un known

Horror Drama

2  

un known

Horror Drama

পিলুর বন্ধু

পিলুর বন্ধু

5 mins
721



পিলুর বন্ধু


১)


মূলত জেলেপ্রধান গ্রাম কালীদহ। নিম্নবিত্ত, গরীব মানুষের সংখ্যাই বেশি। গ্রামের মধ্যেই আট দশটা পুকুর। এই কালীদহ গ্রামকে বেড় দিয়ে ঘিরে রেখেছে চওড়া খালটা।

নয় নয় করেও দুবছর পোস্টিং হয়ে গেল সুবিনয় ডাক্তারের। স্ত্রী মালা আর একমাত্র ছেলে পাঁচবছরের পিলুকে নিয়ে প্রথম যখন এখানে পা রেখেছিল, একবারেই ভালো লাগেনি। কারই বা ভাল লাগে! শহুরে জাঁকজমক আর লোভনীয় প্র্যাকটিসের হাতছানির মায়া কাটিয়ে, কেই বা আসতে চায় এই অজ পাড়াগাঁয়ে! তারপর কেমন করে যেন সবুজে ঘেরা ছবির মতো সুন্দর গ্রামটাকে আস্তে আস্তে নিজের অজান্তেই ভালবেসে ফেলল সুবিনয়। 

রোগীর যে খুব চাপ এখানে, এমনটা নয়। আসলে কালীদহ গাঁয়ের মানুষগুলো যেন অদ্ভুত ধাতুতে গড়া। যেন ওদের রক্তমাংসের শরীর না, অন্য কিছু দিয়ে গড়া। শরীর খারাপের বিলাসিতা করে ঘরে বসে থাকলে অন্ন জুটবে না যে!

ঘা, ফুসকুড়ি, দাদ হাজা'র রুগী অবশ্য দুচারটে রোজই আসে। জলের মানুষদের অমন একটু আধটু হয়েই থাকে। তেমনই একজন সনাতনবুড়ো। ফি দিন হাজিরা দেবেই। শেষে এমন হল, কিছু না হলেও সনাতনবুড়ো এসে বসে থাকে মেঝেতে। তার বক্তব্য,

--ডাক্তারবাবু, আপনে হলেন মাণ্যিগণ্যি মানুষ। দুটো কতা কইলেও অনেক পূণ্যি হয়!


শুনে হেসে ফেলে সুবিনয়। সনাতন মানুষটাকে তার মন্দ লাগে না। 

কাজকর্মে আর গল্পে গল্পে দিনগুলো বেশ পেরিয়ে যায়।


একদিন কথায় কথায় সনাতন এক অদ্ভুত কথা বলে বসল। ওই খাল নাকি অভিশপ্ত। তেনাদের দীর্ঘনিশ্বাস খালের আকাশে বাতাসে পাক দিয়ে ঘোরে। তাই নাকি কেও ও খালে নামে না। ভরা বর্ষায় খালের জলে মাছেদের ঝাঁক থেকে থেকে খলবলিয়ে ওঠে। সনাতনদের অভিজ্ঞ চোখ টের পায় তা। তবু ভয়ে খালপাড় মাড়ায় না কেউ। অশরীরী কোন এক অস্তিত্ব যেন হিমশীতল ছোঁয়া দিয়ে যায় ঘাড়ের ওপর। 


শুনে হা হা করে হেসে উঠেছিল সুবিনয়। হাত তুলে থামিয়ে দিয়েছিল সনাতনকে,

--না গো সনাতন কাকা। ওসব কিছু নয়, ও তোমাদের মনের ভুল। 


--বিশ্বেস করলে না তো ডাকতারবাবু! তবে বলি শোন। বেশ কয়েক বছর আগে এই গেরামেই থাকতো হারাণ, বৌ আর ফুটফুটে পাঁচবছরের ছেলেটাকে নিয়ে l দিব্যি আনন্দে ছিল। খালে মাছ ধরত আমাদের সাথে। সুখ না থাকলি হবে কি, বড় শান্তিতে ছিল গো ওরা। বাচ্চাটা বড় ভালোবাসতো জন্তুজানোয়ার। কুকুর, বিড়াল পাখি তো কোন ছার ডাকতারবাবু, ওর বাপ হারাণ মাছ ধরি বাড়ি ফিরলে মরা মাছ দেকে হাঁউহাঁউ করে সেকি কান্না! তা বাপু ভগমানের সইলে না।


সুবিনয় নির্বাক হয়ে শুনছিল। একটু নড়েচড়ে বসে বলল,

--কেন? কি হল তারপর?


গামছার খুঁটে চোখদুটো মুছে নিয়ে সনাতন বলল,


--গরমেতে খালে জল কম থাকে গো বাবু। বর্শা মেরে মাছ ধরার ভারী সুবিধা। তা এক দুক্কুরবেলা হারাণ আর ওর বৌ ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে খালে নেমেছিল। কে আর জানতো ও ছেলেও ঘুম ভেঙে হারানদের পিছুপিছু খালের জলে নেমে পড়েছে! লোকজন সেদিন কম ছিল। কারও নজরে পড়েনি। চোরা কাদায় পড়ে ওটুকু ছোঁড়া আর কতক্ষণই বা লড়তে পারে বলো? শেষমেষ কটা বুড়বুড়ি কেটে তলিয়ে গেল!!


--তারপর?


--এখেনেই শেষ নয় গো বাবু। নিঠুর ভগমানের এতেও মন ভরল না! হারানের চোখ পড়ল বুড়বুড়িতে! ভাবল বুঝি বড়সড় কোনো মাছ। হাতের বর্শা চাইলে দিল সোজা বুড়বুড়ি মদ্দি দিয়ে। এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল ছোট্ট শরীলটা।


সুবিনয় ডাক্তার শিউরে উঠল। কোনরকমে চেয়ারের হাতল আঁকড়ে বলল,

--বলছ কি!


-হ্যাঁ গো ডাকতারবাবু! পরদিন হারাণ আর ওর বৌয়ের শরীলদুটোও পড়ে ছিল খালপাড়ে। বোধহয় বিষ খেয়ে মরেছিল গো। শোক সইতে পারেনি ছেলেটার! তাপ্পর থেকেই একেনে ওরা বাপ মা ব্যাটাতে ঘুরে বেড়ায় অষ্টপোহর! আমরাও আর ঘাঁটাইনে!


২)


বদলির চিঠি এসেছে। মালা আর পিলু ভারী খুশি তাই শুনে। সুবিনয় খুশি হলেও কোথাও যেন একটা চোরা চিনচিনে ব্যথা টের পাচ্ছে বুকটায়! কালীদহকে ছেড়ে, সনাতনকাকাকে ছেড়ে, এখানকার সহজ সরল মানুষগুলোর এতোদিনের নিবিড় সান্নিধ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্টটা যেন বড় বেশি জানান দিচ্ছে। চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসেছিল সুবিনয়। মালা এসে বলল,


--এতোদিন এখানে থাকলাম। গ্রামটাই তো ভাল করে দেখা হল না। চলো না কাল, একটু ঘুরে দেখি। আর কোনদিন হয়ত আসা হবে না!


সুবিনয় রাজি হল।


পরেরদিন মালা আর পিলুকে নিয়ে ঘোরাঘুরি সেরে খালপাড়ে এসে দাঁড়াল সুবিনয়। এখন ভরা বর্ষার খাল। ছোট ছোট ঘূর্নি তৈরি করে খালের ঘোলাজল যেন নাচতে নাচতে ছুটে যাচ্ছে। যেমন অপূর্ব তার রূপমাধুর্য্য, তেমনই ভয়ঙ্কর! সুবিনয় বিভোর হয়ে দেখছিল! হঠাৎ হারানের বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে গেল সুবিনয়ের। কেমন যেন বিষন্ন হয়ে গেল মনটা।

তবে হারাণ আর ওর পরিবারের অশরীরী অস্তিত্বের কথা মোটেও বিশ্বাস করেনি সে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে সনাতনবুড়োর মত মানুষের মনে এটুকু কুসংস্কার থাকা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।

মালাও দৃশ্যত নির্বাক হয়ে খালের জলের অপরূপ শোভা দেখতে ব্যাস্ত। আর কোনদিকে মন নেই!


এমন সময় কিছু দূরের খাড়া পাড় থেকে ঝুপ করে একটা শব্দ কানে এল সুবিনয়ের। কিছু না ভেবেই আনমনে সেদিকে তাকাল। চকিতে খেয়াল পড়ে গেল, পিলু কই!! এই তো ছিল এখানেই! হাত ছাড়িয়ে ছুটে যেতে দেখেছিল সুবিনয়। হ্যাঁ, ঠিক ওই খাড়া পাড়ের দিকেই!


অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। পিলুর কাহিল হয়ে পড়া ছোট্ট শরীরটা তখন পাড় থেকে সরে গিয়ে খালের প্রায় মাঝবরাবর হাবুডুবু খাচ্ছে! ছোট্ট ছোট্ট হাতদুটো কোনররকমে জলের ওপর তুলে পিলু প্রাণপণ চেষ্টা করছে ভেসে থাকার। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। 

আস্তে আস্তে নিস্তেজ শরীরটা ক্রমশ আরো দূরে সরে যেতে থাকলো। মালা আর্তনাদ করে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে! উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করে উঠল সুবিনয়।

গ্রামবাসীরাও ততক্ষণে ছুটে এসেছে। দু একজন প্রাণের মায়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। কিন্তু তীব্র স্রোতের টানে এগোতে পারল না বেশিদুর। পিলুর দেহটা অদৃশ্য হয়ে গেছে ততক্ষণে!


আর কিছুই করার নেই! মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল সুবিনয়।

হঠাৎ একটা শোরগোল উঠল ভীড়ের মধ্যে। অনেক দূর থেকে অস্পষ্ট কিছু একটা ভেসে আসছে। বেশ কিছুটা কাছে আসতেই ছিটকে উঠে দাঁড়াল সুবিনয়। ওই তো, ওই তো! লাল জামাটা তো পিলুরই! কেও যেন সযত্নে পিলুর শরীরটাকে ধরে ভাসিয়ে রেখেছে! ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে আসছে পাড়ের দিকে!


ধরাধরি করে পিলুকে পাড়ে তুলে শুইয়ে দেওয়া হল। পেটে একটু জল ঢুকে যাওয়া ছাড়া এমন কিছু ক্ষতি হয়নি! কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে বসল সে। সবাই হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে পড়ল। 

মালা পাগলের মত ছুটে এসে পিলুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল,

--সোনা আমার, কি কষ্ট হচ্ছে আমায় বল! বল আমায়!


--কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না মা। আমি তো ডুবে যাচ্ছিলাম। তখনি ওই বন্ধুটা হাসতে হাসতে এসে আমায় ধরল। বলল, 'ভয় পেও না, আমি তোমায় পাড়ে পৌঁছে দেব।' 

কিন্তু মা, ওকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? কোথায় গেল ও? একবার ডাকো না।


পিলুর কথা শুনে সনাতনবুড়ো ভীড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে এসে বলল,

--ও নাতি, তোমার বন্ধু অনেক দূরে থাকে। ওই ওখেনে। আর আসবে না যে!


বলে আকাশের দিকে আঙুল দেখাল।


গাড়ি ছুটে চলেছে তীব্রবেগে। সনাতনবুড়ো এগিয়ে দিতে এসেছিল বড় রাস্তা অবধি। এখন আর দেখা যাচ্ছে না তাকে। দেখা যাচ্ছে না পোড়া চোখদুটোর জলটুকু হাতের চেটো দিয়ে মুছে নিতে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে কালীদহ গ্রাম, তাকে ঘিরে থাকা কালীদহ খাল।


সুবিনয় স্টিয়ারিং ধরে আছে। মালা তার পাশে। দুজনেরই মন ভালো নেই। উদাস দৃষ্টি!


পেছনের সিটে পিলু বসে ক্রমাগত হাত নেড়ে চলেছে অদৃশ্য কারও উদ্দেশ্যে।


প্রত্যুত্তর ভেসে আসছে বাতাসে,,

--আবার এসো বন্ধু!


         ------------সমাপ্ত------------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror