পিকলু, টুকাই এবং ফেসবুক
পিকলু, টুকাই এবং ফেসবুক


১
পিকলু-টুকাইয়ের মা সঙ্গীতা ভারী রাশভারি একজন মানুষ। ছেলেপুলেকে চিৎকার চেঁচামেচি করে বকাঝকা মারধর করা উনি একদম পছন্দ করেননা। অন্যায় প্রশ্রয় আর অতি আদরের আদিখ্যেতা দেখানোও ওনার নাপসন্দ। শাসন, আদর যাই হোক, ওঁর পদ্ধতি এক্কেবারে ইউনিক। এই যেমন একটু আগে বোর্ড পরীক্ষার্থী বড়ছেলের স্বাস্থ্যের প্রতি অযত্ন, আলস্য, ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা, জিনিস হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি ইত্যাদি ইস্যুতে অত্যন্ত আপসেট হয়ে একটি ফাইভ-পয়েন্ট উপদেশাবলি তৈরি করে, সেটাকে খাবার ঘরের সাপ্তাহিক মেনু লিখে রাখার বিশাল বোর্ডে আটকে দিয়ে, একটা উবের ডেকে, গম্ভীর মুখে খটমট করে কলেজ চলে গেলেন। সাড়ে চার ফুটের টুকাই ডিং মেরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে লিস্টিটা পড়ে। পড়ার পর তার মনে ঠিক কিরূপ চিন্তা ভাবনার উদ্রেক হয় সেটা ব্র্যাকেটের মধ্যেকার অংশটা পড়লে জানা যাবে।
**১
স্বাস্থ্যই সম্পদ। এর সঠিক যত্ন না নিলে এ একদিন তোমার ওপর প্রতিশোধ নেবেই নেবে আর জীবন তখন অন্ধকার হয়ে যাবে। (ও বাবা! সেদিন যে ছুটির পর প্রত্যয়ের সাথে শেয়ার করে পাঁচখানা ফুচকা খেয়েছিলাম মা কি সেটা কোনভাবে জেনে ফেলেছে?)
**২
A penny saved is a penny earned. অতএব টাকাপয়সা সবসময় হিসেব করে গুছিয়ে রাখ। নো অপচয়, নো অভাব। (সে আর বলতে! পকেট মানি খরচ না করে করে এক হাজার চারশ সাঁইত্রিশ টাকা জমিয়ে ফেলেছি। হুঁ হুঁ বাবা, মাসের শেষে দাদা আমার কাছে ধার করলে, কড়ায় গন্ডায় পাওনা বুঝে নিই।)
**৩
স্টিফেন কিং একটুও বাড়িয়ে বলেননি -- বই সত্যি সত্যিই একটা বহনযোগ্য ম্যাজিক। বইকে অবসরের সাথী করে নাও। তবে কখনোই পাঠ্যবই কে অবহেলা করে নয়।(দাদা যে সেদিন সায়ন্তনী দিদির কাছ থেকে One of us is lying বইটা এনে ফিজিক্স বইয়ের তলায় লুকিয়ে পড়ছিল মা সেটা নির্ঘাত দেখে ফেলেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় মার মাথার পেছনে সত্যিই দুটো চোখ আছে।)
**৪
ওয়র্ল্ড হেল্থ অরগ্যানাইজেশন সম্প্রতি কম্পিউটার গেমসের প্রতি আসক্তিকে একটি মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসে, মাঠে নেমে একটু গা ঘামাও -- শরীর মন দুটোকেই রিচার্জ করে নাও। (মাকে একসময় কায়দা করে জানিয়ে দিতে হবে যে বাবা কালকেই ল্যাপটপে Battlefield 4 ডাউনলোড করেছে।)
**৫
দায়িত্ব নিতে শেখ। সংসারের ছোটখাট কোন কাজ বেছে নাও এবং দায়িত্ব সহকারে, কোন সাহায্য বা নির্দেশ ছাড়াই সেটা কমপ্লিট করতে চেষ্টা কর। যেমন, নিজের সুবিধা মতো দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বেছে নিয়ে সেই সময়টা তোমাদের গ্ৰ্যান্ডপ্যারেন্টসদের সাথে বাধ্যতামূলকভাবে কাটাতে পার, তাঁদের খোঁজখবর নিতে পার। দিনগত ব্যস্ততার দরুন মাঝেমাঝেই আমরা হয়তো নিয়ম করে এই কাজটা করে উঠতে পারিনা -- সেই গ্যাপটা তোমরা পূরণ করার চেষ্টা কর। ওঁরা ভীষণ নিঃসঙ্গ।( নিঃসঙ্গ? তার মানে তো লোনলি। লোনলি মানুষরা খুব দুঃখী হয় আমি জানি। সুপ্রিয়া ম্যাম এই সেদিনই ওঁর পাড়ার এক ঠাম্মির গল্প করছিলেন ক্লাশে। বুড়িমানুষটা একটা পেল্লায় বাড়িতে থাকেন। ভীষণ দুঃখ নাকি ওনার। বিদেশে নাকি এমন লোনলি মানুষের ছড়াছড়ি। তাঁরাও কারো না কারো ঠাম-দাদাই। কিন্তু কেউ থাকে না ওঁদের কাছে। বড় দুঃখ ওনাদের জীবনে। কিন্তু আমাদের ঠাম্মি-দাদুন নিঃসঙ্গ হতে যাবে কোন দুঃখে? এ বাড়িতে ঠাম্মির কাছেই তো থাকি আমরা। আর দাদুন নিজের বাড়িতে একা থাকে বটে, কিন্তু মাতো দুয়েকদিন ছাড়া ছাড়াই দাদুনের কাছে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসে। মায়ের যদিওবা কাজের চাপে কখনও কখনও দাদুনের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনা, আমরাতো যাই প্রত্যেক উইকেন্ডে। তা সত্ত্বেও নিঃসঙ্গতা? মা যখন বলছে, নিশ্চয়ই তাই। ধুৎ ভাল লাগেনা। এটা নিয়ে দাদার সাথে আলোচনা করতে হবে। )
২
মায়ের পাঁচ নম্বর উপদেশটা বড্ড হন্ট করতে থাকে টুকাইকে। নিঃসঙ্গ শব্দটা ভুলতে পারেনা ও। এত লোক চারধারে থাকতেও তার প্রিয় দুটো মানুষ কেন যে একা বুঝে উঠতে পারেনা দশ বছরের ছেলেটা, কিন্তু তার সেন্সিটিভ মনটা বড্ড কেমন কেমন করে।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরেই স্ট্রেট সে যায় তার ঠাম্মির কাছে।
-- আচ্ছা ঠাম্মি, তুমি কি মাঝে মাঝে খুব লোনলি ফিল কর?"
টুকাইয়ের সিরিয়াস মুখের প্রশ্ন শুনে অনুরাধা খুব একচোট হাসেন। প্রিয় নাতিটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, " বুড়োরা একটু নিঃসঙ্গ হয়ই-- ও নিয়ে ভাবার কিছু নেই। আমি বেশ আছি। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্নটাই তোমার মনে জাগল কেন বলতো দাদুভাই?"
" মা বললতো। বলল আমায় আর দাদাকে তোমার আর দাদুনের সাথে প্রতিদিন নিয়ম করে সময় কাটাতে -- মা আর বাবাতো প্রতিদিন সময় পায়না।"
-- তোমাদের মাতো মস্ত শিক্ষিত, প্রোফেসর মানুষ -- তোমাদের সুশিক্ষে দেওয়ার জন্যই একথা বলেছে, বুঝলে? নয়তো আমি কি জানিনা, তোমরাও কম ব্যস্ত নও? বড়ো দাদুভাই তো সকাল বিকেল গাদগাদা টিউশন আর ফিটজি মিটজি ঐসব করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে আর তোমার ছুটির দিনগুলো তো আঁকার স্কুল, ক্যারাটে ক্লাশ এসব করেই কেটে যায়। মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে তোমাদের মুখগুলো আমায় দেখিয়ে যেও -- আমি তাতেই খুব খুশি থাকব, বুঝলে? এখন যাও -- বাইরে গিয়ে একটু সাইকেল চালিয়ে এস গিয়ে।
অনুরাধা কৌটো থেকে বার করে নাতির হাতে একটা নাড়ু গুঁজে দেন -- বেশি দেননা। সঙ্গীতা যখনতখন ছেলেপুলেকে এটা ওটা খেতে দেওয়া একদম পছন্দ করেন না। মিষ্টিটা পেয়ে টুকাই খুব খুশি। হেলতে দুলতে চলেছে হৃষ্টচিত্তে। বয়সের তুলনায় একটু ছোট খাটো, রোগাসোগা, আদরের ছোট নাতিটির যাওয়ার দিকে অনুরাধা মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকেন।
৩
শনিবার শনিবার টুকাই ক্যারাটে ক্লাশ থেকে ড্রাইভার সুধন্যকাকুর সাথে দাদুনবাড়ি যায়। পিকলুও টিউশন সেরে সোজা চলে আসে সেখানে। কিন্তু সেই শনিবার অবধি অপেক্ষা করার তর সয়না টুকাইয়ের। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর, মাবাবা যখন লিভিং রুমে বসে দুজনে গল্প করতে করতে টিভি দেখছে, টুকাই ফোন লাগায় তার দাদুকে।
-- দাদুন, মা বলেছে তুমি নাকি খুব নিঃসঙ্গ। আমার না সেটা শুনে থেকে বড্ড মনখারাপ করছে। কান্নাকান্না পাচ্ছে। লোনলি মানুষরা ডিপ্রেশনে ভোগে। আমি জানি। স্কুলে ম্যাম বলেছে।
সঙ্গীতার বাবা, রিটায়ার্ড গেজেটেড অফিসার সুপ্রিয়বাবু মুহূর্তের জন্য একটু থতমত খান। নাতির গলার স্বরে তার ছলোছলো চোখটা স্পষ্ট দেখতে পান যেন। কিন্তু স্বভাবগত প্রত্যুতপন্নমতিত্ব দিয়ে পুরো ব্যাপারটা চটপট নিজের কন্ট্রোলে নিয়ে নেন।
-- হাহাহাহাহা। আমি! লোনলি! ডিপ্রেসড! রিয়েলি!তোমার মাকে বোল, তার থেকে অনেক বড় ফ্রেন্ড সার্কল আছে আমার -- সকালবেলায় মর্নিং ওয়াকের বন্ধু, মাসে একবার করে পেনশন আ্যশোসিয়েশনের বন্ধু, এখন আবার প্রণামের বন্ধু -- এদের নিয়েই তো হইহই করে দিন কাটাই -- নিঃসঙ্গতা-টতা, ডিপ্রেশন ফিপ্রেশন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আছে নাকি আমার? গলায় যথাসম্ভব তাচ্ছিল্য ঢেলে নাতিকে প্রবোধ দেন শিশু- মনস্তত্ত্ব গুলে খাওয়া প্রবীণ মানুষটি।
-- আসলে কি জান? তোমার মাতো বড় হয়ে উঠেছে যৌথ পরিবারে। সে দেখেছে বৃদ্ধ বয়সে, তার দিদিমা ঠাকুমা আর দুই দাদুকে ঘিরে থাকত একঝাঁক মানুষ। এখন যখন আমরা সেই বয়সে পৌঁচেছি, জীবনযাত্রার এই কনট্রাস্টটা দেখে সে হয়তো দুঃখ পায়। কিন্তু তুমি জেনে রেখ দাদুভাই -- আমি একজন অত্যন্ত হ্যাপিম্যান। তোমার ঠাম্মিও। তোমাদের মত হিরের টুকরো নাতি যাদের রয়েছে তারা হ্যাপি না হয়ে যায় কোথায়? এসব নিয়ে চিন্তা না করে এবার পুজোয় কটা জামা নেবে আমার কাছ থেকে সেটা ভাবতে ভাবতে লক্ষী ছেলের মত ঘুমিয়ে পড় দেখি।
ক্লাশ ফোরে পড়া বালকের মন ভাল করে দিতে অবসরপ্রাপ্ত দুঁদে আমলাটির একমিনিটের চেয়ে জাস্ট কয়েকসেকেন্ড বেশি সময় লাগে। অতঃপর দাদুনাতি পরস্পরকে শুভরাত্রি আর প্রচুর মিষ্টি স্বপ্নের আশ্বাস জানিয়ে দূরভাষের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
৪
পড়াশোনা সেরে নিজের শুতে শুতে অনেক রাত। তবে স্ট্রিক্ট ডিসিপ্লিনারিয়ান সঙ্গীতা টুকাইকে রাত দশটা বাজলেই শুতে পাঠিয়ে দেন এবং ঘন্টাখানেক পরে এসে একবার সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা সার্ভে করে যান। সেইসময়টায় অনেক দিনই টুকাই জেগে থাকে কিন্তু মাকে বুঝতে দেয়না। আজ যখন সঙ্গীতা ঘরে এসে পাখাটা কমিয়ে, গায়ের চাপাটা একটু টেনে দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, টুকাই হাত বাড়িয়ে মায়ের হাতটা চেপে ধরল। সঙ্গীতা আশ্চর্য হয়ে তাকান ছেলের দিকে।
-- ঘুমোওনি এখনো? ঠিক আছ?
-- মা, ঠাম্মি-দাদুন কেউ লোনলি নয়। দাদুন বলেছে দাদুন নাকি ভীষণ হ্যাপি আর ঠাম্মিও তাই।
টুকাই হড়বড় করে কি বলে ওঠে সেটা মাথায় ঢুকতে সঙ্গীতার অল্প একটু সময় লাগে। বুঝে ওঠার পর নরম গলায় ছেলেকে বলে, তুমি ওঁদের একথা জিজ্ঞাসা করলে বুঝি?
-- হ্যাঁ মা। তুমি কি তার জন্য রাগ করলে?
-- না, একটুও না। কিন্তু কি জান? তোমার ঠাম্মি আর দাদুন দুজনেই খুব স্ট্রং মানুষতো -- ওঁরা ওঁদের কোন দুঃখকষ্টের কথা আমাদের জানাবেনই না পাছে আমরা কষ্ট পাই। সবসময় ভাবেন ওঁদের কারণে আমাদের কাজকর্মের যেন কোন ক্ষতি না হয়ে যায়। আর তাই সবসময় নিজেদের, কষ্ট, চিন্তা এমনকি ছোটখাট অসুখবিসুখও আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখতে চান। তাই ওঁরা মুখে যাই বলুন, তোমাদেরই প্রোআ্যক্টিভ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
-- আচ্ছা মা, আমরা সবাই এত ভালবাসতেও, এত খেয়াল রাখতেও ঠাম্মি দাদুন একলা ফিল করে কেন?
-- সেটা এখনই পুরোপুরি বুঝতে পারবেনা। শুধু এটুকু জেনে রাখ, বয়সের সাথে সাথে মানুষ অনেক কিছুই হারাতে থাকে -- স্বাস্থ্য, কর্মক্ষমতা, চিন্তার ক্ল্যারিটি। এব্যাপারগুলো যদিও তোমার ঠাম্মি-দাদুনের ক্ষেত্রে এখনো আ্যপ্লিকেবল নয়, ওঁরা হারিয়েছেন আরও দামি জিনিস -- অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছেন ওঁরা। প্রথমত ঠাম্মি তোমার দাদাইকে আর দাদুন তোমার দিদুনকে হারিয়েছেন। স্বামী বা স্ত্রী হওয়া ছাড়াও সবার আগে ওঁরা ছিলেন পরস্পরের খুব ভাল বন্ধু। ওঁদের আ্যবসেন্সটা যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে সেটা আমরা হাজার চেষ্টা করেও ভরতে পারবকি? তার ওপর দুজনেই তাঁদের ভাইবোনেদের এক এক করে হারিয়েছেন। দাদুনের দুই দাদা, এক দিদি পরপর চলে গেছেন। একমাত্র ভাই, আমার কাকা অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন; আজ কুড়ি বছরের ওপর হয়ে গেল ওনার সাথে আমাদের কারোর কোন যোগাযোগ নেই। আর ঠাম্মির একমাত্র ছোটবোন -- ঠাম্মি নিজের হাতে তাঁকে বড় করেছিলেন -- ক্যান্সারে ভুগে ভুগে বড় কষ্ট পেয়ে চলে গেলেন কিছু বছর আগে। এসব কারণেই মনের দিক থেকে দুজনেই একটু একা -- তোমাদের সঙ্গ ওঁদের ঐ গোপন ব্যথার জায়গাগুলোতে একটু হলেও প্রলেপ দেবে।
সঙ্গীতা আপনমনে কথা বলে যাচ্ছিলেন। চোখ ফিরিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখেন ছেলের দু'গাল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। সঙ্গীতার একটু কষ্ট হয় -- কিন্তু মনে মনে ভাবেন জীবনের রিয়েলিটিগুলোর সাথে পরিচয়ও তো করাতে হবে আর সেটা করতে হবে তাঁকেই।
-- মা, কিকরে ঠাম্মি-দাদুনকে আরও একটু খুশি রাখতে পারি বলনা মা।
স্নেহের অভিব্যক্তি দেখান সঙ্গীতার অভ্যাস নয়। তাই এই সেন্সিটিভ বাচ্চাটার জন্য ওর গর্ব আর মায়ায় মনটা ভরে উঠলেও, বুকে চেপে ধরে আদর করতে ইচ্ছে হলেও নিজেকে কন্ট্রোল করেন। মুখে বলেন, ভাব ভাব। আমাদের মাথার ভেতরে সবকিছুর উত্তর থাকে। ভাল করে খুঁজলেই উত্তর একটা না একটা পেয়েই যাবে।
টুকাই মায়ের হাতটা ধরেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে যেতে স্বপ্ন দেখে তার ঠাম্মি আর দাদুন কিশোরবেলায় ফিরে গেছে। আরও কত সমবয়সী ছেলে মেয়ে। সবাই হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে ঘুরছে। ঠাম্মি দাদুন ভীষণ হাসছে। অন্যরাও।। সবাই ভীষণ এনজয় করছে। সবাই ছোটবেলায় ফিরে গেছে।
৫
ছেলেদের আজ স্কুল ছুটি। সঙ্গীতা আর সুপ্রতীক যথাক্রমে কলেজ আর অফিস বেরবেন। তাড়াতাড়ি করে ব্রেকফাস্ট সারছেন দুজনে। এমনসময় দুই মূর্তির উদয়।
-- মা, বাবা তোমাদের সাথে একটু কথা ছিল।
সঙ্গীতা মুখ তুলে তাকান।
-- আমাদের একটা খুব দরকারি জিনিস কেনার জন্য ১২০০০ টাকা মত লাগবে।
সুপ্রতীক টোস্টে কামড় দিতে যাচ্ছিলেন; টোস্ট ধরা হাতটা মুখের ইঞ্চি দুই আগে এসে থেমে রইল।
সঙ্গীতা ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন।
-- আমরা ২০০০ টাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। বাবা আমায় যে নতুন একটা মোবাইল কিনে দেবে বলেছিলে, সেটার বদলে আমায় ক্যাশ দেবে? নতুন ফোন আমার চাইনা -- পুরোনোটা দিয়েই চালিয়ে নেব আরও বছর দুয়েক।
-- আমার পুজোয় নতুন জামা চাইনা। তার বদলে আমায়ও ক্যাশ দিয়ে দিও। টুকাই দাদার প্রতিধ্বনি করে।
সঙ্গীতার কপালের মাঝখানের খাঁজ আরও গভীর হয়।
-- কি ব্যাপার বলতো? এত টাকার হঠাৎ কি প্রয়োজন পড়ল তোমাদের? সুপ্রতীক একটু রূঢ় হন।
১৭ বছরের পিকলু ভাঙা গলায় যতটা সম্ভব গাম্ভীর্য এনে বলে, সেটা এখনই ডিসক্লোজ করা যাবেনা। তবে তোমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। টাকাটা আমরা ভাল কাজেই খরচ করব।
সুপ্রতীক শুরু করেন, ভাল বলতে ঠিক কি....
সঙ্গীতা হাতের নির্দেশে থামিয়ে দেন স্বামীকে। বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন সে বিশ্বাস আমার আছে। টাকা পেয়ে যাবে। তবে কাজটা যেন এমন হয় যা নিয়ে তোমরা গর্ব করতে পার। আমাদের তরফ থেকে শুভেচ্ছা রইল।
দুইভাই হাইফাইভ করে প্রস্থান করে। তার ঠিক চারদিনের মাথায় বাড়িতে আ্যমাজোন থেকে দুটো মাঝারি মাপের বাক্স এসে পৌঁছায়। সঙ্গীতা ও সুপ্রতীকের সামনেই ছেলেরা বাক্স খোলে। ভেতর থেকে বেরয় দুটো স্মার্টফোন -- সাধারণ, এন্ট্রি লেভেল মডেল।
ঠাম্মি আর দাদুনের জন্য -- সঙ্গীতা ও সুপ্রতীকের কৌতূহল নিরসন করতে টুকাই জানায়।
-- আচ্ছা! তা ঠাম্মির জন্য এনেছ ভাল করেছ, দাদুনেরতো অলরেডি স্মার্টফোন আছে।
-- সেটাকেতো দাদুন নর্মাল ফোন হিসাবে ব্যবহার করে। এই নতুন ফোনটায় আমরা দুজনের ছোটবেলাটা ঠেসে পুরে দেব, পিকলু গম্ভীরভাবে জানায়।
সঙ্গীতা-সুপ্রতীক কিছুই মাথামুন্ডু বুঝতে পারেনা। কিন্তু ছেলেদের উৎসাহ ওদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। অপেক্ষা করতে থাকে নেক্সট কি হয় তা দেখার জন্য।
পরের দিনটা দুই ভাই খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটায়। দাদুনকে জোর করে ধরে নিয়ে আসে ওদের বাড়িতে দিনকয়েক থেকে যাওয়ার জন্য। দিনের বিভিন্ন সময় দেখা যায় চারটে মাথা এক হয়ে কি যেন করছে। সুপ্রতীক কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে টুকাইকে জিগ্গেস করেই ফেলল, হ্যাঁ রে তোরা সবাই কিনিয়েএত ব্যস্ত রে?
--ট্রেনিং চলছে ট্রেনিং। রেজাল্ট দুয়েকদিনের মধ্যেই দেখতে পাবে।
সত্যিই দুদিনের মাথায় রেজাল্ট দেখতে পেল টুকাই পিকলু র মা-বাবা। ব্রেকফাস্টের সময় সুপ্রতীক ফেসবুক চেক করতে গিয়ে দেখেন নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট --- একটা এসেছে জনৈকা অনুরাধা মজুমদারের কাছ থেকে আর অন্যটার প্রেরক নান আদার দ্যান মিস্টার সুপ্রিয় সেন।
আরিব্বাস! সঙ্গীতা শিগ্ণির একবার তোমার ফেসবুক খুলে দেখ -- কোন দুই নতুন চরিত্র এইমাত্র জুকুর দুনিয়ায় এন্ট্রি নিল রঙ্গমঞ্চ মাতিয়ে দিতে!
সঙ্গীতার ডানভুরুটা একটু ওপরে ওঠে; নাটুকেপনা উনি একদম পছন্দ করেননা। ওদিকে ঠাম্মির মুখে লাজুক হাসি। ফেসবুক চেক করে সঙ্গীতার মুখেও অবশ্য হাসি ফুটে ওঠে। রিকোয়েস্ট আ্যকসেপ্ট করেন। অতঃপর ভারচুয়াল দুনিয়ায় গোটা পরিবার একত্রিত হয়।
পরে সঙ্গীতা ছেলেদের ঘরে আসেন।
একথা সেকথার পর সরাসরি বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, সো? তোমাদের ভালো কাজটা কি এটাই ছিল? ঠাম্মি আর দাদুনকে ফেসবুক জয়েন করানো?
-- আ্যকচুয়ালি আমরা ফেসবুকের মাধ্যমে দাদুন আর ঠাম্মিকে ওদের ছোটবেলার কিছুটা অংশ ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি মা। যাঁরা অলরেডি ঠাম্মি-দাদুনের জীবন থেকে চলে গেছেন তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা তো আর কোনমতেই পসিবল নয়, কিন্তু আরও অনেকেই তো এখনও আছেন, যাঁরা ঠাম্মি আর দাদুনের বেড়ে ওঠার সঙ্গী ছিলেন। এই বয়সে নতুন করে পুরনো বন্ধুকে খুঁজে পেলে ওঁদের কত আনন্দ হবে বলতো মা? আর সেই আনন্দটা হয়তো ওঁদের মনের কষ্ট কিছুটা হলেও কম করতে পারবে। আর এই কাজটা সোশ্যাল মিডিয়ার থেকেও ভালোভাবে আর কেই বা করতে পারবে বল?
-- তোমরা এইভাবে ভাবতে পারলে? সঙ্গীতা অভিভূত।
-- ডিপ্রেশন কাটানর জন্য চাইল্ডহুড থেরাপিটা অবশ্য টুকাইয়ের আইডিয়া যেটা কিনা ও স্বপ্নে পেয়েছে। ফেসবুকের মাধ্যমে ইমপ্লিমেনটেশনের প্ল্যানটা অবশ্য আমার। সদ্য গজানো কচিকচি দাড়িগোঁফ ভেদ করে লাজুক হাসে পিকলু।
সঙ্গীতা তাঁর অংকের অধ্যাপিকা-সুলভ ইমেজের কথা ভুলে গিয়ে দুই হাতে দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। চোখের জল কোনমতে চেপে রেখেছেন। এত থটফুল, এত ম্যাচিয়োরড?
ক্লাশ ইলেভেনে পড়া পিকলু এঁকে বেঁকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, কিযে করনা মা?
ছোট্ট টুকাই মাকে আরো জোরে, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
মায়ের কানে কানে বলে, এবার ঠাম্মি দাদুনের আর মনখারাপ হবেনা -- তুমি খুশিতো?
-- খুব খুব, ফিসফিসিয়ে জবাব দেয় সঙ্গীতা।
উপসংহার
সুপ্রতীক ঠিকই বলেছিলেন -- দুই বেয়াই বেয়ান মিলে ফেসবুক একেবারে মাতিয়ে দিয়েছেন। দুজনেই বেশ তাড়াতাড়ি সোশ্যাল মিডিয়া স্যাভি হয়ে উঠেছেন। ঠাম্মি তাঁর ছাব্বিশজন বেথুন স্কুলের বন্ধুকে খুঁজে খুঁজে বার করেছেন। দাদুনের লিস্টেতো বন্ধুর সংখ্যা অলরেডি ছশো ছাড়িয়ে গেছে। মেট্রোপলিটন স্কুলের আর যাদবপুর ইউনিভার্সিটির যে বন্ধুদের সাথে বহুদিন কোন যোগাযোগ ছিলনা, তাদের সাথে ফেসবুকের পাতায় আবার জমে উঠেছে আড্ডা। সম্প্রতি দাদুন ছোট্টবেলায় ছেড়ে আসা জলপাইগুড়ি শহরের হারিয়ে যাওয়া একজন বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে যারপরনাই' উল্লসিত। আর ঠাম্মিতো একটা গ্ৰুপে তাঁর ছেলেবেলায় দেখা কলকাতার কথা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে রীতিমত সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছেন। কে জানতো ঠাম্মির এমন চমৎকার লেখার হাত! সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে ঠাম্মির এই প্রতিভার কথা হয়তো অজানাই থেকে যেত সারাজীবন। দাদুন আপাতত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যদি ফেসবুক খুঁড়ে খুঁড়ে তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের সন্ধান বের করা যায়।
টেকনোলজি জিন্দাবাদ!