Abanti Pal

Drama Tragedy Inspirational

3  

Abanti Pal

Drama Tragedy Inspirational

নিরা

নিরা

11 mins
192


‘নিরা, ও নিরা, এবার শোন কথাটা, খেয়ে নে’

কোন প্রত্যুত্তর নেই। না পাওয়ারই কথা। খগেন, বিজনের কম্পউণ্ডার, জানতো এই অবলা প্রাণীটাকে বাকশক্তি দেননি ভগবান, তবু চতুর্গুণ ক্ষমতা দিয়েছেন চোখ দিয়ে ভাষার ঊর্ধে কথা বলার। আর সেই চোখে নেমেছে প্লাবনের ধারা।

 যাকে উদ্দেশ্য করে ডাকা, সেই নিরা হচ্ছে গ্রামের বিজনডাক্তার আর ওনার স্ত্রী মিনতিদেবীর পোষ্য হস্তিনী। সেই শাবকাবস্থায় একাকী হাতিটাকে হিংস্র মানবধারী শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, ওকে তুলে নিয়ে আসে ওরা নিজেদের গ্রামে। ওদের গ্রামের অনতিদূরেই অবশ্য জঙ্গল। বলা চলে মানুষ আর জন্তুদের অকথিত সীমান্তরালের এপারে-ওপারে সহাবস্থান। সেই সীমানায় গ্রামের প্রান্তে কাদায় পড়ে থাকতে দেখেছিল গ্রামের লোকজন। তারপর অনেক চিন্তাভাবনা করে নিরাকে নিজের কাছেই রেখে দেয় বিজন।

সেই শাবকাবস্থা থেকেই নিরা জানে বিজন-মিনতি ওর মা বাবা, আর ও তাদের কাছে সন্তানতুল্য। ওদের সম্পূর্ণ গ্রাম জুড়ে মাঠে ঘাটে ওর অবাধ বিচরণ। 

মিনতি মনে মনে চায় নিরা বড় হোক, সাবলীল হওয়ার ক্ষমতা আসুক, ঝুঝবার মতন শক্তি হোক, তারপর ওকে নিজের জঙ্গলে রেখে দিয়ে আসবে। কারণ আর কিছুই না, নিরা নিজের হাতির পালের সাথে জঙ্গলের পরিবেশে সাচ্ছন্দে থাকবে, এবং বিজন আর তাদের খোকার মতি ফিরবে। এই দুটো মানুষের নিরার প্রতি আদর-আব্দার এর বাড়বাড়ন্ত একেবারে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার কথা, উপদেশ, বাধা-নিষেধ তো আর কেউ কানেই তোলে না।

এই অশ্বিনে সাত বছর হতে চললো ওরা নিরাকে ওদের বাড়িতে এনেছে। বিজন এই গ্রামের ডাক্তার। তবে নিরা-অন্ত-প্রাণ থাকায়, এক বেলায় দু-দশটা রুগীর বেশি আর দেখা হয়ে ওঠেনা তার। নিরা ঠিক চিনে চিনে ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে পৌছে ডাকাডাকি আরম্ভ করলো, ব্যাস্, হয়ে গেল ওনার রুগী দেখা। সক্কলে মিলে তখন নিরার দেখভালেই ব্যস্ত। এহেন খামখেয়ালি মানুষের সাথে সংসার করার যে কি জ্বালা, তা মিনতিই হাড়ে হাড়ে বোঝে। 

আর খোকা? সে তো নিরার পিঠে চড়ে জঙ্গলে রওনা দিলেও তাকে কিচ্ছুটি বলবার জো নেই। ওমনি মুখ ফুলিয়ে ওদের ভাব-ভালোবাসার বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগে সারা গ্রাম মাত করে দেবে। কি, না একটা ছয় বছরের বালক আর একটা আট বছরের হস্তিনীর বন্ধুত্বে ছেদ টানা হচ্ছে! এ যে ভীষণ অপরাধের কাজ!!

তাদের সারা সকল আর অপরাহ্ন কাটত মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে। আর নিরা উঁচু ডাল থেকে রোজ একগুচ্ছ রঙ্গন ফুল পেড়ে দিত তার ভাইটাকে। সন্ধ্যাবেলায় তুলসীতলায় যখন মিনতি সন্ধ্যাপ্রদীপ দেখিয়ে শাঁখ বাজাত, তখন রোজ রেখে যেত এমনি আরেক গুচ্ছ এই টকটকে লাল ফুল।

কিন্তু এবার অনেক ভেবেচিন্তে কর্তামশাইকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে মিনতি।

‘খোকার পড়া তো ডকে উঠছে, নিরা-নিরা করে পাগল। এইবার স্কুলে ভর্তি হয়েছে, এতো ঘুরে বেড়ালে তো পড়াশোনায় মন বসবে না’

‘তা তুমি বলতে কি চাও মিনতি? নিরাও তো আমাদের সন্তান’ খবরের কাগজের থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন করে বিজন।

‘শোনো, যথার্থ মানবিকতা বজায় রেখেছে এই ঢের। জঙ্গলের প্রাণীকে কিন্তু জঙ্গলেই মানায়। নিরা আর কদিন বাদে আরেকটু বড় হলে, পারবে ওকে সামলাতে? একটা হস্তিনী প্রতিপালন করা এত সহজ?’

‘আলাদা করে প্রতিপালনের কি আছে? ও তো আমাদেরই একজন’

‘হায়রে ভগবান! কার সাথে কথা কইছি!’ কপাল চাপড়ায় মিনতি। ‘এখনো না হয় বাচ্চা আছে, তাই এমন মনে হচ্ছে। এরপর বড় হবে, ওর খাবারের জোগান দিতে পারবে? এখনই তো হিমশিম অবস্থা। আর গাঁয়ের লোকজনেরাই বা মানবে কেন? এরপর গাছপালা, ক্ষেত্ লন্ডভন্ড করে যদি, কেউ আমাদের ছেড়ে কথা কইবে না’

‘লন্ডভন্ড করবে কেন? আমরা কি ওর যথেষ্ট যত্নআত্তি করছি না! আর ওকথা বলোনা মিনতি, এ গাঁয়ের সক্কলে ওকে বড্ড ভালোবাসে।’

‘দেখো তা নয়, করছি তো আমরা অনেক কিছুই। আমি ভবিষ্যতের কথা ভেবে বলছি। আর তোমরা বাপ-বেটা মিলে বেটিকে যা আদরে রেখেছ, এরপর ও নিজের জায়গায় ফিরতে চাইলে হয়!’

‘নিজের জায়গা মানে?’

‘কানে কথা যায় না, না কি? নিজের জায়গা মানে ওর জঙ্গল যে…’

‘ওটা তো ওর শশুরবাড়ি। ওখানে এখন এই শিশুকে পাঠাচ্ছি না’ ব্যাঙ্গ করে ভোলানোর চেষ্টা করে বিজন তার স্ত্রীকে।

‘কাকে কি যে বোঝাই!’ এবার রাগ করে উঠে যায় মিনতি। এই মানুষটাকে এসব বোঝানোই বৃথা।

নিরাকে একা ওই গহীন অরণ্যে একান্তে ছেড়ে দিতে হুহু করে ওঠে বিজনের বুকটা। এই জঙ্গল বিজনের ছেলেবেলা থেকে খুব চেনা হয়েও বড় অপরিচিত। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বহুবার এসেছে এখানে। এখানে মূলতঃ হাতি, হরিণ ও বন্য শুকরের আবাস। শীতকালে হয় রং-বেরঙের আকর্ষণীয় পরিযায়ী পাখিদের আগমন। নিবিড় গাছের ছায়ায়-ছায়ায় ঘুরে বেড়িয়ে কেটেছে বিজনের অগুনতি ছুটির সকালবেলা। আর বিয়ের পরপর মিনতিকে শৈশবকালে কাটানো জঙ্গলের বিশেষ জায়গাগুলো ঘোরাতে নিয়ে যেতে গিয়ে, গ্রামের শেষ প্রান্তে দেখতে পেয়ে যায় নিরাকে। 

কয়েকজন গ্রামবাসী তখন নিরাকে দেখতে পেয়ে আলচোনায় নিমগ্ন ছিল। কি করা যায় কেউই ভেবে পাচ্ছিল না। হাতিরা যে সবসময় একত্রে ঘোরে, কিন্তু কি ভাবে যে এই শাবকটা সেদিন পরিত্যাক্ত হয়ে কাদায় পড়েছিলো, তা আজও বিজনের অজানা। আশেপাশে অনেক্ষন ঘোরাঘুরি করেও কোনো হাতির খোঁজ মেলেনি। 

সেদিন ছোট্ট হাতিটাকে কাতরাতে দেখে ভারী মায়া পড়ে যায় ওর ওপর। ওখানে উপস্থিত কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে নিয়ে আসে ওকে নিজেদের গ্রামে। থেকে যায় সে বিজনদের কাছেই। তখন থেকেই তার আদরের নাম নিরা। 

যত্নআত্তি করে সুস্থ করে তুলে, আবার একদিন ওরা কয়েকজন মিলে নিয়ে যায় হাতিটাকে ওর নিজের জায়গায় ফেরত দিয়ে আসার অভিপ্রায়ে। কিন্তু কোনো হাতির পালের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনা। আরো দুই-তিনবার এমনি চেষ্টা করে। 

শেষে ভয় হয়, একা ছেড়ে দিলে নদী পেরিয়ে জঙ্গলের ওপারের আরো ঘন জঙ্গলে চলে গিয়ে যদি সে শিকারীদের কবলে পড়ে, তাহলে তার দুর্মূল্য জীবনের সেখানেই ইতি ঘটবে। তাই বারংবার ফেরত নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়।

তবুও মনের এক ছোট্ট কোনে বিজন জানে যে একদিন ছেড়ে দিতেই হবে এই মেয়েতুল্য হস্তিনীকে, যাকে দিনের পর দিন আগলে রেখেছে। কারন একটা প্রাপ্তবয়স্ক হস্তিনীকে ঘরে লালনপালন করা যে এই স্বল্প আয়ের ডাক্তারের কাজ নয়, তা সে বেশ বোঝে। 

সেই কারণেই মাস কয়েক আগে নিরাকে ঘোরানোর অছিলায় মিনতিকে অল্প আভাস দিয়ে একবার বেরিয়েছিলো বিজন, জঙ্গলের পথে। মন না চাইলেও দূরে চলে গিয়ে নিরীক্ষণ করছিল নিরার চলাফেরা, ওর কান্ডকারখানা। কিন্তু সে বেচারি বিভ্রান্ত হয়ে এখানে-সেখানে খানিক দৌড়োদৌড়ি করল। ব্যাকুল ভাবে খুঁজলো কোথায় গেল তার সর্বরক্ষক বাবা। তার ডাকে বিজন মনে করলো বুঝিবা কোনো হাতির দল নিশ্চই এগিয়ে এসে ওকে টেনে নেবে নিজেদের সাথে। কিন্তু গাছের মাচায় টানা দু-রাত্রি কাটিয়েও যখন দেখলো যে কোনো হাতিই এগিয়ে এলো না, তখন ভারী চিন্তায় পড়ে গেল। তাহলে কি ওখানকার সমস্ত হাতি অন্যত্র চলে গেল, না কি সর্বশান্ত হলো বুভুক্ষু শিকারীদের হাতে? 

দ্বিতীয় দিনে ভোরের দিকে চোখটা লেগে এসেছিল বিজনের। রাতেই দেখে রেখেছিল নিরা কোন কোন জায়গায় বিচরণ করছে। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই চারিদিক খুঁজে বেরিয়ে, কোত্থাও নিরার দেখা মিললো না। ভীতত্রস্ত হয়ে জঙ্গলের এধার-ওধার খুঁজেও যখন হস্তিনীতার কোনো হদিস পেলনা, তখন হতাশ হয়ে ফিরে এলো নিজের ঘরে। এসেই চমক লাগলো তার। আরে, এই তো নিরা! কি করে সে চিনে চিনে চলে এলো এতটা পথ! ওকে তো গ্রামে নিয়ে আসা হয়েছিল সেই কোন ছোট্টবেলায়। আর এবারে একবারই সেই লম্বা পথ দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল জঙ্গলে, তাহলে আজ এতটা অচেনা পথ অতিক্রান্ত করে ওদের পরিবারের মাঝে কি ভাবে পৌঁছতে সক্ষম হলো! একেই কি বলে হৃদয়ের টান? একেই কি তবে বলে সার্বজনীন সংযোগে একাত্ম হওয়া? 

জানা নেই বিজনের। তবে সেদিনের পর থেকে এটা জেনেছে যে, যেই মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে নিরা ওদের সাথে, সেটা জীবনব্যাপী। কারুর সাধ্য নেই তাদের অন্যত্র করার। তারপর কেটে গেছে আর কয়েক মাস।

কিন্তু কিছু অপরিকল্পিত ঘটনা সত্যিই বিধিনিষেধহীন, অনিয়ন্ত্রিত। সেদিন ছিলো এক বর্ষার দিন। আকাশ ভেঙে নেমেছে বৃষ্টির ঘনঘটা। খোকা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরে। বিজন নিজে ডাক্তার, বুঝলো যে এই কঠিন অসুখ সারাতে ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে চিকিৎসার জন্য। এই গ্রামের হাসপাতালে সেই পরিকাঠামো নেই যা খোকার চিকিৎসার অপরিহার্য উপকরণ। এই দুর্যোগের দিনেও আর কালবিলম্ব না করে, বিজন তার কম্পউণ্ডার খগেনকে স্বল্পদিনের জন্য নিরার পরিচর্যার দায়ভার দিয়ে, সপরিবারে বেরিয়ে পড়লো কলকাতার উদ্দেশ্যে। বিজনের ভরসা ছিল যে খগেন নিরাকে ঠিক যত্নআত্তি করবে, কারণ সেও ছোটবেলা থেকেই দেখছে তাকে।

কিন্তু বিধাতা বোধহয় অন্য কিছুই ভেবে রেখেছিলেন। খগেন নিরার দীর্ঘপরিচিত হলেও, হস্তিনী বড়োই অস্থির হয়ে পড়তে লাগলো দিনের পর দিন। সে তো বুঝতেই পারলো না যে তার বাবা-মা-ভাই হঠাৎ তাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেল। গ্রামের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত খুঁজে বেড়াতে লাগলো হন্যে হয়ে।

খগেন যতই বোঝাতে থাকে, তোর বাবারা ফিরে আসবে কয়েকদিন পর, ভাইয়ের তোর বড়ো কঠিন অসুখ, সে ততই নির্বাক তাকিয়ে থাকে শুধু শুন্য চোখে। কি যে বোঝে, তা খগেন ঠিক বোঝে না। জানা চেনা এক জিনিস, কিন্তু এক আট বছরের হস্তিনীর যত্নআত্তি যে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস, তা খগেন এবার বেশ টের পায়।

ধন্যি ডাক্তারবাবুর অধ্যাবসায়, মনে মনে প্রনাম ঠুকতে লাগলো সে বিজনের প্রতি। এতো রুগীর দেখ্ভাল করেও কি ভাবে যে হাতি পালনের ধৈর্য রাখেন, তা উনিই জানেন। গত কয়েকদিন এক নতুন বিভ্রাটে পড়েছে খগেন। নিরা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। যতই ওকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে, ততই বিফলে যায় তার সমস্ত উদ্যম। 

 তাও নতুন করে এগিয়ে যাই সে অভিমানিনী নিরাকে কাছে টানার প্রচেষ্টায়।

‘নিরা, ও নিরা, এবার শোন্ কথাটা, খেয়ে নে’ তার মনখারাপ কাটানোর প্রয়াস।

কিন্তু উদাস হতে থাকা নিরা আজকাল আর বিশেষ হেলদোল করে না, খুঁজেও বেড়ায় না কাউকে গ্রামের প্থে পথে।

ওদিকে খোকার চিকিৎসার জন্য আরো দেরি হবে বলে বিজন খবর পাঠিয়েছে। নিরার কথা শুনে ঠিক করল যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, খোকা সুস্থ হতে শুরু করলেই, একদিন গ্রামে এসে দেখে যাবে তাকে। তারপর খোকা সম্পূর্ণ সেরে উঠলে, আবার ফিরে আসবে সকলে।

সেই রাতে ভারী বর্ষণ নেমেছিলো আবার। খগেন বাড়ি ফেরার পথে ভাবলো একবার নিরার হাতিশালে গিয়ে দেখে আসে, সে ঠিক আছে কিনা। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখল কেউ কোথাও নেই। ফাঁকা হাতিশালে একটা একাকী কাঠবিড়ালি ঘোরাফেরা করছে। এবার কি করবে ভেবে পেল না খগেন। এই বৃষ্টির রাতে কোথায় খুঁজবে নিরাকে! যে গত কয়েকদিন ধরে ঘোরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, সে হঠাৎ এই দুর্যোগের রাতে কোথায় অন্তর্ধান হয়ে গেল? মহা ফাঁপরে পড়লো সে।

পরদিন সকাল থেকে বিস্তর খোঁজাখুঁজি চললো গ্রামে জঙ্গলে। এভাবে দুইদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল, তবুও নিরার দেখা মিললো না। এই সমস্যার কথা বিজনডাক্তারকে বলে কোন মুখে, অনেক ভেবেও বুঝে পেল না কম্পউণ্ডার।

আরো এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে গেল এভাবেই. গ্রামের সকালেই এবার খোঁজ করতে লাগলো একে একে। যে হস্তিনী সারা গ্রাম ব্যাপী মানুষজনদের মাতিয়ে রাখত, সকলের উঠোনের সামনে গিয়ে কারুর থেকে কলা, কারুর থেকে বাঁধাকপি,কারুর থেকে আবার লাউ, ইত্যাদি আহার করতে প্রতিনিয়ত, সেই হাতি তাদের এক অভ্যাসের মতন হয়ে গেছিলো। আজ তার অনুপস্থিতিতেই কি যেন একটা শুন্যতা ভরে গেল, গ্রামের মাতোয়ারা পরিবেশে এক অকথিত মনখারাপির ছায়া নেমে এলো। কেউ মুখে কিছু না বললেও, সেই শূন্যতা গ্রামের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল ক্রমশ।

খোকা দিন দিন বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছিলো, তাই এভাবেই মাসখানেক কেটে গেল। বিজনের আর মাঝে ফেরা হল না এই অবস্থায়। অবশেষে, দীর্ঘ চিকিৎসান্তে, প্রায় তিনমাস পর বিজন সপরিবারে ফিরে এলো গ্রামে। খোকা এখন সুস্থ হলেও খুবই দুর্বল। সাবলীলভাবে চলাফেরা করার ক্ষমতা হারিয়েছে। তবে শহরের ডাক্তার বলেছেন যে ধীরে ধীরে সেটা ঠিক হয়ে যাবে। দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে আরো মাসদুয়েক সময় লাগবে। এই সময়টুকু যেন ওকে হাসিখুশি রাখা হয়, ওনার নির্দেশ। তাহলেই ও চটজলদি সেরে উঠবে।

বিজন গ্রামে ফিরেই নিরার খোঁজে লেগে পড়ল তৎপর হয়ে। খগেনের থেকে বিস্তারিত ঘটনা আগেই শুনেছিলো। নিরার অন্তর্ধানে তাই সে যথেষ্টই চিন্তিত। নিরার মতন সংবেদনশীল প্রাণী মনে হয় বড়ই কম আছে পৃথিবীতে! অবশ্য যেভাবে হঠাৎ ওকে না বলে চলে যেতে হয়েছিল; অভিমান তো হওয়ারই কথা। 

তারপর আবার নিজের মনেই হেসে উঠলো… কিই বা বোঝাতো নিরাকে? কিভাবে বিদায় জানাত? যখন ওকে নিজের পরিবেশে রেখে আসতে চেয়েছিল, তখনও তো ঠিক পথ চিনে ফিরে এসেছিল ওদের অনুরক্ত হস্তিনী। এবার তাই আর বিলম্ব না করে একাই বের হল বিজন, জঙ্গলের উদ্যেশ্যে। খুঁজতে খুঁজতে দিন পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো, বিজন তখনও নিরার দেখা পেল না। মনে মনে কুন্ঠাবোধ হতে লাগলো, হাজার হোক, তাকে সাত-আট বছর প্রতিপালন করেছে সে শাবকাবস্থা থেকে। এভাবে যে হঠাৎ চিরবিচ্ছিন হয়ে যাবে, তা অভাবনীয় ছিল। একদিন বিজন-মিনতিই চেয়েছিল নিরাকে স্বহস্তে নিজ-জায়গায় রেখে আসতে। আজ বুঝি ওদের ভাবাবেগের ফলে নিজেই অভিমানিনী সে প্রত্যাবর্তন করলো বহু দূরে, নিরুদ্দেশে।

কারন বিজন জানে যে এই জঙ্গলে নিরাকে না পাওয়ার অর্থ, সে হয়তো আরো গভীর জঙ্গলে পাড়ি দিয়েছে, আর সেখানে তাকে খুঁজতে যাওয়া দুরূহ। এতদিনে কোনো অবশিষ্ট হাতির পালের কাউকেই যখন চোখে পড়েনি, তখন নিরা কেও যে ফিরে পাওয়া যাবে, সে আশা করা বৃথা।

বাড়ি ফেরার পথ ধরতে যায় বিজন। তখনই চোখে পড়ে তার সেই চিরস্মরণীয় মুহূর্ত। নিরা এগিয়ে আসছে তার দিকে। খুব ধীরে, অনেকটা দূর থেকে। পড়ন্ত সূর্যের আলোর বর্ণবলয়ে এগিয়ে এলো সে। বিজন হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ধরলো তাকে। তাদের এই বাবা-মেয়ের নীরব স্নেহের সাক্ষী হয়ে রইলো সেদিনের অস্তগামী সূর্য। নিঃশব্দে। 

অবশেষে বিজন বলল

‘চল, বাড়ি ফিরে চল’ বলে এগিয়ে যেতে লাগলো।

কিন্তু নিরা ওখানেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকলো।

‘ঘরে ফিরবি না? বাবার ওপর এত অভিমান হয়েছে? ছোট্ট ভাইটার যে প্রাণসংকট হয়েছিল, কি করে না গিয়ে থাকতাম বল! আর তোর জন্য তো তোর প্রিয় খগেনকাকা কে বলেই রেখেছিলাম।‘

কি বুঝলো নিরা কে জানে, খানিক মাথা ঝাঁকাল। তারপর যেদিক থেকে এসেছিলো, ফিরে গেল সেদিকেই। ক্ষনিকের দেখা দিয়ে গেল মাত্র। ওর চলে যাওয়াটা হতবাক হয়ে দেখতে লাগলো বিজন। যখন সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল দ্রুত নেমে আসা অন্ধকারে, তখন ফিরে গেল বিজন।

ঘরে ফিরে এসে হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিয়েই ফিরে গেছিলো চেম্বারে রুগী দেখতে। ভেবেছিলো বেরোবে না, মনটা ভালো ছিল না একদম। তবু নিরার সাথে চোখের দেখাটুকু হয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল অনেকটাই। আর এতদিন গ্রামে না থাকায়, লোকজনদের ভিড়ও হচ্ছিলো খুব। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে চলেই গেছিলো চেম্বারে।

এদিকে খোকার ভীষণ কাশি ওঠায় চিন্তান্বিত হয়ে পড়লো মিনতি। ওষুধ দিয়ে, হাওয়া করে, অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তাকে সুস্থিত করা গেল না। উঠোন থেকে লোকজনকে ডাকাডাকি করেও, কাউকে না পেয়ে, সে উদ্বিগ্ন হয়ে পাশের বাড়ির রুমকিকে গেল খবর দিতে, তার ডাক্তার স্বামীকে ডেকে আনার অনুরোধ করতে। 

আর তখনি এলো ভীষণ ঝড়। উদ্বেল ঝড়ের রোষে নিমেষে সারা গ্রাম অন্ধকার হয়ে গেল। পাশের বাড়ি থেকে কোনোক্রমে ঘরে ফেরার অবকাশ মিনতি পেলো না। এদিকে না গেলেই নয়। অসুস্থ খোকা একলা ঘরে। না জানি কি অবস্থা হচ্ছে তার। 

তখনি কড়্কড়্ করে বাজ পড়ে শুরু হল মূষলধারে বৃষ্টি। ঝড় বেড়ে গেল বহুবিধগুন। আকস্মিক ঝড়ো হাওয়ায় টিনের চাল উড়ে গেল একটা বাড়ির। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মিনতিদের বাড়ি লাগোয়া সুপুরিগাছটা উপরে পড়লো ওদের বাড়ির ছাদে। টিনের চাল সমেত ভেঙে পড়লো ভেতরে।

সর্বনাশা এই পরিস্থিতিতে মিনতি আর স্থির থাকতে পারলো না, দৌড়ে এগিয়ে যেতে গেল বাড়ির দিকে। কিন্তু প্রবল ঝড়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়লো মাটিতে।

 এমন অবস্থায় যখন পৃথিবীর সমস্ত আলো নির্বাপিত হয়ে আসতে লাগলো তার দুচোখের সামনে থেকে, তখন আচমকা বিদ্যুৎ ঝলকের আলোয় দেখতে পেলো তাকে এগিয়ে আসতে। দূর থেকে এগিয়ে আসছে সে ওদের বাড়ির দিকে। 

নিরা। ওদের নিরা। ওদের সবার আদরের হস্তিনী। 

এসেই নিজের বলশালী শুঁড় দিয়ে গাছটা তুলে সরিয়ে দিলো, তারপর ভেঙে পড়া টিনের চালটা। তারপর তছনছ হয়ে যাওয়া ঘরের ভেতর থেকে খুব সন্তর্পনে উদ্ধার করলো খোকাকে, তার ভাইকে। সে তখন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় লুটিয়ে আছে মাটিতে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে তাকে স্বযত্নে এনে রাখল পাশের ঘরের উঠোনে, যেখানে ঝড়ের দাপটে তখনও বাড়িটার কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। 

এরপর সারারাত খোকার জ্ঞান ফেরেনি। তার শিয়রে বসে অবিরত চোখের জল ফেলছে মিনতি। এমনি এক দুর্যোগের দিনে খোকার প্রাণভয়ে তাকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলো কলকাতায়। আজ সেরকমই এক ভয়াবহ সন্ধ্যায় তার মেয়ে সমতুল হস্তিনী যদি সময়মতন এসে উদ্ধার না করতো খোকাকে, নাহ্, তাহলে যে কি হতে পারতো আর ভাবতে পারছে না মিনতি.. সেই মুহূর্তে অসহায় এক মায়ের ক্রন্দনেই হোক বা নিজের পরিবারকে ভালোবাসার টানেই হোক, কোনো এক অজ্ঞাত জাদুমন্ত্রে নিরা এসে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো ওদেরকে। 

সারারাত অনেক চেষ্টা করে বিজন অবশেষে খোকাকে বিপদমুক্ত করতে পেরেছিলো। মানুষ না হয়েও, এক সন্তান যে তাদের আরেক সন্তানের সংকটে এসে তাকে রক্ষা করেছিল, এতে বিজন-মিনতি নিশ্চিত হয়ে গেল যে সহোদরত্ত সর্বব্যাপী, নিরন্তর, সর্বাত্তিক।

ভোরের প্রথম আলোর সাথে সাথে মেঘ কেটে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। পাড়ি দিলো তারা বাতাসের আহ্বানে অন্যত্র। 

আর নিরা? সারারাত স্থির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার পরে, যখন দেখল খোকা জেগে উঠেছে, তখন উঠোনের সামনে এক তোড়া রক্তবর্ণ রঙ্গন ফুল রেখে, আবার ফিরে গেল তার নিজের ঠিকানাবিহীন জগতে। 

সমাপ্ত।।


পুনশ্চ: নিরা প্রতীকী মাত্র, তার জায়গায় আপনি সমাজের যে কোনো যথার্থ সত্তাকে স্থান দিতে পারেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama