পিসঠাকুমার শীতলপাটি
পিসঠাকুমার শীতলপাটি
১
উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক কিছু পেয়ে থাকে লোকে। জমি-বাড়ি, টাকা পয়সা, গয়নাগাটি, এমন কী ঘটি বাটিও পাওয়া যায় বৈকি। তবে বীরেশ্বর বাঁড়ুজ্যের কপালখানা লাখে এক। পরলোকগমনের আগে পিসঠাকমা তাঁর শীতলপাটিখানা তাঁকে লিখে দিয়ে গেলেন। লিখে মানে লিখে - রীতিমত উকিল ডেকে সইসাবুদ করানো ব্যাপার। মৎসমুখীর পর দিন বাড়ি ফেরার সময় যখন নিমাইজ্যাঠা জরাজীর্ণ পাটিখানা বেঁধেছেঁদে সঙ্গে দিলেন, তখন বেকুবের মত দন্তপাটি বিকশিত করে বাড়িমুখো রওনা দিতেই হল বীরেশ্বরকে।
বীরেশ্বরের বাড়ি ঠিক বাড়ি নয়, প্রাসাদ। জরাজীর্ণ, ভগ্নপ্রায়, কিন্তু প্রাসাদ বটে। পূর্বপুরুষরা ভোগ করে গেছেন, বীরেশ্বর প্রসাদ পেয়েছেন, এবং পেয়ে অবধি ভুগছেন। আজ দরজা পড়ে যায় তো কাল জানালা নড়ে যায়। সাপখোপ বিছের বংশ বাড়ির দখল নিয়েছে, দয়া করে নিচের তলায় খান তিনেক ঘর ছেড়ে দিয়েছে তাঁকে, তাতেই তিনি পরিবার সমেত অধিষ্ঠান করেন। ছেলেদের একজন উঠতি কবি, একজন পড়তি ব্যবসাদার। কারোরই ট্যাঁকে টাকা নেই। গৃহিণীর মেজাজ চড়া সুরে বাঁধা থাকে। এমতাবস্থায় পাটি নিয়ে ঘরে ঢোকার মত বুকের পাটা বীরেশ্বর রায়ের ছিল না। তবে ভগবানের দয়ায় বাগানখানা এমন জঙ্গুলে, বাঘ ঢুকলে পথ হারিয়ে ফেলবে। সেই জঙ্গলেই পাটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন বীরেশ্বর। নামে বীরশ্রেষ্ঠ হলেই বা, আসলে মানুষটা তিনি বড়ই ভীতু।
গল্পের শুরু পরের দিন ভোর থেকে। ভোর জিনিসটা বীরেশ্বর চাক্ষুষ করেন না বিশেষ। সকালের মিঠে ঘুমখানা তাঁর জীবনের একমাত্র বিলাসিতা। কাঁকালে গিন্নির আঙুলের খোঁচা খেয়ে সেই ঘুম ভেঙে খানখান হয়ে যায়। ককিয়ে উঠতেই সাঁডাশি আক্রমণে মুখ চেপে ধরেন গিন্নি, চাপা গলায় বলেন, "চুপ! চুপচাপ এসো দেখি আমার সঙ্গে!"
ঘুমচোখে ছিলেন বলেই কিনা, অসমসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আপত্তি তোলেন বীরেশ্বর। কাঁথাখানা চেপে ধরে বলেন, "না না, আমি এখন যেতে টেতে পারব না। ফুলচুরি আমার ডিপার্টমেন্ট নয়। ভুতোর মায়ের সাথে তুমি বোঝাপড়া করে নাও।"
এবারের খোঁচাখানা পাঁজর ভেদ করে হৃদযন্ত্রে ফুটো করে দেয় প্রায়। রক্ত জল করা চাউনি দিয়ে গিন্নি বলেন, "ফুল বলেছি, অ্যাঁ? মোহর, মোহর! জলজ্যান্ত মোহর একেবারে! গোটা একখানা, দুয়োরের সামনে পড়ে জ্বলজ্বল করছে! ওঠো না রে বাপু, উঠে দ্যাখো না এসে!"
২
মোহরখানা নিয়ে ভারি আতান্তরে পড়লেন বীরেশ্বর। পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, গিন্নির চোখ রাঙানিতে শেষটায় ভোলা স্যাকরাকে ডাকাতে হল। ভোলা এখন হোমরাচোমরা লোক, ডাকলেই কিছু ছুটে আসে না। তবে বাঁড়ুজ্যেবাড়ির ওপরে তার নজর আছে। কানাঘুষোয় শোনা যায়, বাঁড়ুজ্যেবাড়িতে নাকি গুপ্তধন লুকিয়ে রাখা আছে। সে ধন আত্মপ্রকাশ করল কিনা জানার লোভেই বোধ হয় সে এসেছে।
বীরেশ্বর সকাল থেকে ভয়ানক একটা মানসিক চাপের মধ্যে আছেন। মুখেচোখে গ্রাম্ভারি একটা ভাব আনার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু সে ভাব দেখে মনে হচ্ছে তাঁর পেট কামড়াচ্ছে। ভোলা আতস কাচ দিয়ে মোহর দেখছে এক মনে। গিন্নির কনুইয়ের খোঁচা খেয়ে মুখ খুলতে হয় বীরেশ্বরকে। যথাসম্ভব জমিদারী মেজাজে তিনি বলেন, "কী বুঝছ ভোলা? খাঁটি সোনা হে। বাপদাদার জিনিস, হাতছাড়া করতে চাই না, নেহাত বাড়িঘরদোর একটু মেরামত না করালেই নয় -"
খাঁটি সোনা সেটা ভোলাও ভালই বোঝে। কিন্তু বুঝলেই তো আর সব কিছু বলে ফেলতে নেই। অতএব সে রায়কর্তাকে বোঝায়, "সোনা মোটে ভাল নয় কত্তা। ভালই খাদ আছে মনে হচ্ছে। আমি দোকানে নিয়ে গিয়ে দেখব একবার। তবে কিনা আমরা হলুম স্বর্ণকারের বংশ, সাত পুরুষের পেশা, আমরা এক ঝলক দেখলেই বলে দিতে পারি। হাজার পাঁচেকের বেশি পারব না কত্তা।"
তা' পাঁচ হাজারই বা দেয় কে! তাও আবার পড়ে পাওয়া টাকা। নোটগুলো গুনে নিতে নিতে চিন্তা হয় বীরেশ্বরের, মোহরের মালিক এসে আবার জিনিস ফেরত চাইবে না তো!
এদিকে ভোলা দারুণ একটা দাঁও মারার আনন্দে আটখানা। একখানা মোহর পাওয়া গেছে, বাকি গুপ্তধন হস্তগত করতে কতক্ষণ! একটু সুলুকসন্ধান লাগাতে পারলেই হল, গাঁটের কড়ি খরচ করে আর কিনে নিতে হবে না, লোক লাগিয়ে চুপচাপ সরিয়ে ফেলা যাবে।
আসন্ন লাভের লোভে বেভুল হয়ে হাঁটছিল ভোলা, হঠাৎ কীসে হোঁচট খেয়ে পড়বি তো পড় সিধে বাঁড়ুজ্যেবাড়ির বিখ্যাত বিছুটির জঙ্গলের মধ্যে। চোখের চশমা ছিটকে কোন মুলুকে গেল কে জানে। ভুঁড়ি সামলে, ধুতি সামলে হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠতে পারলে খুঁজত। কিন্তু তারই মধ্যে সামনের দিকে দৃষ্টি পড়ায় আরো এক বার আছাড় খেতে হল ভোলাকে। সামনের ঝাঁকড়া আমগাছখানার মোটা ডালে বসে এক বুড়িমানুষ পা দোলাচ্ছে। বুড়ি মানে খুনখুনে কোলকুঁজো ফোকলামুখো নয় মোট্টে। ইনি দশাসই, আড়েদীঘে পাহাড়প্রমাণ, মাথায় হেইয়া বড় চুড়ো খোঁপা, গোল চোখে আরো গোল কালো ফ্রেমের চশমা। পানের ছোপ ধরা লালচে দাঁতে যখন হাসলেন তখন ভয়ে ভোলার প্রাণপাখি উড়ে গেল। অজ্ঞান হওয়ার আগে বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন শুনতে পেয়েছিল মাত্তর - "কাজটা কি তুই ভাল করলি ভোলা?"
৩
বীরেশ্বরের বিপদ কিন্তু উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। রোজ সকালে নিয়ম করে দোরগোড়ায় মোহর পড়ে থাকে। ভোরের ঘুম ঘুচেছে বীরেশ্বরের, মোহরের আতঙ্কে রাতও প্রায় বিনিদ্রই কাটে। খান পাঁচেক মোহর জমা হয়েছে, নিত্যি গিন্নির খোঁচা খেয়ে খেয়ে বীরেশ্বরের পাঁজরে ব্যথা হয়েছে, কিন্তু এত এত মোহর ঠিক কীভাবে কাজে লাগালে বদ লোকের কুনজর পড়বে না সে সমস্যার কূলকিনারা হয়নি। ছেলেদের কাছে অবধি বলতে পারেননি। ভোলাকে ভরসা করতে ইচ্ছে করে না, এদিকে পড়ে পাওয়া টাকাপয়সার বৃত্তান্ত পাঁচকান করতেও ভয় লাগে। দোলাচলে কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন।
এই কয়েক দিন ভোলা ঘাপটি মেরে বসে ছিল। না থেকে উপায়ও ছিল না। আছাড় খেয়ে ইস্তক মাজায় ব্যথা, বিছুটি লেগে চুলকুনিতেও ভুগতে হয়েছে। তা' ছাড়া সেই ভীষণদর্শন ঠাকরুনটির মুখখানা মনে পড়লেই দাঁতকপাটি লাগছিল আর কী। তবে দ্বিতীয়বার বীরেশ্বর বাঁড়ুজ্যের ফোন পেয়ে খানিকটা চাঙ্গা হয়ে উঠতেই হল। টালবাহানা করে নিজের দর বাড়ানো এবং মোহরের দর কমানোর চেষ্টায় ছিল ভোলা, কিন্তু বীরেশ্বর উদাসী গলায় বললেন, "থাক তাহলে, তুমি ব্যস্ত মানুষ, এসব ছোটখাটো ব্যাপারে তোমার মাথা ঘামানোর সময় নেই বুঝতেই পারছি। আমি বরং কলকাতায় যোগাযোগ করি একটু -"
গুপ্তধন তাকে ডিঙিয়ে সোজা কলকাতা পাড়ি দেবে - তা' কখনো হতে দেওয়া যায়? অতএব লাঠিতে ভর দিয়ে ভোলা বাঁড়ুজ্যেবাড়ির পথ ধরে। সাবধানতা বশত সঙ্গে নেয় স্যাঙাত হারুকে।
মোহর এবার একটা নয়, দু'টো। কান চুলকোতে চুলকোতে ভোলা বলে, "অভয় দেন তো একটা কথা শুধোই কত্তা। সর্বমোট ক'খানা আছে? মানে একটা দু'টো করে না বেচে - আপনারও হাতে থোক টাকা আসে, আমারও বার বার আসতে হয় না আর কী।"
বীরেশ্বরের টাকে ঘাম জমে। অবস্থা সামাল দিতে বাঁড়ুজ্যেগিন্নি রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন। বলেন, "পূর্বপুরুষের সঞ্চিত ধন, সবটুকু হাতছাড়া করলে তাঁরা কুপিত হবেন না? তোমার অসুবিধে থাকলে বল বাপু, আমরা বরং কলকাতায় -"
ভোলা মনে ভাবে সেদিনের কুপিত ঠাকরুনটি তবে কোনো পূর্বনারীই হয়ে থাকবেন। অর্থাৎ কিনা ভূত। ভূতের ভয় কে না পায়। ভয়ের চোটেই মোহরের দাম পাঁচ থেকে ছয়ে ওঠে এবার। নগদ টাকা গুনে বের করে দিতে গিয়ে যেন বুকের বাঁ দিকে কনকন করে ওঠে। ওফ, কী বাজে খরচা! তৎক্ষণাৎ মনস্থির করে ফেলে ভোলা - ভূতঠাকরুনের একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। ওঝা নয়, ওসব কুসংস্কারে ভোলা একদম বিশ্বাস করে না। বছর তিনেক এইট ক্লাসে পড়েছে, শেষতক পাশ করতে পারেনি সে আলাদা কথা - যাই হোক শিক্ষিত ব্যক্তি তো একটা! চক্কোত্তি পুরুতমশাইকে দিয়ে একটা শান্তি সস্ত্যেন করাবে। ঠিক বিধিমত করানো যাবে না - বাঁড়ুজ্যেবাড়িতে শান্তি সস্ত্যেন করানোর সে কে! রাতের অন্ধকারে চুপিসারে কাজ সেরে ফেলতে হবে।
হারুর সঙ্গে আলোচনা করতে করতে ভোলা বাড়ি পৌঁছয়। আলোচনা কিছু নয়, হারু ব্যাটা মাথামোটা, তাকে সব কাজ পাখিপড়া করে বোঝাতে হয়। বাঁকা পথে থাকা সহজ নয়। কাজ কেঁচে গেলে এমন বদনাম হবে, যে গ্রামে টেঁকা দায় হয়ে উঠবে। পঞ্চাশ বার করে শুধোয় ভোলা, "হ্যাঁ রে, বুঝলি?"
হারু ঘটাঘট মাথা নাড়ায়। ঘটে কদ্দূর কী ঢুকল সে সন্দেহ নিরসন হয় না তাও। পাঁচের মত মুখ করে বগলে চেপে রাখা কালো ব্যাগটা হাতড়াতে হাতড়াতে ভোলা বলে, "দু'হাজার নিয়ে গিয়ে ফেলে দে, চক্কোত্তিমশাইকে বল তিথিনক্ষত্তর দেখে আমার কাছে আসতে। ফোনাফুনি করতে বারণ করবি। এসব কথা ফোনে বলা একদম উচিত নয়। কথায় বলে, দেওয়ালেরও কান আছে।"
কথা বলতে বলতে কপালে ভাঁজ পড়ে ভোলার। হাতে কিছু ঠেকে না কেন? রুমাল, নস্যির ডিবে, কলম - কাজের জিনিসগুলো কি উবে গেল? টাকার বান্ডিল?? মোহরের বাক্স??? হুড়মুড়িয়ে ব্যাগের মুখ হাঁ করে ভেতরে উঁকি মারে ভোলা! তারপরেই হাহাকার করে ওঠে, "এ কী সব্বোনাশ!! টাকা কোথায় গেল? মোহর কোথায় গেল?"
৪
পঁচিশ হাজার টাকা আর পাঁচখানা মোহর হারানোর শোকে ভোলা তো শয্যাশায়ী হলই, ওদিকে বীরেশ্বরও বিছানা নিলেন। কারণটা অবশ্য এক্কেবারে উলটো। রোজকার মত একখানা মোহর নয়, আজ পাঁচ পাঁচ খানা মোহর, আর পঁচিশ হাজার টাকা দরজায় রাখা ছিল। গোনাগুনতি অবধি যাওয়ার আগেই, দর্শনমাত্রেই বীরেশ্বরের পতন ও মূর্ছা। বাধ্য হয়েই বাঁড়ুজ্যেগিন্নিকে ছেলেদের ডাকতে হল, এবং শুরু থেকে সব কিছুর বিস্তারিত বিবরণ দিতে হল। জুতো শুঁকিয়ে কর্তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার পরেই বাঁড়ুজ্যেবাড়িতে বসল রূদ্ধদ্বার বৈঠক।
মোহরের উৎসস্থল নিয়ে বীরেশ্বর বাদে প্রত্যেকের নিজের নিজের বক্তব্য আছে। বিক্রমাদিত্য আর বিজয়কেতন, দুই ভাইয়ের কাছেই ব্যাপারটা মানুষঘটিত মনে হয়। বিক্রম ব্যবসায় ফেল মেরে মেরে সব কিছুকেই এখন বাঁকা চোখে দেখে। মোহরের লোভ আর সন্দেহবাতিকের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে।
বিজয়ের মতে মোহরগুলো কোনো পরোপকারী মানুষের দয়ার দান। পাওয়া যাচ্ছে যখন, চুপচাপ নিয়ে নিলেই হয়।
বাঁড়ুজ্যেগিন্নি মনে করেন এত দিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। কিস্তিতে করুণাবারি বর্ষাচ্ছেন।
বিক্রম খুঁতখুঁত করে। বলে, "বাবা, এসব সেই মহুলগঞ্জের বুড়িঠাকমার শ্রাদ্ধশান্তির পর থেকে শুরু হল না?"
তিনখানা মাথা বোঁ করে ঘুরে যায় বীরেশ্বরের দিকে। গিন্নি চাঁছাছোলা গলা যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে প্রশ্ন তুললেন, "হ্যাঁ গো, পিসঠাকমা কি মোহরের কলসী দিয়ে গেছেন নাকি তোমার নামে? তাই তো, এসে তো কই মুখ খুললে না একবারও! অ্যাঁ? কী চেপে যাচ্ছ বল দেখি?"
পিসঠাকমা। চোখ বন্ধ করেন বীরেশ্বর। মোহরের পেছনে পিসঠাকমার শীতলপাটির কিছু কারিকুরি আছে নিয্যস। এবার পাটির বৃত্তান্তটা ঠিক কোনখান থেকে মোলায়েম করে শুরু করা যায় সেটা ভাবতে হবে।
৫
একটু রোদ উঠতেই ফেলে দেওয়া শীতলপাটিকে সসম্মানে ঘরে তুলে আনার জন্য বিক্রম আর বিজয় বাগান অভিযানে বেরিয়ে পড়ল। খুঁজে পেতে কোনো ঝক্কিই পোয়াতে হল না। জলবিছুটির জঙ্গলের ঠিক মধ্যিখানে, ঝুপসিমত আমগাছটার নিচে শীতলপাটি পাতা। পাটিতে আসীন বুড়িঠাকমা। রোদ পোয়াতে পোয়াতে হাঁক ছাড়েন তিনি, "অ্যাই যে, নাতিসায়েবরা, পালাচ্ছ কেন, অ্যাঁ? এসো দেখি এদিকে।"
অগত্যা আসতে হয়, সদ্যমৃতা বুড়িঠাকুমার সঙ্গে এক আসনে বসতে হয়। গায়ে বিছুটি লাগে, দু'ভাই দু'হাতে গা মাথা চুলকোয়, কিন্তু ঠাকুমা চুলকুনি ইত্যাদির ঊর্ধ্বে এখন, তিনি সে সবকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, "পাটিখানা এক্ষুনি ভেতরে নিয়ে যেও না। দু'এক দিন বাইরে পাহারা থাকি।"
বিক্রম সবিনয়ে জিজ্ঞেস করে, "পাহারা কেন ঠাকমা?"
মাথা নাড়িয়ে ঠাকমা বলেন, "লোকজন ভাল নয় ভাই, সর্বদা মনে রাখবে। তোমাদের বাপ আলাভোলা বোকাসোকা লোক। তোমাদের দেখেও তো বুদ্ধিশুদ্ধি তেমন আছে বলে মনে হচ্ছে না।"
নির্বুদ্ধিতার খোঁটা দু'জনেরই গায়ে বাজে। তাদের তোম্বা মুখের তোয়াক্কা না করে ঠাকমা বলেন, "বংশের ধারা পেয়েছ আর কী! অকর্মার ঢেঁকি সব। যাকগে যাক, তোমাদের নিভাননী ঠাকমা এসেছে যখন, এ যাত্রা বেঁচে যাবে। মোহর যা দিচ্ছি সেগুলো বেচে টাকাটা কাজে লাগাও। তবে সাবধান, এসব কথা জনে জনে বলে বেড়াতে যেও না যেন! আমি একলা মেয়েমানুষ, ডাকাতরা দল বেঁধে এলে কদ্দূর কী করতে পারব বলা মুশকিল আছে।"
গ্রামের আরেকদিকে তখন ভোলা স্বর্ণকার কোনোমতে আঘাতখানা সামলে উঠেছে। চক্কোত্তিপুরুত আমাশায় ভুগছেন, বড় ছেলেকে প্রক্সি পাঠিয়েছেন। তাকে দেখামাত্র বিদেয় করতে উদ্যত হতে হয় ভোলাকে। হাত পা প্রবলভাবে নেড়ে সে বলে, "না ঠাকুর না, বাবাকে পাঠাওগে যাও। তুমিই না, সরস্বতীপুজোয় শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়েছিলে?" পুরোহিতপুত্র মোটেও পিছপা হয় না, একটা চেয়ারে গেঁড়ে বসে বলে, "সে তো সেই শুরুর দিকে। এই এখন দেখুন -" - বলে সে তারস্বরে সরস্বতীপুজোর মন্ত্রপাঠ শুরু করে। ভোলা ভারি বিরক্ত হয়ে বলে, "খেলে যা, আরে এসব বড়সড় কাজ, বাবাকে ওষুধ খেয়ে হলেও আসতে বল। তোমার দ্বারা হবে না। উফ কী যন্ত্রণা, অ্যাই হারু, নগেনডাক্তারকে নিয়ে যা তো ঠাকুরমশায়ের বাড়ি। যাও যাও, হারুর সঙ্গে যাও।"
৬
রাত প্রায় দু'-আড়াইটে হবে। বিছুটির ঝোপ থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ভোলা বলে, "নিন ঠাকুরমশাই, শুরু করুন।" বড় চক্কোত্তি গুনগুন করেন, "বাস্তের এত দূর থেকে কী করে কী করব বাবু, একটা থাম খিলেন টিলেনের কাছে না গেলে কী করে হবে!" হারুর দিকে তাকিয়ে কপাল চাপড়ায় ভোলা, বলে, "নে শোন! বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে মন্ত্রপাঠ করবে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে! উফ! আর দু'পা এগিয়ে যান গে যান! গলা নিচু রাখবেন! তুমি না তুমি না, অ্যাই হারু, সামগ্রীগুলো নিয়ে এগিয়ে যা না! আপনার ছেলেকে যে আবার কেন নিয়ে এলেন ঠাকুরমশাই!"
চক্কোত্তি মিনমিন করে সাফাই গান, "জোর আমাশা হয়েছে বাবু, মাঝপথে ইয়ে, যেতে টেতে হলে ফটকে এদিকটা দেখতে পারবে'খন।"
ভোলার কপাল কুঁচকে থাকে। চক্কোত্তি চাপাগলায় মন্ত্র পড়া শুরু করেন। দু'ছত্তর পরে পরে হারুর এগিয়ে দেওয়া বোতল থেকে গঙ্গাজল ছেটান। এদিকে ছেলে চক্কোত্তির দিক থেকে চটাস চটাস আওয়াজ আসা শুরু হয়, এবং সে আওয়াজ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। ভোলা বিষম খেপে দাবড়ানি দেয় বটে, কিন্তু মশা তো তাকেও নেহাত কম কামড়াচ্ছে না। মিনিট কয়েক পরে অধৈর্য হয়ে সে নিজেই জিজ্ঞেস করে, "অ ঠাকুরমশাই, আর কতক্ষণ? দক্ষিণা যা চান নেবেন, একটু শটকাটে সারুন না।"
দক্ষিণার কথায় ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্রপাঠ দ্রুত হয়। এতটাই দ্রুত, যে ভোলা চিন্তিত হয়ে আবার ডাক পাড়ে, "ঠাকুরমশাই, একটু আস্তে করে। কাজ যেন ঠিক হয়। ভূত টূত অপশক্তি টক্তি সব যাবে তো এতে?"
চক্রবর্তীদ্বয় থমকে যান, ও খাবি খান। বাবা চক্কোত্তি অনুযোগের সুরে বলেন, "ভূত কী বলছেন বাবু? এরকম তো কথা ছিল না!" বলে ভয়ানক রকম মুখ চোখ পাকিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে আবার মন্ত্রপাঠ শুরু করেন। গঙ্গাজল ছিটে পড়তে থাকে ফোয়ারার মত। মাঝেমাঝে ভোলা পেছন থেকে মনে করিয়ে দেয়, "কাজ যেন ঠিকঠাক হয় ঠাকুরমশাই!"
ঝাড়া চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে স্বরে চক্কোত্তি বলেন, "ওঃ, আর পারছি না, ভারি দুর্বল লাগছে। বাবা হারু, ও আর এস এর বোতলটা একটু দে তো বাবা, গলাটা ভিজিয়ে নিই একটু।" ভোলা মশার কামড়ে ফুলে ঢোল, তার ভারি মাথা গরম হয়। যত্তসব পেটরোগা লোকজন জুটেছে!
ঢকঢক করে অনেকখানি ও আর এস গলায় ঢেলেই থু থু করে ফেলে দেন চক্কোত্তি। চোখ কপালে তুলে বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকেন তো তাকিয়েই থাকেন। তিতিবিরক্ত ভোলা শুধোয়, "অ ঠাকুরমশাই, আবার কী হল? ফিটের ব্যামো আছে নাকি আপনার?"
চক্কোত্তি হু হু করে ডুকরে ওঠেন। বলেন, "ব্যাটা অলপ্পেয়ে হারু!! এটা গঙ্গাজলের বোতল রে! গঙ্গাজল খেলাম আমি!"
আচ্ছা ন্যাকামি তো! রাগ উঠে যায় ভোলার। খিঁচিয়ে বলে, "হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকাছে, দু' ঢোঁক গঙ্গাজল খেয়েছেন ভাল হয়েছে, অন্তরাত্মা শুদ্ধ হয়ে গেছে। শুরু করুন!"
চক্কোত্তি হাত পা ছুঁড়ে বলেন, "করব তো। আবার শুরু থেকেই তো শুরু করতে হবে! এতক্ষণ গঙ্গাজল বলে তো ও আর এস ছেটালাম! তাই বলি, হাত চ্যাটচ্যাট করে কেন!"
তারপর ভারি একটা হুলুস্থুলু শুরু হয়ে গেল। ভোলা চটি খুলে হারুকে রে রে করে তেড়ে গেল। হারু হাত ফসকে বেরিয়ে গেল, হাতে পড়ল ফটিক চক্কোত্তি, ফাঁকতালে দু'ঘা তার পিঠেই পড়ল। বাবা চক্কোত্তি হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন, ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে অনেক শাপশাপান্ত করে বলতে লাগলেন, "কী ব্যাপারটা কী, অ্যাঁ? তখন থেকে ফটিককে হ্যাটা করছেন, আপনার হারুই তো সবটা ঝোলালো এবার? এবার কী হবে, অ্যাঁ?" তালেগোলে হরিবোলে ও আর এস আর গঙ্গাজল - দু'খানা বোতলই ছিটকে পড়ে ফেটে জল টল বেরিয়ে গিয়ে একাক্কার কান্ড হল। সেদিকে তাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে চক্কোত্তি বললেন, "নাও, হয়ে গেল!"
"তা' গেল। এবার ঘরের ছেলেরা মানে মানে ঘরে ফিরে যাও তো দেখি বাছারা।" আচমকা ভেসে আসা বামাকন্ঠের উৎস ওপর দিকে কেন বুঝতে পারেন না চক্কোত্তি। তাও ওপরে তাকান। আর ভোলা যা দেখেছিল তাই দেখেন। বদলের মধ্যে চুড়ো খোঁপা এলো হয়ে ঠাকরুনের রূপ আরো খোলতাই হয়েছে। হাতে কোত্থেকে একখান মুড়ো ঝ্যাঁটা উদয় হয়েছে, সেটাকে তিনি সপাসপ চাবুকের মত আছড়াচ্ছেন।
হারু পত্রপাঠ ঝোপঝাড় ভেঙ্গে পি টি ঊষার মত বাঁই বাঁই দৌড় লাগাল। ফটিক কোনো ঝামেলায় না গিয়ে ফিট হয়ে গেল। ভোলার মাজায় ব্যথা, বুক ধড়ফড় করছে, দৌড়তে গেলে হার্ট অ্যাটাক নিশ্চিত। অতএব ফিট হয়ে যাওয়াই নিরাপদ মনে করে পড়ে যেতে যেতে সে শুনল ঠাকুরমশাই কঁকিয়ে উঠলেন, "মা গো, জোর কামড় মেরেছে পেটে! ঠিক হয়ে গেছিল গো, ঐ গঙ্গাজলটা খেয়ে আবার - "....
৭
জ্ঞান ফেরার পরে চার পাশে একবার তাকিয়ে ভোলার আবার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। গাছের মগডালে বসে পায়ের তলায় নিকষ কালো অন্ধকার দেখতে পেলে মাথা ঘোরারই কথা। কিন্তু টপ করে খসে পড়ার আগেই খপ করে তার নড়া ধরে তাকে সিধে করে বসিয়ে দেন ঠাকরুন। পা দোলাতে দোলাতে বলেন, " চুরিচামারি করে যার পেট চলে, তার কি কথায় কথায় ভিরমি খাওয়া মানায় বাপধন?"
ভোলার আঁতে এতটাই ঘা লাগে, যে সে ভূতের ভয় জয় করে চিড়বিড়িয়ে ওঠে। "চুরি মানে?? আমি হলুম সাত পুরুষের জাত স্যাকরা! জানেন আমার বাবা কে, আমার ঠাকুদ্দা কে!"
মার্কামারা আকর্ণবিস্তৃত হাসিটি হেসে ঘাড় হেলান ভূতঠাকরুন। বলেন, "জানি বাপ, সব জানি। তা' রাতের আঁধারে ঝোপেঝাড়ে বনেবাদাড়ে গয়না গড়ে বেড়াচ্ছিলে বুঝি খোকা?"
ভোলার মুখে কথা জোগায় না। নিভাননী আবার প্রশ্ন করেন, "তা' বাপের কথা তুললে যখন, কেমন আছে শিবে? পরিবারের সুনাম ডুবিয়ে কী করে বেড়াচ্ছ সে জানে?"
ছেলের কাজের ধরনধারণ শিবনাথের পছন্দ ছিল না একেবারেই, অতএব ব্যবসা ভোলার নামে হওয়ামাত্তর সে বাপকে কাশীর বাড়িতে চালান করে দিয়েছে। সে কথা তো আর ভূতকে বলা যায় না। অগত্যা ভোলা বলে, "বাবা কাশীবাসী হয়েছেন। বিষয়আশয়ে মতি নেই আর। আপনি বাবার নাম জানলেন কী করে?"
ভারি আমোদ পেয়ে খ্যাক খ্যাক হেসে উঠলেন নিভা। বললেন, "বাপু রে, আমার জন্ম এই ভিটেতে রে। এ গ্রাম আমি হাতের তেলোর মত চিনতাম। শিবেকে কোলেপিঠে করেছি আমি, বুঝলি। শিবের ছেলে হয়ে তুই এমন কুলাঙ্গার হলি?"
গাছের ডালে বসে মশার কামড় খেতে খেতে ভূতের সঙ্গে খেজুরে গল্প করা কার পোষায়? ভোলা ঘ্যানঘ্যান করে, "বারবার বাপ-ঠাকুদ্দা তুলছেন কেন? নামিয়ে দিন না, বাড়ি যাব। আর করব না।"
দুষ্টুমিষ্টি হেসে ভোলার কানটি ধরে নেড়ে দেন নিভাননী। বলেন, "যাবে, যাবে। একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। আসুক সে। ততক্ষণ আমার কাছে বসে একটা গল্প শোনো।"
গল্প শোনার কোনো ইচ্ছেই দেখায় না ভোলা, শুধু উসখুস করে। কাঁহাতক ধৈর্য থাকে মানুষের, থুড়ি ভূতের! ভোলার পিঠে এক রাম টোকা দেন নিভাননী। পপাত হওয়ার আগেই হাত বাড়িয়ে ধরেও ফেলেন যদিও। হিসহিস করে বলেন, "গুরুজনের কথা মান্যি করতে কী হয় রে ছোঁড়া? জানিস আমি গ্রাম সম্পর্কে তোর ঠাকমা হই? অ্যাঁ?"
ঠাকুরমার গল্পের ঝুলি খোলা হয় অতএব। উদাসী গলায় নিভাননী বলতে শুরু করেন, "বাঁড়ুজ্যেরা জমিদারের দেওয়ান ছিল জানিস তো।" জমিদারির কথা শুনে ভোলা নড়েচড়ে বসে।
ঠাকমা বলতে থাকেন, "তা' পরের দিকে সে রমরমা আর ছিল না। চৌধুরীদের ও অবস্থা পড়ল, সঙ্গে আমাদেরও। চাকরিবাকরি করে উপায় করার তো অভ্যেস ছিল না, আরামে আয়েসে থেকে থেকে স্বভাব নষ্ট হয়েছিল। আমার দাদারা ভাইয়েরা কেউ তেমন উপার্জন করতে পারেনি, পূর্বপুরুষের সঞ্চয় ভেঙে ফুটুনি করেছে। তা' যাকগে যাক, গল্পটা শোন। তা' হয়েছে কী, দুর্গাদাস চৌধুরীর মেয়ের বিয়ে। টাকাপয়সার অভাব, কিন্তু জাঁকজমক দেখে কে বলবে সে কথা! গোটা গ্রাম নিমন্ত্রিত, বুঝলি! অনেক রাত্তিরে বিয়ের লগ্ন ছিল। লোকজন খেয়েদেয়ে চলে গেছে যখন, তার অনেক পরে ডাকাত পড়ল। মোনা ডাকাত, মোহন সর্দার - নাম শুনিসনি? তার নামে গ্রামকে গ্রাম কাঁপত। তা' তারা সব চেঁছেপুঁছে নিয়ে যায় যায় অবস্থা, চার দিকে কান্নার রোল পড়ে গেছে, এরকম একটা গোলমালের মধ্যে আমি টুক করে অন্দরমহলে সেঁধিয়ে গেছিলুম। আমি তখন দশ বছরের খুকী, আমার দিকে কেউ তাকায়ইনি। মোনা তখন কাজ সেরে মাংসভাত খেতে বসেছে দলবল নিয়ে। আমিষ হেঁশেল থেকে আঁশবঁটিটা এনে যখন গলায় ধরলুম, খাওয়াদাওয়া মাথায় উঠে গেল!"
খিলখিল করে খুব হাসেন নিভাননী। শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করে মহা আনন্দিত তিনি। ভোলার তেমন আনন্দ হয় না। বঁটি টটি তার মোটে ভাল লাগে না। গুপ্তধনের কথাও কিছু উঠল না ছাই।
নিভাননী বলেন, "সর্দারের গলায় কোপ পড়ার ভয়ে ডাকাতরা তো সব ফেরত দিয়ে নাকেখত দিয়ে চলে গেল বুঝলি। আর দুর্গাদাস চৌধুরী আনন্দে কী করবেন ভেবে না পেয়ে নিজের মেয়ের বিয়ের গয়নার সমমূল্যের মোহর উপহার দিলেন আমায়। বুঝলি?"
ভোলার চোখ চকচক করে ওঠে। ফ্যাঁসফেঁসিয়ে বলে, "বাঁড়ুজ্যেবাড়ির গুপ্তধন!!"
খ্যাঁক করে ওঠেন নিভাননী। বলেন, "আ মোলো যা! বাড়ির গুপ্তধন কেন হতে যাবে র্যা? আমার স্ত্রীধন! আমার উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসের জোরে পাওয়া ধন! মনে করিস না সে সব আমি উজাড় করে দিয়ে দেব! নেহাত গোমুখ্যুগুলোর হাতে পড়ে বসতবাটিটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঐ একটা করেই পাবে বাবা, ওর চেয়ে বেশি আশা কোরো না।"
ভোলা মাথা চুলকে বলে, "আপনার নিজের বংশধরদের দিলেন না?"
মুখ বাঁকান নিভাননী। "ওরা করেকম্মে খেতে জানে। আমার বিয়ে হয়েছিল মোনা সর্দারের বোনের ঘরে। সর্দার নিজে সম্বন্ধ এনেছিলেন জানিস! আমার মত ডাকাবুকো মেয়ে নাকি জন্মে দেখেননি!"
ভোলার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায়। গল্পের গুণে, না ঠাকমার পেছনে এসে দাঁড়ানো অবয়বটির দিকে চেয়ে, তা' বলা যায় না। ভোলার দৃষ্টি অনুসরণ করে ফিরে তাকান নিভাননী। একগাল হেসে বলেন, "এসেছিস তারক? এই নে, নাতিকে বাড়ি নিয়ে যা। বড্ড বখে গেছে, একটু শাসনে রাখিস। একটা অভিভাবক না হলে চলে, বল!"
স্বর্গত ঠাকুরদার কানমলা খেতে খেতে ভোলা বাড়ির পথ ধরে। গুপ্তধনের আশ তার মিটেছে। আখেরের লাভে জুটল অশরীরীর গার্জেনগিরি। মনে মনে কপাল চাপড়ায় ভোলা।
আড়মোড়া ভেঙে গাছ থেকে নামেন নিভাননী। ভোর হয়ে এল বলে। আঁচলের গিঁট খুলে সেদিনের বরাদ্দ মোহরখানা বের করে নিয়ে বাঁড়ুজ্যেবাড়ির ভাঙা দরজার দিকে এগিয়ে যান তিনি।

