Rinki Banik Mondal

Drama

2  

Rinki Banik Mondal

Drama

পরম প্রাপ্তি

পরম প্রাপ্তি

6 mins
937



-------"গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে তো ছেলের বাড়ির লোক চলে এসেছে গিন্নী; একটু তাড়াতাড়ি করো তোমরা, ওই দিকে মেয়েটা তো স্নান-খাওয়া না করেই বসে আছে। আমি মন্দির থেকে মায়ের ভোগ নিয়ে এসেছি। ওকে জোর করে নিজের হাতে খাইয়ে দিও। কোনো উপোসের দরকার নেই ওর।"

-------"হ্যাঁ গো, আর তুমি একটু এদিকে শোনো, কথা আছে।"


-------"বলো, এখন আবার কি কথা আছে তোমার?"


-------"বলছি, তুমি আরেকবার ভেবে দেখতে পারতে, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? লোকজনে নানা কথা বলছে।"


-------"গিন্নী, আজ তুমি এই কথা বলছ? এইসব বাজে কথা আমি আর কিন্তু শুনতে চাই না। যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে। লোকে যা খুশি বলুক, তুমি ভালো মতই জানো, আমি লোকের কথায় কান দিই না। আর মেয়েটার সামনে সব সময় এই আলোচনা করো না, মেয়েটা কষ্ট পাবে।"

গিন্নীকে এই কথা বলে পঙ্কজবাবু নিজের কাজে চলে গেলেন। স্নেহাদেবী আর সাত-পাঁচ না ভেবে সোজা গেলেন আলোর ঘরে। আলো স্নেহাদেবীকে দেখে হঠাৎই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। শত কষ্ট জমিয়ে রাখা আলোর গুমোট মনটা আজ অঝোরে ঝরিয়ে দিচ্ছে বুকের মাঝে জমে থাকা দুঃখ যন্ত্রণা।

রৌনক আর আলোর আজ শুভ পরিণয়। রূপ রঙে নয়, গুণে আলো রৌনকের মন কেড়েছে। তবে আলোর দিক দিয়ে রৌনকের জন্য শুধু শ্রদ্ধাই ছিল, ও কোনদিনও রৌনককে মনের মানুষের আসনে বসাতে চায়নি। কিন্তু নিয়তি আজ ওদেরকে এক সুতোয় বাঁধতে চলেছে। আর নিয়তির থেকেও বড় কথা পঙ্কজবাবু চান আলোর সাথে রৌনকের বিয়েটা হোক। সেখানে স্নেহাদেবীর প্রথমে আপত্তি ছিল বটে, তবে সেই আপত্তি পঙ্কজবাবুর জন্য কার্যকর হতে পারেনি।

আলো আর রৌনক একই অফিসে চাকরি করে। আর সেই সূত্রেই আলোর সাথে রৌনকের আলাপ পরিচয় গভীর হতে থাকে। তবে সেই গভীরতা শুধু রৌনকের দিক থেকেই। আলো তো ওকে শুধু একজন ভালো বন্ধুর স্থানে বসাতে চেয়েছিল, যার প্রতি আছে ওর অগাধ শ্রদ্ধা। রৌনক আলোর বাড়িতে গিয়ে পঙ্কজবাবুকে সব জানায় ওর মনের কথা। যদিও রৌনককে পঙ্কজবাবু আগে থেকেই চিনতেন একজন ভালো ছাত্র হিসেবে। পঙ্কজবাবু যখন প্রেসিডেন্সিতে পড়াতেন, তখন সেখানে তার একজন প্রিয় ছাত্র ছিল রৌনক। রৌনকের বাবা-মা কেউ নেই। মামাবাড়িতেই মানুষ হয়েছে। কিন্তু ছেলেটি যে মানুষ হিসাবে সৎ তা পঙ্কজবাবু জানতেন।

হঠাৎই চারিদিকে উলুধ্বনি!


-------"কিগো চলো, চলো। আলোকে স্নান করাতে হবে তো!"

কয়েকজন আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশী হুড়মুড় করে এসে এই বলে স্নেহাদেবীকে তাড়া দিলেন। স্নেহাদেবীর সম্বিত ফিরলো। সত্যিই তো কত ভাবনা মাঝেমধ্যেই উনার মনের মধ্যে হাতছানি দিয়ে আবার কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে। আর আলোর কান্না দেখে তো উনি আরো ভেঙে পড়েছিলেন।

গায়ে হলুদ পর্ব শেষ হতেই অনেক বেলা হয়ে গেল। এদিকে কনেকে সাজানোর লোক চলে এসেছে। স্নেহাদেবী আলোর সমস্ত শাড়ি-গয়না বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ঠিক তখনই একটা টুংটাং শব্দে ম্যাসেজ ঢুকল তার ফোনে। শাড়ি গয়না বুঝিয়ে ওদেরকে সাজাতে বলে আলোর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন স্নেহাদেবী। এত তাড়াহুড়োর মধ্যে ফোনে কে মেসেজ করেছেন, তা তিনি দেখার সময় পাননি।

-------"কৈ গো গিন্নী! আমার ধুতি-পাঞ্জাবিটা আলমারি থেকে বের করে দাও।"


-------"ওহ! ভুলেই গেছি, এত দিক কি একা হাতে সামলানো সম্ভব! এই ফোন আর টাকার ব্যাগটা ধরো। আমি নিয়ে আসি তোমার পাঞ্জাবি।"

এই বলে স্নেহাদেবী চলে গেলেন আবার নিজের ঘরে। পঙ্কজবাবুর হাতে স্নেহাদেবীর ফোনটা থাকাকালীন আবার টুংটাং শব্দে আরেকটি মেসেজ এলো। পঙ্কজবাবু দেখলেন নোটিফিকেশনে "টু নিউ মেসেজস" লেখা। পঙ্কজবাবু মেসেজ বক্সটা খুলে দেখলেন তনয়ের মেসেজ। প্রথম মেসেজটাতে 'হাই', তারপরের টাতে 'মাম্মাম কেমন আছো?' লেখা আছে।

পঙ্কজবাবু মেসেজগুলো দেখে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। কিছুক্ষণ পর যখন স্নেহাদেবী এলেন তার ধুতি পাঞ্জাবি নিয়ে, তিনি গিন্নীকে দেখালেন মেসেজগুলো। স্নেহাদেবী শুধু আজকের এই দিনটার জন্য তনয়কে মেসেজের উত্তর দিতে বিরত থাকলেন।

আসলে, তনয়ের সাথে স্নেহাদেবীর প্রায়ই কথা হয়। আর মায়ের সাথে ছেলের যোগাযোগ থাকাটাই তো স্বাভাবিক। সন্তান যতই অন্যায় করুক না কেন, তাকে ভালোবেসে কাছে ডাকতে পারে, একমাত্র মা। কিন্তু পঙ্কজবাবুর কাছে তার ছেলে তনয় একজন জেলখাটা আসামীর মতই সমান অপরাধী। কারণ তার ছেলে তার বিবাহিত স্ত্রী'কে ঠকিয়েছে। বিদেশে চাকরি করার নাম করে সেখানেই আরেকজন মেমসাহেবকে নিয়ে সংসার গোছানোর স্বপ্ন দেখেছে। শেষমেশ সব জানাজানির পর বৌ'মার সাথে ওর বিচ্ছেদটা হয়ে যায়।

হ্যাঁ, আজ এই বাড়ির বৌমার বিয়ে দিচ্ছেন পঙ্কজবাবু। বৌমার থেকে বেশি আলো পঙ্কজবাবুর মেয়ে। বড় ভালবাসেন তিনি আলোকে। আর আলোও যে এই বাড়িটাকে একদম আপন করে নিয়েছে। তাই একমাত্র ছেলের অন্যায় কাজকে পঙ্কজবাবু মেনে নিতে পারেননি। যেহেতু ছেলের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক, তাই তিনি তনয়কে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেননি। পঙ্কজবাবু নিজের এই বিশাল সম্পত্তির অর্ধেক তনয়কে আর অর্ধেক তার মেয়ে মানে বৌমা আলোকে লিখে দিয়েছেন। কিন্তু এতদিন ধরে তিনি আলোর এলোমেলো জীবনটাকে গুছিয়ে দিতে পারেননি। তবে এবার সুযোগ এসেছে, তাই তিনি যে কোন কিছুর বিনিময়ে আলোর জীবনটা আবার নতুন করে গুছিয়ে দিতে চান।

শুভদৃষ্টির সময় এসে উপস্থিত! ভালোবাসার মানুষের চোখের উদ্ভাসিত রশ্মিতে আলো তার নতুন জীবনে আপনজনকে খুঁজে পায় আজ। কিছু সময়ের ব্যবধানে আলোর সিঁথির ফিকে হয়ে যাওয়া সিঁদুরটাও আবার নতুন গাঢ় লাল রঙে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

পরের দিন লাল বেনারসি পড়ে রক্ত আলতা পায়ে, অশ্রু মিশ্রিত চোখে কনের বিদায় পর্বের সময় সকলেরই মুখ ভার। আলোর নিজের বাবা-মা,ভাই সকলেই উপস্থিত ছিল বিয়েতে। কিন্তু আলোর কাছে আজ তাদের থেকেও বেশি আপন তার শ্বশুরমশাই। যে কিনা শুধুমাত্র বৌমার কষ্ট লাঘব করার জন্য সব সময় চেষ্টা করে গেছেন। পঙ্কজবাবু মনের দিক দিয়ে এত শক্ত, কিন্তু এই ক্ষণে দাঁড়িয়ে তারও চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে সকলকে প্রণাম করে, শেষে পঙ্কজবাবুকে যখন আলো প্রণাম করতে যায় তখনই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন পঙ্কজবাবু। আলো আজ বড্ড নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে পঙ্কজবাবুর বুকের মাঝখানটাতে এসে। 

-------"বাবা, ভালো থেকো, মা'কেও দেখে রেখো। তুমি ছিলে দেখেই আজ আমি আবার একটা নতুন জীবন পেলাম। তোমার মত এরকম একজন বন্ধু আমি প্রত্যেক জন্মে পেতে চাই"

-------"না রে, মা। এটা তোর প্রাপ্য। খুব ভালো থাকিস মা। আর তোর এই বয়স্ক বন্ধুর খোঁজ খবরটা কিন্তু নিস। " 

আলো চলে যাওয়ার পর পঙ্কজবাবু আর স্নেহাদবী মিলে বাড়ির পুকুরটার সামনে ঐ শিউলি গাছ'টার নীচে খানিক সময়ের জন্য একটু বসেন। পঙ্কজবাবু স্নেহাদেবীর হাতখানা ধরে বলেন-  

-------"আজ বড্ড অসহায় লাগছে জানো গিন্নী; আলো চলে গিয়ে যেন এ বাড়িটাতে অন্ধকারের ছায়া নেমে এলো। কিন্তু, আমাকে যে এই দায়িত্বটা পালন করতেই হতো।"

-------"না কর্তা, তুমি যা করেছ ঠিকই করেছ। তুমি তো ওর আপনজন, ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। বড্ড ভালোবাসে ও তোমায়। মেয়েটা ভালো থাকুক। কি করব বলো, ছেলেটাকে যে কষ্ট করে জন্ম দিয়েছি। তাই আমি ওকে একবারে অগ্রাহ্য করতে পারিনা। ওইটুকুনিই ফোনে কথা বলে যা শান্তি! তনয় তো আর এখানে আসতেও চায় না। কিন্তু মেয়েটাও যে আমার আর এক সন্তান ছিল গো। মনে আছে কর্তা, আজ থেকে সাইত্রিশ বছর আগের কথা?

-------"হ্যাঁ, গিন্নী।

-------"একজন লগ্নভ্রষ্টা মেয়েকে তোমার বাবা এই বাড়ির বউ করে এনেছিলেন। সেই লগ্নভ্রষ্টা মেয়েটা ছিলাম আমি। কারণ ছেলের বাড়ির লোক আমাদের থেকে মোটা পণ দাবি করেছিল। কিন্তু আমার বাপেরবাড়ির লোক তা দিতে অক্ষম ছিল। এখনো মেয়েরা যদি নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করে তাহলে এই সমাজ কত নিন্দেমন্দ করে বলতো? আজ আলো আর তোমার সম্পর্কের শক্ত বাঁধনটা দেখে মনে পড়ে গেল, আমিও জীবনে এরকম আপনজনের সন্ধান পেয়েছিলাম। এক তো আমার শ্বশুরমশাই আর তুমি। আলোর ক্ষেত্রেও তাই হলো, কিন্তু আমার ছেলেটাই ওকে ভালোবেসে ধরে রাখতে পারলো না।" 

-------"থাক্ না গিন্নী, ছাড়ো এসব কথা। এইসব মনে করে আর দুঃখ পাওয়ার দরকার নেই। তার চেয়ে বরং তুমি আমায় আজ একটা গান শোনাও। তোমার গান অনেকদিন শুনিনা। 

-------"ধুর্! কি যে বলো না তুমি! ঐদিকে বাড়ি ভর্তি লোকজন রয়েছে। আর আমরা এখানে বসে আছি।

-------"শোনাও না গিন্নী একটা গান। মনটা একটু হালকা হোক।"

-------"আচ্ছা, তুমিও গাও আমার সাথে।


এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়,

স্বপ্ন মধুর মোহে

এই জীবনে যে কটি দিন পাবো

তোমায় আমায় হেসে খেলে

কাটিয়ে যাব দোঁহে

স্বপ্ন মধুর মোহে


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama