পিঠে-পুলি
পিঠে-পুলি
নীলাঞ্জনার সকাল থেকেই মন খারাপ। প্রতি বছর আজকের দিনে ওর দিদুন ওকে কতরকমের পিঠে বানিয়ে খাওয়াত। পাটি-সাপটা, গোকুল পিঠে, দুধপুলি, শিমুইয়ের পায়েস আরও কত কি। কিন্তু দিদুন চলে যাওয়ার পর থেকে এসব কিছুই আর হয়নি। ওর মা-বাবা তো সেই কোন ছোটবেলায় ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এখন ওর প্রাণের চেয়েও প্রিয় দিদুনও নেই। তাই এসব কিছু খাওয়ার আবদার শোনানোরও লোক নেই। প্রীতম অবশ্য চেষ্টা করে ওর সব আবদার মেটানোর। তবে এই অচেনা জায়গায় প্রীতম আর কত করবে। ওর অফিস আছে। এক্ষুনি বেরিয়ে যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে নীলাঞ্জনা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। দুকাপ চা করে বারান্দায় এসে বসে। কিছুক্ষণ পর প্রীতম এসে বলে- কী ব্যাপার, মহারানির আজ মন খারাপ নাকি? সকাল থেকে এত চুপচাপ।
-না কি আবার হবে? আর আমি কি সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করি নাকি যে আজ তোমার আমাকে শান্ত মনে হচ্ছে।
-আরে আমি সেটা বলিনি। আচ্ছা শোনো, আমি বেরচ্ছি। আমার আজ আসতে দেরি হবে।
নিজের মনখারাপের কথাটা আর প্রীতমকে বলতে ইচ্ছে করল না ওর। প্রীতম বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের জন্য একটু খিচুড়ি রান্না বসিয়ে দিয়ে গান শুনতে লাগল। সারাদিন কোনোভাবে কেটে গেলেও সন্ধ্যেবেলা ওর আর ভালো লাগছে না। প্রীতম কখন আসবে এটা ভেবে বার বার ঘড়ি দেখছে। এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দেখে পাশের ফ্ল্যাটের দত্তকাকু আর দত্তকাকিমা বড়ো একখানা টিফিনকারি নিয়ে ওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওনাদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে প্রীতম মুচকি মুচকি হাসছে।
-কীরে নীলুমা, ভেতরে ঢুকতে বলবি না? দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?
-এই সরি সরি। তোমরা ভেতরে এসো।
ওনারা ভেতরে এসে টিফিনকারিটা নীলাঞ্জনার হাতে দিয়ে বলেন- এই নে তোর সব পছন্দের পিঠে বানিয়ে এনেছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে বল তো কেমন হয়েছে। তুই খেয়ে বলার পরই কিন্তু আমরা যাব।
-আরে কার জন্য অপেক্ষা করছো নীলাঞ্জনা?।তাড়াতাড়ি খোলো। আমার তো আর তর সইছে না।
-আসলে কি বল তো আমরা এই বুড়ো-বুড়ি নিজেরা আর কত পিঠে খাব। ছেলেমেয়েরাও সব বিদেশ-বিঁভুইয়ে থাকে। তারাও এখানে আসার সময় পায় না। তাই ভাবলুম তোদের জন্যেই একটু পিঠে-পুলি বানিয়ে নিয়ে আসি। তুই খুশি হয়েছিস তো?
আনন্দে নীলাঞ্জনার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। দিদুনের পর এই প্রথম কেউ ওর জন্য এইভাবে পিঠে-পুলি বানিয়েছে এটা ভেবেই ও আজ ভীষণ খুশি। প্রীতম ততক্ষণে সব পিঠেগুলো প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে চলে এসেছে।
-এইসব পিঠে তোমরাও আমাদের সাথে খেয়ে তারপর যাবে। তোমাদের ছেলেমেয়েরা যেমন তোমাদের সাথে নেই তেমনি আমাদের বাবা-মাও তো আমাদের সাথে নেই। এইবছর নয় এই নতুন ছেলেমেয়ের সাথেই তোমরা পৌষপার্বন পালন করো।
খাবার টেবিলে শুরু হয় ওদের আড্ডা। রক্তের সম্পর্কে নয়, ভালোবাসার সুতোয় গাঁথা অটুট সম্পর্কগুলো এইভাবেই অকারণে জীবনভরের সুখ দিয়ে যায় বোধহয়। ওদের এই সুন্দর মুহুর্তগুলো ধরা থাকে প্রীতমের মুঠোফোনের ক্যামেরায়।