Pradipta Bhattacharya

Crime Others

4  

Pradipta Bhattacharya

Crime Others

গুরবিন্দর

গুরবিন্দর

10 mins
234


বড়মেয়ের সাথে কথা শেষ করে সবেমাত্র ভাতের হাড়িটা গ্যাসে চাপিয়েছিলেন মৌসুমী সেন আচমকা মোবাইলে বেজে ওঠে হনুমান চল্লিশা মন্ত্র। আসলে ঐটি ওনার মোবাইলের রিংটোন।


-- " হ্যালো! "

-- " মাম্মি জি প্যায়চনা মুঝকো ?"


গলাটা খুব চেনা লাগলেও মুখটা মনে পড়ল না। এটা একটা নতুন ব্যারাম হয়েছে ওনার। কিছুতেই গলা শুনে মুখটি মনে করতে পারেন না। বয়সটাও প্রায় ষাটের ঘর ছুঁইছুঁই। এসময় এমনটা হাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলেন মৌসুমী দেবী,


-- " কৌন হো তুম। আসলে ঠিক সে ইয়াদ নেহি পড়তা। "

-- " ম্যায় গুরবিন্দর। রাঁচি সে...!"


হ্যাঁ এইবার ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তির ছবিটা স্পষ্ট ভেসে উঠল মনে। সাদা শার্ট, নীল রঙের জিন্স এর প্যান্ট, মুখে দাড়ির জঙ্গল, মাথায় পাগড়ি, আর মুখে একটা সব সময়ের সারল্যের হাসি....


ঠিক মাস দুয়েক আগের কথা সকাল সাতটায় রাঁচি স্টেশনে নেমে দিকভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন মৌসুমী সেন ও তার পরিবার। অনলাইনে হোটেল বুকিং এই প্রথমবার। হোটেলের নাম "শান্তিপ্রিয়া ইন"। স্টেশনের বাইরে দাঁড়ানো টোটো বা অটোচালকেরা কেউই হদিস দিতে পারল না। বড়জামাই সুকল্যাণ বোস, অনলাইনে প্রাপ্ত একটি ল্যান্ড লাইন নম্বরে ফোন করলেন।


-- " হ্যালো!"

--" গুডমর্নিং, হোটেল শান্তিপ্রিয়া ইন সে বোল রাহা হুঁ। বলিয়ে.."

-- " হাঁ হাঁ অনলাইন সে এক বুকিং থা মৌসুমী সেন কে নাম পর..। "


-- " ওকে স্যার। জাস্ট গিভ মি ওয়ান মিনিট।..... ক্যায়া নাম বাতায়া থে স্যার....?

-- " জি মৌসুমী সেন... "


-- " হাঁ স্যার আজ সে হি তো বুকিং থা। আপ আ গ্যায়ে স্যার? "


--" হাম লোগ আধে ঘন্টে সে স্টেশন পর হুঁ। কোয়ি ভি লোক আপকা হোটেল কো প্যাহেচান হি নেহি রাহা হে "


-- " সরি স্যার। অউর এক মিনিট রুকিয়ে স্যার। প্লিজ। "


ঠিক এক মিনিট পর একটি কালো টাটাসুমো দাঁড়ালো স্টেশনের সামনে এসে। নেমে এলেন এক জন সুদর্শন পাঞ্জাবী পুরুষ। হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন মৌসুমীদেবীদের কাছে। পরিচয় দিলেন নিজের উনিই গুরবিন্দর, "শান্তিপ্রিয়া ইন" এর ম্যানেজার।


গুরবিন্দর, প্রথম দেখাতেই মন জয় করে নিয়েছিল মৌসুমী দেবীর। কি মার্জিত ব্যবহার! অসম্ভব সহনশীল মানুসিকতা, রুচিশীল পোশাক, খুব সুন্দর কথা বলতে পারা এবং খুব কম সময়ে কাউকে আপন করে নেওয়ার একটা অদ্ভূত ক্ষমতা বিমুগ্ধ করেছিল ওনাকে।


পেনশনের টাকা জমিয়ে সপরিবারে ঘুরতে এসেছেন রাঁচি। ঘোরার অভ্যাস তৈরী করে দিয়ে গিয়েছিলেন ওনার স্বামী প্রদ্যুৎ সেন। রেলের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। ঘুরতে যাবার পাস পেলেই স্ত্রী মৌসুমীকে এসে বলতেন,

-- " কৈ গো এবার জামাকাপড় সব গুছিয়ে নাও চটপট। মনটা আর বসছেনা যে বাড়িতে। "


মৌসুমী দেবী পেশায় ছিলেন শিক্ষিকা। তিনিও স্বামীর সুরে সুর মেলাতেন। ফলস্বরূপ বছরে তিন চারবার তো ঘোরাঘুরি হয়েই যেত। আনন্দ হত, মজা হত, খাওয়া দাওয়া হত, দুজনে দুজনকে চেনাও হত। প্রদ্যুৎ বাবু মারা যাবার পর মৌসুমী দেবী ঠিক করেছিলেন আর কোথাও ঘুরতে যাবেন কিন্তু ওই বড়জামাই, সুকল্যাণ, আরেকজন ভ্রমণ প্রিয় মানুষ ওনার জোরাজুরিতে বেশ কয়েকটা জায়গা ঘুরে ফেলেছেন। এবার পুজোয় ঘুরতে আসার প্ল্যানটি বড়মেয়ের ছেলে ওরফে তোতন এর জন্যই হয়েছে। অনেক দিন ধরেই দিদার কাছে বায়না ধরেছিল তোতন। সাধারণত পূজার সময় ঘুরতে বেরোনো একেবারেই অপছন্দের মৌসুমীদেবীর নেহাতই নাতির মন রাখতে ঘুরতে আসা।


রাঁচিতে প্রথম দিন...


প্রথম দিনটা কাটল বিশ্রামের মধ্যেই। তোতন দিদা বলতে অজ্ঞান। দিদার সাথেই ওর যত কথা। সন্ধ্যা বেলায় বড়মেয়ে মৌমিতা ও জামাই সুকল্যাণ কে পাঠিয়ে দিলেন আসে পাশের জায়গাগুলি একটু দেখে আসার জন্য সর্বোপরি একটা তো গাড়ির বন্দোবস্ত করতে হবে। তিনটি দিনের ঘোরার ব্যাপার ও রয়েছে। সুযোগ বুঝে তোতন ওর পিঠের ব্যাগটা থেকে লুডোর বক্সটা বের করে ফেলে। একটা নিষ্পাপ আবদার আসে আদরের নাতির কাছ থেকে,


-- " দিদুন লুডো খেলো না। ও দিদুন। "


না করতে পারলেন না দিদুন। খেলতে খেলতে বেশ অনেকটা সময় হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ দরজায় টোকা মারার শব্দ। তোতন গিয়ে দরজা খুলতেই দেখা যায় গুরবিন্দর এর হাসি মুখটা।


-- " মাম্মি জি সব ঠিক ঠাক হ্যা না। "

হেসেই মাথা না নাড়লেন মৌসুমীদেবী।


-- " সোচা কি আপকি সাথ থোরা বাত করু। "


হিন্দিটা তেমন বলতে না পারলেও ভালোই বোঝেন মৌসুমী সেন। হাত নেড়ে গুরবিন্দরকে ভিতরে আসতে বললেন। শুরু হল এদিক ওদিকের কথা। কথায় কথায় জানা গেল কলকাতার সাথে গুরবিন্দর এর একটা বহু পুরোনো সম্পর্ক হয়েছে। বলা যেতে পারে গুরবিন্দরের ছোটবেলার রঙিন দিন গুলো কলকাতার বুকেই কেটেই। কলকাতার প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে মাঝে মাঝেই খেই হারিয়ে ফেলছিল গুরবিন্দর। বেশ বোঝা যাচ্ছিল গুরবিন্দর নস্টালজিক হয়ে পড়ছে মাঝে মাঝে ওর চোখ দুটি ছলছল করছে আবার সেটিকে সুকৌশলে মুছেও নিচ্ছে।


গুরবিন্দরের কথায় জানা যায় ওর মামাবাড়ি কলকাতায় শ্যামবাজার এলাকায়। বাবা ট্যাক্সি চালাতেন, তাই ছোটবেলাটা মামাবাড়ির অনতি দূরেই এক ভাড়া বাড়িতেই কেটেছে ওর। হঠাৎ একদিন এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনার জেরে বাবা মারা গেলেন। সেইসময় গুরবিন্দর আর ওর মায়ের খুবই করুন পরিস্থিতি। মামাবাড়িতে তখন দুই মামা ও ওনাদের সংসার। ওনাদের উপার্জন এমন কিছু ছিল না যে আরও দুইটি প্রাণীকে তারা সংসারে আশ্রয় দেবেন। কাজেই গুরবিন্দরের মা লোকের বাড়িতে কাজ করা শুরু করেন। খুব কষ্ট করে মানুষ হয়েছে গুরবিন্দর তাই টাকার মূল্য খুব ভালো ভাবেই বোঝে ও। জীবন ওকে একটা চরম শিক্ষা দিয়েছিল, ভালোভাবে বাঁচতে গেলে টাকার দরকার। টাকা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই।


কোনোক্রমে বারো ক্লাস পাস করেই ভাড়ার ট্যাক্সি চালাতে শুরু করে গুরবিন্দর। ধীরে ধীরে মাকে কর্ম মুক্তি দেয়। ভগবানের দূত হিসেবে গুরবিন্দরের জীবনে আবির্ভাব হয় ওর এক দুর্সম্পকের কাকা এর। উনিই গুরবিন্দর এবং ওর মাকে রাঁচিতে নিয়ে আসেন। গুরবিন্দর কে হোটেলের কাজ সেখান নিজের হাতে। গুরবিন্দর একজন মিষ্টভাষী ছেলে সাথে বেশ বুদ্ধিমান ও বটে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে হোটেলের সমস্ত কাজ শিখে ফেলে ও। কেটে যায় বেশ কয়েকটা বছর। ইতিমধ্যে কাকাও মারা যান। কাকার উত্তরসূরী একজন কাজের ছেলে গুরবিন্দরকেই হোটেলের ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করেন "শান্তিপ্রিয়া ইন " এর মালিক। মালিক থাকেন অন্যত্র। গুরবিন্দরই সমস্ত হোটেলটি চালায়।


গুরবিন্দরের জীবনের কাহিনী শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলেন মৌসুমী দেবী। একটা সময় মৌসুমী দেবীর ও কম অভাবে কাটেনি। সাতজনের সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য। সারাদিনের কাজ মা এতটাই ক্লান্ত থাকতেন যে ছেলেমেয়েদের মানুষ করা ওনার পক্ষে অসম্ভব ছিল। বাড়ির বড়মেয়ে হিসেবে ভাই বোনদের সুখ,দুঃখ, আনন্দ, আবদার পূরণের দায়িত্ব নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিলেন মৌসুমীদেবী। নিজের হাতে মানুষ করেছেন প্রত্যেকটি ভাইবোনকে। জীবনযুদ্ধের মানেটা ভালোই বোঝেন মৌসুমী দেবীও। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে মৌমিতা ও সুকল্যাণ। কথায় কথায় এত রাত খেয়ালই নেই কারুর। গুরবিন্দরের জীবনের গল্পটা এতটাই মনোমুগ্ধকর যে ছোট্ট তোতন ও হাঁ করে গিলছিল।


মৌমিতা বলল,


-- " মা গাড়ি বুকিং হয়ে গেছে। কাল সকাল সাতটায় আসবে। "


গুরবিন্দর জিজ্ঞেস করল,


-- " কাল কিধর যা রহে হে অপলোগ। "


মৌমিতা এতক্ষন খেয়ালই করেনি গুরবিন্দরকে।


-- " ও আপ ! "

-- " একচুলি, মাম্মি জি একেলি থি তো ম্যায় নে সোচা থোরা বাত কর লু। আপলোগ ভি নেহি থে.. "


-- " ওহঃ ঠিক হ্যা কোয়ি বাত নেহি। " হেসে উত্তর দেয় সুকল্যাণ।


-- " ডিনার কে কুচ চাহিয়ে তো বলিয়ে ম্যায় আভি ভেজ দেতা হুঁ। "


-- " নো থাঙ্কস !"

গুরবিন্দর চলে যেতেই মৌমিতা, মৌসুমীদেবীকে বলল,


-- " মা একটু সাবধান। বেশী কথা বলোনা ওনার সাথে। আমার কিন্তু ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। এত গায়ে পড়ে আলাপ... "


-- " আহঃ মিতু মনটাকে পরিষ্কার কর। সন্দেহ করার বাতিকটা যেন তোমার রক্তে মিশে গেছে। জানিস গুরবিন্দর কত কষ্ট সহ্য করে বড় হয়েছে, জীবনে কি কি করেছে?"


-- " মা আমার জানার কোনো ইচ্ছা নেই। তুমি তোমার গুরবিন্দর কে নিয়েই থাক। আমি এবং পলি তো কেউ নয়। "


এরকম ছোটোখাটো তর্কাতর্কি মা এবং মেয়ের মধ্যে হয়েই থাকে আবার মুহূর্তে ঠিক ও হয়ে যায়। মেয়ের কথায় একটু মুচকি হেসে মৌসুমী দেবী সুকল্যানকে বললেন,


-- " দেখলে তোমার বৌ এর ছেলেমানুষি। নিজের ছেলে মানুষ করছে এদিকে ভিতরের ছেলেমানুষি এখনও কাটলো না। "


মৌসুমীদেবীর কথা শুনে তোতন ও সুকল্যাণ বাবু হেসে উঠলেন। মৌমিতা জড়িয়ে ধরল মা কে। দুই মেয়েই মাকে খুব ভালোবাসে। ছোট মেয়ে পলি ওরফে ঈপ্সিতা বর্তমানে কানাডায় চাকুরীরত, আর বড় মেয়ে মৌমিতা একজন ব্যাঙ্ক কর্মী। বড়জামাই সুকল্যাণ স্কুল শিক্ষক, কাজেই শাশুড়ির সাথে খুব ভাব। ভালোবাসায় ঘেরা একটি ছোট্ট সুখী পরিবার।


প্রথম দিনে মন মাতানো তিনটে জলপ্রপাত সীতা, জোনা এবং হুড্রু দেখলেন দু চোখ ভরে। বিশেষ করে হুণ্ড্রু জলপ্রপাত। যদিও শতাধিক সিঁড়ি নামা ওঠা এই বয়সে খুবই কষ্টকর কিন্তু ভগবানের আশীর্বাদে মৌসুমীদেবী এখনও ঠিক যৌবনের মতোই প্রাণচঞ্চল। পথে যেতে যেতে দেখলেন ছত্তিশগড় এর সেই গহন অরণ্য, যেখানে শ্রী রাম, সীতা এবং লক্ষণসহ এসেছিলেন বনবাসের জন্য। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দিদার শাড়ির ভাঁজে মুখ ঢুকিয়ে তোতন জিজ্ঞাসা করল,


-- " দিদুন রাম কেন গেছিলো বনবাসে ? "


 সারাটা দিন নাতির সাথে রামায়ণের গল্প করেই কেটে গেল দিদুনের। মাঝে শুধু একবার থেমেছিলেন হুড্রু জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে। কি অপরূপ মুগ্ধতা ! প্রকৃতির সৃষ্টি বড়ই অদ্ভূত ! জীবনের সমস্ত স্মৃতিগুলো যেন ধুয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়েছিলেন মৌসুমী দেবী। মনে ক্ষনিকের জন্য ভেসে উঠেছিল প্রদ্যুৎ বাবুর হাসি মুখটা, ঝাপসা হয়ে গেছিল দৃষ্টি।


আচমকা সম্বিত ফেরে নাতির চিৎকারে।


-- " দিদুন এসো। ছবি তুলবো। "


ক্যামেরা বন্দী করলেন কিছু মুহূর্তকে। শরীরের যা পরিস্থিতি আর হয়ত ঘুরতে যেতে পারবেন না। তাই রাঁচির মুহূর্তগুলোকে স্মরণীয় করে রাখতে চান মৌসুমী দেবী।


রাতে হোটেলে ফেরার পর শুরু হয় প্রচন্ড গা হাত পা ব্যাথা। রিসেপশনে কল করতেই ওষুধ নিয়ে ছুটে আসে স্বয়ং গুরবিন্দর। সত্যিই অদ্ভূত ! গুরবিন্দর তো রিসেপশনে ছিল না। তাহলে কিভাবে ও জানলো মৌসুমীদেবীর অসুস্থতার কথা। ব্যাপারটা এখন সুকল্যাণের চোখেও সন্দেহজনক ঠেকছে কিন্তু উনি কিছু বললেন না। মৌমিতা মাকে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছিল। পাশেই দাঁড়িয়েছিল গুরবিন্দর, হঠাৎ বলে উঠল সুকল্যাণকে উদ্দেশ্য করে,

-- " স্যার, মুঝে তো একবার বোল সাকতে থে। ইতনা ছোটা গাড়ি কোয়ি লেতা হ্যা ক্যায়া। জাহিরসি বাত হ্যায়, দার্দ তো হোগাহি। "


একদম মনের কথাটাই বলেছে গুরবিন্দর। আজকের গাড়িটা সত্যিই খুবই ছোট ছিল। মৌমিতার সাথে সুকল্যাণের এ ব্যাপারে রাস্তায় দুই একবার কথা কাটাকাটি ও হয়ে গেছে। "কিন্তু এত রাতে গাড়ি বুকিং করবে কিভাবে , কাল অনেক দূরের যাত্রা সেই নেতারহাট" মনে মনে চিন্তা করতে থাকে। চিন্তাহরণ গুরবিন্দর একটা আশ্বাসবাণী দিল,

-- " টেনশন করনেকা কোয়ি বাত নেহি। মেরা গাড়ি হ্যায় না। মাম্মি জি কে লিয়ে ইতনা কর হি সাকতা হুঁ। ম্যায় আজ হি বোল দেতা হুঁ ড্রাইভার কো সুবাহা সাত বাজে, ঠিক হ্যায় স্যার "


সত্যিই অনেকটা চিন্তামুক্ত হল সুকল্যাণ। শুধু শুধুই মানুষটাকে খারাপ ভেবেছিলো এতক্ষন ধরে। এরজন্য নিজের মনটাকেই দু তিন ধমকে নিল সুকল্যাণ।


সকালে সবাই রেডি। কালো টাটাসুমো শান্তিপ্রিয়া এর গেটের সামনেই অপেক্ষারত। গুরবিন্দর এর দেওয়া মলমটা অব্যর্থের মত কাজ করেছে। শরীরের সব ব্যথা বেদনা যেন ম্যাজিকের মত গায়েব হয়ে গেছে। গাড়িতে অপেক্ষা করছে চারজন। সুকল্যাণ গাড়ির ড্রাইভারকে বললেন,


-- " ভাইয়া সব লোগ তো আ গ্যায়ে, চলিয়ে। "


-- " স্যার রুখনে কে লিয়ে বোলা হ্যায়। "


-- " কিউ!"


মৌসুমীদেবীদের অবাক করে গাড়িতে উঠে বসে গুরবিন্দর।


-- " চলো অব "


পিছনের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে গুরবিন্দর বলে ওঠে,


-- " সরি মাম্মি জি, বেহেন জি, সরি স্যার। মাফি চাহতাহু। আজ আপ লোগো কে সাত ম্যায় যা সাকতা হুঁ কেয়া? উহা পার গ্যায়ে হুয়ে বহুত মাহিনা হো গ্যায়ে। সোচা কি আপকি সাত হি থোরা ঘুম লু।"


কালকের পর থেকে ওদের সবার মনেই গুরবিন্দর পাকাপোক্তভাবে জায়গা বানিয়েছিল। তাই কেউই আপত্তি করলেন না বিশেষ। তোতনকে পাশে বসিয়ে গল্প শুরু করল গুরবিন্দর। অবাক হয়ে মৌসুমী দেবী জিজ্ঞেস করলেন,


-- " গুরবিন্দর তুমি বাংলা ও জান। "


-- " জাদা নেহি থোরা থোরা। "


সেই দিনের ঘুরতে যাওয়াটা সত্যিই স্মরণীয় হয়ে থাকবে ওদের জীবনে। হোটেলের ব্যবসার পাশাপাশি ওকে একজন দক্ষ ট্যুর গাইড বলা যেতেই পারে। প্রত্যেকটি জায়গার ইতিহাস, সম্পকিত তথ্য, ওখানকার খাবার দাবার সমস্ত গড় গড় করে বলে যাচ্ছিল আর যাত্রী চারজন শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল ওর কথা। সানরাইজ পয়েন্টের নান্দনিক সৌন্দর্য, কোয়েল ভিউ পয়েন্ট এর নিস্তব্ধতা, নেতারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাহাত্ম্য, আপার ঘাগড়ির জঙ্গলঘেরা পরিবেশের মহিমা যেন এক আলাদা মাত্রা পেয়েছিল গুরবিন্দরের বর্ণনায় এবং সর্বোপরি সানসেট পয়েন্ট এর ওই ঘোড়া সহ ছেলে-মেয়ে দুটির ইতিহাস শুনতে শুনতে দুচোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল মৌমিতা ও মৌসুমীদেবীর। কিভাবে প্রেমের জন্য ওরা দুজনেই নিজের জীবন শেষ করে দিয়েছিল দেখাদেখি ঘোরাটাও ঝাঁপ দিয়েছিল ওই সুউচ্চ পাহাড় থেকে। উফঃ জাস্ট ভাবা যায়না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেকটাই রাত হয়ে গিয়েছিল। ফেরার ট্রেন পরের দিন রাতে। মৌমিতা দের প্ল্যান ছিল পরের দিন সকালে কাছাকাছি কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে নিয়ে একেবারে স্টেশনে চলে যাওয়া তবে দুদিনের জার্নি তে ওরা সবাই ক্লান্ত পড়েছে। তাই বাতিল করতে হল ঘুরতে যাবার প্ল্যানটা।


দুপুরের লাঞ্চটা অফার করল গুরবিন্দর নিজের পক্ষ থেকে। এমনিতে নিরামিষ খাবার তেমন পছন্দ করেন না সুকল্যাণ। কিন্তু এই পনির বাটার মসলা, খাবার যে অমৃত। বেশ অনেকটাই করেই ভাত খেয়ে নিয়েছিল সকলে। ব্যাস নিদ্রাদেবীর আগমন অবসম্ভাবী। ঘুম ভাঙার পর মৌমিতা আঁতকে উঠেছিল। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে সাতটা, সাড়ে নয়টায় ট্রেন। মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে দেখে দরজা খোলা মৌসুমীদেবী নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। "সত্যি মা এর যে কি ভীমরতি হয়েছে না!" মেয়ের কর্কশ চিৎকারে ধরপরিয়ে ওঠেন উনি। কিন্তু ওনার যতদূর মনে পড়ছে দরজা আটকেই শুয়েছিলেন। যাইহোক এত ভাবার সময় নেই এখন বেরোতে হবে।


ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে এমনসময় মাথায় যেন বাজ পড়ল মৌসুমীদেবীর। "টাকার ব্যাগ টা তো ফেলে এসেছেন হোটেলেই।" মৌমিতা যথারীতি চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। সুকল্যাণ খুঁজতে থাকেন "শান্তিপ্রিয়া ইন" এর নম্বরটা। আবার ও সবাইকে চমকে দিয়ে আবির্ভাব হয় গুরবিন্দর। দৌড়োতে দৌড়োতে এসেছে বোঝায় যাচ্ছে, সারা শরীর ঘামে ভেজা। হাঁপাতে হাঁপাতে গুরবিন্দর বলল,


-- " মাম্মি জি আপকা পার্স। গুরুজী কা কৃপা হ্যায়। আপ লোগ কো ঢুন্ড লিয়া। বাই বাই মাম্মি জি। হ্যাপ্পি জার্নি। "


সেদিন গুরবিন্দরকে ছেড়ে আসতে ওনাদের সবারই বিশেষ করে মৌসুমী দেবীর খুবই কষ্ট হয়েছিল। আজ প্রায় দু মাস পরে গুরবিন্দর নামটা শুনে রাঁচি ভ্রমণের স্মৃতিটা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল মনে।


-- " বল গুরবিন্দর। কেমন আছ? মনে পড়ল মাম্মি জি এর কথা। " অভিমানী সুরেই জবাব দিলেন মৌসুমীদেবী।


-- " ইয়ে ক্যায়া বোল রহি হে আপ। আপ মেরে দিল হো হরওয়াক্ত। এক কাম থা। শান্তিপ্রিয়া হোটেল কা এক ফিডব্যাক ফর্ম আপকো ভেজ রাহা হুঁ। আপ সির্ফ একসেপ্ট কর লে না। ঠিক হ্যায়!"


-- " অত শত বুঝিনা বাপু। কি বললে ফিডব্যাক..!"


-- "কচ্ছু না আপনি শুধু একসেপ্ট করে দিবেন ব্যাস।"


-- " ওহঃ আচ্ছা ঠিক আছে। "


গুরবিন্দর ফোন কাটার তিনবার মেসেজ এসেছিল। ওই তিনবারই একসেপ্ট করেছিলেন মৌসুমীদেবী। তিন মিনিট পরে তিনটি মেসেজ আসে। মৌসুমীদেবী প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারেন নি। পরে মেয়েকে দেখালে জানতে পারেন আর্থিক ক্ষতির পরিমান। তিন বার ত্রিশ হাজার করে নব্বই হাজার টাকা খোয়া গেছে। শত চেষ্টা করেও মৌসুমীদেবীকে বিশ্বাস করানো যায়নি টাকাটা গুরবিন্দর সরিয়েছে। পরে পুলিশ মারফত খোঁজ নিয়ে দেখা যায় "শান্তিপ্রিয়া ইন" এ গুরবিন্দর নামের কেউ ছিলই না। যে লোকটা গুরবিন্দর নামের মুখোশ পড়েছিল তাকে আর কোনোদিনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।


Rate this content
Log in

More bengali story from Pradipta Bhattacharya

Similar bengali story from Crime