ফুল আর অলি
ফুল আর অলি
নাট মন্দিরের সংস্কার শুরু হয়েছে মাস দুই আগে থেকে। এখন তা শেষ পর্যায়ে রং করা চলছে মিস্ত্রিদের কাজ তদারক করছেন জমিদার বাড়ির ছোট তরফের সেজ ছেলের জামাই বৃন্দাবন। বাড়ির ভাঙ্গা সিংহদরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ওদিকে একবার নজর বুলিয়েই ভেতরে চলে গেলো মন্দার। মন্দিরের দরজার ওপারে মা দুর্গা তার পরিবার নিয়ে অপেক্ষায় আছেন মৃণ্ময়ী রূপ থেকে চিন্ময়ী রূপে প্রকট হওয়ার জন্য। আজ সন্ধ্যেতেই কুলপুরোহিত তাঁকে বেলতলায় বরণ করবেন। সবাই এসে পড়ছে আর দুদিনের মধ্যেই বাকিরাও এসে পড়বেন।
বহুদিন বাড়ির বাইরে ওর পরিবার। ঠাকুরদাই চাকরি নিয়ে বাংলার বাইরে চলে গিয়েছিলেন। তার পালা শেষ হলে ওর বাবাও সেই ধারাই বজায় রেখেছেন। বরাবর বাইরে বাইরে চাকরি তাও আবার বদলির। বাড়ির সঙ্গে তাই যোগাযোগ ক্ষীণ, ওই কালেভদ্রে দুর্গা পুজাতে বা দীপাবলিতে কখনও-সখনও আসা। ছোটবেলায় দু একবার এলেও তারপর আর আসেনি এ বাড়িতে মন্দার, বড় হওয়ার পর এই প্রথমবার এলো। তার অবশ্য একটা কারণও আছে। বহু বছরের মন্দির লাগোয়া নাট মন্দিরটা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার দশায় দাঁড়িয়ে। বাড়ির বড় তরফের বড় নাতির হঠাৎ মনে খেয়াল উদয় হয়েছে প্রপিতামহের তৈরি এই বাড়ি মন্দির বাঁচিয়ে রাখা উচিত। কিন্তু মাথায় খেয়াল চাপলেই তো হলো না তার জন্য টাকা চাই এবং বেশ যথেষ্ট পরিমাণে। তাছাড়া বাড়ির যখন এতোগুলো ভাগিদার রয়েছে তখন ও একাই বা সব খরচা করবে কেন? তাই সবাইকেই ফোন করেছিলো প্রতাপ। সবাই টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে এবং এবার কথা দিয়েছে পুজোতেও আসবে। ছোট তরফের ওই বৃন্দাবনই গিয়েছিলো টাকাটা নিতে তাই মন্দার চেনে ওকে।
মন্দার সেই কথামতো এসে পড়েছে পঞ্চমীর দুপুরে। বাবা নেই তাই মাও আসার সেরকম আগ্রহ দেখায়নি। মন্দাররা দু ভাই এক বোন। ওদেরকেও আসতে অনুরোধ করেছিলো ও কিন্তু ওরাও মায়ের মতোই আগ্রহ দেখায়নি। শ্রীময়ী তো বলেই দিলো,
"বাবাহ! কলকাতার পুজো ছেড়ে কে যাবে ওই অজ পাড়াগ্রামের পুজোয়, তোরও খেয়েদেয়ে আর কাজ ছিল না যে হ্যাঁ বলে দিলি?’'
মন্দার কোন উত্তর দেয় না। ওদের বোঝানো যাবে না এক অন্যরকম স্বাদ ওই গ্রামের আবহাওয়ায়, এক অন্যরকম অনুভূতি যা প্রায় হারিয়ে গেছে শহরের বুক থেকে। ছোট তরফের বড় ছেলে ছিল ওর ঠাকুরদা তো হিসেব মতো বৃন্দাবন ওর পিসেমশাই হবেন। নাকি অন্যকিছু? হাল ছেড়ে দেয় ও। এই আত্মীয়তার গোলকধাঁধায় ও ঢুকতে চায় না। দরকারই বা কি দুদিন পর চলেই তো যাবে।
এই বাড়িতে বাবার এক বিধবা পিসি ওর থাকার আর এবেলার খাবারের বন্দোবস্ত করেছেন। ষষ্ঠী থেকে তো পুজো উপলক্ষ্যে সারা পরিবারের একত্রে খাওয়া দশমী পর্যন্ত। তখন রান্নার ঠাকুরের হাতে সব। বাড়ির বাথরুমেই স্নান সেরে মন্দার দাঁড়িয়ে ছিলো দোতলা ঘরের জানলায় হঠাৎ চোখে পড়লো নীচের বাগানে এক কন্যার উপস্থিতি। মেয়ে তো নয় যেন পরী উড়ে উড়ে এ ফুলগাছ থেকে ও গাছে যাচ্ছে আর যা তুলছে তা স্থান পাচ্ছে বাঁ হাতের ঝুড়িতে। ওর মনে হলো একবার যদি ও ওপর দিকে তাকাতো! আর কি আশ্চর্য পরী মুখ তুলে তাকালও আর চোখাচোখি হয়ে গেলো। কি সুন্দর! চোখদুটি চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। খানিক পরে যখন ঠাকুমা ডাকলেন খেতে তখন মন্দারের খেয়াল হলো পরী কখন ফাঁকি দিয়ে উড়ে গেছে আর ও বোকার মতো বাগানের দিকেই তাকিয়ে আছে। ও সাড়া দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলো ঠাকুমার রান্নাঘরে। ঠাকুমা ওকে দেখতে পেয়ে বললেন,
'‘ও তুই এসে পড়েছিস, হাত ধুয়ে বসে পড়।'’
বলে মাটিতে পাতা আসনের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আসন দেখেই ওর খুব আনন্দ হল, বহুদিন পর মাটিতে বসে খাবে ও। বাড়িতে তো এসবের চল নেই তার ওপর মায়ের হাঁটু ব্যাথা। তাই টেবিল চেয়ারই ভরসা। ঠাকুমা সামনে নামিয়ে দিলেন ভাত, ঘি, মুগ ডাল, বেগুন ভাজা, পটলের তরকারি, ওলের ডালনা আর চাটনি। মন্দার খাওয়া শুরু করেই বুঝল ঠাকুমার রান্নার হাত চমৎকার। ও চুপচাপ খেয়ে চলেছে দেখে ঠাকুমা বললেন,
'‘তোর খুব অসুবিধে হচ্ছে বুঝতে পারছি নিরামিষ খেতে। এবেলা এই দিয়ে খেয়ে নে ওবেলা মানসীকে বলবো তোর জন্য একটু মাছ পাঠিয়ে দিতে।'’
খেতে খেতেই মন্দার অনিচ্ছা প্রকাশ করলো,
'‘না না কাউকে বলতে হবে না। তুমি যা রান্না করবে তাই খাবো। বাড়িতে তো সবসময় আমিষই হয় এখানে তোমার হাতে নিরামিষ খেতে দারুণ লাগছে।’‘
"ওই দেখ ছেলের কাণ্ড! তাই কি হয় সোনা? তুমি আমার আদরের নাতি আর এতদিন পর এলে আর তোমাকে একটু ভালোমন্দ খাওয়াবো না তাই কি হয়!'’
মন্দার বুঝলো ঠাকুমাকে কোনভাবেই নিরস্ত করা যাবে না। বুড়ির নিস্তরঙ্গ জীবনে ওর ক্ষণিকের উপস্থিতি এক আলাদা আনন্দ এনে দিয়েছে। ও বলল,
'‘তোমার যা ভালো লাগে করো, আমি আর কিছু বলবো না।’'
খাওয়ার পর শোয়ার অভ্যেস নেই ওর তাই ঠাকুমাকে বলে নীচতলায় নেমে এলো ও। ছোটবেলার যেটুকু স্মৃতি ওর মনের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে তার মধ্যে আছে এই বাড়ির দক্ষিণদিকে থাকা এক বিশাল পুকুর। ওর গন্তব্য এখন সেখানে। উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে একবার ওপরের দিকে তাকালো। বিশাল বাড়ি তৈরি হয়েছে এই বড় উঠোনকে মাঝে রেখে। উঠোন পেরিয়ে বার মহল পেরিয়ে বাইরের উঠোনে পা রেখে মন্দার তাকালো নাট মন্দিরের দিকে। কাজ সমাপ্ত হয়েছে মিস্ত্রিদের দেখা যাচ্ছে না যার মানে তারা পাওনাগণ্ডা পেয়ে গিয়েছে। নাটমন্দির থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর আগেই ওর চোখে পড়লো কেউ মন্দিরের সামনে বসে কিছু করছে। একটু মন দিয়ে দেখার পর বুঝতে পারলো সেই মানুষটি, সকালের দেখা সেই পরী। এত কাছে দেখতে পেয়ে ও নিজেকে আটকাতে পারলো না, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো তার কার্যকলাপ দেখতে। মেয়েটি আপনমনে আলপনা এঁকে চলেছে। কি সুন্দর লতাপাতায় ভরে উঠছে মন্দিরের মেঝে।
‘'বাহ! কি সুন্দর আঁকো তুমি!'’
চমকে উঠে মন্দারের দিকে তাকালো। সে তারপর বললো, '‘ধন্যবাদ।'’
‘'তুমি এ বাড়ির মানে কার মেয়ে?’'
‘'আমি এ বাড়ির নই।'’
‘'ও আচ্ছা। তাহলে?'’
‘'সে একটা পরিচয় আছে। পরে মনে হয় পেয়েও যাবেন।'’
‘'ঠিক আছে, পরেই জানবার অপেক্ষায় থাকলাম।'’ বলে মন্দার পেছন ঘোরে পুকুরের দিকে যাওয়ার জন্য।
মেয়েটাই বলে ওঠে,
'‘আপনি কোথাও যাচ্ছেন নাকি?’'
‘হ্যাঁ ওই পুকুর পাড় ধরে একটু ঘুরবো এই ইচ্ছা।"
‘'এ বাড়ির পুকুর কোথায় আছে আপনি জানেন?’'
‘'হ্যাঁ কেন জানবো না? আমি এ বাড়িতে এর আগেও এসেছি ছোটবেলায়।''
মেয়েটি বলল,
'‘যান ঘুরে আসুন, ভালোই লাগবে।"
মন্দার এগিয়ে গেলো পুকুরের দিকে। একটু এগিয়ে পুকুর পাড়ে ঘাটলায় বসলো ও। এখান থেকে গোটা পুকুরটাই দেখা যায়। এই পুকুরটায় বাড়ির কেউ স্নান করে না। বাড়ির পেছনের আমবাগানে যাওয়ার যে খিড়কি দরজা আছে তার পাশের পুকুরে করে। পুকুরটা আর তত বড় নেই যেমনটা দেখেছিলো খানিকটা বুজে গেছে খানিকটা পানায় ভর্তি। তবে সামনের দিকে শুধু পরিষ্কারই নয় পদ্মও ফুটেছে, কি সুন্দর যে লাগছে দেখতে! ছোটবেলায় এই পুকুরে দু একবার নেমেছে ঠাকুরদার সাথে, মায়ের বারণ সত্ত্বেও। আনমনে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল কে জানে হঠাৎ জলে ঝপাৎ আওয়াজে ওদিকে নজর গেলো। একজন পুরুষ নেমেছে পদ্ম তুলতে। মন্দার জিজ্ঞেস করলো,
'‘আপনি এখন ফুল তুলছেন?’‘
"আজ্ঞে দাদাবাবু আপুনি বলবেন না তুমি! কাল পুজো শুরু তো তাই দেখে রাখছি কাল ভোরে কটা তোলা যাবে তাছাড়া আমার মা জননী বললেন খানিক জিওল মাছ তুলে দিতে অতিথি এসছেন খাবেন।’'
মন্দার বুঝলো পিসিমা তুলতে বলেছেন।
'‘তুমি থাক কোথায়?'’
'‘আজ্ঞে দাদাবাবু ওই গেরামের শেষ দিকে কুমোর পাড়ার পাশে।'’
'‘ও।'’
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। ওদিকে পুরোহিতমশাই এলেন বেলতলায় মাকে বরণ করতে। মন্দার পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো ঘরের দিকে।
সন্ধ্যার চা খেতে আর গল্প করতে যখন ঠাকুমার রান্নাঘরে পা দিলো ও তখন দেখল সেই পরীও উপস্থিত। ঠাকুমার কাছে কোন দরকারে এসেছে। ওকে দেখিয়ে ঠাকুমা বললেন,
'‘একে চিনতে পারছিস মন্দার?’'
'‘হ্যাঁ মানে ওই আজ সকালে বাগানে দেখেছি একবার আর তারপর পুজো মণ্ডপে আরেকবার এই, নামটা অবশ্য জানি না এখনও!'’
'‘ও মানসী আমার মামাতো বোনের মেয়ে। নিশি মারা যাওয়ার পর থেকে ও আমাদের বাড়িতেই আছে।'’ মন্দার বুঝল সম্পর্কে মানসী ওর পিসি হবে।
রাতে ঠাকুমার ঘরে নয় মানসীর রান্নাঘরে ওকে খতে দেওয়া হল। মানসী ওর জন্য আমিষ রেঁধেছে যা ঠাকুমা বলেছিল। ওর হাতের রান্নার স্বাদও দারুণ। খেতে দিয়ে মানসী চুপ করে এক পাশে বসে ছিল। মন্দার বলল,
'‘তুমি....আপনি এখানে থেকেই পড়াশোনা করেন?’'
'‘বেশ তো তুমি দিয়ে কথা শুরু করেছিলেন আবার আপনি কেন?’'
'‘না মানে এখন তো জানি সম্পর্কের দিক দিয়ে আপনি আমার পিসি হবেন!'’
কথা শেষ হওয়ার আগেই রিনরিন শব্দে কি চুড়ি বেজে উঠলো? খাওয়া ছেড়ে মুখ তুলতেই মন্দার দেখল মানসী হাসছে।
'‘আমি বয়েসে ছোট আপনার থেকে আর আমাদের মধ্যে সেরকম কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। তাই আপনাকে অত মান্যতা দিতে হবে না।'’
'‘বেশ তাহলে দুজনেই তুমি বলে সম্বোধন করবো ... রাজি?'’
'‘আচ্ছা।’'
'‘এবার তাহলে আগের প্রশ্নের জবাব দাও।'’
'‘ওই স্কুল ফাইনাল পর্যন্তই পড়া হয়েছে। পরের বাড়িতে থেকে এর বেশি কিছু হয় না। এখন বাড়ির কাজ শিখছি পরের বাড়িতে দিলে যাতে নিন্দে না হয়।’'
মন্দার চুপ করে তাকিয়ে রইলো মানসীর করুণ মুখের দিকে।
পুজোর দিনগুলো আনন্দে হৈ চৈ এর মধ্যে পেরিয়ে গেলো। এর মধ্যে মানসীর সাথে দেখা হলেও সে ভাবে কথা হয়নি মন্দারের। চোখাচোখি হলে মন্দারের মনে হয়েছে ওই চোখ দুটো কি যেন বলতে চায়।
দশমীর বিকেলে ঠাকুর বিসর্জনের পর সবাই যখন বড়দের প্রণাম করছে সমবয়সীরা কোলাকুলি আর সেই সঙ্গে মিষ্টিমুখ! মন্দার এলো পিসিঠাকুমার ঘরে। ঠাকুমা নেই ঘরে মানসী জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরে দেখছে। ওর পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকালো।
'‘কাল সকালে তো চলে যাবো তাই এখন এসেছিলাম ঠাকুমার সাথে খানিক গল্প করতে। তা ঠাকুমা কোথায়?'’
'‘এই তো ছিল এখানেই ... কাল চলে যাচ্ছো। আর তো এখানে আসা হবে না নিশ্চয়... অবশ্য আসবেই বা কেন? তোমার চাকরি বাড়ি শহরের বন্ধুবান্ধব এসবের ভিড়ে গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবন কোন প্রভাব ফেলে না।'’
মন্দার অবাক হল মানসীর কথা শুনে। ওর উপস্থিতি কি ওর জীবনে কোন বিশেষ প্রভাব ফেলেছে? ও কি ভালবেসে ফেলেছে ওকে? একি সত্যি? ওর মুখে কোন কথা জোগাল না। মানসীর মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলো। ‘মানসী এই মানসী’ ডাকতে ডাকতে ঠাকুমা ঘরে এলেন।
''কি রে মন্দিরে গেলি না শান্তিজল নিতে?"
তারপরই মানসীকে ভালো করে খেয়াল করে বললেন,
'‘ও শান্তিজল তো চোখ থেকেই ঝরে পড়ছে।'’
মানসী দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। ঠাকুমা মন্দারের দিকে তাকিয়ে হাসল বললেন,
''কি রে চারদিনেই ওকে কাবু করে ফেলেছিস?'’
"কিন্তু ঠাকুমা আমি তো কিছুই ঠিক...’'
'‘সেকি রে! আমি ওর রকমসকম দেখে বুঝতে পারলাম আর তুই শহরের ছেলে হয়ে পারলি না?'’
মন্দারের চোখের সামনে মানসীর কান্না ভাসা চোখদুটো ভেসে উঠলো।
''কিন্তু ঠাকুমা ...’
'‘কোন কিন্তুর যায়গা নেই যদি তুইও ওকে পছন্দ করে থাকিস। শোন তোর মাকে বলিস সামনের কালীপূজোতে তোদের বাড়ি যাবো তোর মায়ের সাথে আমার কিছু কথা আছে।'’
মন্দার মাথা নেড়ে মুখ তুলতেই দেখতে পেলো দরজার আড়ালে মানসী চোখের জল মুছে হাসার চেষ্টা করছে! কি মিষ্টি যে লাগছে ওকে!