Saswati Roy

Romance

3  

Saswati Roy

Romance

ফেরা ( ভুল সংশোধন)

ফেরা ( ভুল সংশোধন)

21 mins
874


#এক


রবিবারটা এমনিতেই এই বাড়িতে একটু দেরিতে শুরু হয়। সারা সপ্তাহ দম দেওয়া পুতুলের মতো ছোটার পর বাবা, মা, মেয়ে তিনজনেই দশটা বাজিয়ে ঘুম থেকে ওঠে। এই রবিবারটা অবশ্য তার ব্যতিক্রম। আজ কাকভোরে শালিনীর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সাততলার কাঁচের জানালার মধ্যে দিয়ে শহরটাকে ধীরে ধীরে জাগতে দেখছিল শালিনী। অলস পায়ে হাঁটা পথচারীদের গতি ক্রমশ বাড়ছিল ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে। কাল সারাটা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কেটেছে শালিনীর। ভোরের দিকে যাও বা একটু ঘুম এসেছিল, চাপা উদ্বেগে তাও উবে গেল। রান্নাঘরে এসে চায়ের জল চাপালো শালিনী। বেশি দুধের চা খাওয়া বরাবরের অভ্যাস তার। ফ্রিজ থেকে দুধের বাটি বের করতে গিয়ে দেখলো, অল্পই দুধ আছে। ছুটির দিনে যদিও তিতলিকে ঠেলে ঠুলে না তুললে ওঠে না কিন্তু আজ যদি দুধওয়ালা আসার আগে উঠে পড়ে, তাহলে ওর কম পড়ে যাবে। থাক আজ নাহয় একটু বেলাতেই চা খাবে শালিনী। গ্যাস বন্ধ করে লিভিংরুমে এসেছে। তিতলির যত্নে কণামাত্র ত্রুটি হতে দিতে চায় না সে। কিন্তু আজকের পর তিতলির কি হবে? অঞ্জনের সাথে যদি সত্যিই তার সেপারেশন হয় তাহলে কি তিতলির কাস্টডি পাবে সে? কোর্টে যখন ব্যভিচারিনি হিসাবে তাকে দাঁড় করাবে অঞ্জন, তখন কোর্ট কি দুশ্চরিত্র মাকে মেয়ের দায়িত্ব দেবে? আর যদি বা তিতলি মাইনর বলে তিতলির কাস্টডি পেয়েও যায় শালিনী, তাহলে সন্দীপ আর তার সম্পর্কের কি হবে? সন্দীপ তিতলিকে খুবই ভালোবাসে কিন্তু অঞ্জনের মতো করে কি ভালোবাসতে পারবে? তাদের স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কে যতই ফাঁক থাকুক, তিতলির জন্য অঞ্জন যে প্রাণ দিতে পারে, সেটা সে অস্বীকার করে কি করে। ফোনটা ভাইব্রেট করছে। স্ক্রিনে চোখ রাখলো শালিনী। যা ভেবেছে তাই... সন্দীপ। ইদানিং যেন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে সন্দীপের এই পজেসিভনেস। ঘণ্টায় ঘন্টায় ফোন নাহয় মেসেজ। যাতে কোনভাবেই শালিনীর মাথায় অন্য কারো চিন্তা না আসতে পারে, তার জন্যই কি সন্দীপের এই প্রচেষ্টা? এই মুহুর্তে তিতলির জন্য চিন্তায় বুক পুড়ছিল শালিনীর। এখনই সন্দীপকে ফোন করতে হল! আজকাল শালিনী নিজেই নিজেকে বুঝতে পারে না। একটা সময় সে এই চার দেওয়ালে বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। বলতে গেলে সে জন্যই সন্দীপকে আঁকড়ে ধরা। তাহলে আজ এই দোটানা কিসের জন্য? শুধুই কি অপরাধবোধ নাকি গত দশ বছরে বিন্দু বিন্দু করে জমা হওয়া মায়া। যা সে নিজেও বোঝেনি। আজ কেন বারবার মনে হচ্ছে সব ভুল....। দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো শালিনী।


#দুই


-"আর কতদিন চলবে এরকম ভাবে?" -"আমি জানি না সন্দীপ। সত্যিই জানি না। তিতলির দিকে তাকালে আমি..." -"দ্যাখো যা করার তাড়াতাড়ি করো। আমি মাকে মোটামুটি আভাস দিয়েছি। বাবাকে মা ই রাজি করাবে। আর বাবা যদি রাজি নাও হয় তাহলে আমরা আলাদা থাকবো। " - "আমার বাড়িরও কি কেউ মেনে নেবে এই সম্পর্ক?" - "লুক শালু, মেনে যে কেউ নেবে না সেটা তো আমরা প্রথম থেকেই জানতাম। এটা তো নতুন কিছু নয়। এসব সম্পর্ক শুরুতে কেউই সহজভাবে মেনে নেয় না। পরে সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যায়।" - "তাহলে তুমিও মানছো যে আমরা ঠিক করছি না। আমরা কি পাপ করছি তাহলে?" - "আচ্ছা কি হয়েছে তোমার বলতো? রোজ রোজ একই ঘ্যান ঘ্যান কেন কর ? আজ যখন আমি বলছি বেরিয়ে আসতে তখন তোমার পাপ-পুণ্যের কথা মনে হচ্ছে। অথচ আমি যদি টালবাহানা করতাম তাহলে বলতে এটাই আমাদের পুরুষদের স্বভাব।" দিন তিনেক আগে সিসিডি তে বসে সন্দীপের সাথে কথা হয়েছিল শালিনীর। সেদিন অল্পতেই খুব রিয়াক্ট করছিল সন্দীপ। হয়তো ওর দিক থেকে ও ঠিকই ছিল। শালিনীর মনের অবস্থা বোঝা তো ওর পক্ষে সম্ভব না। আর সেটাই স্বাভাবিক। সন্দীপের কোনো পিছুটান নেই। খুব খামখেয়ালি আর স্বাধীনচেতা হওয়ায় বিয়ে নিয়ে এতদিন চিন্তাভাবনাও করেনি। সন্দীপ সিঙ্গল বলেই হয়তো শালিনীকে নিয়ে এত পজেসিভ। প্রথম প্রথম শালিনীও এই মনোযোগ খুব উপভোগ করত। এখন মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। আফশোসও হয়। এই যে প্রতিদিনের প্রবঞ্চনা, শঠতা এসবই তো ওই সম্পর্কটার জন্য। আয়নাতেও আজকাল নিজের মুখোমুখি হতে পারে না শালিনী। অঞ্জনের অফিসের পিকনিকেই সন্দীপের সাথে আলাপ হয়েছিল শালিনীর। অঞ্জনই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। পিকনিকে সবার অনুরোধে গান গেয়েছিল সন্দীপ। রবীন্দ্রসংগীত। সন্দীপের মার্জিত কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিল শালিনী। এরপর অঞ্জনের আমন্ত্রণে তিতলির জন্মদিনে আসে সন্দীপ। ফোন নম্বর আদান প্রদানের পর ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের গণ্ডি পেরিয়ে ধীরে ধীরে শালিনীর মনে কখন যে জায়গা করে নিয়েছিল সন্দীপ, শালিনী নিজেই বোঝেনি। সংসারের চাপে নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দেওয়া শালিনী আবার ঝর্নার মত হাসছিল। নিজেকে সাজাচ্ছিলো, ভালোবাসছিল। সন্দীপ স্মার্টনেস, সেন্স অফ হিউমার সব কিছুতেই অঞ্জনকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছিল। সর্বোপরি সন্দীপের ঝোড়ো ভালোবাসা শালিনীর সংযত জীবনকে তোলপাড় করে দিয়েছিল। তুলনায় অঞ্জন তো নেহাতই সাদামাটা। বৌয়ের কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলতেও তার অস্বস্তি। এসব লোকদেখানো ভালোবাসায় সে বিশ্বাসী নয়। যদিও গোপন ভালোবাসাতেও সে যে খুব পটু তা দশ বছরে একটি দিনের জন্যও শালিনীর মনে হয়নি। সে তুলনায় সন্দীপের ভালোবাসা তো স্বপ্নের মতো। সে ভালোবাসায় লক্ষ্যবার ডুব দিলেও তৃপ্তি হয়না। অঞ্জনের সাথে সন্দীপের তুলনাটা বারবার এসেই যাচ্ছিলো। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণগুলোর জন্যই কি একটা সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া যায় না ভেঙ্গে দেওয়া উচিত। গত আট মাসে এই প্রশ্নটা কয়েক হাজার বার নিজেকে করেছে সে, কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি তার মন। বিবেকের তাড়নায় শেষ অবধি স্কুল জীবনের বন্ধু পারমিতাকে সবটা জানিয়েছিল শালিনী। খুব হেসেছিল পারমিতা। শালিনীর অপ্রস্তুত লেগেছিল -"আমি হাসির মত কি বললাম রে?" -"হাসব না? এগুলো কোনো কারণ হতে পারে ডিভোর্সের?" - "কারণ নয় বলছিস?" - "হ্যাঁ বলছি। বর রোম্যান্টিক নয় বলে ডিভোর্স, এমন সত্যিই শুনিনি। অঞ্জনদা যদি ইম্পোটেন্ট হতো তাহলে অবশ্য ভেবে দেখা যেত। কিন্তু সে গুরেও বালি। তোদের বাচ্চা আছে। আর তাছাড়া এখনো তোদের কনজুগাল লাইফ মোটামুটি ভালই রান করছে। সোওওও... " পারমিতা চুপ করে গেছিলো ক্ষণিকের জন্য। -"সো হোয়াট?" - "সো, তুমি এভাবে ডিভোর্স পাবে না সখি। এক যদি অঞ্জনদা তোমার চরিত্র দেখে ডিভোর্স দেয় তাহলে অন্য কথা।" রাগে গা টা চিড়বিড় করে উঠেছিল শালিনীর। চরিত্র বলতে কি বোঝাতে চাইল পারমিতা। অঞ্জনকে সমর্থন করার আগে এটুকু তো বোঝা উচিৎ ছিল, যে শালিনী বিয়ের আগে কোনদিন কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি সে কেন হঠাৎ এই কাজ করলো। বন্ধু হয়ে যদি আরেক বন্ধুর মনটাই না পড়তে পারল তবে কিসের বন্ধুত্ব! পারমিতা কি বুঝবে কোনোদিন, তার চরিত্রবান অঞ্জনদা দিনের পর দিন তার বান্ধবীকে ইগনোর করেছে। শালিনীর চাওয়া পাওয়ার কোনো মূল্য দেয়নি। অঞ্জন নিতান্তই একটা কেজো লোক। সকালে উঠেই অফিসের জন্য দৌড় দৌড় দৌড়। রাতে বাড়ি ফিরে একপেট ভাত গিলে ভোঁসভোঁস ঘুম। যদি কোনদিন শরীর জাগল তো শালিনীকেও তার সাথে সাড়া দিতে হয়। সেখানেও তো তার শুধু নিজের রতিটুকু নিয়েই মাথাব্যথা। কবেই বা শালিনীর কথা ভেবেছে। খাওয়া, ঘুম, মলমূত্র ত্যাগের মতই এটাও অঞ্জনের কাছে একটা জৈবিক ক্রিয়া মাত্র। এটাই কি তবে কনজুগাল লাইফের সংজ্ঞা। ঘেন্না ঘেন্না, ঘেন্না ধরে গেছিলো শালিনীর। কত রাতে সাততলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভেবেছে একটু পা বাড়িয়ে দিলেই তো সব জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। পারেনি শুধু তিতলির মুখ চেয়ে। রীতিমত ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলো শালিনী। সারাদিন খিটখিট করতো। তিতলিকে মন দিয়ে পড়াতেও পারতো না। কথায় কথায় অঞ্জনের সাথে ঝগড়া করতো। বিষময় হয়ে উঠেছিল জীবন। ঠিক সেই সময় যদি সন্দীপ না আসত.....! কিন্তু এত কথা কি পারমিতাকে বলা যায়, নাকি বলা উচিৎ? চার দেওয়ালের মধ্যের কিছু কথা ওখানেই থেকে যাওয়া ভালো নয় কি? ওয়েটার দু প্লেট চিকেন কাটলেট রেখে গেছে। ধোঁয়া উঠছে কাটলেট থেকে। শালিনীর থমথমে মুখ দেখে পারমিতা হয়তো কিছু আন্দাজ করেছিল। শালিনীর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলেছিল - "দ্যাখ, এই যে তুই স্বামী, মেয়ে সব ছেড়ে দিবি বলছিস, যার জন্য ছাড়বি সেই যে ভবিষ্যতে তোকে এটা নিয়ে খোঁটা দেবে না তার গ্যারান্টি তুই দিতে পারিস? আর প্লিজ কিছু মনে করিস না এটা বলছি বলে। তুই যেটা অঞ্জনদার সাথে করছিস সেটা যদি ওই সন্দীপ তোর সাথে করে, সহ্য করতে পারবি?" এক নিমেষে মিইয়ে গেছিল শালিনী। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠেছিল তার। পারমিতার কথাকে সে খনার বচন ভাবে না ঠিকই কিন্তু ভবিষ্যতের কথা কেই বা বলতে পারে। এটা তো সে কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারে না যে একটা সাজানো গোছানো ভবিষ্যতকে ছুঁড়ে ফেলে সে পা রাখতে চলেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ঠিকানায়। অস্ফুটে বলে উঠেছিল - "তাহলে কি করতে বলিস আমাকে।" কাঁটা চামচে করে এক টুকরো কাটলেট সবে মুখে পুরেছিল পারমিতা। গরমটা সইয়ে সইয়ে খাবারটা গলাধঃকরণ করলো। এক ঢোক জল খেয়ে বললো - "তুই তো ইংলিশে এম.এ করেছিলি। চেষ্টা করে দ্যাখ না কোনো স্কুল টুলে। সেশনের মাঝে হয়তো নাও হতে পারে কিন্তু প্লে-স্কুল গুলোতে তো হামেশাই রিক্রুটমেন্ট হয়। আপাতত ওরকমই একটা স্কুলে জয়েন কর। দেখবি সারাদিন ওই বাচ্চাগুলোর সাথে হৈচৈ করে কেটে যাবে। তারপর বাড়িতে ফিরে তিতলি তো আছেই। সারাদিন এসব কাজ-কর্মের মধ্যে থাকলে দেখবি সন্দীপ-ফন্দীপ সঅঅঅব হাওয়া হয়ে গেছে দিমাগ থেকে।" পারমিতার কথাগুলো শালিনীর মস্তিষ্ক মেনে নিলেও মন অন্য কথা বলছিলো। মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো -" পারবো না রে সন্দীপকে ছেড়ে থাকতে।" - "কদিন চেষ্টা তো করে দ্যাখ। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তুই ওকে ভুলে যাবিই। কথা দে চেষ্টা করবি?" পারমিতার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল শালিনী। প্রিয় বান্ধবীকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে মন চায়নি। সন্দীপকে ছেড়ে থাকার কথা সে তখন ভাবতেও পারছিল না। আর সন্দীপও তো মনে প্রাণে তাকে পেতে চাইছিল। রোজ অশান্তি করছিল অঞ্জনকে নিয়ে। আদাজল খেয়ে সে নতুন চাকরির খোঁজ করছিল তখন। অঞ্জনের ছায়া অবধি সে পড়তে দিতে চায় না শালিনীর ওপর। কেন চায় না? তবে কি সন্দীপও টের পায়, অঞ্জন আর তিতলির সাথে এক সুতোয় বাঁধা আছে শালিনী! শিকড় ছিঁড়ে শালিনীকে দূরে নিয়ে গেলেই কি সে পারবে তাকে ভালো রাখতে? দশ বছরের অভ্যাসকে কি এত সহজেই হারিয়ে দিতে পারবে মাত্র আট মাসের ভালোবাসা? সত্যিই কি ভালোবাসা নাকি ভালো লাগা। নাকি শুধুই এই একঘেয়ে জীবন থেকে ক্ষণিকের মুক্তির আস্বাদ পাওয়া।



#তিন


দেওয়াল ঘড়ির পিকপিকে হুশ ফিরলো শালিনীর। নটা বাজে। ঘড়িটা বিয়েতে শালিনীর মাসতুতো দাদা গিফ্ট করেছিল। সুইস ঘড়ি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় একটা ছোট্ট পাখি তার খুপরি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বলে পিকপিক পিকপিক। পিকপিক বলে, নাকি স্মরণ করিয়ে দেয় আমি আছি, আমি আছি, আমায় ভুলে যেও না। অনেকটা যেন শালিনীরই মতো। অঞ্জনকেও তো এভাবেই ডেকে ডেকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হয় শালিনীকে। অন্নপূর্ণা আজ জলদি জলদি কাজে এসে পড়েছে। ঘটাং ঘটাং করে বাসন মেজেই, ঝাঁট দিতে শুরু করেছে গোটা বাড়ি। ফ্যান বন্ধ হওয়ায় তিতলি আর অঞ্জন দুজনেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। বাপ,মেয়ে দুজনের কেউই এক ফোটা গরম সহ্য করতে পারে না। তিতলি উঠেই শালিনীর কাছে চলে এসেছে। মা কে জড়িয়ে ধরে কোলে মুখ ঘষছে। এক মাথা কোঁকড়ানো চুল তিতলির। শালিনী হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো মেয়ের মাথায়, গায়ে। মেয়ের ছোঁয়ায় বুকটা চিনচিন করে উঠলো শালিনীর। এই স্পর্শসুখটুকুও হারিয়ে ফেললে জীবনে আর থাকবেটা কি! - "আর আদর খেতে হবে না। যাও গিয়ে ব্রাশ করে নাও"। মেয়েকে আলতো করে ঠেললো শালিনী। - "উমমম, আর একটু থাকি না মা। তুমি কেন আমার কাছ থেকে উঠে এসেছ? জানো না তোমায় না জড়ালে আমি ঘুমাতে পারি না"। তিতলির বলা শব্দগুলো কাঁটার মতো বুকে গিয়ে বিঁধলো শালিনীর। এ কি করতে যাচ্ছে সে! সাত বছরের ছোট্ট মেয়েটাকে ফেলে চলে যাবার কথা ভাবছে কি করে? এত স্বার্থপর কবে হয়ে গেল সে, কিভাবে হয়ে গেল? গলার কাছে জমে থাকা এক দলা কান্না চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উফ্ মা গো, তিতলিকে বুকে চেপে ধরলো শালিনী। - "বাব্বাহ সক্কাল সক্কাল তিতলি সোনা মা কে এত আদর করছে কেন? নিশ্চয়ই আজ পড়াশুনা করার ইচ্ছা নেই?" তিতলি মায়ের কোল থেকে মুখ তুলে জিভ ভেঙালো বাবাকে। অঞ্জন খবরের কাগজ খুলে বসেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে টুকটাক মন্তব্য করছে। শালিনী অবাক হয়ে দেখছিল অঞ্জনকে। কি মানুষ রে বাবা, পরম নিশ্চিন্তে হাত পা ছড়িয়ে বসে দেশের খবর নিচ্ছে। কাশ্মীর ভাঙ্গলো না গড়লো তাই নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। এদিকে যে নিজের ঘরটা ভাঙ্গতে চলেছে সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ঘড়ির দিকে দেখলো শালিনী। ন'টা বাজতে চলেছে। তিতলিকে তুলে বাথরুমে নিয়ে গেলো। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে মেয়ের হাতে ধরিয়েছে। তিতলি আয়না দেখে দেখে দাঁত ব্রাশ করছে। এক মুখ ফেনা নিয়ে নিজেই নিজেকে ভেংচি কাটছে। হাসি চেপে মেয়ের হাত থেকে ব্রাশ নিয়ে নিলো শলিনী। -"অনেক দুষ্টুমি হয়েছে, চলো এবার।" তিতলির মুখ ধুইয়ে অঞ্জনের কাছে বসিয়ে রান্নাঘরে এলো শালিনী। গ্যাসের একধারে তিতলির দুধ গরম করতে বসিয়ে আরেক দিকে নিজেদের চা বসালো। ফোনটা আবার ভাইব্রেট করছে। ফোনটা কানে চেপে রান্নাঘরের এক কোণে সরে গেলো শালিনী। - "কি হয়েছে? এত বার কল করছো কেন?" -"তোমারই বা কলটা রিসিভ না করার কি কারণ?" - "কেন তুমি জানো না আজ রবিবার। ও থাকে বাড়িতে।" প্রায় হিসহিসিয়ে বললো শালিনী। - "ওহ হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গেছিলাম। আজ তো তোমার "ও" বাড়িতে থাকে"। সন্দীপের গলায় বাঁকা সুর। বিরক্ত লাগছিল শালিনীর। যে কোনো মুহূর্তে হয়তো অঞ্জন চলে আসবে। - "যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।" -"ফর গডস সেক শালু, তোমার এই পতিব্রতার অভিনয়টা স্টপ করো এবার।" পতিব্রতা শব্দটা খট করে কানে লাগলো শালিনীর। দাঁতে দাঁত চেপে বললো -"বাজে বকা বন্ধ করে পয়েন্টে এসো"। - "ওকে ওকে, আয়াম সরি। শোনো, আজকে বিকাল পাঁচটার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছি। তুমি সাড়ে চারটে নাগাদ যাদবপুর এইট বির সামনে চলে আসবে। ওখান থেকেই একসাথে ওনার চেম্বারে চলে যাবো"। - "ঠিক আছে"। - "প্লিজ শালু, এবারে আর ঝুলিও না। লাস্ট টাইম তিতলির জ্বরের বাহানায় আসোনি। এবারটা আর মিস কোরো না। অনেক কষ্টে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছি"। নিজেকে কেমন যেন কলে ধরা পড়া ইঁদুরের মত লাগছিল শালিনীর। বিরক্ত গলায় বলল - "ঠিক আছে, ঠিক আছে রাখছি এখন"। দুধটা উথলে পড়ে যাচ্ছিলো প্রায়। তাড়াহুড়ো করে গ্যাসটা বন্ধ করলো শালিনী। উফ্ বেঁচে গেছে দুধটা। তিতলির কর্নফ্লেক্সে দুধ ঢেলে, চটপট নিজেদের চা টা বানিয়ে ফেললো। অন্যমনস্ক মুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো শালিনী। মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তা বিজবিজ করছে। সন্দীপ এক ল'ইয়ার ঠিক করেছে। সে নাকি বিবাহে বিচ্ছেদ ঘটাতে সিদ্ধহস্ত। আজ অবধি তার কোনো কেস ফেল করেনি। এত নামী দামী ল'ইয়ার জেনে শালিনী পিছিয়ে যাচ্ছিলো। তার হয়ে ফিস্ দেবার তো কেউ নেই। সন্দীপ শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো। - "আমি থাকতে তুমি ফিস্ নিয়ে কেন ভাবছো শালু"? - "তুমি কেন দেবে? সেপারেট তো আমি আর অঞ্জন হচ্ছি।" - "হ্যাঁ নিশ্চয়ই, কিন্তু তাতে আমারও তো কিছু গেইন হবে তাই এটা ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট নয়"। হা হা হেসেছিল সন্দীপ। শালিনী সেই হাসিতে যোগ দিতে পারেনি। কেমন যেন নিজেকে একটা বোঝার মতো মনে হয়েছিল। আজ এর ঘাড়ে তো কাল আরেকজনের। সন্দীপকে বিয়ে করলেই কি পরিস্থিতি এক নিমেষে বদলে যাবে? প্রেমিক সন্দীপ আর স্বামী সন্দীপের মধ্যে কিছু অন্তর তো এসেই যাবে। তখন তো আবার যে কে সেই.... - "কি ভাবছো বলতো তখন থেকে"? অঞ্জনের ডাকে সম্বিত ফিরলো শালিনীর। - "তেমন কিছু না। তিতলির এই মাসে একটা ভ্যাকসিন আছে না?" প্রসঙ্গ বদলাতে চাইল শালিনী। অঞ্জনের মুখ দেখে মনে হলো না সে বিশ্বাস করেছে কথাটা। তবে আর কিছু বললও না। তিতলি যথারীতি কর্নফ্লেক্সের বাটিতে চামচ দিয়ে আলপনা এঁকে চলেছে। এখনও নিজের হাতে কিচ্ছুটি খায় না মেয়ে। -"কি হল, খাচ্ছিস না কেন"? - "তুমি খাইয়ে দাও না।" তিতলি গা মোচড়াচ্ছে। বড়ো বড়ো কয়েক চামচ কর্ণফ্লেক্স তিতলির মুখে দিয়ে রান্নাঘরে এলো শালিনী। অন্নপূর্ণা ময়দা মাখছে। আলু, ফুলকপিও কেটেকুটে রেডি শালিনীর অপেক্ষায়। কড়াইতে তেল দিয়ে আরও একবার সবজিগুলো ধুয়ে নিলো সে। একবারের বেশি সবজি ধুতে অন্নপূর্ণার বড়ই আলস্য। চচ্চড়িটা বসিয়ে লিভীংরুমে এলো শালিনী। তিতলি যথারীতি অর্ধভুক্ত কর্নফ্লেক্সের বাটির সামনে নাক কুঁচকে বসে আছে। উল্টোদিকের সোফায় অঞ্জন আয়েশ করে বসে খবরের কাগজের পাতা উল্টাচ্ছে। মেয়ে খাচ্ছে কি খাচ্ছে না হুঁশই নেই। আর মেয়েও হয়েছে তেমন, মায়ের হাতে ছাড়া কিচ্ছুটি দাঁতে কাটবে না। তবে এ ব্যাপারে শালিনীর নিজেরও দোষ আছে, এ কথা সে মানে। মেয়েকে নিজের হাতে খেতে দিলে, মেয়ে পেট ভরে খাবে কিনা সেই চিন্তাতেই শালিনী এখনো তিতলির একা খাবার অভ্যাসই করায়নি। বেশিরভাগ দিনই স্কুলের টিফিনবক্স প্রায় ভরা অবস্থায় বাড়িতে ফেরে। তিতলিকে খাইয়ে লুচিগুলো বেলছিলো শালিনী। ফোনটা আবার ভাইব্রেট করছে। দুরু দুরু বুকে স্ক্রিনে চোখ রাখলো শালিনী। নাহ, সন্দীপ নয়, মা কল করছে। -" বলো মা"। - "কিরে কাল থেকে কোনো খোঁজ নেই তোদের। সবাই ঠিক আছিস তো?" সুলতার কণ্ঠে সহজাত উদ্বেগ। মায়ের এই অত্যধিক দুশ্চিন্তা করার অভ্যাস আর গেলো না। তার ওপর শালিনী যেদিন থেকে আভাস দিয়েছে তার আর অঞ্জনের সম্পর্কের ফাঁকটুকু, মা যেন আরও বেশি দুশ্চিন্তা করছে। সবটাই কি শুধু মেয়ের সংসার ভাঙার ভয় নাকি তার সাথে জড়িয়ে আছে আরও অনেক অনেক কিছু। সমাজ, লোকলজ্জা, তার ওপর এই বছরের শেষেই শালিনীর ছোট বোন নন্দিনীর বিয়ে। শালিনীর সম্পর্কে জানাজানি হলে বিয়ে ভেঙ্গেও যেতে পারে। অসহিষ্ণুতা গোপন করে উত্তর দিলো শালিনী -"সব্বাই ঠিক আছি মা। ছুটির দিনে বোঝোই তো কাজের চাপ থাকে। একটু ফ্রি হয়েই তোমায় কল করতাম"। - "আচ্ছা এখন ছাড়ি তবে। সময় করে ফোন করিস কিন্তু"। মায়ের ওপর বিরক্ত হওয়ায় নিজেরই মনটা খারাপ হয়ে গেলো শালিনীর। মা তো অন্যায় কিছু চাইছে না। পৃথিবীর কোনো মা-ই কি চাইবে তার মেয়ে সাজানো গোছানো সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসুক। যেখানে আপাত দৃষ্টিতে জামাইয়ের তেমন কোনো দোষও দেখা যাচ্ছে না। অঞ্জন খুবই দায়িত্বশীল স্বামী, দায়িত্বশীল পিতা, আর্থিক দিক থেকেও শালিনী এবং তিতলিকে যথেষ্ট সুরক্ষা দিয়ে রেখেছে সে। বলতে নেই, অঞ্জনের তেমন কোনো বিপদ যদি ঘটেও যায়, তাহলেও শালিনীকে সারাজীবন কারুর কাছে হাত পাততে হবে না। তবে কি সত্যিই অঞ্জনের দিক থেকে কোনো ত্রুটি নেই। সবটাই কি তবে তার মনগড়া? নিজেরই করা প্রশ্নের জালে নিজেই ক্রমাগত জড়িয়ে পড়ছিল শালিনী। বিয়ের দিন থেকে শুরু করে একের পর এক স্মৃতি এসে ঝাপটা দিচ্ছে মনে। পাকে পাকে বেঁধে ফেলছে শালিনীকে। ঝাপসা হয়ে আসা চোখে কড়ায় লুচিগুলো ছাড়ছিলো শালিনী। মূহুর্তের অন্যমনস্কতায় গরম তেলে আঙ্গুল ডুবে গেলো। কোনোরকমে ভাজা হয়ে যাওয়া লুচিটা নামিয়ে, বাঁ হাতে গ্যাস বন্ধ করলো। শালিনীর আর্তনাদে তিতলি আর অঞ্জনও ছুটে এসেছে রান্নাঘরে। হাতের চারটে আঙ্গুল যেন জ্বলে যাচ্ছে। তিতলিকে ফার্স্ট এইড বক্সটা আনতে বলে, সিঙ্কের কলটা খুলে শালিনীর হাতটা কলের তলায় ধরলো অঞ্জন। জলের স্পর্শে ধীরে ধীরে স্তিমিত হচ্ছে দহন জ্বালা। জলের স্পর্শে না অঞ্জনের স্পর্শে! বুঝতে পারছিল না শালিনী। অঞ্জনের মায়াভরা স্পর্শটুকু চারিয়ে যাচ্ছিলো হৃদয়ের গভীরে। ভালোবাসা কি তবে মরে না!



#চার


দুপুরে খেয়ে উঠে অঞ্জন যথারীতি ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছে। তিতলি বাবার কোল ঘেঁষে বসে এক মনে ছবি আঁকছে। শালিনীকে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো দৃশ্যটা। প্রায় চারটে বাজে। এবার তৈরী হতে হবে তাকে। সন্দীপ বারবার মেসেজ করে তাড়া দিচ্ছে। গত আট মাস ধরে শালিনী যা চেয়ে এসেছে আজ তা বাস্তবায়িত হতে চলেছে, তবে কেন এই দ্বিধা। কেন আজ মনে আনন্দের ঢেউ উঠছে না। কেন আজ মন সাড়া দিচ্ছে না সন্দীপের আহ্বানে। তবে কি আজও অঞ্জনই...... -"অ্যাই শালু, তখন থেকে আয়নার সামনে বসে কি এত ভাবছো"? অঞ্জনের ডাকে ভাবনার সুতোয় টান পড়ল শালিনীর। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল - "কই কিছু না তো"। - "বলছি এবার পুজোর ছুটিতে কোথায় যাবে ঠিক করলে কিছু"? অবাক হয়ে অঞ্জনকে দেখছিল শালিনী। অঞ্জনের গোলগাল ফর্সা মুখে শিশুর সারল্য। শালিনীর মতামতের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে অঞ্জন। যেন শালিনী মত দিলেই এক্ষুণি সুটকেস গোছাতে শুরু করবে। শালিনীকে চুপ করে থাকতে দেখে অঞ্জন আবার বলল -"ভাবছি রাজস্থানটা ঘুরিয়ে আনি তোমাদের। তুমি হ্যাঁ বললে তবেই টিকেট বুক করব। জয়পুর অবধি প্লেনে যাবো। আমাদের তিতলি সোনা তো প্লেনে চড়েনি। এনিওয়ে তুমি যেন কোথায় বেরোবে বলছিলে?" অঞ্জনের নিশ্চিন্ত মুখটা আজ যেন বড্ড বেশী পীড়া দিচ্ছিলো শালিনীকে। আমতা আমতা করে বলল - "হ্যাঁ মানে একটু কাজ ছিলো"। -"মা, তুমি এখন কোথাও যাবে না"। - না সোনা, মা নিশ্চয়ই কোনো কাজে যাচ্ছে। তুমি মা কে বলে দাও যেন ফেরার সময় আমাদের সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসে"। - "মা না থাকলে আমায় কালকের জন্য পোয়েম মুখস্ত করাবে কে? আর আমার প্রপ কে বানিয়ে দেবে?" প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় তিতলি বলে এবার। -"এই রে, দেখেছিস, ভুলেই গেছিলাম তোর পোয়েম কম্পিটিশনের কথা। দু মিনিট দে আমায়, একটা কাজ সেরে এসেই আমরা দুজন মিলে পোয়েমটা মুখস্ত করে ফেলবো"। - "এরকম করে না তিতলি। অ্যাই শালু তুমি যেখানে যাচ্ছিলে যাও। আই উইল ম্যানেজ"। অঞ্জন চোখ টিপে ইশারা করলো শালিনীকে। বুকের ভিতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিলো শালিনীর। এত ভরসা করে অঞ্জন তাকে।একবার জিজ্ঞেসও করছে না সে একা একা হঠাৎ কোথায় যাচ্ছে। আর এই মানুষটাকে সে ঠকাচ্ছে! অঞ্জনের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল শালিনী। স্বগতোক্তির মত বলে উঠল - "নাহ, আমার কোত্থাও যাবার নেই"। পাশের ঘরে এসে সন্দীপকে ফোন লাগালো শালিনী -"হ্যাঁ শালু, কখন বেরোচ্ছ"? - "আমি আসছি না সন্দীপ। পারলে ক্ষমা কোরো আমায়"। - "মানেটা কি? কি বলতে চাইছ"? - "মানে আমি.... আমি পারবো না তিতলিকে ছেড়ে থাকতে"। -"আরে, তিতলিকে তোমায় ছেড়ে দিতেই হবে এরকম ভাবছো কেন? ও মাইনর, তুমিই হয়তো কাস্টডি পাবে"। - "হয়তো পাবো, তাহলে ও বাবার ভালোবাসা পাবে না। যা কিছু ক্ষতি তা তো তিতলিরই হবে"। - "সত্যি করে বলতো, কাকে ছাড়তে অসুবিধা তোমার? তিতলি না অঞ্জন"? - "জানি না"। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এলো শালিনীর বুক থেকে। - "ন্যাকামো কোরো না। আমাকে কি তোমার গাড়ল মনে হয়? আমার সাথে প্রেম প্রেম খেলে এখন বরের কোলে বসে সতী সাজতে চাইছ না"? - "জাস্ট শাট আপ সন্দীপ"। - "আই ওন্ট। আমি তোমাকে এতো সহজে ছেড়ে দেবো না শালিনী। তোমার অঞ্জনের মত গবেট আমি নই"। - "মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ সন্দীপ"। - "উহ্হহ, বরের জন্য প্রেম উথলে পড়ছে না? তা বর যখন বৌয়ের সব কীর্তিকলাপ জানবে তখন এই প্রেম টিকবে তো মিসেস শালিনী মজুমদার"? - "কি বলতে চাইছো তুমি"? - "তোমার সব মেসেজের আমার কাছে স্ক্রিনশট নেওয়া আছে। পৌঁছে দেবো তোমার বরের কাছে"? দাঁতে দাঁত ঘষে বললো সন্দীপ। - "তুমি এতো নীচ? আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো"। - "হ্যাঁ, আমারও বোঝা উচিত ছিল যে তুমি অঞ্জনের সাথে যেটা করেছো সেটা আমার সাথেও করতে পারো"। - "আমি ভুল করে ফেলেছি। প্লিজ আমায় মুক্তি দাও সন্দীপ"। শালিনীর গলার তীব্র আকুতিতে সন্দীপ বোধহয় থমকালো সামান্য। প্রায় ফিসফিস করে উঠলো - "ডিড ইউ এভার লাভ মি শালু"? কিছুক্ষণ চুপ করে রইল শালিনী। যেন অন্ধকারে কথা হাতড়াচ্ছে। তারপর কেটে কেটে বলল - "তিতলির থেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট আমার জীবনে আর কেউ নেই সন্দীপ"। - "বড্ড দেরিতে বুঝলে কথাটা। এনিওয়ে এটাই তোমার ফাইনাল ডিসিশন তো"? - "হুম..." -"ওকে, ভালো থেকো"। আর কথা বাড়ালো না সন্দীপ। ফোন রেখে দিয়েছে। ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকল শালিনী। মাথা কাজ করছে না একেবারেই। সন্দীপ যদি অঞ্জনকে সব জানিয়ে দেয়, কি প্রতিক্রিয়া হবে অঞ্জনের? শালিনীকে কি মন থেকে মেনে নিতে পারবে অঞ্জন। যদি মেনেও নেয়, তাহলে কি তাদের সম্পর্কের মাঝে একটা অদৃশ্য দেওয়াল উঠে যাবে না? আর ভাবতে পারছিল না শালিনী। নাহ, অন্য কারুর মুখ থেকে জানার আগে সে নিজেই অঞ্জনকে জানাবে সব কিছু। তাতে যা হবার হবে। পায়ে পায়ে শোবার ঘরে এলো শালিনী। ছবি আঁকতে আঁকতে তিতলি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে অঞ্জনের কোলের কাছে। শালিনী অঞ্জনের একদম সামনে এসে দাঁড়ালো। উসখুস করছে। কি করে কথাটা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। -"বলবে কিছু"? অঞ্জন ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলেছে। - "হ্যাঁ,কয়েকটা কথা বলার ছিলো তোমায়"। - "বলো.. পারমিশন লাগবে নাকি তোমার"? - "তুমি কাজ সেরে নাও তারপর বলছি"। -"ওকে, একটু ওয়েট করো। এই মেইলটা সেন্ড করেই শুনছি"। ঝড়ের গতিতে টাইপ করছে অঞ্জন। কয়েক মিনিট যেন কয়েক যুগের মত মনে হচ্ছিলো শালিনীর। - "বলো এবার, কি বলবে"। অঞ্জন ল্যাপটপকে ঘুম পাড়াচ্ছে। চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড দম নিলো শালিনী। তারপর গলগল করে উগরে দিয়েছে তার গোপন অভিসারের বৃত্তান্ত। সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো অঞ্জন তারপর পোশাক বদলে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। অঞ্জনের থমথমে মুখচোখ দেখে ভীত সন্ত্রস্ত শালিনীও তাকে আর আটকানোর সাহস পেলো না। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। তিতলি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে শালিনী রাস্তার ধারের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খবরে বলছিল বঙ্গোপসাগরে নাকি তৈরী হয়েছে এক গভীর নিম্নচাপ। সেই জেরে এখন দুদিন এরকমই চলবে। অঞ্জন এখনও ফেরেনি। সংকোচ কাটিয়ে বার কয়েক ফোন করেছিল শালিনী। প্রতিবারই সুইচ অফ পেয়েছে। চিন্তা হচ্ছিলো তার। কোথায় গেলো অঞ্জন! সন্দীপের সাথে দেখা করতে যায়নি তো? ভিতরের ঘরে তিতলি কাশছে। দ্রুত পায়ে ঘরে এল শালিনী। মেয়েকে তুলে অল্প করে জল খাইয়ে, পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিল। ঘড়ির কাঁটার সাথে দুশ্চিন্তারাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আজ। তৃতীয় সম্পর্কের জেরে ঘটে যাওয়া নানা রকম দুর্ঘটনা ছায়া বিস্তার করছিলো শালিনীর মনে। সত্যিই যদি তেমন কিছু হয়, ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে সে! কলিং বেলের শব্দে শালিনীর ভাবনার জাল ছিড়ে গেলো। ছুটে গিয়ে দরজা খুলেছে। সামনে অঞ্জন। -"এত রাত অবধি কোথায় ছিলে"? উৎকণ্ঠায় প্রশ্নটা করেই ফেললো শালিনী। উত্তর দিল না অঞ্জন। শু-র‌্যাকে জুতো জোড়া রেখে, ব্যস্ত পায়ে শোবার ঘরের দিকে চলে গেলো। পর্দা সরিয়ে একবার ঘুমন্ত মেয়েকে দেখছে। শালিনীও এসেছে পিছন পিছন। - "কি হলো কিছু বলছো না যে"। - "কি বলবো।" অস্বাভাবিক রকমের নিস্পৃহ অঞ্জনের কন্ঠস্বর। - "কোথায় ছিলে এত রাত অবধি"? - "কাজ ছিলো"। - "ছুটির দিনে কি কাজ ছিল তোমার"? - "ফ্রেশ হয়ে আসছি। খেতে দাও"। শালিনীকে পাশ কাটিয়ে শোবার ঘর লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেছে অঞ্জন। অঞ্জনের জন্য খাবার বাড়তে বাড়তে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলো শালিনী। কোথায় গেছিলো অঞ্জন? বলছে কাজ ছিল। কি এমন কাজ এত রাত অবধি? সন্দীপের কাছে গেছিলো কি? - "তুমি খাবে না"? অঞ্জন ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছে। - "হ্যাঁ"। শুকনো গলায় শালিনী উত্তর দিলো। - "বসে যাও। আর কত রাত করবে। এরপর খেলে তো অ্যাসিডিটি হবে"। অনিচ্ছাসত্বেও একটা রুটি আর অল্প তরকারি নিয়ে বসলো শালিনী। খুঁটছে খাবার। এক দানাও মুখে তুলতে পারছে না। - "কি হলো খাও"। অঞ্জনের কথায় এবার সামান্য সপ্রতিভ হয়েছে শালিনীর আঙ্গুল। মাথা নিচু করে খাওয়ায় মন দিয়েছে। এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে পুড়লো। শুকনো রুটি গলায় আটকে যাচ্ছে। অঞ্জনের নিস্পৃহতায় চোখে জল এসে যাচ্ছিলো শালিনীর। নীরবতা যে কি ভয়ানক টের পাচ্ছিল সে। এর থেকে যদি অঞ্জন তুমুল অশান্তি করতো তাহলে অন্তত বুকের ওপর চেপে বসে থাকা পাথরটা নেমে যেত। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকতে রান্নাঘরে এলো শালিনী। টুকটাক কাজ সারছে। ঘষে ঘষে ডাইনিং টেবিলটা মুছল। বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো ছোট ছোট বাটিতে করে ফ্রিজে তুলছে। আগামিকালের ব্রেকফাস্টের জন্য সবজিও কেটে রাখলো। অঞ্জনকে এড়াতেই হয়তো খুঁজে খুঁজে কাজ বের করছে। সব কাজ সেরে অনেক রাতে যখন বিছানায় এল, অঞ্জন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত পোশাকে নিজেকে বদলে, জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলো শালিনী। ধরে এসেছে বৃষ্টিটা। ভালোই হয়েছে, কাল তিতলির স্কুল। সবে কদিন হল জ্বরে ভুগে উঠেছে মেয়েটা। এই বৃষ্টিতে ভিজলে আবার না জ্বরটা ফিরে আসে। মসকিউটো রিপেলেন্টটা অন করে বিছানায় এল শালিনী। অঞ্জনের নিঃশ্বাসের হালকা ওঠাপড়ার শব্দ আসছে। প্রায় নিঃশব্দে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিল শালিনী। বড় ক্লান্ত লাগছে আজ, আবার ভারমুক্তও। গোপনীয়তার এই বোঝা বইতে বইতে সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। বিছানায় শুয়েও ছটফট করছিল শালিনী। কিছুতেই ঘুম আসছে না। কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। অস্বস্তিটা কাটাতে উঠে একবার বাথরুম গেল। গলায় ঘাড়ে জল ছিটিয়ে এসে আবার শুয়েছে। এলোমেলো চিন্তারা ফিরে ফিরে আসছে। পাশ ফিরে একবার তিতলিকে দেখলো শালিনী। এসির ঠান্ডায় কুঁকড়ে মুকরে শুয়ে আছে তিতলি।গা থেকে চাদরটাও সরে গেছে। তিতলিকে ভালো করে ঢেকে দিল শালিনী। নরম নরম চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। - "ঘুমাওনি কেন এখনও? কাল ভোরে ওঠা আছে না"? অঞ্জনের গলায় চমকে উঠলো শালিনী। মৃদু স্বরে বলল - "ঘুম আসছে না"। - "কেন? সন্দীপের কথা মনে পড়ছে"? অঞ্জনের স্বরে কি ব্যঙ্গ না অন্য কিছু বুঝতে পারছিল না শালিনী। - "অঞ্জন প্লিজ...." অস্ফুটে বলল শালিনী। "আমি তো বললামই ভুল করে ফেলেছি। তারপরেও কেন এভাবে বলছো"? - "ভুল! হাহ ... তুমি তো বলেই খালাস "আমার ভুল হয়ে গেছে"। তোমার কোনো ধারনা আছে তোমার এই ভুলটার জন্য কতগুলো মানুষ সাফার করতো? বোঝার ক্ষমতা আছে তোমার, কতটা সাফার করছি আমি! পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে বুকের ভিতরটা। জানতে চাইছিলে না কোথায় ছিলাম। পাগলের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলাম আর নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, আমি তোমায় কি দিইনি যার জন্য তোমায় অন্য কারুর কাছে যেতে হল"। - "আমি ক্ষমা চাইছি অঞ্জন। প্লিজ একটা বারের জন্য অন্তত ক্ষমা করে দাও আমায়"। - "এটা বলা খুব সহজ তাই না? সন্দীপের কাছে যাবার সময় আমার কথাটা একবারের জন্য ভেবেছিলে তুমি? আমার কথা ছেড়েই দাও, তিতলি.? তিতলির কথাটাও ভাবোনি। মা হয়ে এতটা স্বার্থপর তুমি হয়ে গেলে কি করে? আসলে আমি, তিতলি আমরা কেউই তোমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট ছিলাম না কোনদিন। এনিওয়ে, তুমি যদি চলে যেতে চাও তো যেতে পারো শালিনী। আমি তোমায় আটকাব না"। - "চুপ করো, প্লিজ চুপ করো। আর শুনতে পারছি না"। এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো শালিনী। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে সারা শরীর। বরাবরের আদুরে, অভিমানী, জেদী শালিনীকে এভাবে দেখে কষ্ট হচ্ছিলো অঞ্জনের। তিতলিকে সামান্য সরিয়ে শালিনীর পাশে উঠে এসেছে। উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে রয়েছে শালিনী। পিঠে হাত রাখলো অঞ্জন। - "এদিকে ফেরো"। অঞ্জনের স্পর্শেও শালিনীর ফোঁপানো থামছে না। -"কি হল তাকাও আমার দিকে"। জোর করে শালিনীকে নিজের দিকে ফেরাল অঞ্জন। নাইট ল্যাম্প এর হালকা আলোয় দেখছে শালিনীকে। স্টেপকাট চুল অগোছালো হয়ে রয়েছে। চোখের জলের সাথে কেশগুচ্ছ লেপ্টে রয়েছে শালিনীর মুখে গলায়। যত্ন করে চুলগুলো শালিনীর মুখের উপর থেকে সরাল অঞ্জন। চোখ বুজে রয়েছে শালিনী। - "তাকাও আমার দিকে শালু। প্লিজ...." অঞ্জনের স্বরে এমন কিছু ছিল যা তাকাতে বাধ্য করল শালিনীকে। - "আমি জানি তোমার মনে আর আমি নেই, অন্য কেউ আছে। কিন্তু সব জেনেও আমি তোমায় দূরে সরিয়ে দিতে পারব না"। - "ভুল জানো তুমি, ভুল জানো। আমার জীবনে তোমার আর তিতলির থেকে বেশি গুরুত্ব আর কারুর নেই। আমি রিপেন্ট করছি অঞ্জন। প্রতি মুহুর্তে রিপেন্ট করছি। তুমি যা খুশি শাস্তি দাও আমায় কিন্তু প্লিজ চলে যেতে বোলো না। তোমাদের ছাড়া আমি....." অঞ্জনকে আঁকড়ে ধরেছে শালিনী। চোখের জলে অঞ্জনের পাতলা পাঞ্জাবীটা ভিজে যাচ্ছে। শালিনীর পানপাতা মুখ দু হাত দিয়ে তুলে ধরলো অঞ্জন। ঠোঁট দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে চোখের জল। গাঢ় স্বরে বলল - "আমার ট্রাজেডি কি জানো শালু? আমি এখনও তোমায় ভালোবাসি। তোমায় ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারি না। আমরা কি সব ভুলে আবার নতুন করে...." অঞ্জনের কথাগুলো অসম্পূর্ণই থেকে গেল শালিনীর গভীর চুম্বনে। ক্রমশ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে আলিঙ্গন। অনেকদিন পর আবার ডুবছিল দুজন ভালোবাসায়, নির্ভরতায়। আলো আঁধারিতে অঞ্জনে মিশে যাচ্ছিলো শালিনী। বাইরে আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে....


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance