ঝুমঝুমির প্রেম
ঝুমঝুমির প্রেম


মন দিয়ে আচার খেতে খেতে ঝুমঝুমি ভাবছিল, এতদিনে সে সত্যি সত্যি কারও প্রেমে পড়েছে। কবি ও সাহিত্যিকরা প্রেম সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু একটা কথা কি কেউ বলেছেন? যে প্রেমে পড়লে সব সময় মনে খুব আনন্দ হয়। চিৎকার করে নিজের প্রেমকাহিনী সবাইকে বলতে ইচ্ছা করে, গান বেসুরো শোনালেও গাইতে ইচ্ছে হয়----- এমন আরও কত কী! কবি বা সাহিত্যিকদের কথা বেশি জানে না ঝুমঝুমি। গল্পের বই পড়ার অভ্যেস তার কোনওকালেই নেই। বই পড়বে কি! সে এক জায়গায় চুপ করে বেশিক্ষণ বসতেই পারত না এতদিন। তার ধৈর্যের বড় অভাব।
নিঝুম দুপুর। চারদিক একেবারে খাঁ খাঁ করছে। এ বাড়িতে এই সময় বেশি কেউ থাকে না। ঝুমিঝুমি ছাদের পাঁচিলে হেলান দিয়ে বসে নিজের কথাই ভাবছিল। এখন তার খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়, এই যেমন এক সপ্তাহ হয়েছে তার একখানা নতুন জীবন শুরু হয়েছে। একটা অচেনা বাড়িতে এসে সে হঠাৎ থাকতে শুরু করেছে----- সেই সব নিয়ে খানিক এলমেলো বকবক করতে মন চাইছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এখন তার হাতে একটা বই। বেশ মোটাসোটা একটা বই দেখা যাচ্ছে। অরুন্ধতী রায়ের 'মিনিস্ট্রি অফ আট মোস্ট হ্যাপিনেস'। একজনের কথায় ঝুমঝুমি এখন খুব বই পড়তে শুরু করেছে। এতদিন সে যা মোটেই ভালোবাসত না। অথচ সেটাই সে এখন দারুণ ভালোবেসে করছে। প্রেমের এ-ও এক অদ্ভুত কাণ্ড বলা যায়। আগের ঝুমঝুমি আর এখনকার ঝুমঝুমির বিস্তর ফারাক।
এসব কথা মোটেই ঝুমঝুমি তার বরকে বলতে পারবে না। কারণ বেশিরভাগ কথাগুলোই তাকে নিয়ে। তার বুকের ভেতর কথার পাহাড়, অথচ কাকে বলবে সে এত কথা? ঝুমঝুমির দুই বন্ধু জিয়া আর তিয়াসা। ওরা দুজনেই এখন এমএসসির অ্যাডমিশন নিয়ে ব্যস্ত। সেও অ্যাডমিশন নিয়েছে। তার নাম ইউনিভার্সিটির লিস্টের একদম প্রথমদিকেই ছিল। এত ভাল নম্বর পেয়ে অনার্স পাস করে, সে বিয়ে করছে এই খবর পেয়ে ওদের মুখে কেমন যেন একটা তাচ্ছিল্য-মাখা করুণা দেখতে পেয়েছিল ঝুমঝুমি। তাই ওদের সে কিছুতেই ফোন করবে না। বাকি থাকল দাদু, বাবা আর দাদা। এদের কাউকেই এসব কথা বলা যাবে না।
ঝুমঝুমির মা মারা গেছেন তার ছোটবেলায়। ছোট থেকে দাদুই তাকে মানুষ করেছেন। তাদের বাড়িতে সে হল একমাত্র মেয়ে, আর তাই হয়তো প্রচণ্ড আদর এবং প্রশ্রয়ে বড় হয়েছে সে। ঝুমঝুমির দাদু প্রাণগোপাল মুখোপাধ্যায় হলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এখন বয়সের জন্য ব্যবসার সব ভার তাঁর ছেলেকে ছেড়ে দিলেও, ঝুমঝুমিদের বাড়িতে এখনও তাঁর কথাই শেষ কথা। ঝুমঝুমি কিছুতেই তার বন্ধু জিয়া আর তিয়াসাদের বোঝাতে পারেনি যে, তার দাদু এখনও প্রায় মধ্যযুগের গৌরীদান প্রথায় বিশ্বাসী। তার বিয়ে আরও কয়েক বছর আগে দিতে পারলে, দাদু আরও বেশি খুশি হতেন। দাদুর কথাতেই কলেজ পাশ করতে না করতেই মাত্র একুশ বছর বয়সে ঝুমঝুমিকে বিয়ে করতে হয়েছে।
বিয়েতে প্রথম থেকেই একেবারে মত ছিল না, ঝুমঝুমির। একে তো তার হবু বর তার থেকে দশ বছরের বড়, তার উপর আবার ডাক্তার! তিনি চশমা পরেন আর খুব গম্ভীর। এরকম গোমড়ামুখো সিরিয়াস ছেলেদের একদম ভাল লাগে না ঝুমঝুমির। ঝুমঝুমি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশুনো করেছে, সে যাকে বলে একেবারে এ যুগের মেয়ে।
ঝুমঝুমির যাকে ভাল লাগে সে হল—জিকো। সে যাকে বলে একেবারে চোখা স্মার্ট ছেলে। তীব্র বেগে বাইক চালায়, চুলে জেল আর স্পাইক। চোখে রঙিন সানগ্লাস। পরনে বডি হাগিং জিন্স আর বুক খোলা শর্ট শার্ট। শার্টের উপর থেকেই স্পষ্ট ফুটে ওঠে ওর পেশীবহুল শরীর। জিকোর বাইকে সওয়ার হয়ে ঝুমঝুমির মনে হত তার দুটো ডানা হয়েছে। সে চোখ বন্ধ করে শক্ত করে জিকোর কোমর জড়িয়ে ধরে বসে থাকত। বাইক উড়ে চলত শহরের নানা প্রান্তে। তারপর সিনেমা, অজস্র এলোমেলো কথা আর এন্তার খাওয়া দাওয়া। জিকো বাবা মায়ের কাছ থেকে ভাল হাতখরচ পেত, তাই দেদার খরচ করতে কোনো বাধা ছিল না ওর। এদিক থেকে বলা যেতে পারে জিকো খুবই উদার মনের ছেলে।
বিয়ে ঠিক হতেই ঝুমঝুমি জিকোকে বলল,
-জিকো, আমার বিয়ে! জিকো হাসতে হাসতে বলেছিল,
-নো প্রবলেম ডিয়ার!
-মানে?
-মানে বিয়ে করে নে।
- আর তুই?
-আমি যেমন আছি থাকব। তুইও বিন্দাস থাক। আমরা মাঝে মাঝেই দেখা করব। এবার তো ছাড়পত্র পেয়েই গেছিস! মানে মাথায় লাল স্ট্যাম্প। জিকো হাতের ইশারায় ঝুমঝুমির সিঁথিটা দেখাল। বলল,
-আমাদের রিলেশন, আউটিং যেমন চলছিল সবই চলবে। বর ডাক্তার হওয়ায় মস্ত সুবিধা রে! ব্যাটা সবসময় পেশেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, আর আমরা দুজন মস্তিতে থাকব। শুধু এরপর থেকে তোর হবে ডবল রোল। একজন জিকোর গার্লফ্রেণ্ড আর অন্যজন ডাক্তারের বউ, ব্যস্।
জিকো এত সহজে সবটা উড়িয়ে দিল দেখে, ঝুমঝুমির চোখে জল এসে গেল। সে তাড়াতাড়ি চোখের জল লুকাল। জিকোর উপর তারও যে বিরাট মানসিক দুর্বলতা আছে তা নয়। এখন ঝুমঝুমিদের বয়সি সবারই এমন দু-একটা সম্পর্ক থাকে, এবং এইসব সম্পর্কে তৈরি করাকে ঝুমঝুমিদের প্রজন্মের সবাই তাদের আবশ্যিক কর্তব্য বলে মনে করে।
ঝুমঝুমিও সপ্তাহের আউটিং আর এন্টারটেনমেন্ট এর জন্য জিকোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। ক্লাশ ইলেভেন থেকে জিকো তার ফেসবুক ফ্রেণ্ড। সামান্য ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে তাদের। অন্ধকার সিনেমা হল এ, এবং ওর বাইকে সওয়ার হয়ে। কারণ অত জোরে বাইক চললে, খানিকটা ঘনিষ্ঠ না হয়ে বসা সম্ভবই নয়। যদিও জিকো আর ঝুমঝুমি দুজনের কাছে সেসব হল শুধুই মজা--- জাস্ট ফান অ্যাণ্ড এন্টারটেনমেন্ট!
তবে ঝুমঝুমির এখনকার সমস্যা একেবারে অন্য। তার সঙ্গে এমন একজন মানুষের সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে, যিনি অত্যন্ত কঠিন এবং কঠোর মানুষ। যার কাছে এই ধরণের আচরণের নাম হল ব্যভিচার।
ঝুমঝুমির বরের নাম তপোব্রত ব্যানার্জী। সে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের কৃতী ছাত্র ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে খুব ধীরস্থির ভাব। স্কুলের শিক্ষক ছিলেন যেসব সন্ন্যাসী মহারাজেরা, তাঁরা বলতেন,
'তপোব্রতর সব থেকে বড় গুণ হল তার ধৈর্য্য।'
মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করার পর সে মেডিসিনে পোস্ট গ্যাজুয়েশন করেছে। এখন শহরের বেশ কয়েকটি নামি দামি নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে চরমতম ব্যস্ত জীবনযাপন করছে। ডাক্তারি ছাড়া তার একমাত্র ভাললাগা বিষয় হল বই। সে মোটামুটি একজন সর্বভূক পাঠক। যে কোনো বিষয় পেলেই সে পড়তে শুরু করে। পড়ার ব্যাপারে তার কোনও বাছবিচার নেই। বাংলা এবং ইংরাজি দু-ধরণের সাহিত্যই সে পড়তে ভালবাসে। তার বাড়ি যেন একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি, এমনকী তার গাড়ির ড্যাশবোর্ড আর ডিকিতেও বেশিরভাগ সময় থাকে অজস্র বই।
তপোব্রত আর ঝুমঝুমির দাদা দুজনেই নরেন্দ্রপুরের ছাত্র ছিল। একদিন কলেজস্ট্রিট চত্বরে হঠাৎ দুই বন্ধুর দেখা হয়ে গেল। আকস্মিকভাবে সেদিন ঝুমঝুমির দাদু প্রাণগোপালবাবুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বইয়ের দোকানে নামেননি, গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলেন। তপোব্রতকে দেখা মাত্রই তাঁর খুব পছন্দ হয়ে যায় এবং তখনই তাকে বিয়ের প্রস্তাবও তিনিই দেন।
ঝুমঝুমি গল্পের বই পড়ে না। মাঝেমধ্যে ইউটিউবে সিনেমার ট্রেলার দেখে সে। একটা গোটা সিনেমা বসে বসে দেখতে তার বয়েই গেছে। কোনও কাজে সে বেশিক্ষণ লেগে থাকতে পারে না। তার ধৈর্য্যই ধরে না। এমন সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের দুটি মানুষ একদিন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। বিয়ের আগে পাত্র পাত্রীর কথা বলা বা মেলামেশা দাদু একদম পছন্দ করেন না। তাই বিয়ের আগে পর্যন্ত ঝুমঝুমি ও তপোব্রত কেউ কারুর সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেই পারল না। ঝুমঝুমিকে দেখে তপোব্রতর পছন্দ হল। একপলক দেখে তার ঝুমঝুমিকে সরল সোজা বলেই মনে হল, তাছাড়া ঝুমঝুমি মেধাবী এবং সুন্দরী। তবে একবারও ঝুমঝুমির মতামত নেওয়া হল না। দাদু জেদ করে বিয়ের দিনও ঠিক করে দিলেন। নাতনীকে তিনি বুকে করে মানুষ করেছেন, তাই ঝুমঝুমির উপর তার জোর সবার চেয়ে বেশি। দাদু সবাইকে বললেন,
-আমি মানুষ চিনি। এতবছর ব্যবসা করে চুল পেকেছে। এ ছেলে হল খাাঁটি ছেলে। একালে এমন ছেলে আর পাবে না।
প্রাণগোপালবাবুর কথায় বাড়ির সবাই-ই মত দিল। কেবল ঝুমঝুমি চুপ করে থাকল। তার মতামত কেউ চায়নি।
তপোব্রত বিয়েতে হইচই পছন্দ করে না, একথা আগেই সবাইকে জানিয়েছিল। তার কথামতো হাতে গোনা পাঁচ-ছজন বরযাত্রী এসেছিলেন এবং তপোব্রতর ইচ্ছায় বিয়ের কোনও আচার অনুষ্ঠানও হয়নি। তাদের শুধু রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়েছিল। সকালবেলাতেই বিয়ে সারা হয়ে গেল। ঝুমঝুমির দাদু আর বাবা বিগলিত চিত্তে বরের সব শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। ঝুমঝুমি তো অবাক! একদিনের জন্য নায়িকা হওয়ার এমন সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল! সবই এই বিশ্বপাকা সবজান্তা লোকটার জন্য!
সকালে বিয়ে সেরে বিকেলে ঝুমঝুমিকে নিয়ে আসার সময় তপোব্রতর গাড়িতে ওর দুজন
ডাক্তার বন্ধু ছিলেন। গাড়িতে পুরো সময়টাতে তিনবন্ধু বিভিন্ন ডাক্তারি আলোচনা করে চলল। বেশিরভাগই মেডিক্যাল টার্মস্, ঝুমঝুমি আড় চোখে কয়েকবার তপোব্রতকে খেয়াল করে দেখল, তপোব্রতর মুখ গম্ভীর। আলোচনায় অন্য দুজন কথা বললেও, ঝুমঝুমির গোমড়ামুখো বর কেবল শ্রোতার ভূমিকায় ছিল। কেউ একবারও ঝুমঝুমির দিকে খেয়ালই করছে না। সে যে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ বসে আছে, সে কথা যেন সকলে ভুলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে তিনজনেই তার অনুমতি না নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে খেতে শুরু করল। তার যে এতে কষ্ট হতে পারে, বা অসুবিধা হতে পারে, এদিকে যেন কারুর নজরই নেই। ঝুমঝুমি ভয়ানক রেগে গেল। মনে মনে কড়া কথা শোনাবে মনে করলেও, যেহেতু তপোব্রত সঙ্গে তার খুব একটা আলাপ নেই, এবং তার সবে নতুন বিয়ে হয়েছে---- এই কথা ভেবে সে চুপ করে বসে রইল। রাগে তার গা জ্বালা করছে, কথা শোনাবার জন্য জিভ উৎসুক। নেহাত ভদ্রতা রক্ষার জন্য চুপ করে থাকল ঝুমঝুমি। তারপর কী করবে খুঁজে না পেয়ে সে নিরুপায় হয়ে একটু শব্দ করে কাশল।
ঝুমঝুমির কাশি শুনে বাকি দুজন ডাক্তার তাদের সিগারেট ফেলে দিলেও তপোব্রত সিগারেট ফেলল না। তপোব্রতর মুখ যেন রাগে থমথম করছে। ঝুমঝুমির একটু ভয় করে উঠল, ব্যাপারটা কী?
ঝুমঝুমির শ্বশুরবাড়ি সল্টলেকে। ও বাড়িতে কেউ কোনো লোকাচার মানেন না। পুজোপাঠেরও কোনো বালাই নেই। তাই বাসর এবং কালরাত্রি কিছুই মানা হবে না। অবশ্য বউভাতের একটা পার্টি হবে বলে সে শুনেছিল, তবে ঝুমঝুমি দেখল, বাড়িতে একজনও আত্মীয় উপস্থিত নেই। হয়ত, সকলে পরে আসবেন। বাড়িতে ঝুমঝুমিকে নিয়ে লোকসংখ্যা চার। তপোব্রত ও ঝুমঝুমি ছাড়া আছেন তপোব্রতর বাবা এবং তার বিধবা পিসি।
এবং সর্বনাশের কথা হল, রাতে ঝুমঝুমির শোওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে তপোব্রতরই খাটে!
পাড়ার একজন বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তপোব্রত বাড়ি ফেরার পরেই সেখানে চলে গেছে। এ বাড়ির রান্না ও অন্যান্য কাজ, সকালে দুজন কাজেরলোক এসে সেরে রেখে যায়। নিঝুম নিস্তব্ধ বাড়ি। ঝুমঝুমির এমন বাড়ি একদম ভালো লাগে না। সে অবশ্য বেশি কিছু ভাবতেও চাইল না। রাত হয়ে যাচ্ছে বলে, পিসি তাকে খাবার বেড়ে দিল। তপোব্রত তখনও ফেরেনি। ঝুমঝুমি খেয়ে নিল। রাতে সে চিকেন স্যুপ আর রুটি খাবে বলায়, তাকে তাই-ই দেওয়া হল।
ঘরে ঢুকে ঝুমঝুমি দেখল, তপোব্রতর বিছানায় নতুন সাদা চাদর পাতা রয়েছে। ঘরে ফুলদানিতেও গুচ্ছ গুচ্ছ রজনীগন্ধা সাজানো। ঝুমঝুমির কিন্তু ঘরটা বেশ ভালো লাগল। একটা বই হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। রাত প্রায় তিনটে নাগাদ তার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। ঘরে মৃদু শব্দে চমকে উঠে ঝুমঝুমি দেখল, তপোব্রত কখন ঘরে ঢুকেছে। তার পরনে সাদা ফতুয়া আর পাজামা। সারা ঘর আমোদিত করে তুলেছে বিদেশি সুগন্ধের ঘ্রাণ। সে গভীর রাতে অচেনা পুরুষের সঙ্গে এক বিছানায় শুতে হবে ভেবে, অস্বস্তিতে আর ভয়ে কাঁটা হয়ে গেল। ঝুমঝুমি ভাবল, ঘুমের ভান করে চুপচাপ পড়ে থাকবে, কোনো কথা বলবে না।
-''ঝুমি! ঘুমাচ্ছো? না জেগে?''
ঝুমঝুমি ভাবে এই রে! জেগে আছি বুঝতে পেরে গেছে নাকি? সে চোখ খুলতেই কঠিন মুখে তপোব্রত বলল,
-''আমাকে আজ সকালে তোমাদের বাড়িতে বেরনোর আগে তোমার বন্ধু জিকো ফোন করেছিল।''
শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঝুমঝুমি একটা হার্টবিট মিস করল। সে চুপ করেই থাকল। তার বুক ভয়ানক ঢিপঢিপ করতে লাগল।
-''আমাকে ও খুব নোংরা নোংরা কথা বলছিল, তোমার সম্পর্কে। অবশ্য আমি সবটা বিশ্বাস করিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম, বিয়েটাই করব না। তারপর তোমার দাদুর কথা ভেবে খারাপ লাগল। তিনি বোধহয়, এসবের কিছুই জানেন না। মাঝখান থেকে কষ্ট পাবেন।
আমার জীবন খুব বোরিং। সারাদিন ধরেই কাজের মারাত্মক চাপ। দেখো! আজ আমাদের যৌথ জীবনের প্রথম রাত, অথচ কেমন বিশ্রী হয়ে গেল তাই না! তুমি যদি দাদুর কথায় বাধ্য হয়ে বিয়েটা করে থাকো, তাহলে এই সম্পর্কটাকে আর না বাড়ানোই ভাল। যদি ফিরে যেতে চাও যেতে পারো। এমনকী যদি এখানে থেকে ওই ছেলেটি, মানে জিকোর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে যেতে চাও, রাখতে পারো। আমার তাতেও কোনও আপত্তি নেই।
আসলে, তুমি যদি মন থেকে আমাকে গ্রহণ করতে না পারো, পাশাপাশি থাকার কোনও মানে হয় না। শরীর ছাড়াও মানুষের পরম আশ্চর্য একটি বস্তু আছে, যার নাম মন। মন আছে বলেই সে পশুদের থেকে আলাদা। আমাকে শরীর দেবে, মন দেবে অন্য কাউকে---- সেটা ঠিক নয়। তুমি ভেবে নিয়ে আমাকে জানিও।''
এরপর তাদের আর কোনো কথা হয়নি। তপোব্রত ওপাশ ফিরে শুয়েছিল। ঝুমঝুমি এপাশ। মাঝখানে একখানা মোটা কোলবালিশ। শুয়ে শুয়ে ঝুমঝুমি জিকোর বাপের শ্রাদ্ধ করছিল। জিকো এতবড় বিশ্বাসঘাতক! ওকে কিছুতেই ছাড়বে না সে। খুন করে ফেলবে একদম!
বিয়ের পরেরদিন একটু বেলা হতেই ঝুমঝুমি শাড়ি ছেড়ে জিনস্ আর ঢিলে একখানা কুর্তি পরে তৈরি হয়ে নিল। তার গায়ে এখন একটাও গয়না নেই, কেবল মাথায় একচিলতে সিঁদূর। বাড়িতে এখন তপোব্রতর পিসি ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা ও ছেলে সকাল সকাল জলখাবার খেয়েই তাদের কর্মক্ষেত্রে বেরিয়েছে। এ বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষে এতটুকু হইচই নেই। সব আত্মীয়রাই দুপুর থেকে আসতে শুরু করবে। আগামীকাল বউভাতের পার্টি হওয়ার কথা, তার জন্য ম্যারেজহল ভাড়া নেওয়া আছে। ঝুমঝুমি পিসিকে একটু দরকার আছে বলে বাড়ি থেকে বের হল। পিসি হেসে বললেন,
-''তাড়াতাড়ি ফিরো। তপোব্রতর মামা মামিরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাকে আশীর্বাদ করতে এখানে চলে আসবেন।'' উত্তরে ঝুমঝুমি কষ্ট করে কেবল একটু হাসল।
সকাল থেকে জিকোকে সে ফোনে পাচ্ছে না। তাতে রাগে ঝুমঝুমির কান মাথা সব ঝাঁ ঝাঁ করছে। এইমুহূর্তে সে জিকোর সামনে যেতে চায়। তাই বাধ্য হয়ে ওর বাড়িতেই সে যাচ্ছে। ওর কাছে ঝুমঝুমি জানতে চায়, কেন ও এমন করল? তার বিবাহিত জীবনের যেন ছানা কেটে গেছে, এবং তা শুধুমাত্র জিকোর জন্য। জিকোদের বাড়িও সল্টলেকে। এখান থেকে বেশিদূরের পথ নয়। সে একটা অটোয় উঠে বলল,
-বৈশাখি চলো।
জিকোকে ওর বাড়িতেই পাওয়া গেল। ওর বাবা মা শিলং বেড়াতে গেছে। বাড়িতে জিকো একা। অনেকক্ষণ ডোর বেল বাজানোর পর, ঝুমঝুমিকে দরজা খুলে দিয়ে জিকো নির্লজ্জভাবে একগাল হাসল। তার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুল উস্কোখুস্কো। হাসতে হাসতে বলল,
-কাল থেকে তোর কথা ভেবে ভেবে রাতে একফোটা ঘুম হয়নি, সকালবেলায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঝুমঝুমি ঘরে ঢুকেই ঠাস করে একটা চড় মারল জিকোর গালে। মুহূর্তে বদলে গেল জিকোর মুখ। ঝুমঝুমির হাতটা সজোরে পিছনে টেনে মচকে দিল সে নির্লজ্জভাবে। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল আবেগে চুমু খেতে লাগল। ঝুমঝুমি নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। তার কেন জানি না একদম ভাল লাগছে না। একজন গোমড়ামুখো মানুষের মুখ মনে পড়ছে তার। বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল ঝুমঝুমির।
এরই মধ্যে জিকো তার শরীরটা দলে পিষে ওর বিছানায় টেনে এনেছে। ছটফট করতে থাকা ঝুমঝুমির মুখে হাত চাপা দিয়ে জিকো বলল,
-তোর জন্য খুব মন খারাপ করছিল, সেদিন তাই তোর বরকে ফোন করেছিলাম। আমি জানতাম তুই এখানে আসবি। দু-হাত দূরেই তো থাকিস! তোকে আগে আমি টেস্ট না করে, কী করে ডাক্তারবাবুকে হ্যাণ্ডওভার করি বল্? আর কালই যে তোর ফুলশয্যা! মনে রাখিস, তুই আগে আমার গার্লফ্রেণ্ড, পরে ডাক্তারের বউ, তাই না?
ছটফট করতে করতে হাতের কাছে খাটের মাথার ধারে একটা কাচের ফ্লাওয়ার ভাস পেয়ে গেল ঝুমঝুমি। তারপর ওটা দিয়ে শরীরের সব শক্তি জড়ো করে জিকোর মাথায় আঘাত করল সে। আঘাতটা ঝোঁকের মাথায় বেশ জোরে করে ফেলেছে ঝুমঝুমি। অক! করে একটা শব্দ করে জিকো অজ্ঞান হয়ে গেছে। রক্ত পড়ছে। চারদিকে কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে। গায়ের কুর্তিটা টেনেটুনে ঠিক করে ঝুমঝুমি ফোনে একটা বিশেষ নম্বর ডায়াল করল। তপোব্রতর নম্বর।
মিনিট পনোরোর মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে তপোব্রত জিকোদের বাড়িতে পৌঁছাল। জিকোকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বলল, তেমন কিছু হয়নি। এক্ষুণি সেন্স চলে আসবে। সে চট করে জিকোর কাটা জায়গায় ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল। তারপর এই প্রথম ঝুমঝুমির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল,
-তুমি তো দেখছি সাংঘাতিক! রাগ করলে আমাকেও এমন করে মারবে নাকি?
ঝুমঝুমির কাছে আর একটাও কথা জানতে চাইল না সে। গাড়িতে বাড়ির দিকে যেতে যেতে ঝুমঝুমিকে একটা হিরে বসানো আংটি দেখিয়ে তপোব্রত বলল,
-পিসিকে বলবে, এই আংটিটা পছন্দ করতে আমার সাথে বেরিয়েছিলে, কেমন!
ঝুমঝুমির ভীষণ ভালো লাগছে। গোমড়ামুখো লোকটা নেহাত খারাপ নয়। তার খুব ইচ্ছে করল, আজ কালরাত্রির রাতেই লোকটার কাছে তার সবটুকু সমর্পণ করতে।
------------------------------------------------------------------------------------------