ফিরে পাওয়া
ফিরে পাওয়া
প্রযুক্তির আশীর্বাদে বিহু আজ তার ছোট্ট বেলাকার বান্ধবীকে ফিরে পেয়েছে। কোনদিনও বিহু কল্পনা করতে পারেনি সেই প্রিয় বান্ধবীর সাথে ওর আবার দেখা হবে। কিন্তু হঠাৎ করে কিছুমাস আগে ফেসবুক ঘাটতে ঘাটতে চোখের সামনে একটা নাম জ্বলজ্বল করে ওঠে বিহুর। বিহুর মন ক্যানভাসের পুরনো স্মৃতি গুলো আবার রঙিন হয়ে ওঠে। বিহুর ঠোঁটের কোনে এক চিলতে মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে।
বিহু তাড়াতাড়ি প্রোফাইলটা খুলে ফেলে, কিন্তু তাতে কোন ছবি দেওয়া নেই। বিহু প্রোফাইলের ডিটেল দেখতে থাকে এবং সেখানে দেখতে পায় ওয়েন্ট টু মায়াপুর, লিভ ইন বেলুড় । বিহু সাথে সাথে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে দেয়। আর বিহুর মনে হাজার হাজার প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে থাকে।
কিছুক্ষনের মধ্যে বিহুর ফোনে নোটিফিকেশন আসে। বিহু খুলে দেখে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট হয়েছে। শুরু হয়ে যায় ম্যাশেনঞ্জারে কথা বার্তা। তারপর ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া। অবশেষে আজ দেখা করার পালা। বিহু দক্ষিনেশ্বরের মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার হারিয়ে যাওয়া ছোট বেলাকার বান্ধবীর অপেক্ষায়। আর বিহুর মন ক্যানভাস তখন পুরনো স্মৃতি কে আবার সতেজ এবং তরতাজা করতে ব্যস্ত।
বিহুর বাবা সরকারি ব্যাঙ্কের ফিল্ড অফিসার ছিলেন। বিহুর জন্ম এবং ছোট বেলা মায়াপুরে কেটেছে। ছোট বেলায় বিহু খুব ভীতু ছিল একসাথে দু পাঁচজন লোক দেখলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগত। এমনকি বিহু যতক্ষন স্কুলে থাকত ততক্ষন ওর মাকে বাইরে অপেক্ষা করতে হত। এই বিহুর একমাত্র খেলার সঙ্গী ছিল পিউ। এই ঝগড়া, মারামারি আবার এই ভাব। বেশ মজা করেই কাটছিল দুই বান্ধবীর জীবন।
হঠাৎ করে বিহুর বাবার বদলি হয়ে গেল কোচবিহারে। বিহু তার বান্ধবী এবং পরিচিত জায়গা ছেড়ে যেতে চাইনি, বিহু খুব কেঁদে ছিল যাওয়ার আগে কিন্তু কিছু করার ছিলনা বিহুর। দুই প্রানের সখির বিচ্ছেদ ঘটে গিয়ে ছিল। তারপর থেকে শুরু হল বিহুর নতুন জীবন। নতুন স্কুল, নতুন জায়গা, নতুন বন্ধু, বান্ধবী। আস্তে আস্তে পিউ যেন স্মৃতির ভীড়ে চাপা পড়ে গেছিল। তারপর আর কোনদিনও মায়াপুরে ফিরে যাওয়া হয়নি বিহুর। পড়াশোনা শেষ হতে না হতেই চাকরি চেষ্টা, তারপর জীবনে বসন্তের ছোঁয়া লাগল। ধীরে ধীরে স্বামী, সন্তান এবং নিজের সংসার এবং চাকরি এই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বিহু।
তারপর সময়ের সাথে সাথে সব ব্যস্ততা যেন ধীরে ধীরে কমে গেল। এখন জীবনে শুধুই অবসর। তবে বিহুর এই দীর্ঘ বাষোট্টি বছরের জীবনে পিউ এর স্মৃতি মলিন হলেও মন ক্যানভাস থেকে মুছে যায় নি। আসলে তখন প্রযুক্তি এত উন্নত ছিলনা তাই বিহুর প্রিয় বন্ধুরা সময়ের গভীর অতলে হারিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু এখন প্রযুক্তির আর্শিবাদে সব কিছুই সম্ভব হচ্ছে, হারিয়ে ফেলা মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
হঠাৎ একটা গলার আওয়াজ পেয়ে বিহু পিছন ফিরে দেখে তার সামনে তার বয়সি একটা মহিলা সিঁথিতে সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে, পড়নে লাল পাড় সাদা শাড়ি, চোখে মুখে বয়সের ছাপ পড়লেও হাসিটা এখনও সেই আগের মত। এবং তার হাত ধরে একটা বছর সতেরোর ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বিহুর চোখের কোনটা হাল্কা ভিজে যায়। বিহু ধীর কন্ঠে বলে কেমন আছিস পিউ?
পিউ এর চোখও তখন ভেজা আসলে এই জল কষ্টের নয় আনন্দের। বহু বছর পর হারিয়ে যাওয়া মানুষ কে ফিরে পাওয়ার আনন্দের জল। পিউ বলে ওঠে আমি ভালো আছি তোর খবর বল। আর এই দেখ এ হলো বিট্টু আমার নাতি। কিছুতেই একা ছাড়বেনা আমাকে। বিট্টু সাথে সাথে বিহুর পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল।
বিহু বিট্টুর মাথায় হাত রেখে বলল জীবনে অনেক বড় হও, আমি ভালোই আছি, চলে যাচ্ছে নিজের মত করে দিনগুলো। আগের বছর স্বামী ঘুমের দেশে পাড়ি দিল, মেয়ে বিদেশে থাকে,আর আমি একা থাকি এইখানে। তবে তোর সাথে আমার দেখা হবে আবার সেটা কোনদিনও ভাবিনিরে।
পিউ বলল আরে এইসব আমার এই নাতির কাজ ঐ ফেসবুকে আমার অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। আমাদের সময় থেকেই যদি এইসব ব্যবস্থা থাকত তাহলে কোনদিনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতনা।
বহু বছর পর পুরনো দুই বান্ধবী আবার একসাথে হল প্রযুক্তির আর্শিবাদে। ভবতারিনীর পায়ে নিজেদের মন বাসনা নিবেদন করে, ওরা গিয়ে বসল গঙ্গার পাড়ে। গঙ্গার শান্ত শীতল জল এবং ঠান্ডা হাওয়ায় মন জুড়িয়ে যেতে লাগল। শুরু হল দুই বান্ধবীর পুরনো স্মৃতিচারণ যে স্মৃতির পাতায় পাতায় আনন্দ আর আনন্দ কোথায় কষ্টের কোন ছোঁয়া নেই। দূরে কোন মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে গুনগুন সুরে গান গেয়ে উঠল...........
"পোড়া মন পোড়ে না.... রে
ভাঙ্গা বাঁশি বাজে না.... রে
মনের কথা কই কারে......
মন্দ-ভালো ভবের মাঝারে....।"

