প্রাণের সাঁঝবেলা
প্রাণের সাঁঝবেলা
হাতে লাল রঙের বাটিটা নিয়ে যখন নীল কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছলো তখন আকাশটা বেশ মেঘলা হয়ে এসেছে।
হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টিও নামবে। মেয়েটা যে এখনো কেন আসছে না? মনটা বিষন্ন হয়ে যাচ্ছে নীলের।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সামনের চায়ের দোকানে পাতা বেঞ্চটার উপর বসে পড়ে ও।
আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে, রাস্তা দিয়ে ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলেছে নিজেদের মনের মানুষদের সাথে।
নীলের একটু অড লাগে এভাবে একা বসে থাকতে।
আচ্ছা ও যখন আজ নিজের মনের কথাটা বলে দেবে তখন তার রিয়্যাকশনটা কি হবে? এতদিনের অভিমান কি সে ভুলতে পারবে?
গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে নীল।
বসে থাকতে থাকতে একটু অতীতের খাতাটা খুলে দেখে, কত মিষ্টি স্মৃতি লেখা আছে ওতে। চোখটা বুজে দিনগুলোকে দেখার চেষ্টা করে।
******
পেনটা মুখে পুড়ে চিন্তামগ্ন হয়ে বসেছিল সাঁঝ।
ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস আজ থেকে শুরু হবে। ক্লাসে যদিও এখনো কোনো টিচার আসেনি কিন্তু বরাবরের সিরিয়াস গুরু গম্ভীর সাঁঝ বই খুলে পড়া শুরু করে দিয়েছে।
কলেজের প্রথম দিন, জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সব ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে মেয়েরা একেঅপরের সাথে আলাপ করতে ব্যস্ত।
শুধু মিডল রোয়ের থার্ড বেঞ্চে বই মুখে করে বসে আছে সাঁঝ ওরফে রাম গরুরের একশো দশ নম্বর ছানা।
ক্লাসরুম ভর্তি শোরগোলের মাঝে একটা অল্প বয়সী ছেলে ঢুকে এলো। কিছুক্ষণ অবাক চোখে ইতিউতি চেয়ে সাঁঝের বেঞ্চের কাছে চলে গেল।
বেঞ্চে হঠাৎ ঠকঠক আওয়াজ হওয়ায় চমকে মাথাটা তোলে সাঁঝ। পাশে তাকিয়ে দেখে ওরই বয়সী একটা ছেলে বড় বড় চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে আছে।
সাঁঝের সাথে চোখাচোখি হতেই ছেলেটা বেঞ্চের খালি জায়গাটায় আঙুল দেখিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করে, "বসতে পারি?"
ছেলেটার আবভাব দেখে সাঁঝ একটু অবাকই হয়েছিল, তাই কথা না বাড়িয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে দেয়।
ছেলেটা ব্যাগটা রেখে বসে পড়লো পাশে। তারপর অবাক হয়ে এদিক ওদিক চাইতে লাগলো।
সাঁঝ মুখটা আবার বইয়ের দিকে ঘুরিয়ে নিলেও চোখদুটো লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলেটাকেই দেখে যাচ্ছিল।
ছেলেটা একটু বেশিই অদ্ভুত। পুরো ক্লাসরুমটাকে অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর কপালটা কুঁচকে কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে।
সাঁঝের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে স্যার ক্লাসে ঢোকে।
নতুন ব্যাচ, তাই এক এক করে সবাইকে ইন্ট্রোডাকশন দিতে বললেন উনি।
প্রত্যেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিচ্ছিল।
সাঁঝের পাশে বসে থাকা ছেলেটা এতক্ষণ দেখছিল সবাই একে একে উঠে দাঁড়াচ্ছে, কিছু একটা বলছে তারপর আবার বসে পড়ছে।
এই করতে করতে কখন যে ছেলেটার টার্ন এসে গেল ও বুঝতেই পারেনি।
তখনো চারপাশে কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে ও।
"এই যে ছেলে, শুনতে পাচ্ছো না নাকি কখন থেকে ডেকে চলেছি তোমায়।" প্রোফেসর বেশ কড়া গলায় বলে উঠলেন।
ছেলেটার কানে বোধহয় ঢোকেনি কিছুই ঢোকেনি। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে স্যার ওকে রাগী চেহারা নিয়ে কিছু বলে যাচ্ছে।
কথাটা ওকে বলা হচ্ছে ধরে নিয়েই ছেলেটা হাত নেড়ে ইশারা করে কিছু একটা বললো।
প্রোফেসর বোঝার চেষ্টা করলেন ও কি বলতে চাইছে।
ভ্রু দুটো কুঁচকে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে।
ছেলেটা আবার একই ভাবে হাতটা মুখের কাছে দেখিয়ে দুই দিকে মাথা নাড়লো।
"তুমি কথা বলতে পারোনা?" প্রোফেসর জিজ্ঞেস করলেন।
ছেলেটা আবার আগের মতন তাকিয়ে থাকে।
প্রোফেসর বাধ্য হয়ে টেবিলের থেকে একটা খাতা এনে ওতে বড় বড় করে কথাটা লিখে দেয়।
ছেলেটা লেখাটা পড়ে মাথা নাড়িয়ে ওতে সায় দেয়।
সাঁঝ পাশে বসে এতক্ষণ পুরো ঘটনাটা দেখছিল। শুধু সাঁঝ না, ক্লাসের সবাই বেশ উৎসাহ নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কেউ মিটিমিটি হাসছিল, কেউ আবার নিজের মতন মতামত প্রকাশ করছিল।
কিন্তু ছেলেটা কথা বলতে পারে না জেনে সবাই বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। হয়তো কিছুটা করুনাবশতই।
সাঁঝও মুখটা নামিয়ে নিলো। কিছুটা খারাপও লাগলো।
খাতাটা ছেলেটার দিকে এগিয়ে প্রোফেসর ইশারা করে বলে, "কি নাম তোমার?"
ছেলেটা মুক্তর মতন অক্ষরে লিখে দেয়, "নীলাকাশ সেনগুপ্ত।"
সাঁঝ কৌতুহলবশত মুখটা ঈশৎ বাড়িয়ে নামটা দেখে নেয়।
মনে মনে ভাবে নামটা বেশ সুন্দর।
"এই যে মিস, আশা করি আপনি কথা বলতে পারেন। নিজের পরিচয়টা দিন।"
প্রোফেসরের ডাকে চমকে ওঠে সাঁঝ।
খেয়ালে এমন ডুবে গিয়েছিল যে নিজের পরিচয়টা দিতেই ভুলে গিয়েছিল।
তাড়াহুড়ো করে উঠে বললো, "আমার নাম সাঁঝবেলা, সাঁঝবেলা মুখার্জী।"
কথাটা বলেই সাঁঝ খেয়াল করে একজোড়া চোখ তারই দিকে তাকিয়ে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো নামিয়ে নেয় সাঁঝ।
ফার্স্ট পিরিয়ডের পরে প্রোফেসর যেই বেড়িয়ে গেলেন নীলাকাশ সাঁঝের হাতটা ধরে ওকে ডাকলো।
সাঁঝ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে।
নীলাকাশ খাতাটায় কিছু একটা লিখে সাঁঝের দিকে এগিয়ে দেয়।
সাঁঝ পড়ে দেখে ওতে লেখা আছে, "তোর নামটা আমাকে একটু লিখে দিবি?"
নীলাকাশের দিকে একপলক তাকিয়ে কি যেন একটা ভেবে নিজের নামটা লিখে দেয় সাঁঝ।
নামটা পড়ে নীলের মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে ওঠে।
আবার খাতাটার পৃষ্ঠায় কিছু লিখে সাঁঝকে দেয় নীল।
"নামটা সাঁঝবেলার সিঁদুরে আকাশের কনে দেখা আলোর মতোই সুন্দর।"
হেসে ফেলে সাঁঝ।
কিছু একটা বলতে গিয়ে জিভ কাটে, মনে পড়ে যায় বলতে গেলে ও শুনতে পাবে না।
খাতার পাতায় লিখে দেয়, "নীল রঙের আকাশ দেখছি খুব সুন্দর কথা বলতে পারে।"
"বলতে পারি না, লিখতে পারি।" উত্তরটা লিখতে গিয়ে নীলের উজ্জ্বল মুখটা ঈষৎ ম্লান হয়ে যায়।
সাঁঝের মনেও একটু অন্ধকার নামে। না বুঝেই ছেলেটাকে কষ্ট দিয়ে ফেললো।
খাতাটা টেনে সাঁঝ লেখে, "কিছু কিছু শব্দরা কথা বলে। বুঝলি?"
নীলাকাশের আকাশ থেকে মেঘ কেটে গিয়ে আবার রোদ ঝলমলিয়ে ওঠে।
সাঁঝের দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করে, "ফ্রেন্ডস?"
সাঁঝ মিষ্টি হেসে হাত মেলায়।
বন্ধুত্বের চেয়ে মিষ্টি সম্পর্ক বোধহয় আর নেই। বন্ধুত্বই তো যেকোনো সম্পর্কের ভিত।
তাই তো সাঁঝবেলা আর নীলাকাশের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো।
দুজনের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল বেশি।
সাঁঝের বইয়ে বেশি মন আর নীলের খাওয়ারে।
খেতে আর খাওয়াতে খুব ভালোবাসে ছেলেটা।
কলেজ ক্যান্টিন বা কলেজ স্ট্রিটের সামনের চায়ের দোকান না জানি দুজনের কত কথার সাক্ষী। কথার মাধ্যম হত চিরকুট।
কলমই যেন দুজনের মুখের কাজ করতো।
নীলের মনের কথা শোনার লোকের খুব অভাব ছিল। সাঁঝ যেন ওর জীবনে সেই মানুষটা হয়ে এসেছিল , যে ওর মনের ভাঁজে ভাঁজে সাজানো অগোছালো কথাদের শুনবে।
নীলের বাবা মা বেশ বড়লোক, টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে ছেলেকে সময় দিয়ে ওঠা হয়না।
আসলে দুজনেই ছেলে অন্ত প্রাণ, ওর এতটুকু কষ্টও দুজনে সহ্য করতে পারেন না। তবে সমাজের চাপে কি করে যেন এই ধারণা ওনাদের ভিতরে বদ্ধমূল হয়েছে যে নীল কখনো নিজে খেটে খেতে পারবে না, ওর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাঁধ সাধবে।
তাই তো দুজনে মিলে যতটা সম্ভব ওর জন্য আর্ন করে সেভ করার চেষ্টা করে যাতে ওর লাইফটা সিকিওর করা যায়।
কিন্তু ওনারা ভুলে গিয়েছিলেন যে এভাবে নিজেদের ছেলের আত্মবিশ্বাসটাই ওনারা ভেঙে দিচ্ছিলেন।
ধীরে ধীরে নীলও মানতে শুরু করেছিল যে ওর দ্বারা কখনো কিছু হবে না, তাই নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো ও।
কথাগুলো মন দিয়ে শুনেছিল সাঁঝ।
কিছুক্ষণ বাদে ওর হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছিল।
বলেছিল , "এভলিন গ্লেনির নাম শুনেছিস? সি ইজ ওয়ান অফ দ্য বেস্ট ইন্টারন্যাশনালি অ্যাক্লেইম্ড পার্কিউশানিস্ট। উনি বারো বছর বয়স থেকে কানে শুনতে পান না অথচ উনি স্টেজে সিঙ্গারদের সাথে পারফর্ম করেছেন কেবল মাত্র মিউজিকের ওয়েভগুলো ফিল করে।
আর তুই সামান্য নিজে করে খেতে পারবি না?"
সাঁঝই প্রথম ওকে বোঝায় নিজের দুর্বলতাটাকে কখনো বড় করে দেখতে না, লোকে কি ভাবছের বাইরে গিয়ে নিজের ভাবনাটাকে প্রাধান্য দিতে।
ওর হাত ধরে কবে যেন নীলও একটা নকশীকাঁথা বুনতে শুরু করেছিল।
সাঁঝই ওকে প্রথম আইডিয়া দেয় নিজের কালিনারি স্কিলটাকে পারসিউ করতে।
আগেও দেখেছে সাঁঝ, নীল সাধারণ সব শাক সবজি দিয়ে কত রকমের অসাধারণ পদ বানিয়ে ফেলে।
নীলও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ওর নিজের একটা রেস্টুরেন্ট হবে, সেখানে দেশ বিদেশ থেকে মানুষ আসবে খেতে।
নিজেকে একটু একটু করে মেলে ধরতে শিখলো নীলাকাশ, শিখলো নিজের কাঁধে ভর দিয়ে কি করে টিকে থাকতে হয়। জীবনের পাঠ নিলো সেই প্রিয় বন্ধু সাঁঝবেলার কাছ থেকে।
কিন্তু ভালোবাসা হল কি?
ভাবতে ভাবতে থেমে যায় নীল। ওই তো, সাঁঝ আসছে। হালকা গোলাপী রঙের শাড়ির সাথে এলোমেলো চুল।
নীলের খুব ভালো লাগে ওই মিষ্টি মায়াবী মুখটার সাথে ওই এলোমেলো চুলগুলো।
সাঁঝ এসে নীলের পাশে বসে পড়ে চুপ করে। চোখেমুখে অদ্ভুত গাম্ভীর্যতা ফুটে উঠেছে ওর।
নীল সাহস পায় না ওর মুখ দেখে কোনো কথা বলার।
নীলকে চুপ থাকতে দেখে সাঁঝ বলে ওঠে, "কিছু বলার থাকলে বল নাহলে আমি চললাম।"
নীল শুনতে পায় না সাঁঝ ওকে কি বললো তবে আন্দাজ করতে পারলো সাঁঝ ঠিক কি বলতে পারে।
একটু ইতস্তত করে সাঁঝের দিকে বাটিটা এগিয়ে দিলো নীল।
বাটিটা হাতে নিয়ে খুলে দেখে সাঁঝ। মুখে অজান্তেই একটা হাসি ফুটে ওঠে।
নীল ওর জন্য রেড স্যস পাস্তা এনেছে। বাটির উপরে একটা চিরকুটে লেখা, "হ্যাপি ভ্যালেন্টাইস ডে।"
এই ডিশটা সাঁঝের বড্ড প্রিয় আর নীল বানাতোও খুব সুন্দর করে।
সাঁঝ বাটিটা খুলতে গিয়েও থেমে গেল।
নীলের হাতে বাটিটা দিয়ে বললো , "আমাকে কেন দিচ্ছিস এটা?"
সাঁঝের হাত নাড়া দেখে নীল একটু থতমত খেয়ে যায়। মেয়েটাকে মানাবে কি করে?
বাটির ঢাকনাটা খুলে সাঁঝের সামনে ধরে নীল। পাস্তার সুগন্ধে সাঁঝের পেটটা আনচান করে উঠলেও মন বাধা দেয়।
মনে মনে সাঁঝ বলে, "কি ভেবেছেটা কি ও, যখন ইচ্ছে ছেড়ে চলে যাবে আবার যখন ইচ্ছে ফিরে এসে ওই এক বাটি খাবার দিলেই আমার মন গলে যাবে? আমাকে মানানো অত সোজা নয়।"
মুখটা ঘুরিয়ে বসে থাকে সাঁঝ।
নীল একবার পাস্তার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার সাঁঝের দিকে তাকাচ্ছে।
শেষে কি করবে বুঝতে না পেরে পকেটের থেকে চিরকুট বের করে ওতে লিখছ দেয়, "আই এম সরি।"
চিরকুটটা পড়ে ভ্রু কুঁচকায় সাঁঝ। তবে কোনো উত্তর দেয় না।
নীল আবার লেখে, "আই প্রমিস আর কক্ষনো এমন করবো না। প্লিজ রাগ করে থাকিস না।"
"আমার রাগ করা না করায় কার কি যায় আসে বলতো? আমি তোর কে?"
"আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।" নীল লেখে।
কথাটা পড়ে সাঁঝের বেশ রাগ হয়।
"শুধুই বন্ধু আর কিচ্ছু না?"
"আরো বেশি কিছু বানানোর জন্যই তো এলাম। কিন্তু মহারানী তো কথাই বলছেন না।"
নীলের এহেন উত্তর পড়ে সাঁঝ বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকায়।
নীল একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে সাঁঝের দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দেয়। ইশারায় বলে, "পড়ে দেখ, প্লিজ প্লিজ প্লিজ।"
সাঁঝ ধীরে ধীরে চিঠিটা খোলে। পড়া শুরু করার আগে আড় চোখে একবার নীলকে দেখে নেয়।
"আমার মিষ্টি সাঁঝবেলা,
জানি খুব রাগ করে আছিস আমার উপর। রাগ আমারও হয়েছে নিজের উপর।
যেইদিন তুই আমায় ভালোবাসার কথা বললি সেইদিন তোকে ফেরাতে খুব কষ্ট হয়েছিল জানিস? আরে এত সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড পাওয়া কত ভাগ্যের ব্যাপার বল তো? আর আমি কিনা হাতের লক্ষ্মী পা দিয়ে, না না পা দিয়ে না , একটা কাগজের টুকরো দিয়ে ঠেলে দিলাম।
মনে আছে তোকে আমি বলেছিলাম আমার মত ছেলে কখনো তোর যোগ্য হতে পারেনা। কথাটা বলে তো আমি বিদেশে পালিয়ে গেলাম, বলে গিয়েছিলাম রান্না শিখতে যাচ্ছি।
কিন্তু ট্রাস্ট মি, একদিনও কুকিং ক্লাসে অ্যাটেন্ডেন্স দিইনি।
আরে বাবা, আমার কি আর ওইসব ধরে বেঁধে শেখায় মন আছে? আমার তো কল্পনায় যা আসে আমি সেটাকে কড়াইতে ঢেলে দিই।
কিন্তু বিদেশে গিয়ে আই রিয়েলাইস্ড যে আমার তোকে ছাড়া জাস্ট চলছে না। শুধু মিস করছিলাম না , আমি রীতিমতো সাঁঝ সিক হয়ে পড়েছিলাম।
কথাটা বুঝলি তো?
আরে বাবা, হোম সিক মানে যেমন বাড়ির জন্য মন কেমন করা তেমনি সাঁঝ সিক হল সাঁঝের জন্য মন কেমন করা।
টাইম নিলাম , ভাবলাম, দিনের চব্বিশটা ঘন্টার মধ্যে কুড়ি ঘন্টাই ভাবতাম তোর কাছে আমার ফিরে যাওয়া উচিত হবে কিনা।
পারলাম না থাকতে, সেই ফিরে আসতেই হল।
ক্যান আই গেট ওয়ান মোর চ্যান্স?"
"নো ইউ ক্যান্ট।" চিঠিটা পড়া শেষ হলে সাঁঝ বেশ গম্ভীর গলায় বলে।
চিঠিটার উল্টো পৃষ্ঠায় বেশ কিছুটা সময় ধরে কলম চালায় সাঁঝ।
লেখাটা পড়ে নীলের মুখটা কালো হয়ে যায়।
"আমি যেইদিন তোকে নিজের মনের কথা বলেছিলাম সেইদিন তুই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি নীল। বলেছিলি তুই আমার যোগ্য নোস, তোর মতন ছেলের সাথে নাকি সংসার করা যায়না। আমার ভালোবাসার উপর তুই সেইদিন ভরসা করতে পারিসনি বলেই চলে গিয়েছিলি।
তুই ভাবলি কি করে এতদিন পর হঠাৎ তোর খেয়াল হয়েছে তাই আমি তোর লাইফে ফিরে আসবো? আমি আমার জীবনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি নীল।
আজ তুই রিকোয়েস্ট করেছিলি বলেই আমি একবার দেখা করতে এলাম তবে নতুন করে আমাদের মধ্যে আর কিছুই হওয়ার নেই।"
সাঁঝ উঠে চলে যায়। এতদিনের জমানো অভিমান সহজে কি করে ভেঙে যায়?
নীল অনেকক্ষণ ভেজা চোখে বসে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামে।
উঠে পড়ে নীল, ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরলে মা বকবে।
.........
বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল নীল। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা আজকে।
ভেবেছিল আজকে সাঁঝের সাথে সবটা মিটিয়ে নেবে। কিন্তু মহারানীর অভিমানের মেঘ এতটাই বেশি যে সে কিছুতেই মানলো না।
এমন সময় ঘরে তন্দ্রা দেবী ঢুকলেন। পঞ্চাশের উপরে বয়স তবুও এখনো ডাকসাইটে সুন্দরী বলা চলে।
একসময় আই.আই.টির র্যাঙ্ক হোল্ডার ছিলেন। চাকরিও করেন হাই প্যাকেজের। এছাড়াও হাজব্যান্ডের বিজনেসে ওনার শেয়ার আছে।
সারা জীবনে টাকা কামিয়েছেন বিস্তর, ভেবেছিলেন এতে ছেলের জীবনটা নিশ্চিন্ত হবে।
তবে এখন কোথাও গিয়ে যেন মনে হয় কিছুটা সময় ছেলেকেও দিতে হত। যেইদিন নীল এসে বলেছিল ও কালিনারি স্কিলটাকে পারসিউ করতে চায় সেইদিন প্রথমবার ওনার মনে হয়েছিল হয়তো ওর মধ্যেও পোটেনশিয়াল আছে।
নীলের মাথায় আলতো করে হাত রাখেন তন্দ্রা দেবী।
"সাঁঝের মান ভাঙাতে পারিসনি তাই তো?"
নীল উঠে বসে, মায়ের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে।
তন্দ্রা দেবী একটু হাসেন।
"শুধু এক বাটি পাস্তায় কি কারো মন ভোলে?"
"তাহলে কি করতে হবে?" নীল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
"এমন কিছু কর, যেটা সাঁঝকে স্পেশাল ফিল করাবে।"
নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যান তন্দ্রা দেবী।
******
মাঝে দুটো দিন কেটে গেছে। সাঁঝ সেইদিনের পর থেকে আরো বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে।
সকালবেলা অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল সাঁঝ এমন সময় কলিং বেলটা বেজে ওঠে।
দরজা খুলে দেখে একজন পোষ্টম্যান দাঁড়িয়ে আছে।
একটা ইনভিটেশন কার্ড আর সাথে একটা নোট দুটোর দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকে সাঁঝ। নীল পাঠিয়েছে ওকে।
ওর রেস্টুরেন্ট ওপেনিং-এর দিন সাঁঝকে স্পেশাল ভাবে ইনভাইট করেছে নীল।
সাথে নোটে লেখা আছে, "আমাকে রেস্টুরেন্ট খোলার বুদ্ধিটা তুই দিয়েছিলি। আমার সাথে সম্পর্ক নাই বা রাখলি কিন্তু এই বিশেষ দিনটায় আমার বন্ধু হয়ে তো আসতেই পারিস। আসবি তো?"
চোখটা অজান্তেই ছলছল করে ওঠে সাঁঝের।
মনে মনে বলে, "সেইদিন তুই আমায় না ফেরালে আজ তোর এই স্পেশাল দিনে আমি তোর স্পেশাল মানুষ হয়েই তোর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম নীল।"
কি ভেবে যেতে রাজি হয়ে যায় সাঁঝ।
--------
সন্ধ্যে ছটা নাগাদ সাঁঝ নীলের রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে পৌঁছায় সাঁঝ।
লাইটিং আর ডেকরেশন মিলিয়ে ঝলমল করছে সাজানো গোছানো রেস্টুরেন্টটা।
প্রথমেই যেটা সাঁঝের নজর কাড়ে সেটা হচ্ছে রেস্টুরেন্টের নামটা।
বড় বড় অক্ষরগুলো তারার মতন ঝিলমিল করছে "প্রাণের সাঁঝবেলা" লেখাটা।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সাঁঝ। রেস্টুরেন্টটা নীল ওর নামে করেছে?
ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সাঁঝ। দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।
অনেক লোক এসে উপস্থিত হয়েছে আজকে। আজ ওপেনিং ডে , তাই আজ খাওয়ারের জন্য প্রাইজ চার্জ করা হবে না।
সেই কারণেই হয়তো এত ভিড় জমেছে।
কিছুটা দুরেই নীল দাঁড়িয়েছিল। রয়্যাল ব্লু কালারের ব্লেজারে আজ কি একটু বেশি ভালো লাগছে ওকে?
সাঁঝ নীলের সামনে গিয়ে ওর হাতে ফুলের তোড়াটা দেয়।
নীল হাসি মুখে ওকে চেয়ার দেখিয়ে দেয়, ইশারায় বলে বসার জন্য।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন লোক স্টেজে উঠে কিছু অ্যানাউন্স করা শুরু করলো। ওইসব দিকে সাঁঝের তেমন খেয়াল ছিল না, খেয়াল হল যখন মাইকে ওর নামটা অ্যানাউন্স করা হল।
চমকে ওঠে সাঁঝ, হঠাৎ ওকে ডাকা হচ্ছে কেন?
একটু ইতস্তত করে উঠে দাঁড়ায় সাঁঝ, শাড়িটা সামলে স্টেজে ওঠে।
লোকটা সাঁঝের পাশে গিয়ে বলে, "আজ এখানে যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের সবার উদ্দেশ্যে আমাদের রেস্টুরেন্টের সদস্যদের কিছু বলার আছে। এই যে মেয়েটিকে দেখছেন ওনার জন্যই আমাদের স্যার, এই রেস্টুরেন্টের ওনার নিজেকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করাতে পেরেছেন।
মিস সাঁঝবেলাকে ডেডিকেট করে তাই স্যার ওনার ইনভেন্ট করা স্পেশাল রেসিপির নাম রাখছেন 'সাঁঝের হাসি।"
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না সাঁঝ। নীল ওকে এতটা স্বীকৃতি দিলো?
এরপরে কি করে ওকে দুরে সরিয়ে রাখবে সাঁঝ?
সন্ধ্যেটা কিভাবে কাটলো বুঝতে পারলো না সাঁঝ। সবাই একে একে চলে গেছে।
থেকে গেছে শুধু সাঁঝ আর নীল।
নীল মুখটা নীচু করে সাঁঝের সামনে এসে কান দুটো ধরে।
সাঁঝ ছলছলে চোখে তাকিয়ে থাকে।
নীল একটা চিরকুট এগিয়ে দেয় সাঁঝের দিকে। ওতে লেখা আছে, "তুই আমার মুখের শব্দ হবি?"
আজ আর নিজেকে সামলাতে পারে না সাঁঝ। এতদিনের জমা বরফ এক নিমেষে গলে যায়।
নীলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে সাঁঝ।
নীল জল ভরা চোখে হাসতে হাসতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা প্লেট তুলে নেয়।
কাঁচা হলুদ আর লাল রঙের মিশ্রণে তৈরি পুডিংটা অল্প কেটে সাঁঝের মুখের সামনে ধরে।
তখনো "সাঁঝের হাসি" লেখাটা পুডিং-এর উপর জ্বলজ্বল করছে।
কলমে-আশালতা

