Sangita Duary

Romance Tragedy

3  

Sangita Duary

Romance Tragedy

প্রাক্তনী

প্রাক্তনী

4 mins
228



কলেজ রিইউনিয়নে, কলেজ ক্যাম্পাসের বিশাল খোলা মাঠে, সবাই জড়ো হতে শুরু করেছে ধীরেধীরে। কী ভীষণ নস্ট্যালজিয়া!

সেই দুহাজার আটের ব্যাচ। মিতালি,কঙ্কনা,অঙ্কন, অরিন্দম, প্রত্যূষ, সেঁজুতি,তমালি,মোনালিসা, শুভদীপ, রাজেশ সবাই সবাই এসেছে দল বেঁধে, আরে কতদিন পর আবার সেই দলছুট গরুগুলোকে এক মাঠে ছাড়া হয়েছে! ওসব গান বক্তৃতা নাটক শোনার কোনো ইচ্ছেই নেই ওদের।

চারিদিকে ছড়ানো সব স্মৃতি, স্মৃতি নয় যেন প্রাণ, সেই পুরোনো ক্যান্টিন যেখানে দিনের বেশিরভাগ সময়টা কেটে যেত প্রত্যুষের পলিটিক্স দিয়ে হোমড়া চোমড়া ভাষণে কিংবা সেঁজুতি নিত্য নতুন হ্যান্ডব্যাগ প্রদর্শনে, মিতালির কেতা দেওয়া হেয়ার স্টাইল, অঙ্কনের বেঞ্চ বাজিয়ে তবলার বোল আর শুভদীপের কণ্ঠে... সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা!

নীলাঞ্জনা! 

নীলাঞ্জনা আসবে না?

শুভদীপ মিতালির দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকায়, "আসবে না, কিরে?"

একমাত্র মিতালির সঙ্গেই যোগাযোগ আছে নীলাঞ্জনার। সেও থতমত খেয়ে বলে, "আসবে বলেছিল তো!"

অঙ্কন শুভদীপের পিঠ চাপড়ে বলে, "ঘরে বউ, বাচ্চা আছে তো মামু, এখনো প্রাক্তনীর জন্য মনকেমন কেন?"

শুভদীপ ভাবলেশহীন চোখে তাকায় অঙ্কনের দিকে, "তুই বুঝবিনা!"


 সেদিন কিন্তু শুভদীপও বোঝেনি, দীর্ঘ পাঁচটি বছর সম্পর্কের পরেও কেন বিচ্ছেদ নেমে আসে?

দীর্ঘ পাঁচটি বছরের পবিত্র অনুভূতিগুলো কেন কোন ঝড়ের দমকা ঝাপটে গুঁড়িয়ে যায়,

 সেদিনও বোঝেনি শুভদীপ।

ঐযে মাঠের শেষপ্রান্তে ওই অশ্বত্থগাছটা আজও স্বমহিমায় মাথা উঁচিয়ে সব্বাইকে ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ও সাক্ষী আছে, শুভদীপের ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিলনা, কোনো উদ্দেশ্য ছিলোনা!

চরম মধ্যবিত্ত বাড়ি থেকে কলেজে পড়তে আসা ছেলেকে টিফিন খরচ কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করার খরচ কোনো বাবাই দেয়না।

অনেকসময় নিজের খরচটা এমনকি বই কেনার খরচটাও নিজেকেই জুটিয়ে নিতে হয়, টিউশন পড়িয়ে।

শুভদীপও পড়াতো, কলেজে আসার আগে, কলেজ ছুটির পরে।

বরাবরের সাশ্রয়ী শুভদীপ। কলেজ ফিজ আর বইপত্রের খরচ ছেড়ে যেটুকু থাকতো, বাঁচিয়ে রাখতো, কিজানি কোথায় প্রয়োজন পড়ে!


নীলাঞ্জনার বাবা বড়মানুষ, বাড়ির গাড়িতেই মেয়েকে কলেজে পাঠাতেন রোজ। 

চকচকে ফর্সা ত্বক, পালক পালক চোখ, টুকটুকে ঠোঁট আর তীক্ষ্ণ নাক, কলেজের ছেলেরা ওকে দেখলেই বুকের বাঁ পাশটা চেপে ধরতো। 

মেয়েরা সাহস করে কথাই বলে উঠতে পারতোনা ওর সঙ্গে, এমনকি স্যারেরা পর্যন্ত ওর দিকে তাকিয়েই ক্লাসে নোট দিতেন।

একমাত্র মিতালির সঙ্গেই ওর বন্ধুত্বটা ছিল।

আর শুভদীপকে? নীলাঞ্জনা কোনোদিন পাত্তাই দিতনা, যে মেয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য পুরো কলেজ পাগল সেই মেয়ে কিনা একটা তেল চুকচুক সাশ্রয়ী মধ্যবিত্ত ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে!

তবু হয়েছিল। বন্ধুত্ব ডিঙিয়ে প্রেমও।


দুটো ক্লাসের পর একটা অফ ক্লাস। বাড়ি থেকে বয়ে আনা পিউরিফাইড জল শেষ হয়ে গিয়েছিল নীলাঞ্জনার। ওদিকে তেষ্টায় গলা ফেটে যায়। সামনে শুভদীপ। বিগলিত গলায় ডাকে শুভদীপকে, "হেই, ইউ, একটা জলের বোতল এনে দেবে? পিউরিফাইড?"

অতিআত্মবিশ্বাস ছিল নীলাঞ্জনার, এরকম কুহেলী ভঙ্গিমায় যে কোনো ব্রহ্মচারীকে কামদেবের ভক্ত বানাতে পারে।

শুভদীপ অবহেলার ছলে বলেছিল, "ঈশ্বরপ্রদত্ত হাত পাগুলো নাড়ুন, নাহলে জং ধরবে, তখন একটা ভিখিরীও ফিরে তাকাবে না!"

এত ঘ্যাম! নীলাঞ্জনা মিতালিকে জিজ্ঞেস করে, ''কে রে? চিনিস?"

-"আলবাত, আরে কিপটে দি গ্রেট, শালার হাত থেকে অচল পয়সাও গলে না!"

-"এই কথা? আমিও দেখবো!"


ফাইর্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট বেরিয়েছে, শুভদীপ সেকেন্ড হায়েস্ট মার্কস পেয়েছে। রেজাল্ট হাতে হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে যাবে হঠাৎ একটা ছেলে এসে বলে, "তুমি শুভদীপ? একটু ক্যান্টিনে চলো, তোমার একটা পার্সেল এসেছে!"

পার্সেল, তাও শুভদীপের, আবার ক্যান্টিনে?

ভ্রুতে ভাঁজ নিয়ে শুভদীপ ক্যান্টিনে যায়।


সেখানেই তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটা বিল, দশজনের এগচিকেনরোলের দাম, দুশো টাকা।

শেষ বেঞ্চ থেকে নীলাঞ্জনা উঠে আসে, "সেকেন্ড হায়েস্ট মার্কস, সেলিব্রেট হবে না? এটা আমাদের জন্য ট্রিট হিসেবেই ধরলাম!"


শরীরে ঢেউ তুলে বেরিয়ে গিয়েছিল নীলাঞ্জনা। সেদিনও কিছু বলেনি শুভদীপ।


কিন্তু যেদিন নীলাঞ্জনার দামি চারচাকার সামনে শুভদীপের সাইকেলটা হঠাৎ ছিটকে পড়লো আর নীলাঞ্জনা তাদের দামি গাড়ির গায়ে পড়ে যাওয়া সামান্য আঁচড়ের জন্য তাকে দায়ী করলো, তখন নিজের কনুইয়ের রক্ত চেপে ধরে শুভদীপ বলেছিল,

 "গাড়ির রক্ত পড়ে না, একটু সারিয়ে নিন, সেরে যাবে, কিন্তু আমার হাতের রক্ত মুছলেও মনের দাগ মেটাতে পারবেন কি? পারলে একটু মানবিক হন, নারীর নামে অহংকারী নয়।"


তারপর কি যে হলো...

অহংকারী নীলাঞ্জনা প্রেমে পড়ল শুভদীপের। দিব্যি টিব্যি দিয়ে টাকা গুঁজে দেয় হাতে, বাসের সিটে পাশাপাশি বসে, খালি পায়ে ঘাসে দাঁড়ায় আর ওই অশ্বত্থগাছের নিচে দাঁড়িয়ে শুভদীপ প্রার্থনার সুরে বলে, "এত স্বপ্ন দেখাচ্ছ, কখনো হাত ছাড়বে না তো?"


হাত তো ছাড়তেই হয়েছিল, অপবাদ নিয়ে, বড়লোকের মেয়েকে ফুসলিয়ে সম্পত্তি বাগানোর অপবাদ।

সেদিন নীলাঞ্জনাও কেমন অপরিচিতা হয়ে গিয়েছিল। তখন কলেজ শেষ করে শুভদীপ হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে।


মিতালিই প্রথম জানিয়েছিল, নীলাঞ্জনার বিয়ে, এনআরআই পাত্রের সঙ্গে।


শুভদীপ রাতের সুন্দর স্বপ্নের মত ভেবে ভুলে যেতে চেয়েছিল নীলাঞ্জনাকে। 


তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। শুভদীপ এখন সরকারি চাকুরে, বিয়েও হয়েছে, বাচ্চাও আছে। নীলাঞ্জনা এখন কেবল একটা নাম।


 তবু যখন এই রিইউনিয়নে কথা শুনলো, বারবার অতীতটা ফিরে ফিরে এসেছে চোখে, নিশ্চয়ই আরো সুন্দর হয়েছে সে, বিশ্বজোড়া সুখ খেলা করে ওর আঁচলে এখন নিশ্চয়ই!

শুভদীপ দেখতে চেয়েছে এমন সুখী মানুষকে মানুষের মত দেখতে লাগে কিনা! 


অনুষ্ঠান শেষের পথে নীলাঞ্জনা এলো। 


বত্রিশ বছর বয়সেই বাহান্নর প্রবীনা লাগছে কেন শুভদীপের প্রাক্তন স্বপ্নচারিণীকে!

মিতালিও জানতো না, এনআরআই টাকার জন্য সব করতে পারেন, প্রয়োজনে বউকে অন্যের বিছানায় পাঠাতেও।


নীলাঞ্জনা এখন একটা বস্তিতে থাকে, সেলাই করে, টিউশন পড়ায়, ঠোঙা বানায়, তবু বড়মানুষ বাবার কাছে ভিখারী সাজেনি। 


*************************

সেদিন আর নীলাঞ্জনার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি, "কেমন আছো?"


প্রাক্তন সুখে থাকলে পুরোনো আক্রোশ কথার জালে ফিরিয়ে দেওয়া যায়।

কিন্তু প্রাক্তন কষ্টে থাকলে?

নিজের সুখী মুখটা লুকিয়ে ফিরেও আসতে হয়। অপরাধ শূন্য হলেও একবার ভাবতেই হয়... এরকমটা তো চাইনি কখনও!!


বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরঝির। মোবাইলের মিউজিক গ্যালারিতে নচিকেতার 'নীলাঞ্জনা' গানটা বাজছে। বহুবছর পর শুনছি। ভালো লাগছে। পুরোনো অনেক কিছু চোখের সামনে ঘুরে ফিরে আসছে।

মৃদু একটা কষ্ট বুকের বাম পাশটায়।


মধ্যরাত। নীলিমা টুনিকে সরিয়ে শুভদীপের কোলের কাছে গুটিসুটি সরে এসেছে। স্ত্রীর এই ইঙ্গিতের অর্থ বোঝে শুভদীপ।


 নীলাঞ্জনা শুভদীপের প্রথম প্রেম। প্রথম প্রেমকে ভোলা যায়না কক্ষনো।

নীলাঞ্জনা শুভদীপকে ঠকিয়েছিলো, ঠকবাজকে ক্ষমা করা যায়না কক্ষণও।

নীলাঞ্জনা শুভদীপকে কষ্ট দিয়েছিল, কত রাত চোখের জলে বালিশ ভিজেছে তখন, আজ সেই জল সেই কষ্ট হয়তো ঘুরে ফিরে নীলাঞ্জনার দিকেই, শুভদীপের তো খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি হতে পাচ্ছে কই?

সেই পালক চোখ, সেই টুকটুকে ঠোঁট, সেই তীক্ষ্ণ নাক, শরীরে সেই মোহিনী বিভঙ্গ যেগুলো একটি ছেলের ঠোঁটে হাসি ফোটাতে যথেষ্ট এরও বেশি, সেসব কোথায়? শুভদীপের সেই খুশি আজ কোথায়?

শুভদীপ তো এই নীলাঞ্জনাকে চেনেনা!

সেই প্রথম প্রেম নীলাঞ্জনা... হারিয়ে গেছে!!

প্রথম প্রেম... হারিয়েই যায়!!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance