Tathagata Banerjee

Horror

2.8  

Tathagata Banerjee

Horror

নিশিরাত ভয়ঙ্কর

নিশিরাত ভয়ঙ্কর

11 mins
1.9K


কলকাতার ভাড়া বাড়িটার একফালি ঘরের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে জীবনের পট পরিবর্তনের ফলে মাত্র পঁচিশ বছর বয়েসেই একে একে বোন, মা ও অবশেষে বাবাকে হারিয়ে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়লাম। অতীতের আনন্দে মাখা উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো জলে ভেজা চোখের পাতায় স্বজন হারানোর ব্যাথার মোড়কে এক একটা উত্তাল ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়তে লাগলো বিনা বাধায়।

 

জীবনটা বেশ সুন্দর ও স্বচ্ছল ছিল আমাদের। বাবা ছিলেন রায়পুর জমিদারী এস্টেটের অধীনস্ত ডাক্তার, বাড়িতে বাবা, আমি-বোন আর মা নিয়ে ছিল আমাদের সুখের সংসার। বাবা আর মায়ের স্নেহাশিসে দুঃখ দেখতে হয়নি সে সব দিনে। কিন্তু, সময়ের কালচক্রের বিধানে আবদ্ধ মানুষের জীবনে যতটা না সুখ তার চেয়েও কয়েকগুন বেশি কষ্ট লেখা থাকে। তাই বোধহয় কালের নিয়মেই, এক সময় আমাদের সুখের সংসারেও নেমে এলো চূড়ান্ত বিষাদের ছায়া। গঙ্গা নিকটবর্তী রায়পুর গ্রাম; মা গঙ্গার অভিশাপে এক রাতে বন্যা বিদ্ধস্ত হলো গ্রাম সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। জলের তোড়ে একে অপরকে বাঁচানোর চেষ্টার মাঝেই, আমার হাত ফসকে কিভাবে যেন ভেসে গেল বোন।

 

দুর্ভেদ্য অন্ধকার রাত, উন্মাদ জলস্রোত ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় হাজার সন্ধানেও মিললো না তার বেঁচে থাকার কোন খবর! সকল আশার আলো হৃদয় অন্তরেই নিভে গেল এক সময়। ক্ষতিগ্রস্ত বন্যা কবলিত অঞ্চলের সহস্রাধিক বুভুক্ষু মানুষ ঘটি-বাটি হারিয়ে সহায় সম্বলহীন হয়ে আশ্রয় পেল সেনা নির্মিত ক্যাম্পে। চিকিৎসা আর ক্ষাদ্য সঙ্কটের মাঝেই হাজার হাজার অস্থায়ী ক্যাম্পে আছড়ে পড়লো মড়ক, কলেরার প্রকোপে বন্যার কবল হতে কোনোক্রমে বেঁচে যাওয়া জীর্ণ-শীর্ণ মানুষগুলো মৃত্যুর মুখে রুখে দাঁড়াতে অক্ষম হয়ে পড়ল; নিদারুণ রোগ ভোগে একে একে ঢলে পড়তে লাগলো মৃত্যু মুখে, সেই দলে শামিল হলেন আমার মা। বাবা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি, নিজের চিকিৎসা শাস্ত্র উজাড় করে দিয়েছিলেন মায়ের সেবায়, কিন্তু ভাগ্য বিধাতা অপ্রসন্ন ছিলেন, অতএব যা হবার তাই হলো।

 

পর পর জোড়া ধাক্কায় বাবাও কেমন দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন, তবু, বাঁচার তাগিদে, অনেক কষ্টে খুঁজে পেতে কলকাতাস্থিত বন্ধু ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হলেন। ঘোরতর বিপদের দিনে আমার বাবার বন্ধু ভগবানের রূপ হয়ে আমাদের পাশে দাড়ালেন আর অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পের পাতলা টিন ঘেরা ঘর, ছেঁড়া বস্তার লজ্জা আভরণ ও পুতিগন্ধময় স্থানকে পেছনে ফেলে বাবা-ছেলের আশ্রয় হলো পাকা ছাদের তলায় শহর কলকাতার নিরাপদ এক আস্তানায়। বাবার বন্ধু অর্থ সাহায্যও করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাবা নিতে চাননি একান্ত শোধ যদি না করতে পারেন, বন্ধু ঋণ, সেই ভয়ে। সেই থেকে আজ বারো বছর শহরের বুকে হাজার অস্বচ্ছলতায়, আর্থিক টানাপোড়েনে কষ্ট করে হলেও কাটিয়েছি জীবন। কোনোমতে দিন গুজরান করার জন্য আমার কপালে জুটেছিল, একটা কারখানায় ঠিকা শ্রমিকের চাকরী, বাবার বন্ধু ব্রজেশ্বর বাবু’র তদ্বিরে। ইতিমধ্যে কবে যে কর্কট রোগ বাবার ছাতির গভীরে বাসা বেঁধেছিল তা বুঝে উঠতেই পারিনি। অবশ্য বুঝলেও কিছু তো করতে পারতাম না। সে যে রাজ রোগ আর আমরা তো দীন-দরিদ্র! না শহরে এসেও ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হননি। বাবার ডাক্তারির পসার কলকাতার বুকে জমেনি, আর তাই রোগের ব্যায়ভার টানার মত কোন সম্বলই ছিল না আমাদের, শেষের দিনগুলোতে বাবাকে দেখেছি, নিদারুণ কষ্ট পেতে! বেদম কাশির ঝলকে উঠে আসা বিষাক্ত রক্তধারা আমার একমাত্র নির্ভরতার আশ্রয়টাও কেড়ে নিয়ে আমায় অনাথ করে দিল।

 

নিজের অজান্তেই মনের মাঝে কালো ঘন মেঘের মত জমে থাকা স্বজন হারানোর ব্যাথা স্নিগ্ধ বর্ষা ধারায় রূপান্তরিত হয়ে কখন যেন নিঃশব্দে আমার তপ্ত বুকের ছাতি ভিজিয়ে দিয়েছে খেয়াল করিনি, যেমন খেয়াল করিনি, দুপুর গড়িয়ে কখন চারিপাশে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসে তার নিকষ কালো অন্ধকারে আমায় ঘিরে ফেলেছে। আজ তো ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপটা দেবার কেউ নেই। বাপ – ছেলের সংসারে এই ব্যাপারটা বাবা করতেন নিয়ম করে। কিন্তু, সদ্য শ্মশান ফেরত আমি ছাড়া আজ পুরো ঘরে-বাইরে পরিপূর্ণ শূন্যতা বিরাজ করছে।

এমনি সময়, ঘরের বাইরে উঠোন হতে আমাদের বাড়িওলা ও বাবার বন্ধু নিধু জ্যাঠা ওরফে ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গলা খাঁকারির আওয়াজ ভেসে এলো সেই সাথে স্বভাবসিদ্ধ হেঁড়ে গলায় হাঁক দিলেন “সমু বাবা ঘরে আছো নাকি? উঃ! এত অন্ধকার কেন?” নিঃসন্তান ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী যেদিন থেকে ওনাদের আশ্রয়ে এসেছিলাম, সেদিন থেকেই আমায় স্নেহের আঁচলে আবদ্ধ করেছিলেন।

 

এই দম্পতী এ তল্লাটে ভালমানুষ বলেই পরিচিত কিন্তু ভদ্রলোক যেমনি কিপটে আর কড়া ধাতের মানুষ তাঁর স্ত্রী তেমনি উদার প্রকৃতির। এখন ওনার ডাকে আমি সারা দেবার আগেই নিধু জ্যাঠা হাতে একটা লন্ঠন ঝুলিয়ে খড়ম খটখটিয়ে আমার নিকষ অন্ধকার ঘরের প্রান্তে এসেই বলে উঠলেন “দেখেছো রমা ছেলের কান্ডো দেখো! ভর সন্ধ্যেবেলা এইরকম পরিস্থিতে অন্ধকার ঘরে কেমন একা বসে আছে!” এই বলেই জেঠিমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকে এলেন আর আমায় উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন;

“সত্যি করে বলতো বাবা সমু এত বছরে কি এতটুকু অধিকার বোধও উদয় হয়নি তোমার আমাদের প্রতি? একবার তো ডাকতেও পারতে ঘরে ফিরে? তুমি পারো বটে, ইস! মুখটা শুকিয়ে গেছে দেখছি, একটা দানাও তো পেটে পড়েনি, তা পড়বেই বা কি করে! এখন তো আবার সাধারণ খাবার চলবে না তোমার!” আর তার পরই গলা সপ্তমে উঠিয়ে তিনি হাঁক পাড়লেন “হবিষ্যির চাল-ডাল-সবজীগুলো ওকে দেরে সত্য! আরে কোথায় গেলি রে পোড়ামুখো ত্যাঁদড়!”

 

তাঁদের অল্প বয়সী বিহারী বামুন ঠাকুর বেচারা সত্যকাম মিশ্র, বাইরে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, নিধু জ্যাঠার গলার আওয়াজে আরো দ্বিগুণ জড়োসড়ো হয়ে আধো অন্ধকার ঘরে ঢুকে, এদিক – সেদিক ভীরু চোখে তাকাতে তাকাতে আমার দিকে চাল ও সবজী এগিয়ে দিয়েই তার নিজের বেঁটে পৈতেখানা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে ধাঁ করে ঘরের বাইরে প্রস্থান করলো। সেই দেখে জ্যাঠা বলে উঠলেন “এ হতচ্ছাড়ার আবার কি হলো, অমনধারা হাউই বাজির মত বেড়িয়ে গেল কেন?” জ্যাঠাবাবু আশ্চর্য হলেও আমি বা জেঠিমা সত্যকামের অমনধারা আচরণে কিছুমাত্র বিচলিত হলাম না! কারণ আমরা দুজনেই জানতাম, সত্য বাবুর ভূতের ভয় মারাত্মক। তায় আবার, ও আমার বাবাকে বেশ ভয় পেত জীবিত কালে, আর এখন তার সেই ভয় শত গুণ উর্ধ সীমায় পৌঁছেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

 

রমা জেঠিমাদের দিয়ে যাওয়া চাল আর সবজী ফুটিয়ে কোনোমতে দুটোখানি হবিষ্যি রেঁধে, কিছুটা গলাদ্ধকরণ করে উঠোনের কোণে আঁচিয়ে নিজের ঘরে যাবার উদ্যোগ করছি ঠিক এমনি সময়, আবছা অন্ধকারে নিধু জ্যাঠাদের ওপর তলায় যাবার সিঁড়ির দিকে আমার নজর আটকে গেল; দেখলাম ওই সিঁড়ির গোড়ায় কেউ যেন একটা দাঁড়িয়ে, মনে হল গড়নটা অনেকটা আমার বাবার মতই, শরীরটা হাল্কা শিরশির করে উঠলেও মনটা কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে পড়লো! ঠিক দেখছি না ভুল বুঝে ওঠার আগেই, অন্ধকারে মিশে থাকা সেই শরীর যেন হাওয়ায় ভর দিয়ে কিছুটা আমার দিকে অগ্রসর হল, আর ওই আবছা অন্ধকারে মিশে থাকা অবয়বে দুটো দীপ্তিময় মর্মভেদি নীলাভ চোখ আমায় প্রচন্ড আকর্ষিত করতে লাগলো। ততক্ষণে ষষ্ট ইন্দ্রিয় সক্রিয় হয়ে উঠে আসন্ন বিপদের সম্ভাবনা জানান দিতে শুরু করেছে তবুও মন চাইছে এক ছুটে গিয়ে আবছা অন্ধকারে মিশে থাকা শরীরটাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করতে কিন্তু আমার মনের সেই প্রবল ইচ্ছেটাকে প্রবলতর ভাবে বাধা দিচ্ছে আমার মস্তিষ্ক। বুদ্ধি ও আবেগের টানাপোড়েনে ও নীলাভ সেই চোখ দুটোর আকর্ষন মিলেমিশে ততক্ষণে আমার ঘোর লেগে গেছে তারই মাঝে উপলব্ধি করলাম আমার পা দুটো কেমন করে যেন গাছের শক্ত গুঁড়ির মত প্রচণ্ড ভারী হয়ে মাটির মধ্যে গেঁথে রয়েছে যার ফলে চলৎশক্তি রহিত হয়েছে আর আমার সারা শরীর ধীরে ধীরে ঘামে ভিজে উঠছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে, বড় অসহায় লাগছে নিজেকে।

 

ওই আবছা অন্ধকারে মেশা ততোধিক কালো ধোঁয়াবৃত মূর্তিটা কি সত্যিই আমার বাবার সূক্ষ রূপ নাকি এ কোন দুষ্ট আত্মা অনিষ্ট সাধনে উদ্যত; তা বোঝার মত মনের অবস্থা আমার ছিল না, হিতাহিত বাহ্যজ্ঞানশূন্য আমি নিদারুণ কম্পিত মনে বিস্ফারিত চোখে দেখছি ক্রমবর্ধমান সেই আবছা অশরীরী আরো সন্নিকটে এসে পড়েছে, হাজার হাজার কীট-পতঙ্গ কিলবিল করছে সেই জমাট বাঁধা, কালো দূর্গন্ধময় ধোঁয়াময় অশরীরী শরীরের ভাঁজে ভাঁজে, বেশ বুঝতে পারছি তার আকর্ষণ ক্ষমতা ভেঙে দিচ্ছে আমার মানসিক সচেতনতা, বোধ শক্তি লুপ্ত প্রায়, আমার আশপাশে একটা কটু বীভৎস চামড়া আর অস্থি পোড়া গন্ধ বাতাসকে অসম্ভব ভারী করে দিতে শুরু করেছে আর কয়েক মুহূর্ত তারপরই গাঢ় ধোঁয়ার কুণ্ডলী আ-আ-আ-আমায় গ্রাস করবে সম্পূর্ণ ভাবে, প্রচণ্ড তাপ আমার শরীরের চামড়ায় অনুভূত হচ্ছে, যেন মনে হচ্ছে নারকীয় চিতার আগুনে ঝলসে যাব এবার, বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই। অজান্তেই কখন আমি নিজের অবচেতন মনে ইষ্ট নাম জপ করতে শুরু করেছি বুঝতে পারিনি!

 

“জয় হনুমান জ্ঞান গুণ সাগর।

জয় কপীস তিঁহু লোক উজাগর।।

রাম দূত অতুলিত বল ধামা।

অঞ্জনি পুত্র পবন সূত নামা।।...”

 

আর সেই জপই ধ্বন্বনতরির মত কাজ দিল কিনা কে জানে, সিঁড়ির গোড়ায় শুনতে পেলাম নিধু জ্যাঠার খড়ম পরা পায়ের শব্দ, উনি নেমে আসছেন নীচে এই অসম বিপদে আমার পরিত্রাতা হয়ে, সাথে সাথেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী শত ভাগে বিভক্ত হয়ে মিশে গেল ঘন অন্ধকার রাতের মায়াজালে। ভয়ে বিহ্বল আমি নিস্তেজ কাটা কলা গাছের মত ধপ করে বসে পড়লাম ঘরের দাওয়ায় কোনোমতে। নিধু জ্যাঠা, সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেই আমায় ওভাবে ঘর্মাক্ত কলেবরে বসে থাকতে দেখে চমকিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন “ একি! সমু কি হয়েছে বাবা? এভাবে বসে আছো কেন?” আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বলতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না, আমার মনের ভয়টা আমার গলার স্বরকে বিকৃত করে এক অদ্ভুত গোঙানির শব্দ করে থেমে গেল।

উনি পণ্ডিত ব্রাহ্মণ আমার ভয়ে বিহ্বল অবস্থা দেখেই হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন আমার কি হতে পারে এবং তৎক্ষণাৎ আমার উদ্দেশে বললেন, “ভয় নেই বাপ, আমি তো আছি তোমার কিচ্ছু হবে না! এই রকম সময় একা তো থাকতে নেই বাবা, তোমায় বললুম আমাদের সাথে ওপরে থাকবে এসো! কিন্তু, তুমি তো শুনলে না! অতএব, আজ থেকে প্রতি রাত্রে আমিই বরং তোমার সাথে থাকবো মনঃস্থির করেছি, তোমার জেঠিমার ও সেই একই মত। চল বাবা অনেক রাত হল, এবার শুতে চলো।” এই বলে উনি পরম স্নেহের সাথে আমার হাত আকর্ষণ করে তুলে ধরে ঘরে প্রবেশ করলেন।


সেদিনের ওই ঘটনার পর আর কিছু অঘটন ঘটেনি প্রতক্ষ্য ভাবে; তাই নানা রকম ব্যস্তস্তার মধ্যে দিয়ে ঘটনার প্রচণ্ডতা হ্রাস পেতে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে, এদিকে নিধু জ্যাঠার তত্ত্বাবধানে প্রায় নির্বিঘ্নেই ঘাট কাজ, শ্রাদ্ধ ও নিয়মভঙ্গের পালা সাঙ্গ হলো। জীবন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এলো, আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো হৃদয়ের অন্তরালে গোলাপ কাঁটার মতো বিঁধে রইলো। ইতিমধ্যে এদিকে শহরে শীতের ছোঁয়া লেগেছে, কুয়াশার চাদর গায়ে কর্মব্যস্ত শহরের চেনা ছবিতে পট পরিবর্তন বিশেষ লক্ষনিও। বেলা ছোট ও রাত বড়। বৃদ্ধ নিধু জ্যাঠা একতলার স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়ছিলেন সেকারণে আমার বিশেষ পিড়াপিড়িতে একান্ত বাধ্য হয়েই তাঁকে দোতলায় তাঁর নিজের ঘরে প্রত্যাগমন করতে হলো আর তাঁর ফল স্বরূপ কপাল পুড়লো মন্দকপাল সত্যকামের। নিধু জ্যাঠার কড়া হুকুমে তার জায়গা হলো আমার ঘরে, প্রতি রাতের পাহারাদার হিসেবে থাকতে যে তার বিপুল আপত্তি তা বেশ বোঝা যেত! কিন্তু, জ্যাঠা মশয়ের হুকুমের অসম্মান করতেও সে পারেনি।

নিয়তীর খেলা বোঝা বড় দায়। আজ নিয়ে দিন দুয়েক হলো আমি আর সত্যকাম একসাথে শুচ্ছি, একতলার ঘরে, কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি, আমার সাথে সাথে সত্যর ভয়ও কিছুটা কেটেছে বোধহয়। এখন মাঝ রাত, হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল, একটানা একটা হুঁ হুঁ শব্দ আসছে মনে হচ্ছে যেন কাছেই কোথা থেকে, অনেকটা মনে হচ্ছে কেউ যেন কষ্ট করে হাঁফ নিচ্ছে আর কাশির বেগ সামলাচ্ছে। মনে পড়ে গেল এভাবে তো বাবা...।


কিন্তু, এখন বাবা কোথা থেকে আসবে! লক্ষ করলাম, অন্ধকার ঘরে শুধু আমিই জেগে নেই, সত্যও কখন ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে, আর উৎকর্ণ হয়ে শব্দটার উৎস কোন দিক থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করছে। এবার আমিও নিঃশব্দে উঠে বসলাম, তক্তপোষের ওপর! আর ঠিক তখনই, উঠোনের দিক থেকে আমাদের ঘরের দরজার বাইরে থেকে অস্পষ্ট অথচ খানিকটা কর্কশ রুক্ষ স্বরে কে যেন বলে উঠলো, “খোকা দরজাটা খোল বাবা! একটু জল দে বাবা... বড় কষ্ট”। অবিকল আমার বাবার গলা, সেই সাথে দরজায় মৃদু ধাক্কাও পড়লো... আর, খড়...খড়...কট...কট...কট করে নড়ে উঠলো দরজাটা! সত্য পাংশুবর্ণ মুখ নিয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সটাং, আর আমার কথা না বলাই ভালো, আমার সব বুদ্ধি বিবেচনা বোধ নিমেষে উধাও হয়ে গেল, আর আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মত দরজার দিকে এগোতে গেলাম কিন্তু সত্য আমায় জাপটে ধরে আমার মুখটা এক হাতে চেপে ধরে, আমায় টেনে হিঁচড়ে দরজা থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো, আর ফিসফিস করে কানে কানে বলে উঠলো “ছোট দা-ঠাকুর এক্কেবারে চুপ থাকো, এক্কেবারে আওয়াজ দিওনি কত্তা, দরজার বাইরে ঘোর বিপদ... ও ডাক নিশির ডাক”! এরপর আবার একই স্বর একই ভাবে... কিন্তু কর্কশতা এবার আরো দ্বিগুন ও প্রচণ্ড রাগে রুক্ষ হয়ে বলতে লাগলো “খোকারে দরজাটা খোল না বাবা! একটু জল দে না বাবা... বড় কষ্ট রে”। এই ভাবে পর পর তিন বার খেপে খেপে বলেই, একটা মর্মভেদী নারকীয় কর্কশ স্বরে কেউ খিক খিক খিক খিইখিইখিই করে হেঁচকি তুলে হাসতে হাসতে চুপ করে গেল হঠাৎই। দরজার ওপারে যেন কালরাত্তিরের নিঃস্তব্ধতা নেমে এলো এবার। কিছুক্ষণ, ওভাবে থাকার পর, আমি আস্তে আস্তে ধাতস্ত হয়ে উঠলাম আর ঘরের কোণে রাখা প্রায় নিভু নিভু লম্ফটা একটু উস্কে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই, আবার দরজায় ধাক্কা, “সমু-সত্য, তোরা ঠিক আছিস তো বাবা?” এবারে স্বরটা নিধু জ্যাঠার! সত্য এবার বিজয়ীর হাসি হেসে ছুটে গেল, দরজার দিকে, দরজাটা হাট করে খুলে দিয়ে বাইরে পা দিল সে... আর সেই সাথে ভয় মেশানো আতঙ্কের ত্রাহি স্বরে আকাশ – বাতাস চূর্ণ বিচূর্ণ করে তার মরণ চিৎকারে আশপাশ ভারী হয়ে উঠলো, সেই সাথে দরজাটা প্রচণ্ড আক্রোশে বন্ধ হয়ে গেল, লম্ফটাও দপ করে উঠে নিভে গেল আর বাইরে থেকে ভেসে এলো একটা উল্লসিত খিখিখি খ্রিক খ্রিক খ্রিক... স্বরে হাসির আওয়াজ। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার দম বন্ধ হয়ে এলো আর আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালাম।

যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন আমায় ঘিরে ডাক্তার, রমা জেঠিমা, নিধু জ্যাঠা ছাড়াও, পাড়ার কিছু প্রতিবেশীদেরও উৎকণ্ঠা মাখা মুখ; চোখে পড়লো। শুধু, সত্যকে দেখতে পেলাম না আশেপাশে আর দেখলাম গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে দু-তিন জন সাদা চামড়ার পুলিশ অফিসার ঘরের এক কোণে। আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে তাঁরা এগিয়ে এসে আমার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলো ডাক্তারের কাছে, ডাক্তার প্রত্যুত্তরে জানালেন “স্থিতিশীল! তবে বেশি চাপ দেবেন না প্লীজ!”

 

আমার হতভম্ব মুখের প্রতি চেয়ে একজন অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন... “বাবু, কাল রাত্তিরে কি হইয়াছিল আপনার কিছু মনে পড়ে কি?” আমি জানালাম কাল রাতে নিশি ডেকেছিল আমাকে আর সত্যকে! আচ্ছা সত্য- সত্য কোথায়? কেমন আছে সে! অফিসার তিনজন এ ওর দিকে মুখ চাওয়াচায়ী করে বিদ্রূপ মাখানো হাসি দিয়ে নিধু জ্যাঠার দিকে ফিরে বললেন, “মিঃ মুকার্জী এনার মনের অবস্থা ঠিক নাই মনে হয়! আমরা আজ আসি, কাল আবার আসবো! খুনীকে চিহ্নিত করথে গেলে! ওনার জবানবন্দীটা বড় প্রয়োজন আছে।” ওনারা নিধু জ্যাঠার সাথে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাবামাত্র আমি রমা জেঠিমাকে প্রশ্ন করলাম খুনি মানে? কে খুন হয়েছে জেঠিমা?” জেঠিমা জানালেন, আজ সকালে ওনারা সত্যকে উঠোনের ধারে পেয়ারা গাছের নীচে মৃত অবস্থায় পান, তার চোখ দুটো ঠিকরে বেড়িয়ে এসেছিল প্রায়, প্রচণ্ড ভয় মাখানো মুখের অভিব্যক্তি সেই সাথে আপাদমস্তক রক্তাক্ত ছিল তার দেহ, কেউ যেন প্রচণ্ড আক্রোশে তাকে ধারালো কিছু দিয়ে ফালাফালা করে কেটে রেখে গেছে। আমার ঘরের আগল বাইরে থেকে দেওয়া ছিল, ঘর খুলে আমায় ঘরের কোণে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়, আমারো মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠে চারিদিক ভরেছিল। পুলিশ মনে করছে এটা খুন। আমি, জেঠিমাকে কাল রাতের পুরো ঘটনার কথা এবার খুলে বললাম, উনি সব শুনে বললেন, এই কথা ওনারা বিশ্বাস করলেও সাদা চামড়ার পুলিশ এসব বিশ্বাস করবেনা। বিশেষত শহরাঞ্চলে “নিশির ডাক” ঘোর অবাস্তব হিসেবেই বিবেচিত হবে।

তারপর আমার মাথায় হাত রেখে রমা জেঠিমা বললেন, “সমু, এটা তোমার নব-জন্ম, সত্য নিজে মরে তোমায় এক নতুন জন্ম দিয়ে গেছে! আমি কামাখ্যায় লোক পাঠিয়েছি, গুরুদেব-কে নিয়ে আসার জন্য! উনি এসে তোমায় আর আমাদের বাড়িটা বন্ধন করে দেবেন! আর যাতে কোন বিপদ না ঘটে! এবার বাবা একটু চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করো! আমি এখানেই আছি, তোমার আর কোন ক্ষতি হতে আমরা দেবোনা, যতদিন বেঁচে আছি। তুমি আজ থেকে আমাদের দুই বুড়ো-বুড়ির অন্ধের যষ্টি। আর একটা কথা বাবা এবার থেকে আমায় “মা” বলে আর জ্যাঠাকে “বাবা”, বলে ডেকো কেমন! আজ থেকে তুমিই আমাদের ছেলে।” কথাটা শুনে আমার চোখ দুটো জলে ভরে উঠলেও মনের এক কোণে পরম শান্তি অনুভব করলাম, চোখে জল নিয়ে আর আমার নতুন মায়ের হাত বুকে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বুজলাম, একটু নিশ্চিন্ত ঘুমের আশায়।


(সমাপ্ত)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror