Kastury Chatterjee Patranabis

Horror Tragedy

4.0  

Kastury Chatterjee Patranabis

Horror Tragedy

পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট

12 mins
185



                   (১)


“ এবার আঁজলা করে চালটা পিছনদিকে মায়ের আঁচলে ছুঁড়ে দে পুতুল, তিনবার ছুঁড়বি। “ চোখের জলে ভাসতেভাসতে মধুমিতা তিনবার চাল ছুঁড়ল পিছনদিকে। মাতৃঋন এবং পিতৃঋন শোধ করা যায়না , কিন্তু সমাজ যেআজও নিয়মের নিগঢ়েই বাঁধা। বিদায় জানাল সে তার চিরপরিচিত সবকিছুকে , মেয়েবেলা এগিয়ে চললসাবালকত্বের দাবিতে। 


“ ইউ ফিলিং ওয়েল ?” গাড়ি চলতেই সাগরময় মধুমিতার দিকে একটা জলের বোতল এগিয়ে দিল। 


“শিওর “। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে বাইরে তাকাল। 


কলেজ থেকেই প্রেম করেছে দুজনে। ছয় বছর ধরেই মধুমিতা জানত বাবা মাকে ছাড়তেই হবে, তাও কেন যে কষ্টহচ্ছে! “ বৌদি, জল বাঁচাও, এ হারে বইলে যে ট্যাক্স বেড়ে যাবে দাদার “ দেওর নীলময়ের কথায় ফিক করে হেসেইফেলল। সাগরময়দের পৈতৃক বাড়ি গোবরডাঙ্গায়, সেখানেই যাচ্ছে তারা। ওখান থেকেই দ্বিরাগমনে আসবে।ঢাকুরিয়া থেকে গোবরডাঙ্গা অনেকটা পথ। সকালবেলা বেরিয়েছে, ঠাকুমা শাশুড়ির কড়া আদেশ ঠিক সূর্যাস্তেরমুহূর্তে ঢুকতে হবে, বৌ যেন ঘরের ছাদ দেখতে না পায়। সাগরময়রা যখন পৌঁছল সূর্য অস্ত যায়নি, বাড়ির গলিতেঢোকার আগেই কয়েকজন লোক দাঁড় করিয়ে দিল। ওদের বাড়িরই লোক। 


গরমে আর যেন পারছেনা মধুরিমা। ফিসফিস করে সাগরকে বলল “ আরে সূর্য তো ডুবে যাবে রে বাবা এক্ষুনি।এভাবে শাস্তি দেওয়ার কোনও মানে হয়! কোন যুগে বাস করে তোমার বাড়ির লোকজন?” 


“আশ্চর্য, তোমারই বা এত তাড়া কিসের? বসে তো আছ এ.সি গাড়িতে। নতুন বৌকে অত কথা বলতে নেই।”


সত্যিই এবার আশ্চর্য হয়ে গেল মধুমিতা। এই প্রথম সাগরময়ের মুখে এমন কথা শুনল সে। স্হানমাহাত্ম্য বলেএকটা কথা আছে, সেটা বোধহয় সত্যি।


বলল ঠিকই, কাজ কিছুই হলনা। আধঘন্টা বাদে সূর্য যখন পাটে বসল, ওদের গাড়িটা ঢুকল বিশাল গেট পেরিয়ে।মধুরিমা এ বাড়ির ছবি আগে দেখেছে, কিন্তু এতো প্রাচীন তা বুঝতে পারেনি। বিশাল দোতলা বাড়ি, সামনে প্রশস্তলন। পুরনো হলে কি হবে বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। তাদের গাড়ি থেকে নামাতে বরনডালা নিয়ে এগিয়ে এলেনসাগরের মা। শাশুড়িমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল মধুরিমা। সিঁথিতে সিঁদূর আর কপালজোড়া লাল সিঁদূরের টিপছাড়া কোনও প্রসাধনই নেই। শাড়িটাও লালপাড় সাদা গরদ। আশ্চর্য হয়ে গেল সে। একমাত্র ছেলের বিয়ে, আশমিটিয়ে শাড়ি গয়না পরার কথা, সে কিনা এইভাবে বধূবরন করছে! সুস্মিতা একবার চোখ তুলেই নববধূর বিস্ময়বুঝতে পারল। চকিতে চোখ সরিয়ে নিল। ঘোষবাড়িতে আজ সবাই লালপাড় সাদা গরদ পরেছে, পুরুষরা পরেছেসাদা ধুতি আর ফতুয়া। সাগরের জাঢ়তুতো দিদিকে একবার একলা পেয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল মধুমিতা। প্রশ্নশুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল দিদি, কয়েক সেকেন্ড বাদে শুধু বলল “ অপেক্ষা করো, সব জানতে পারবে আস্তে আস্তে।এখন বড়রা যা বলছে সেগুলোর পালন করে যাও। “ স্নানঘরে গিয়ে গা ধুয়ে ঘরে এসে মধুমিতা দেখল দিদি শাড়িনিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। “ দিদি, একমিনিট, আমার স্যুটকেসটা কোথায় গো?”

“ পরে খুঁজো। এটা পরে চল আমার সঙ্গে”

“ শুধু শাড়ি! পেটিকোট ব্লাউজ কোথায়?”

“ লাগবেনা। এবাড়ির এই নিয়ম। তবে চিন্তা নেই, ছেলেরা কেউ নেই এখন। “ দিদিই শাড়িটা পরিয়ে দিলমধুমিতাকে। লজ্জায় কান অব্দি লাল হয়ে গেল তার। চোখ ফেটে জল চলে এল। এরা এমন কেন করছে তাকেনিয়ে? এসব কি মধ্যযুগীয় নিয়মকানুন। মধুমিতা জানতনা এটা হিমশৈলের চূড়ামাত্র, তখনও অনেক বাকি।

দোতলা থেকে খাড়া সিঁড়ি নেমেছে একতলার দালানের ঠিক মাঝে। সাগরের মা, জ্যেঠিমা , দিদি নিয়ে চললনববধূকে। নেমেই বামদিকে একের পর এক ঘর পার হয়ে চলল তারা। মধুমিতা অবাক হয়ে দেখতে দেখতে হাঁটতেলাগল। কি বিশাল ঘরগুলো, আসবাবপত্র বহু প্রাচীন। একটা ঘরের দেওয়ালজোড়া পোর্ট্রেট, প্রায় বারোটা। আঁকাখুব উঁচুদরের নয়, বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষন করেনা। টানা দালানের একেবারে শেষের ঘরটাতে ঢুকল ওরা। ঢুকেইসুস্মিতা ক্ষিপ্রহস্তে দরজা বন্ধ করে দিল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। সুস্মিতা এবার মধুমিতার হাতটা ধরেনিজের কাছে টেনে আনল, তারপর একদম তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল “ পুতুল, এখানে মাউইমাথাকেন। উনি কে তা পরে বলব। ওনাকে দেখতে পাবেনা। তোমাকে যেখানে বসিয়ে দেব গড় করে প্রণাম করবে, আরহ্যাঁ মাথার ঘোমটা যেন খুলে না পড়ে। “

আরেকটু এগিয়ে মধুমিতাকে একজায়গায় বসিয়ে দিয়ে নীচু হয়ে ধীরপায়ে সামনে মুখ করেই পিছু হটতে লাগলসুস্মিতা। এদের রকমসকম দেখে এবার হাসি পাচ্ছে তার। এ যেন সরকাররাজ, যার অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে সবচলছে। অন্ধকারে দৃষ্টি চালাবার চেষ্টা করে লাভ হয়নি, তার ওপর চোখের ওপর অব্দি ঘোমটা টানা। একমিনিটহয়েছে সবে, অন্ধকার ঘরে যেন মনে হচ্ছে একঘন্টা হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা অদ্ভূত অস্বস্তি ঘিরে ধরতে লাগলতাকে। ঘরের তাপমাত্রা যেন একধাক্কায় অনেকটা নেমে গেছে, বরফ হতে শুরু করেছে চারিদিক। অন্ধকার জমাটবাঁধতে বাঁধতে চেপে বসতে শুরু করল মধুমিতার বুকে। দম আটকে আসছে দুর্গন্ধে। কি ভয়ঙ্কর মরাপচা গন্ধ। মনেহল বমিই করে ফেলবে। হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে না পেরে বাবু হয়ে বসে পরল মধুমিতা, শ্বাস আটকে আসছে। এমনসময় মনে হল একটা ঘষাঘষা শব্দ এগিয়ে আসছে, যেন পা ঘষে ঘষে আসছে কেউ। চলার গতি না আস্তে নাজোরে। কিন্তু থামছেনা, আসছে একই গতিতে। এইবার মুখ তুলে দেখল তার দশহাতের মধ্যে আপাদমস্তক সাদাথান পরিহিতা একটা মূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা, এইবার আরও একটু এগিয়েএল মূর্তিটা। আর ভয়ে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল মধুমিতার। সাদা কাপড়ের মধ্যে শুধুই অন্ধকার, দেহের কোনওঅস্তিত্বই নেই। আর পারলনা সে। নিজের স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে প্রচন্ড চিৎকার করে পিছনদিকে ছুটল।সাগরের মা জ্যেঠিমা দিদিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এক ঝটকায় দরজার খিল খুলে ছুটে পেরিয়ে যেতে লাগল লম্বাদালান, ঘরের পর ঘর। 


                  (২)


“ সুস্মিতা, তুমি সামলাতে পারলেনা মেয়েটাকে? ভুলে যেওনা আজ মধুরিমা যা করেছে তার ফলভোগ কিন্তুএকপুরুষে শেষ হবেনা। মারাত্মক অভিশাপ নেমে আসবে ঘোষবংশের উপর। তুমি উপরে গিয়ে দেখ, ওর জ্ঞানফিরেছে কিনা। নীচে নিয়ে এস এক্ষুনি। মাউইমার প্রতিশোধ বরদাস্ত করতে পারবেনা কেউ। “ অস্হিরচিত্তেপায়চারী করতে থাকেন সাগরের বাবা। “ তুই একটু শান্ত হ। সব ঠিক হবে। বৌমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওঘরে পাঠাতেহবে। কোনও অভিশাপ নেমে আসবেনা। “ জ্যেঠু চোখের ইশারা করে বসালেন ভাইকে। ওদিকে আকস্মিক ঘটনারঅভিঘাত সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে মধুমিতা। স্হানীয় ডাক্তার অভয় দিয়ে গেছেন। এখন উঠে দাঁড়াতেযতক্ষন লাগে তারই অপেক্ষা করছে সবাই। 

“ পুতুল, এই যে আমি, আমি সাগর। “ স্ত্রীর জ্ঞান ফিরতে দেখে এগিয়ে আসে সাগর। দশ সেকেন্ড সময়ে পুরোপুরিউঠে বসে মধুরিমা আর হঠাৎ করেই কি যেন মনে পরে যায়। চিৎকার করে ওঠে “ না না আমি ওঘরে যাবনা। আমিবাড়ি যাব সাগর। কি নরক ওঘরটা। “ ছুটে এসে মধুরিমার মুখটা চেপে ধরে সুস্মিতা “ আমি রিকোয়েস্ট করছিপুতুল, তুমি আর একবার চল। চুপ করে মাথা নীচু করে বসে থাকবে। চোখও বন্ধ রাখতে পারো। কিচ্ছু দেখতেহবেনা, শুনতে হবেনা। আমি ডাকলে চলে আসবে। প্লিজ পুতুল।”


“ মানে! তোমরাকি পাগল হয়ে গেছ! ওঘরে এমন দুর্গন্ধ যে এক সেকেন্ড থাকা যায়না। আর তাছাড়া ঐ মূর্তিটা কি? বল বল। কি ছিল ওটা? তোমরা কি পিশাচসাধনা করছ নাকি বন্ধ ঘরে মানুষ বলি দিচ্ছ? আমি এখনি বাবাকেফোন করছি। “


“ নাতবৌ, একটু দাঁড়া মা। তোর সাথে আমার কথা আছে। আমার কথাটা শোন। এরপর তোর যা ইচ্ছে তাইকরবি। কেউ আটকাবেনা তোকে, তাতে যা হওয়ার হবে।”

মিহি অথচ ব্যক্তিত্বপূর্ন একটা স্বর ভেসে এল দরজার কাছ থেকে। হুইলচেয়ারে এসে ঢুকলেন এক অশীতিপরবৃদ্ধা। 

“ মা, তুমি আবার কেন এলে? আমরা সামলে নেব। “ বললেন সাগরের বাবা।


“ আমি কথা বলছি। “ হাত তুলে বৃদ্ধা থামালেন ছেলেকে। 


“ শোন্ মা, তোর শাশুড়িমা যেমনটা বলছে কর। আমরা কেউ অপরাধী নই। আজকের দিনটা সহ্য করে নে। কালআমি তোকে সব খুলে বলব। সাগরের উচিত ছিল তোকে বিয়ের আগেই সবটা বলা। আমার ওপর ভরসা আছেতো?”


একটা অদ্ভূত আবেশ আর বিশ্বাসযোগ্যতা আছে বৃদ্ধার কন্ঠস্বরে। কিছু বলতে পারলনা মধুরিমা। সুস্মিতা পুনরায়তৈরী করতে নিয়ে গেল মধুরিমাকে। 

অন্ধকার ঘরে চুপ করে বসে আছে নতুনবৌ মধুরিমা। ভয়ে আতঙ্কে গলার স্বর রুদ্ধ, শ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেছে।আবার তাকে মুখামুখি হতে হবে,আবার আবার। নিজের চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ আবারসেই পায়ের শব্দ শুনল সে। সেই ঘষটে ঘষটে হাঁটার শব্দ। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। এবার শব্দটা সামনে এসেথমকে গেল, তারপর তাকে কেন্দ্র করে ঘুরল একপাক। আচমকা পিছনদিকে ডান কানের কাছে একটা নিঃশ্বাস পরলমধুরিমার। কি ঠান্ডা আর কি দুর্গন্ধময় সে নিঃশ্বাস! 

“ তোর খুব তেজ নারে মাগী? মেয়েমানুষের অত তেজ সহ্যি হয়না বাপু। সব শুনিচি আমি।কি ভাবলি আমি শুধুএঘরে থাকি? আমি এ মহলের সব জায়গায় আছি। আমি কে জানিস তো? মাউইমা।”


“একটা অপার্থিব ঠান্ডা কন্ঠস্বর ফিসফিস করে বলে উঠল নতুনবৌয়ের কানে। দুর্গন্ধটা যেন মিশে যাচ্ছে তারনিঃশ্বাসের সাথে। দুচোখ দিয়ে অঝোরধারায় জল পরতে লাগল তার, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে গলার আওয়াজ অবদমিতকরতে লাগল, একটা শব্দ বেরোলেই এই পিশাচিনী শেষ করে দেবে তাকে। এইভাবে কাটল আরও মিনিট পাঁচেক।এবার সুস্মিতা এগিয়ে এসে সামনের অন্ধকারের উদ্দেশ্যে বলল “ মাউইমা, নাম?” সব চুপচাপ। কিছুক্ষন বাদেফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে উত্তর এল “ ছায়া “। 


                 (৩)


ভয়ে, দুঃখে একেবারে ভেঙ্গে পরেছে মধুরিমা। কত স্বপ্ন নিয়ে একটা মেয়ে বিয়ে করে অন্যের ঘর করতে আসে। এইলেখা ছিল তার কপালে! এরা কি করছে এবাড়িতে? কি উদ্দেশ্যে করছে? কে এই মাউইমা? কোনও প্রশ্নের উত্তরইদিচ্ছেনা কেউ। সর্বদাই কিছু একটা গোপন করছে। “ শরবতটা খেয়ে নাও। “ সাগরকে দেখে আর নিজেকে সামলাতেপারলনা মধুরিমা নিজেকে। উঠে গিয়ে কলার চেপে ধরল “ ড্রিংক ইয়োর ফাকিং শরবত। কি করতে বিয়ে করেছআমায়? হু ইজ ইয়োর ফাকিং মাউইমা? পারভার্টের দল। “

“ তুমি কি পাগল হয়ে গেলে পুতুল? গালাগালি দিচ্ছ কেন? ঠাম্মি তোমায় ডাকছে। “

“ কোথ্থাও যাবনা আমি। তুমি যাও। অল ফাকিং শীট। “

“ মাথা গরম কেরোনা। চল একবার প্লিজ। “

ঠাম্মির ঘরে ঢোকার সময় চোখে পরল একজন বৃদ্ধ বসে আছে। বেশভূষা দেখে মুসলিম মনে হল। মধুরিমাকে দেখেহাসল। প্রত্যুত্তরে কোনরকমে একটু হাসল সে। “ আয় ছায়া। “

ঠাম্মির ডাক শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। ছায়া কে? “ ঠাম্মি আমি মধুরিমা। পুতুল বলেও ডাকতে পারো কিন্তু আমারনাম ছায়া নয়। “ 

“ তুই যখন মাউইমার ঘরে ছিলি তোকে এই নামই তো দিয়েছিল। “

“ আমার পিতৃদত্ত নাম ভুলে যাব? আমি হঠাৎ করে ছায়া হয়ে গেলাম। বাঃ বাঃ। এবার আমাকে কি বলবে কে এইমাউইমা?”

“ শোন আমি এপর্যন্ত কাউকে বলিনি এবাড়ি আর মাউইমার কাহিনী। তারা শুধু জানে উনি ছিলেন আমারশাশুড়িমা। কিন্তু তোকে আজ বলব। কারন সবটা না জানলে এমন কিছু করবি, তাতে তোর অনেক বড় ক্ষতি হয়েযাবে।


 সে অনেক বছর আগেকার কথা। মাউইমা যখন বিয়ে হয়ে এসেছিলেন তখন তার বয়স ছিল আট। নিতান্ত একবালিকা তার শৈশবকে সিন্দুকে বন্ধ করে সংসার-যুদ্ধে নেমেছিল। নয়জন দেওর, ননদ ছিল তার। শ্বশুরমশাইআগেই মারা গিয়েছিলেন। ছিল বিধবা শাশুড়ি। মাউইমা তার বাপের বড় মেয়ে ছিলেন। স্নেহ আর আদরে জীবনেরআটটা বছর কাটিয়েছিলেন। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি আসামাত্র শুরু হল তার ওপর চরম নির্যাতন। একে তো বড়বৌ, হেঁসেল থেকে গোয়াল অব্দি সব কাজ করতেন সারাদিন। তার শাশুড়িটি ছিলেন অত্যন্ত দজ্জাল স্বভাবের। কথায়কথায় মারধোর করতেন বড়বৌকে। বাড়ির ঝিদের সামনেই গালে চড় মারতেন। দশ এগারো বছরের বালিকাচোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারতনা। অনেক রাতে স্বামী ঘরে এলে শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুইহতনা। কোনও কথাই শুনতনা মাউইমার স্বামী মানে আমার শ্বশুরমশাই। এইভাবে কাটছিল দিন। চোদ্দো বছরেপ্রথমবার অন্তঃসত্ত্বা হন তিনি। তারপর তার ছয় ছেলেমেয়ের জন্ম হয়। আমার এক সখীর শাশুড়ি নিজে মুখেবলতেন ওনার শাশুড়িমা কেমন অত্যাচার করতেন। 


ওনার মা মেয়ের বাড়ি আসতেননা। বাবা এলেও সংসার সামলাবার অজুহাতে তাকে বাপের বাড়ি যেতে দিতেননা।তোর দাদাশ্বশুরের মুখ থেকে শোনা একটা ঘটনা বলি। সোমবার বাড়িসুদ্ধু লোক নিরামিষ খেত। সেদিন একসাথেইরান্না হত। প্রায় পঁচিশজনের রান্না একটামাত্র ঝিয়ের সাহায্যে করতেন মাউইমা। সবাই খেতে বসেছে। একটা পদ হলপাঁচমিশালী চচ্চড়ি। সেটা মুখে দিয়েই ওনার স্বামী বললেন তরকারিতে একটুও মিষ্টি হয়নি। মাউইমা স্বীকারকরলেন তিনি ভুলে গেছেন চিনি দিতে। আর যায় কোথায়? একবাড়ি লোকের সামনে, তার নিজের ছেলেমেয়েরসামনে শাশুড়ি জ্বলন্ত কয়লা আঁচ থেকে তুলে এনে ডান হাতের তেলোয় চেপে ধরলেন। ভাব তো মা, যন্ত্রনার সাথেকতটা অপমান তাকে প্রত্যেকদিন সহ্য করতে হত। আমিও ওবাড়ির বড়বৌ ছিলাম। চোদ্দো বছর বয়সে সংসারকরতে এসেছিলাম। ততদিনে ওনার বয়স হয়েছে। ওনার শাশুড়িমাও মারা গেছিলেন। আমি প্রথম যখন ওনাকেদেখি খুব রাশভারী আর চুপচাপ মনে হয়েছিল। আমার বিয়ের পরপরই শ্বশুরমশাই মারা যান। ওনার শাশুড়িমামারা যাওয়ার পর থেকেই মাউইমার আচরনে পরিবর্তন আসতে থাকে। কোনওকালেই বেশী কথা বলতেন না।সংসারের কর্তৃত্ব যখন হাতে এল তখন আরও চুপ হয়ে গেলেন। তবে আমি বৌ হয়ে আসার পর তাঁর অন্য রূপদেখেছিলাম। কোনও কাজে খুঁত দেখলেই অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন। মারধরও করেছেন। তবে কিজানিসতো তখনকার দিনে ওটা শাশুড়িদের স্বাভাবিক আচরনের মধ্যেই ধরা হত। পাড়ার বয়স্কা মহিলারা অবাকহয়ে যেতেন। আর কারও সাথে নয়, আমার সাথেই উনি বড় নিষ্ঠুর ব্যবহার করতেন। এই যে একে দেখছিস এর নামসবুর মিয়ঁা। 

একগাল হেসে সালাম করল সবুর “ আসসালাম আলাইকুম নাতবৌ।”


একটু হেসে মধুরিমা বলল “ সত্যি, এবাড়িতে থাকার জন্য এরকমই নাম হওয়া উচিত। “


“ রাগ করছিস? এই সবুরের বাপ আর ঠাকুমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন উনি। তখনকারদিনে কতটা সাহস থাকলেএকাজ করতে পারে একজন মহিলা। তা যাক গে, যা বলছিলুম দিনগুলো ছাপোষা মধ্যবিত্তদের মতোই কাটছিল।মাউইমার তখন বয়স হয়েছে। আমি রোজ দুপুরে ওনার ঘরে বসে পান সেজে দিয়ে আসতাম। একদিন অদ্ভূত একটাগন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিল। কেমন একটা পচা গন্ধ। এদিক ওদিক দেখলুম কিছু মরে পচেছে কিনা। কিছু দেখতেপেলুমনা। রাতে যখন মশারি খাটাতে গেছি গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। জিজ্ঞাসা করতেই উনি আমায় বার করেদিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কত্তাকে বললুম। উনিও ঘরে ঢুকে কটু গন্ধ পেলেন। সন্ধ্যাবেলা মাউইমা আফিমেরনেশা করতেন। একদিন ভাবলাম এই সুযোগে ঢুকে দেখব। দরজা অল্প ফাঁক করে দেখলুম আফিম খেয়ে উনিঝিমোচ্ছেন। পা টিপে টিপে ঢুকে দেখতে লাগলাম আলমারি, তাক সবকিছু। শেষে যখন বিছানায় হাত দিয়েছি দুমকরে উঠে বসলেন, খপ করে হাতটা ধরলেন। কি বলব তোকে চোখদুটো পুরো জবাফুলের মতো লাল। শীর্ন হাতেরবাঁধন কিছুতে যেন ছাড়াতেই পারছিলামনা। শেষে এক ঝটকায় ওনাকে সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসি। এরপর থেকেরাতে আর ওঘরে যেতামনা। ধীরে ধীরে সবাই ভয় পেতে লাগল ওনাকে। সারা দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতেন।স্বপাকে খেতেন তাই কি খেতেন কেউ বুঝতে পারতনা, বাসন পরতনা দিনের পর দিন। একদিন অনেক রাতে আমিদোতলায় বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি গরমে ঘরে কষ্ট হচ্ছে বলে, নীচেরদিকে তাকিয়ে দেখি কে দাঁড়িয়ে আছে। 


অন্ধকারে চোখ সইতে বুঝতে পারলুম মাউইমা। একভাবে সামনের বিশাল নিমগাছটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েআছেন। আমিও চুপ কে দাঁড়িয়ে রইলাম। সময় যেতে লাগল, আশ্চর্য ব্যাপার একটুও শরীরে নড়াচড়ার নেই। এবারভয় করতে লাগল আমার। একা শুনশান রাতে মাউইমা কি করছিলেন কিছুই বুঝলামনা। 


৯০ বছর বয়সে উনি মারা যান। জীবনের বিরাশিটা বছর এবাড়িতে কাটিয়েছিলেন। হয়তো সে কারনেই এবাড়িরমায়া ত্যাগ করতে পারেননি। ঐ ঘরে এখনও বাস করেন উনি। এবাড়ির বাস্ত্তুর সাথে ওনার আত্মা মিশে আছে।আমরা যে মনগড়া কিছু বলছিলামনা তা তুই নিজের চোখেই দেখেছিস। প্রথম প্রথম আমাদের সবার কষ্ট হত কিন্তুমানতে হয়েছে। তোকেও এই অশরীরীর অস্তিত্বকে মানতে হবে। ওনার নির্দেশ পালন করতে হবে। জীবনে এমন কিছুজিনিষ থাকে যেগুলোকে প্রশ্নের আওতায় ফেলা যায় না। “


“ আচ্ছা, ঠাম্মি। মাউইমার দাহ হওয়ার পর শ্রাদ্ধ হয়েছিল নিশ্চয়ই। আর তা যদি হয়ে থাকে তাহলে তার আত্মামুক্তি পাবে না কেন? তোমরা গয়ায় পিন্ডদানের ব্যবস্হা করনি কেন? না, আমি বলতে চাইছি তোমরা যদি ওনারআত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নাও, তাহলে তাকে মুক্তি দেওয়ার উপায়ও তো ভাবতে হবে। “

বুড়ো সবুর কিছু একটা বলতে চাইছিল, থামিয়ে দিলেন ঠাম্মি “ যা মা। মনকে শান্ত কর এবার। নিজের ঘরে যা।আমি একটু বিশ্রাম করব। সবুর তুমিও যাও বাবা। “


                  (৪)


মনের মধ্যে কেমন একটা খচখচ করছে। কোনও একটা জায়গায় এসে গল্পের সূত্রটা ছিঁড়ে যায়। আত্মা মুক্তি পায়নাএমন কথা সে শোনেনি কখনও। কেন এরা এই ভুতুড়ে কাহিনী বয়ে বেড়াছে? কি কারনে সবই আড়াল করেছে এইঘটনা ?


বিদ্যুৎচমকের মতো একটা নাম এল মাথায়- সবুর। 

হ্যাঁ, সবুর মিয়া বলতে পারবে এবং তা নিরপেক্ষতা হবে। ঠাম্মি যেন বইয়ের অনেকগুলো পাতা বাদ দিয়ে দিল।


ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুতপায়ে লনে এল মধুরিমা।দেখল সবুর ঘাস কাটছে। “ চাচা, শোন একবার।”


“ বল নাতবৌ” এগিয়ে এল সবুর। 


“ মাউইমার সত্যি পরিচয়টা আমার জানা চাই চাচা। ঠাম্মির কথার মধ্যে কি যেন অসঙ্গতি আছে। তাছাড়া তোমারবাবা আর ঠাকুমার ব্যাপারে সেভাবে কিছু বললেন নাতো। কি হয়েছিল চাচা, প্লিজ বল আমায়।”


“ এসব কথা কেন জানতে চাও মা? আমি এবাড়ির নুন খেয়েছি। কোনও কথা বলাই পাপ হবে যে।”


“ ধরে নাও তোমার মাউইমা চান বহুকাল ধরে চাপা পরা সত্যিটা বেরিয়ে আসুক।”


“আমি তোমায় যা বলব তা আমার নিজের চোখে দেখা নয়। বাপজানের কাছে শোনা।

মাউইমা আর আমার বাবার বয়স কাছাকাছি ছিল। ওনার জীবনে না কোনও বন্ধু ছিল না ভালোবাসার মানুষ।সারাজীবন মারধর খেয়েছেন, শ্রদ্ধা পেয়েছেন কিন্তু ভালোবাসা পাননি। আমার বাপজান দিলদরিয়া মানুষ ছিল।ভোরবেলা গাছে জল দিতে দিতে গল্প হত দুজনের। দুপুরবেলা আব্বাজান কোরান শরীফ পরে শোনাতেন। এরকমইচলছিল। হঠাৎ একদিন তোমার দাদাশ্বশুর কি কাজে তার মায়ের ঘরে আসে। সেখানে দুজনকে একসাথে বসেথাকতে দেখে খুব রাগারাগি করে। কৈফেয়ত চায় মায়ের কাছে। মাউইমা কোনও জবাব দেননি। তার রাগী মুখখানাএখনও মনে আছে আমার।বড়ছেলের কাছে এই অপমান জীবনের শেষদিন অব্দি ভোলেননি। 

এরপর একদিন এমন ঘটনা ঘটে যায় যা বাড়িতে এক ঝড় বয়ে আনে। আব্বাজানের কাছে কোরান শুনে, কিভাবেদোয়াদুরুত করতে হয় এসব শিখেছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়ত মাউইমা।আমার আব্বাজান অনেক বারনকরেছিল কিন্তু উনি বলেছিলেন বন্ধ দরজার এপারে কি হচ্ছে তা কেউ জানতে না পারলেই হল। কিন্তু একদিন যখন মুনাজাত  করছেন অকস্মাৎ ঘরে ঢুকে পড়ে তোমার ঠাম্মি। পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, একঝলক দেখেই সব বুঝতে পারে। 


বাড়ির সবাই যেন নির্বাসনে পাঠিয়ে দিল তাকে। তাঁর কথা বলতে বলতে আমার বাজানের চোখ দিয়ে পানি পড়ত।একটা ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে বারোটা বছর কাটিয়েছিলেন। এক ঝি ছাড়া কেউ খোঁজ করতে যেত না। মানুষ কি পাষান। সারা জীবন শাস্তি ভোগ করে শেষ দিনগুলোতেও শান্তি পাননি উনি।

আমার বাজানকে বিদেয় করে দিয়েছিল তোমাদের ঠাম্মি।আটকে রেখেছিল আমায়। হয়তো তাকে শাস্তি দেওয়ারজন্য। 


শোন নাতবৌ মাউইমার কোন শেষ ইচ্ছেই কেউ কোনদিন জানতে চায়নি। কি করেই বা জানবে! মরে কাঠ হয়ে মানুষটা গোটা একদিন পড়েছিল।”


এগিয়ে এসে সবুর এবার ধরে ফেলল মধুরিমার দুখানি হাত “আমি তোমার বাপের মতোন। এখানে যদ্দিন আছ, এরা যা বলে করো।

সবাইকে বলা হয় মৃত্যুর সময় বলে গেছেন তাকে যেন তার ঘরের মাটির তলাতেই গোর দেওয়া হয়। ওনার এই কথাশুনে ভীষন চমকে ওঠে সবাই। মৃত্যুপথযাত্রীকে বোঝাবার মতোন অবস্হাও ছিলনা। তারপর ঠিক হয় উনি যাচেয়েছেন তাই হবে, কিন্তু বাইরের লোকজনের সামনে প্রকাশ করা চলবেনা। 


বুড়ো সবুর চোখের জল মোছে “ যে পাপ সমাজের চোখে মাউইমা করেছিল তার শাস্তিস্বরুপ তাকে ঐ ঘরের মধ্যেই পুঁতে ফেলা হয়। বড় কঠিন মন এনাদের। ভগবান তো একই তাই না? যেভাবেই ডাক সাড়া মিললেই হল।


দুঃখী আত্মা নিজেকে এ মাটির সাথে বেঁধে রেখেছে মা। ওনার দেহাবশেষ মাটির নীচ থেকে তুলে দাহ করতে হবে।নইলে তার মুক্তি নেই, মুক্তি নেই।”


বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মধুরিমা। শাশুড়ি, স্বামী , পুত্র তাকে অপমান করেছে সারাজীবন তাই কি তিনিঅনন্তকাল এখানে থাকতে চান? আট বছর বয়সে দেহে, মনে যে বাঁধন পরেছিল তার থেকে মুক্ত হতে পারেননি মাউইমা। কোন ঈশ্বর তাকে আশ্রয় দেবে! সারাজীবন যাকে তুলসী মালা দিয়েছেন নাকি যার কাছে মুনাজাত করেছিলেন! এই মাটির নীচে এখনও কোনও অদৃশ্য যোগসূত্রে বেঁধে রেখেছেন নিজেকে। 






Rate this content
Log in

More bengali story from Kastury Chatterjee Patranabis

Similar bengali story from Horror