Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy Classics

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy Classics

প্রিয়তমাসু

প্রিয়তমাসু

5 mins
289


প্রিয়তমাসু


"রমু, এই রমু... কী হলো রে? ওওওঠ..." বহুদূর থেকে ভেসে এলো ডাকটা। কোন সুদূর অতীতের ওপার থেকে যেন। রম্যাণি চোখটা খুলতে পারছে না কিছুতেই। চোখটা কড়কড় করে উঠলো ওর। ভাবলো, "মা যে কী করে না... এতো সকালে পুবের জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিয়েছে। সকালের রোদের এই চকচকে তেজটা ভাল্লাগে না... জানে... তবুও!" চোখে বালিশ চাপা দিয়ে রম্যাণি পাশ ফিরলো, দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে। কানে তখনো ওর রিনিঝিনি বাজছে ডাকটা, "রমু, এই রমু..."



মা চা নিয়ে এসে রম্যাণির মাথায় হাত ছোঁয়ালো। সকালে ঘুম ভাঙতেই রম্যাণি এককাপ গ্রিন টি খায়। অনেককালের অভ্যেস। উঠে বসে রম্যাণি কোলের উপরে বালিশটা তুলে মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলো। মায়ের সাথে সকালের এই সময়েই শুধু দু-চারটে কথা বলার নিশ্চিন্ত অবকাশ মেলে। বাকি সারাদিন ধরেই তো যে যার কাজে দৌড়ঝাঁপ করেই চলে। রাতে বেশিরভাগ দিনই ফেরার পরে ঐ মামুলি কিছু দরকারী অদরকারী কথা বলার পরে আর ধৈর্য্য থাকে না দু'জনেরই। তখন তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে নেবার তাড়া। শরীর তখন বিশ্রাম চায়। আজ শরীরটা কেমন একটা যেন জ্বরজ্বর লাগছে। ম্যাজম্যাজ করছে শরীরটা। আরো খানিকক্ষণ শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। মা'কে বলতেই মা শোনায়, "শরীরের আর দোষ কী? এতো পরিশ্রম! তার ওপর সিজন চেঞ্জের সময়। শীতের এই টুকিটুকি আসা যাওয়া দেখে কে বলবে যে এটা মাঝ ফেব্রুয়ারি?" মায়ের কথা শুনেই রম্যাণির চোখ চলে গেলো দেওয়ালে আটকানো ডেট ক্যালেন্ডার সমেত ইলেকট্রনিক ঘড়িটার দিকে। ও, তাইতো, আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন্স ডে! রম্যাণির চোখের কোলে টলটলিয়ে ওঠা দু'ফোঁটা জল ওর মায়ের চোখ এড়ায়নি বলেই হয়তো মা কাজের অছিলায় রম্যাণির সামনে থেকে উঠে চলে গেলো।



রম্যাণি শেষ মাঘের রোদ ঝলমল গাঢ় নীল আকাশের বুকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলো। নীল আকাশের দরাজ বুকে রম্যাণি হারিয়ে যাচ্ছে। নীলাকাশ... নীল কখনো সোহাগকালে, আকাশ আবার রাগানুরাগের ঝাঁঝে। যেই নীল, সেই আকাশ... রম্যাণির হারিয়ে যাবার নিশ্চিন্ত ঠিকানা। নীলাকাশটা কখন যেন কালো ধোঁয়ায় ঢেকে হারিয়ে গেছে। রম্যাণির নাকে ভেসে এলো কটু বারুদের গন্ধ। আর তাতে মেশানো লবণাক্ত রক্তের গন্ধ, পোড়া মাংসের তীব্র গন্ধ। চেনা যায়নি আলাদা করে দেহাবশেষ, শুধু অক্ষত একটি আঙুল... অনামিকা, এনগেজমেন্টের হিরের আংটি পরা। রম্যাণির শরীরটা অবশ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে মোবাইলেই নিউজ আপডেট পেয়েছিলো, বারবার বিভিন্ন মিডিয়া হাউসের নিউজ ফিডে। বিশ্বাস হয়নি প্রথমে, বিশ্বাস করতে চায়নি কিছুতেই রম্যাণি। কী করে এই দুর্ভাগ্য মেনে নেবে রম্যাণি? রম্যাণির কী অপরাধ? এতো বড়ো শাস্তি কেন বিনা অপরাধে? না, একটা অপরাধ অবশ্যই রম্যাণি করেছে। নীলাকাশ যখন সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দিয়েছে, তখন রম্যাণি কোনো বাধা দেয়নি। গর্বিত হয়েছে। ওর নীলাকাশ দেশের কাজে নিয়োজিত। রম্যাণির বুক ভরে উঠেছে গর্বে, আনন্দে... নিজেকে সৈনিকের স্ত্রী ভাবতে। অথচ ইঞ্জিনিয়ার নীলাকাশ, চাইলেই কোনো নিরাপদ চাকরিতে জয়েন করতেই পারতো! তা না করে পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলো। নীলাকাশের বাবাও শহীদ, তবুও নীলাকাশের মায়ের গলা একটুও কাঁপেনি এই খবরে। রম্যাণিকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়েছে শুধু।




সেবারে ফিরে যাবার আগের দিনটায় নীলাকাশের বুকে মাথা রেখে রম্যাণি বলেছিলো, "ভীমপলশ্রীতে একটা গান তুলেছি, তেওরা তালে... চল না, দু'জনে গাই আজ, একসাথে ছাদে বসে।" নীলাকাশ রম্যাণির ঝাঁকড়া নরম খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে বলেছিলো, "চল, রেকর্ড করে নিয়ে যাবো। গভীর রাতে ডিউটি শেষে শুনতে পাবো তোর গলাটা।" রম্যাণি নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছিলো নীলাকাশের শরীরের উত্তাপে। ছাড়তে মন চায়নি। ছাদে বসে স্বচ্ছতোয়া জ্যোৎস্না ধোয়া রাতে দু'জনে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলো, সেই ভীমপলশ্রী, তেওরা তালে, রম্যাণি নীলাকাশের বুকের বাঁ পাশে নিজের গালটা ছুঁইয়ে, আর রম্যাণিকে বেষ্টন করে রেখেও কী নির্ভুল সুরে লয়ে তালে নীলাকাশ সুরবাহারে আঙুল চালিয়েছিলো। পাশে রেকর্ডিং অন করে রাখা ছিলো দু'জনের দু'টো মোবাইল।




নীলাকাশের মা আর রম্যাণির মা দু'জনেই একসাথে গিয়েছিলো রম্যাণিকে নিয়ে। সেই অভিশপ্ত ১৪ই ফেব্রুয়ারি। রম্যাণির সব হারিয়ে যাবার দিন। দেহাবশেষ সনাক্তকরণের পরে, নীলাকাশের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও বুঝিয়ে ফেরত দেওয়া হলো। মোবাইলটা দেখে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো রম্যাণি। আর্মির হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো সাথে সাথেই রম্যাণিকে। অনেক আহত সৈনিকের ভিড়ে কোথাও নেই নীলাকাশ। আছে শুধু ওর একটা আঙুল, শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন। অবশিষ্ট কিচ্ছু নেই আর। রম্যাণি নিতে পারছিলো না এই স্নায়ুর চাপ। নীলাকাশের মা আর রম্যাণির মা দুই বিধবা রমণী, একজন সদ্য পুত্রহারা, আরেকজন কন্যার লণ্ডভণ্ড জীবনের সাক্ষী... দিনরাত পড়ে আছে হাসপাতালের লম্বা ওষুধের গন্ধ মাখা করিডোরে। দু'জনেই অধীর, যে গেছে সেতো গেছেই, ফিরবে না আর কোনোদিনই। কিন্তু তার বীজ যে রয়ে গেছে রম্যাণির শরীরে। রম্যাণি অন্তঃসত্ত্বা, নীলাকাশ ও রম্যাণির সন্তান অঙ্কুরিত হচ্ছে রম্যাণির গর্ভে। ওরা মিলিত হয়েছিলো সেই রাতে, ছাদে... মোবাইলে রেকর্ড করা গানটা চলছিলো তখন। গভীর আশ্লেষে বিশ্রস্তবাস রম্যাণি নীলাকাশের বুকের ওমে মুখ গুঁজে তখনো। রাত বাড়ছিলো, নীলাকাশ ডেকেছিলো স্নেহমেদুর ভরাট গলায়, "রমু, এই রমু... কী হলো রে? ওওওঠ..." ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রম্যাণি। দুর্ভাগ্য ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছিলো যেন। নীলাকাশের চলে যাওয়াটা ওর মা নিতে পারেনি আর, ওপরে যতই কাঠিন্য দেখাক না কেন, ভেতরটা তো একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলো। নীলাকাশ যাবার মাসচারেকের মাথায় নীলাকাশের মাও চলে গেলো। দেখে যেতে পারেনি নাতির মুখ। তারও ক'মাস পরে রম্যাণি আর নীলাকাশের ছেলে রম্যনীল জন্মেছে। দেখতে দেখতে রম্যনীল পাঁচ পার করেছে। মায়ের বয়স হয়েছে, নিজের কাজের চাপ আছে, ছেলেকে ঠিকমতো মানুষ করতে প্রচুর টাকার দরকার। রম্যনীলকে দার্জিলিঙের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করেছে এবছরই। আজকাল গান গাইতে আর ইচ্ছে করে না। শুধু ১৪ই ফেব্রুয়ারি এলেই রম্যাণির বুকটা ফেটে যেতে চায়। প্রতি ১৪ইফেব্রুয়ারি সকালেই চেতনে অথবা অবচেতনে রম্যাণির ঘুম ভাঙে ঐ মায়াবী ডাকে, "রমু, এই রমু... কী হলো রে? ওওওঠ...!"



নীলাকাশের মোবাইলটা রোজ চার্জ দিয়ে দিয়ে বড়ো যত্নে রেখেছে রম্যাণি। নীলাকাশের ছোঁয়া লেগে আছে যে ওতে! চার্জার থেকে মোবাইলটা খোলার সময়ে কেমন করে যেন মিউজিক মিডিয়াপ্লেয়ারে হাত পড়ে গেলো রম্যাণির। সেভ করা আছে রম্যনীল নামে, নীলাকাশ নিজেই এই নামে সেভ করেছিলো। রম্যাণি অন করে দিলো মিডিয়াপ্লেয়ার। কে বলে নীলাকাশ নেই, নীলাকাশ রম্যাণির বুকে, রম্যনীলের ধমনীতে। সুরবাহারের ছোট্ট আলাপের শেষে ভীমপলশ্রীতে তেওরা তালে বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, রম্যাণি আর নীলাকাশের গমগমে সুরেলা গলায়...

"বিপুল তরঙ্গ রে।

সব গগন উদ্বেলিয়া... মগন করি অতীত অনাগত,

আলোকে-উজ্জ্বল জীবনে-চঞ্চল,  

একি আনন্দ-তরঙ্গ।

তাই, দুলিছে দিনকর চন্দ্র তারা...

চমকি কম্পিছে চেতনাধারা,

আকুল চঞ্চল নাচে সংসার কুহরে হৃদয়বিহঙ্গ।

বিপুল তরঙ্গ রে।"



চোখ বুজে বসেছিলো রম্যাণি। গান শেষ হয়েছে। নীলাকাশের গমগমে গলায় ভেসে আসছে ফোন থেকে, "প্রিয়তমাসু, যদি আমি না ফি....." সেদিন যে শেষ করতে দেয়নি রম্যাণি এই হৃদয়বিদারক কথাটাকে... তাও আটকাতে পারলো কোথায়! নীলাকাশ অনন্ত মহাকাশে হয়তো কোথাও হারিয়ে গেছে পথ ভুলে, রম্যনীলের জিম্মায় তার প্রিয়তমাসুকে একলা ফেলে রেখে। এই এতো বছর পরে বুক ফাটিয়ে কাঁদলো রম্যাণি প্রথমবারের মতো, "নীলাআআআকাআআআশ....!"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance