STORYMIRROR

Pradipta Bhattacharya

Horror Others

3  

Pradipta Bhattacharya

Horror Others

নতুন মা

নতুন মা

5 mins
252

অফিস থেকে এসে বিছানায় শুয়েছিলাম। কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল সে খেয়ালই নেই। শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করতেই ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। মাথার পাশে হাসিমুখে বসেছিল টুম্পা।


আমায় দেখে ও বলল, 'সন্ধ্যে হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি ওঠো। ঠাকুর ঘরে গিয়ে সন্ধ্যা আরতি সেরে একবার বাবার কাছে যেও। ওনার শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে। দুপুরের ওষুধটা খেতেও ভুলে গেছেন।'


হাই তুলে একবার চোখের পলক ফেলতেই টুম্পা উধাও। আমার জীবনে টুম্পার আসা যাওয়া এমনটাই তাৎক্ষণিক। অনেকে বলে টুম্পা চলে গেছে, কিছু মানুষ বলেন টুম্পা মারা গেছে। কিন্তু আমার মন বলে টুম্পা আমার মধ্যেই আছে। টুম্পার সাথে প্রত্যেকবার সাক্ষাতের পরই আমি কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে যাই অতীতের দিনগুলোতে ।


আমার বয়স তখন মাত্র ৯ বছর। মা চলে গেছে অনেক দূরে মানে আর যেখান থেকে ফেরা যায় না কোনোদিনও। সবাই বোঝাতো আমায় আমার মা নাকি বেড়াতে গেছে অনেক দূরে। অনেক সময় লাগবে ফিরে আসতে।


আমরা দুই বোন। দিদি আমার থেকে বয়সে অনেকটাই বড়। বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আমি ছিলাম সবার থেকে আলাদা। বাড়ির লোকেরা আমায় 'ডাকাত' বলে ডাকতো। আমার নাম নিরুপমা, ওরফে নিরু।


হঠাৎ একদিন দেখি সবাই বলাবলি করছে আমার বাবার নাকি বিয়ে!! আকাশ থেকে পড়লাম, সেও আবার হয় নাকি। নিজের বাবার বিয়ে খাবার সৌভাগ্য কয়জনেরই বা হয়। আমি তার মধ্যে একজন।


খুব ধুম ধাম করে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাবার বিয়ে। আমার বাবা গজেন্দ্রমোহন সমাদ্দার, পেশায় ছিলেন এলাকার নামকরা একজন উকিল। বেশী কথা বলতেন না কারুর সাথেই। আর আমার সাথে তো ওনার আদায় কাঁচকলা!!


আমার দেখাশুনার সব দায়িত্ব ছিল আমার দিদি অনুপমার উপর। দিদির বিয়ের বয়স হয়ে এসেছে। এতবড় বাড়ি সামলানো, আমায় দেখাশুনা করার জন্যই নাকি বাবার এই দ্বিতীয় বিয়ে।


মায়ের ছবিটা টাঙানো ছিল দেওয়ালে। যাতায়াতের সময় চোখে পড়তো কিন্তু কোনোদিনও সেভাবে খুঁটিয়ে দেখিনি। ছবিটাতে মায়ের মুখটা ছিল কেমন যেন গোমড়া। এমনিতেও আমার মা নন্দিনী সমাদ্দার নাকি খুব একটা মিশুকে ছিলেন না। চুপচাপই থাকতেন। সর্বদাই নিজ কাজে ব্যস্ত থাকতেন। হঠাৎ করেই কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল। চিলেকোঠায় গিয়ে গলায় দড়ি দিলেন।


বাড়ি আলো করে এল বাড়ির নতুন বৌ টুম্পা। এর আগে কোনোদিনও মায়ের জন্য এতটা কষ্ট হয়নি যতটা না কষ্ট পেয়েছিলাম বাবার দ্বিতীয় বিয়ের দিন। আমার মা এর জায়গা নেবে এই বাচ্চা মেয়েটি!! যে কিনা আমার দিদির থেকেও বয়সে ছোট, অসম্ভব। 


রাতের বেলায় বাবা এলেন ঘরে, ' নিরু !নিরু ! নতুন মায়ের সাথে আলাপ হয়েছে তোমার ?' আমি ভূগোল বইটা মুখের সামনে ধরে পড়ার চেষ্টা করছিলাম ঠিকই কিন্তু সবই মাথায় অনেক উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।


বললাম, 'হ্যাঁ বল।না আমার সাথে দেখা হয়নি আর চাই ও না দেখা করতে।' বাবা গর্জে উঠলেন, 'নিরু! একদম মুখে মুখে তর্ক করবে না।' ভাগ্গিস দিদি এসে গিয়েছিল সেদিন না হলে যে কি ভীষণ কান্ড হত।


বাবার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়েছিল বাড়ির নতুন বৌ টুম্পা। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে আর মুচকি হাসছিল। গায়ের রং চাপা কিন্তু মুখটি খুব মিষ্টি। প্রচন্ড রাগ উঠেছিল সেদিন টুম্পার উপর , কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম।


নান্টুকে দিয়ে ভাটপাড়ার ওই জলাভূমি থেকে একটি জ্যান্ত ব্যাঙ এনে ছেড়ে দিয়েছিলাম টুম্পার ঘরে। টুম্পা কেমন জব্দ হয় তা দেখার জন্য লুকিয়ে ছিলাম পাশের ঘরে। দেখলাম, টুম্পা হাতে ধরে সেই ব্যাঙটাকে বাগানে গিয়ে ছেড়ে দিল। আমার প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল ।


বালতিতে তুলে রাখা স্নানের জলে নোংরা মিশিয়ে দেওয়া, ঘরের সামনে আবর্জনা ফেলে রাখা, পিছন থেকে ভয় দেখানো, ইত্যাদি বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেও যখন কিছু হল ফল হল না তখন শেষমেষ একটা উপায়ই ছিল। টুম্পাকে চিরদিনের মত সরিয়ে দেওয়া পৃথিবী থেকে।


বন্ধুরা মিলে স্নান করতে গেছিলাম গঙ্গায়। আমি বেশ ভালোই সাঁতার কাটতে পারতাম সেই সময়ে। পূর্ণিমার দিনে গঙ্গা বেশ উত্তাল। যেচে ভাব জমিয়ে টুম্পাকেও সাথে করে নিয়ে গেছি আমার সঙ্গে। গঙ্গার ঘাটের পাশে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে টুম্পাকে পিছন থেকে একটা জোরে ধাক্কা দিয়েছিলাম।


টুম্পা পড়ে গেল জলে। ধমকের সুরে বললাম, 'আর যেন তোকে আমার বাড়িতে না দেখি।' টুম্পা ভেসে যাচ্ছিল ঢেউয়ের টানে। আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়েছিল আর হেসেছিল। আমি চলে এলাম। বন্ধু সমেত নেমেছিলাম স্নান করতে।


কিছুক্ষন পরেই অনুভব করছি শরীরে কোনো জোর পাচ্ছি না , অভ্যন্তরীণ শক্তি ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে আসছে। বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল আমার নাম ধরে। বুঝলাম আমি দলছাড়া হয়ে গেছি। ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি মৃত্যুর অতল গহ্বরে। ছটফট করছি বাঁচার জন্য কিন্তু ঢেউয়ের শক্তি মারাত্মক। আমার নিয়ে যাচ্ছিল মাঝ গঙ্গার দিকে। ঠিক তখনই আমার হাতটা ধরে টেনেছিল কেউ। ঝাপসা দৃষ্টিতে তখন দেখেছিলাম টুম্পাকে। এর পর আমার আর কিছুই মনে নেই। 


জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে সরকারি হাসপাতালের বেডে দেখতে পাই। সামনে বসেছিল দিদি। পাশে দাঁড়িয়ে বাবা আর পিছনে দাঁড়িয়েছিল হাস্যরত টুম্পা। আমি যে বেঁচে আছি প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার স্পষ্ট মনে ছিল গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু এখানে এলাম কিভাবে জানিনা।


বাবা বললেন, ' ভগবানের অশেষ কৃপায় তোকে ফিরে পেলাম রে মা ।' কেঁদে ফেললেন বাবা। কোনোদিনও বাবাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখিনি। কিন্তু আমায় কে বাঁচালো?? বন্ধুরা বলেছিল আমায় নাকি টুম্পা বাঁচিয়েছিল সেদিন। আমাকে গঙ্গার পারে রেখে কোথাও উধাও হয়ে গেছিল।তারপর সবাই মিলে আমায় নিয়ে আসে হাসপাতালে।


সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিনও টুম্পাকে স্বশরীরে দেখিনি আমি। যতবারই এসেছে ক্ষনিকের জন্য আবার পালিয়ে গেছে মুহূর্তে । অনেক চেষ্টা করেও ধরতে পারিনি আমি । টুম্পা আসে আমাকে বদলাতে। আমার চিন্তাধারা গুলোকে নাড়িয়ে দিতে। আমার দায়িত্বগুলোকে বুঝিয়ে দিতে। যেমন আজ এসেছিল।


একটা ধন্যবাদ জানানোর ছিল টুম্পাকে কিন্তু সেই সুযোগ আর হল না। আমার পুনর্জন্ম হয়েছিল সেদিন শুধুমাত্র টুম্পার জন্য। তাই টুম্পাও আমার মায়ের থেকে কোনো অংশে কম নয়।


 ৪০টা বছর পেরিয়ে গেছে। সেদিনের দস্যি মেয়েটি এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত, মার্জিত, নম্র, এবং পরিণত শুধুমাত্র টুম্পার জন্য। বিয়ে করিনি। এই বাড়িটাই আমার স্বর্গ। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে অন্যত্র। আমিও উচ্চশিক্ষা শেষ করে চাকরি করছি, বাড়ি ঘর সামলাচ্ছি, বাবার প্রতি আমার দায় দায়িত্ব ও পালন করে চলেছি।


মায়ের ফটোর পাশে টুম্পার একটি ফোটো লাগানো আছে। তবে সেটা আমার নিজের হাতে আঁকা । মায়ের সাথে টুম্পাকেও স্মরণ করি রোজ স্নানের পর। টুম্পাকে মন থেকে ডাকলেই ও চলে আসে আমার কাছে। আমার সাথে কথা বলে, আমার না করা কাজ গুলি আমায় মনে করে দিয়ে আবার চলে যায় মুহূর্তে ।


নিজের বলতে আজ আর কেউ নেই। তবে একজনের উপস্থিতি আমি আজও অনুভব করি সে আর কেউ নয়, আমার নতুন মা, টুম্পা।


         


Rate this content
Log in

More bengali story from Pradipta Bhattacharya

Similar bengali story from Horror