড়িতে গীতগোবিন্দ থেকে উদ্ধৃত করে কী বলেছিলে মনে আছে?

বিনোদয়ন্তী দয়িতং সুকেশী

সুকঙ্কনা চামর-চালনেন।

কর্ণে দধানা সুরপুষ্পগুচ্ছম্

বরাঙ্গনেয়ং কথিতা বরাড়ী।।

এরপরেও সম্পর্ক রাখা চলে? শুধু একবার চিঠিগুলো সামনে মেলে ধরে জিজ্ঞাসা করবে সে দোয়েলকে, এর মানে কি? বিয়ে করা দোয়েলের মোটেই উচিৎ হয়নি। কিন্তু, দোয়েলের মুখ চোখে এক অপূর্ব সারল্য আছে। কিছুতেই দোয়েলকে ব্যাভিচারিনী ভাবতে পারছে না অর্ক। দোয়েলের অনুপস্থিতিতে ওর ফোনটাও ঘেঁটে দেখেছে অর্ক। কল লিস্টে কলকাতার কোনও নম্বর নেই। মানুষটি কে? এইটুকু শুধু জানতে হবে। অর্ক অফিস থেকে ফেরার পথে একজন ল ইয়ারের চেম্বারে গিয়ে প্রাথমিক কথা সেরে এল। উকিল ভদ্রলোক চিঠিগুলো মন দিয়ে দেখলেন।

মনে হচ্ছে, আপনার স্ত্রী অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। আপনি কী করতে চান?

ডিভোর্স।

আপনি আপনার স্ত্রী'র বিরুদ্ধে এই প্রমাণগুলো যত্ন করে সংরক্ষণ করবেন। এগুলো সবই আদালতে জমা করতে হবে।

                                      

                                          ২

এ বাবা! এই চিঠিটাগুলো তুমি পড়েছ? কবিতাগুলো তো জীবনানন্দের। সবই আমার সুনীপবাবুকে লেখা ব্যক্তিগত চিঠি। অনেকদিন পরে কাগজে ওঁর গল্প পেলাম তো তাই, সেদিন আবেগে লিখেছিলাম। ওঁকে আমি ভালোবাসি। তবে এ ভালোবাসা এক পক্ষের। লেখক জানতেও পারেন না পাঠকের এ ভালোবাসার কথা। আমি কলকাতায় থাকতে, ওঁর বাড়িতেও একবার গেছিলাম।

আমার কানে ঝোলা দুল দেখে, উনি জয়দেব থেকে উদ্ধৃত করে কবিতা বলেছিলেন। ওঁর বয়স কত জানো? বাষট্টি! তবে কী জানো, বোধহয় লেখকও পাঠকের মন ছুঁতে পারেন! তাই তো কত অনায়াসে আমাদের মনের কথাগুলো লিখে দেন। লেখকদের বোধহয়, বয়স বাড়ে না। তুমি ঠিক এসব বুঝবে না। তুমি তো একেবারেই সাহিত্য পড়ো না। যদি অন্ততঃ আমাকে বুঝতে চাও, একটু আধটু বই পড়তে হবে মশাই!

কথার মাঝখানেই উকিল ভদ্রলোক ফোন করলেন অর্ককে,

 অর্কবাবু কথা বলেছেন? আশা করি খুব তাড়াতাড়ি আমরা মিট করছি।

না, আপনার একটু ভুল হচ্ছে। আমাদের বোধহয়, আর দেখা হবে না। বাঙালি হয়ে যদি বাংলা সাহিত্য একটুও পড়তাম, তাহলে আপনার সঙ্গে মোটেই দেখা হতো না আমার।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics