রাত্রি এসে যেথায় মেশে
রাত্রি এসে যেথায় মেশে


এই গল্পটি আমার এক বান্ধবীকে নিয়ে। যে ভুলের বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তার বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। আজ সাহিত্যের অনুপ্রেরণায় আমি তাঁকে স্মরণ করলাম।
চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে অপর্ণা। ব্যাঙ্কের একটা স্টেটমেন্ট। যেখানে অর্কর পিপিএফ অ্যাকাউন্টের টাকার প্রাপক হিসেবে একজন অচেনা মেয়ের নাম লেখা আছে। অর্ক আর তার সম্পর্কটা কেন জমাট বাঁধেনি, এতদিন বুঝতে পারেনি অপর্ণা। এখন বিষয়টা স্পষ্ট হল। এই নামের মহিলা অর্ককে প্রায়ই ফোন করে। অর্ক তাকে বলেছে ইনি ওর ক্লায়েন্ট। এই লুকোচুরির খেলার কোনো দরকার ছিল না। অপর্ণা ছেলেমানুষ নয়। এতকিছুর পরে তবুও অপর্ণার দু চোখ বেয়ে শ্রাবণের ধারার মত অশ্রুরা বাধাহীন নেমে আসছে। অপর্ণা নিজেকে প্রশ্ন করে, এই কান্না কেন? মন থেকে অর্ককে সত্যিই কি তুমি ভালবাসো? এর উত্তর তোমার জানা। তবে কাঁদছো কেন?
অপর্ণা দার্ঢ্য কন্ঠে নিজেই নিজেকে বলল,
''এই কান্না প্রবঞ্চিত হওয়ার বেদনা। এই কান্না এক স্ত্রীর, যে দীর্ঘ কুড়ি বছর একটি মানুষের সঙ্গে এক ছাদের তলায় থেকেছে। অপর্ণা উঠে দাঁড়াল। তার আঁচল মেঝেতে লুটাতে লাগল। চোখের প্রান্তে লেগে আছে দু এক কুঁচি মুক্তদানা। সে একটা সিদ্ধান্ত নিল। তাকে যেতে হবে।
সবে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। একটা ম্লান আলোয় চরাচর ভরে উঠেছে। চারদিক অদ্ভুত শান্ত। দুই বিপরীত দিক থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আসছে। তাদের চোখ মুখ কিছুটা দিশাহারা। যেন কোথায় এসেছে ওরা ঠিক বুঝতে পারছে না। ম্লান আলো ও শূন্য চরাচর যেন ওরা দেখতেই পাচ্ছে না। ওদের চোখে মুখে ধীরে ধীরে খুশির চিহ্ন ফুটে উঠল। মেয়েটি ছেলেটিকে বলল,
''শুভদা তুমি এখানে?''
''অপু তুই? ওখানে সবকিছু বড় মেকী, তাই চলে এলাম, কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারলাম না। আর তুই?''
''আমিও পারছিলাম না। তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে সারাজীবন আমিও কখনও এতটুকু ভাল থাকিনি শুভদা।''
-''কার উপর অভিমান করে চলে এসেছিস?''
-''কারুর উপর নয়। আসলে আমি আমার বুকের ভেতরের সব পদ্মগুলো সেই কোন ছোটবেলায় তোমাকে দিয়ে রেখেছিলাম শুভদা! আর তো আমার কিছুই নেই! আমার বর অর্ককে দোষ দিয়ে আর কী লাভ! আমার বরের আরও একটা আলাদা সংসার হয়েছে। লোকটা আমাকে নিয়ে বড় অসুবিধায় পড়েছিল। দিবারাত্রি ওকে লুকোচুরি করতে হচ্ছিল! দিনে রাতে কখনও ও স্বস্তি পাচ্ছিল না। আমার ছেলেটারও একটা গতি হয়েছে, আইআইটিতে পড়ছে এখন। কলেজের সেই দিনগুলোতে কী বোকা যে ছিলাম! তোমাকে অভিমান করে দূর করেছিলাম! আর তুমি?''
-''বললে বিশ্বাস করবি? আমি তোকে কখনও ভুলতেই পারিনি। বিয়ে আর করিনি।
-''তবে যে খবর পেয়েছিলাম!''
-''আমার বিয়ের খবর যা পেয়েছিলি সব ভুয়ো। রটিয়েছিলাম এই ভেবে, যে এতে তুই ভাল থাকবি।''
-''একসঙ্গে জীবন কাটানো আমাদের কপালে নেই শুভদা।''
''-ভুল। তাহলে এতবছর পর আমাদের এখানে আবার দেখা হল কেন? বুঝিস কেন?''
''লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে নিল অপর্ণা।''
-''লজ্জা পেলে তোকে এখনও ভারি চমৎকার দেখায়। তা এখন যাবি কোথায় কিছু ঠিক করেছিস?''
-''কী জানি কোথায় যাব? এদিককার কিছুই যে বুঝতে পারছি না শুভদা! সব কেমন অচেনা। এক অচেনার রাজ্য যেন।''
''জায়গাটা কিন্তু বেশ লাগছে আমার! খানিকটা যেন কলেজস্ট্রিট চত্বরের মত। ভালো করে চেয়ে দেখ্!''
আরে! কলেজস্ট্রিটই তো। আমাদের দুজনেরই প্রিয় জায়গা।
''হ্যাঁ তাই তো! কলেজ স্কোয়ারের অমলতাস গাছটা দেখতে পাচ্ছি। এখানেই তুই শেষবারের মত আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি।''
''ওই দেখো বৃষ্টি পড়ছে। এসো সেই আগের মত ভিজবে?''
''যাঃ আমরা তো এখন অনিকেত। আমাদের তো দেহই নেই!''
''তাতে কী হল! দেখো আমরা কেমন আবার আগেকার আমাদের সেই মনটা ফিরে পেয়েছি! চলো জলের উপর ছুটে বেড়াই! কী মজা! এসো, এসো!''
-----------------------------------------------------------------------------------