STORYMIRROR

Anurag Roy

Horror Others

4.5  

Anurag Roy

Horror Others

নিকষা

নিকষা

11 mins
294

            নিকষা 


এখন আষাঢ় মাস চলছে রোজ বেশ জোর বৃষ্টি হচ্ছে। আজ রবিবার অফিস ছুটি। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টি দেখেছি আর কিছু পুরোনো দিনের কথা ভাবছি আমার মোবাইল ফোনে অঞ্জন দত্তের সেই গানটা বাজছে "আমি বৃষ্টি দেখেছি।"

কিছুদিন হল নিলার সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে। নিলার একটা বখাটে ছেলের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি নি।

এখন আমি একা জীবন যাপন করি। প্রথম প্রথম আমার একটু অসুবিধা হত কিন্তু এখন বেশ অভ্যাস হয়ে গেছে। শুধু আমার বাচ্চা ছেলেটার কথা মনে হলে মনটা খারাপ হয়ে যায় না জানি সে এখন কেমন আছে নিলাতো তার সাথে আমাকে দেখাও করতে দেয় না।

আমি ভাবছি আর বিয়ে থা করবো না স্বাধীন ভাবে বেশ ভালই আছি। আত্মীয়স্বজনরা গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন করে আমাকে আবার বিয়ে করতে রাজি হওয়ার জন্য অনুরোধ করছে কিন্তু আমি সাফ মানা করে দিয়েছি।

আজ ভাবছি দুপুরে রান্নাবান্না করবো না হোটেল থেকে খাবার কিনে এনে দুপুরে খেয়ে নেবো।

হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল হাতে নিয়ে দেখি রাজীবদা কল করছে।

কল রিসিভ করতেই রাজীবদার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।


রাজীবদা: তোমার দুপুরের রান্না হয়ে গেছে?

আমি: না।

রাজীবদা: আজ আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো। স্পেশাল পেঁয়াজের খিচুড়ি আর ডিম ভাজা রান্না করছি তাড়াতাড়ি চলে এসো বেশ জমিয়ে খাওয়া হবে আর গল্প হবে।

আমি: ঠিক আছে দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসছি।


রাজীবদা আমাদের পাড়ায় একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে। সে অকৃতদার মানুষ বৌ বাচ্চার ঝামেলা নেই একাই স্বাধীন জীবন যাপন করে। তার রান্নার হাত দারুণ তবে খাওয়ার থেকে বেশী তার রোমহর্ষক অদ্ভুত অলৌকিক গল্পগুলো আমাকে আকর্ষণ করে। তার জীবনে প্রচুর অলৌকিক ঘটনার অভিজ্ঞতা আছে। তার অলৌকিক গল্পগুলো আমার এতই ভাল লাগে যে আমি তার একজন ভক্ত হয়ে গেছি।

না আর দেরি করা ঠিক হবে না বৃষ্টি টা বারছে। আমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে একটা ছাতা মাথার উপর ধরে রাজীবদার ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

রাজীবদার ফ্ল্যাটে পৌছাতেই খিচুড়ির সুগন্ধ আমার নাকে ধাক্কা মারল।

রাজীবদা আমাকে দেখেই বলল " খিচুড়ি তৈরি ডিম ভাজাটা হলেই আমরা খেতে বসে যাব।"

কিছুক্ষণ পর আমরা খেতে বসলাম।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাজীবদা একটা সিগারেট ধরালো।


আমি: আজ এই বৃষ্টি বাদলার দিনে বেশ জমিয়ে একটা রোমহর্ষক ভুতের গল্প বল দেখি।

তোমার সেই পিন্ডদানের গল্পটা শোনার পর আমি একা কোন নির্জন জায়গায় যেতে ভয় পাই মনে হয় যদি সিমার মত কোন প্রেতিনি হঠাৎ আমার সামনে এসে হাজির হয় তাহলে আমি হার্টফেল করবো।

রাজীবদা: আজকে যেই ঘটনার কথা তোমায় বলবো সেটা সিমার ঘটনার ঠিক পাঁচ বছর পরে আমার সাথে ঘটে।

আমি: ঠিক আছে তবে গল্প শুরু কর।

রাজীবদা: তুমি কখনো রাক্ষসের কথা শুনেছো?

আমি: হ্যাঁ ছোটবেলায় ঠাকুমা দিদিমার মুখে রাক্ষস খোক্কসের অনেক গল্প আমরা শুনতে পেতাম এখনকার বাচ্চাদের আবার সেই সৌভাগ্য হয় না এখন এইসব ইতিহাস। এখন বাচ্চাদের ভুলানোর জন্য সদা ব্যস্ত বড়রা তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয় এতে বাচ্চাদের যে কি মারাত্বক ক্ষতি হচ্ছে এটা কেউ বোঝে না। ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের মোবাইল এডিকসন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া কিছু মডার্ন বাঙলী মনে করে বাচ্চাদের এইসব বাংলা গল্প বললে স্টেটাস নষ্ট হয় তারা বাচ্চাদের বড় হলে বিলেতি সাহেব বানাতে চায়। অনেক বাঙালী ঘরের ছেলে মেয়ে বাংলা লিখতে বা পড়তে পারে না এতে তাদের বাবা মা গর্ব বোধ করে। এমন চলতে থাকলে আমাদের ঐতিহ্য আর থাকবে না সেটাও ইতিহাস হয়ে যাবে।

রাজীবদা: তুমি ত ভারি আজব আমি বলছি রাক্ষসের কথা শুনেছো কি না আর তুমি পুরো অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলে।

আমি: ঠাকুমা দিদিমার মুখে আমি রাক্ষস খোক্কসের অনেক গল্প শুনেছি তবে সে তো রূপকথার গল্প।

রাজীবদা: শুধু রূপকথার গল্প নয়। আমাদের বহু হিন্দু পুরানে রাক্ষসদের উল্লেক্ষ আছে। মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতে অনেক রাক্ষসদের কথা উল্লেক্ষিত আছে।

রাক্ষসরা হল অন্ধকার জগতের একধরনের জীব তাদের আকৃতি মানুষের মত তবে তারা বিশাল আকারের ভয়ঙ্কর দর্শন দেখতে।

অনেক সময় নানা কারণে তারা আমাদের জগতে চলে এসে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে তখন ঈশ্বর নিজের হাতে তাদের দমন করেন।

কিছু কিছু গভীর অরণ্যে রাক্ষসরা আজও বাস করে অরণ্যের রক্ষক হিসেবে।

আচ্ছা তোমার রামায়ণের গল্পটা জানা আছে কি? 

আমি: একটু একটু মনে আছে।

রাজীবদা: রামায়ণে উল্লিখিত লঙ্কার রাক্ষস রাজা রাবনের পিতা মাতার নাম তোমার জানা আছে কি?

আমি: সেটা এখন মনে পরছে না।

রাজীবদা: রাবনের পিতা ছিলেন ঋষি বিশ্রবা আর মাতা ছিলেন নিকষা রাক্ষসী।

বাল্মীকি রামায়ণে নিকষার কথা খুব কম উল্লিখিত আছে। আঞ্চলিক রামায়ণ গুলোতে নিকষার বেশি উল্লেক্ষ পাওয়া যায়।

তাছাড়া আধ্যাত্ম রামায়ণে উল্লিখিত আছে- শ্রীরাম যখন লন্কাপতি রাবন কে বধ করে যুদ্ধে জয় লাভ করেন তিনি সীতামাতাকে উদ্ধার করতে ভাই লক্ষণকে নিয়ে লন্কাপুরির ভিতরে এগিয়ে আসতে থাকেন। শ্রীরামকে এগিয়ে আসতে দেখে রাবনের মাতা নিকষা রাক্ষসী সেখান থেকে পালিয়ে যাবার জন্য উদ্যত হয়। তখন শ্রীরাম তার সামনে এগিয়ে এসে বলেন-"আপনার কোন ভয় নেই আমি আপনাকে বধ করবো না।"

তারপর লক্ষণ এগিয়ে এসে বলেন- "আপনার পুত্র রাবন আর কুম্ভকর্ন মারা গেছে তা দেখেও আপনার এত মৃত্যু ভয় আপনার এত বাঁচার ইচ্ছা ইচ্ছা সেটা দেখে আমি অবাক হচ্ছি।"

নিকষা রাক্ষসী লক্ষণের এই কথা গুলো শুনে বলল -"আমি পুত্র শোকে কাতর তবুও আমি আরও বাঁচতে চাই কারন আমি বেঁচে আছি বলেই ভগবান শ্রীরামের কত লীলা দেখতে পেলাম। আরও কিছুদিন বাঁচলে ভগবান শ্রীরামের আরও কত লীলা দেখতে পাবো।"

নিকষা রাক্ষসীর এই কথা গুলো শুনে শ্রীরাম খুব খুশি হলেন। তিনি খুশি হয়ে নিকষা রাক্ষসীকে চিরজীবী হবার বর প্রদান করলেন।

নিকষা রাক্ষসী আজও বেঁচে আছে।

আমি: তুমি আজকে রাক্ষস খোক্কস আর পৌরানিক কথা নিয়ে কেন পরেছো। একটা রোমাঞ্চকর ভুতের গল্প বল না প্লিজ।

রাজীবদা: আজকের গল্প কোন ভুতের গল্প থেকে অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। গল্পতো নয় সত্য ঘটনা।

আমি:তার মানে তুমি রাক্ষসও দেখেছো।

রাজীবদা: একসাথে অনেকগুলো রাক্ষস দেখেছি। আর আজকে যেই ঘটনার কথা তোমায় বলবো সেটা রাবনের মাতা নিকষা রাক্ষসীকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল।


এই কথাগুলো বলে রাজীবদা আরও একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে রাজীবদা গল্প বলতে শুরু করলেন। বৃষ্টিটাও খুব জোর হতে লাগল।


রাজীবদা এবার গল্প বলা শুরু করল।

রাজীবদা বলছে:-


সেই সময় আমি দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে M.S.C করার চান্স পেয়ে গেলাম। আমার বিষয় ছিল ZOOLOGY।

স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। সেখানে আমি ইউনিভার্সিটির হোষ্টেলে থাকতাম। আমার রুমপার্টনার ছিল কৌশিক নামে কোলকাতার একজন বাঙালি ছেলে। কৌশিক ছিল ঘোর নাস্তিক সে ভুত ভগবান কিচ্ছু বিশ্বাস করতো না। সে বলত দুর্বল মনের লোকেরা এইসব বিশ্বাস করে এগুলো সব মিথ্যা সব ধাপ্পাবাজি।

একবার ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের একটা প্রোজেক্ট দেওয়া হয়।

দন্ডকারন্যে একধরনের বিশেষ প্রজাতির ব্যঙ আছে। বর্ষাকালে তাদের বেশি দেখা যায়। আমাদের প্রোজেক্টটা ছিল সেই বিশেষ প্রজাতির ব্যঙের উপর।

সেই প্রোজেক্টের জন্য আমাদের বেচের কয়েকজন ছাত্রকে দন্ডকারন্যে যেতে হল।

রামায়ণে বর্নিত আছে সেই দন্ডকারন্যে থেকেই রাবন সীতাকে হরন করে লঙ্কা নিয়ে যায়। রামায়ণে আরও আছে সেই সময় দন্ডকারন্যে অনেক রাক্ষসদের বাস ছিল। সেই সময় অনেক রাক্ষস শ্রীরামের হাতে নিহত হয়।

দন্ডকারন্য ভারতবর্ষের একটি বিশাল অরণ্যে অঞ্চল যার বেশিরভাগ অংশ পরেছে ছত্তিশগড় রাজ্যে আর কিছু কিছু অংশ পরেছে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তেলেন্গানা এবং উড়িষ্যায়।

ছত্তিশগড়ে যে অংশটা আছে আমাদের সেখানে পাঠানো হল।

জঙ্গলের কাছাকাছি একটি আদিবাসী গ্রামে আমরা কেম্প করে থাকার বন্দোবস্ত করলাম।

ওই গ্রামবাসীদের মতে রামায়ণের সময় রাম, লক্ষণ,সীতা এই গ্রামেই বনবাসের কালে বাস করছিলেন। সেই সময় এই জায়গায় কোন গ্রাম ছিল না তখন এখানেও জঙ্গল ছিল। 

ঠিক যেখানে রামের কুটির ছিল এখন সেখানে রামমন্দির তৈরি হয়েছে।

মন্দিরের একটু দুরে একটা ছোট নদী দেখতে পেলাম। গ্রামবাসীদের মতে- শ্রীরাম যখন সোনার হরিণের খোঁজে কুটির থেকে বাইরে যান তিনি লক্ষণকে সীতার সুরক্ষার ভার দিয়ে যান।

শ্রীরাম যখন সেই সোনার হরিণ রুপি মায়াবী রাক্ষস মারিচকে তীর বিদ্ধ করেন তখন মারিচ মৃত্যুর আগে শ্রীরামের কন্ঠস্বর নকল করে লক্ষণকে আহবান করে।

সেই কন্ঠস্বর শুনে লক্ষণ শ্রীরামকে সাহায্য করতে সেদিকে যায়। যাবার আগে তিনি তীরের ফলা দিয়ে মাটিতে একটি লম্বা দাগ কেটে লক্ষণরেখা তৈরি করেন। তিনি সীতাকে বলেন এই রেখার বাইরে যেন সীতা কিছুতেই না যায়। কিন্তু পরে রাবন সন্ন্যাসী সেজে ছলনা করে সীতাকে লক্ষণ রেখার বাইরে নিয়ে আসে আর জোর করে হরন করে লঙ্কায় নিয়ে যায়।

এই লক্ষণরেখাটাই পরবর্তী কালে আকারে বড় হতে হতে এই নদীতে পরিণত হয়।

গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করে এই জঙ্গলে এখনো কিছু রাক্ষসদের বাস আছে আর রাবনের মাতা নিকষা রাক্ষসী এই গভীর জঙ্গলের ভিতরেই বাস করে।

জঙ্গলের ভিতর ঢুকতেই একপাশে একটা মন্দির চোখে পরল। মন্দিরের ভিতর ঢুকে আমরা দেখলাম একটা বিরাট কালো পাথরের তৈরি ভয়ঙ্কর রাক্ষসীর মুর্তি। মুর্তিটা দেখতে ভয়ঙ্কর সেটার চোখ দুটো লাল রঙের পাথর দিয়ে তৈরি সেটার মুখের ভিতর দুটো বড় বড় শ্বদন্ত দেখা যাচ্ছে।

মন্দিরের পুজারি বলল " এই যে মুর্তিটা দেখতে পাচ্ছেন ইনি হলেন রাবনের মাতা নিকষা রাক্ষসী আমরা তাকে নিকষা মাই বলে ডাকি। উনাকে পুজো করে খুশি রাখলে জঙ্গলে যে রাক্ষসরা থাকে তারা মানুষের কোন ক্ষতি করে না।"


সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যেবেলা আমরা আমাদের কেম্পে ফিরে আসি।

এখন রাত হয়েছে হঠাৎ কৌশিক আমার তাবুর ভিতর এল। প্রথমে সে প্রোজেক্টের বিষয়ে কিছু আলোচনা করল। কাল সকাল থেকেই আমাদের প্রোজেক্টের কাজ শুরু হবে।

প্রোজেক্টের কথা শেষ করেই কৌশিক বলল "আচ্ছা তুই এই গ্রামের লোকগুলোর বলা গল্পগুলো বিশ্বাস করিস।"

আমি বললাম " হ্যাঁ করি।"

কৌশিক বলল " তুই একদম বোকা বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করিস। আমি তোকে প্রমাণ করে দেব এই সব কিছু মিথ্যা।"

আমি বললাম " তোকে কিছু করতে হবে না। ওরা থাকুক না ওদের বিশ্বাস নিয়ে তোর তাতে কি।

এখন অনেক রাত হয়েছে আমি এখন শুয়ে পরবো তুইও নিজের তাবুতে গিয়ে শুয়ে পর কাল সকাল সকাল প্রোজেক্টের কাজ করতে বের হতে হবে।"


পরদিন সকাল থেকে প্রোজেক্টের কাজ শুরু হল। অনচন নামে একটি আদিবাসী ছেলে আমাদের জঙ্গলের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবার গাইড ছিল। সে আমাদের জঙ্গলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত আর আমাদের নিয়ে যেত জঙ্গলের সেই জায়গায় যেখানে ওই বিশেষ প্রজাতির ব্যঙ প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া যায়।

প্রতিদিন জঙ্গলে ঢুকতেই অনচন প্রথমে নিকষা মাইয়ের মন্দিরে প্রবেশ করে নিকষা মাইয়ের পুজো দিয়ে তারপর জঙ্গলের আরও গভীরে যেত আর আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত।

সে বলত " জঙ্গলের গভীরে অনেক রাক্ষস আছে। জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করতে হলে আগে নিকষা মাইকে পুজো দিতে হবে তাহলে কোন রাক্ষস বা কোন হিংস্র বন্য জন্তু আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না । নিকষা মাই খুব জাগ্রত।"

অনচনের এই কথাগুলো শুনে কৌশিক তাচ্ছিল্যের হাসি হাসত।

প্রতিদিন আমরা জঙ্গলের ভিতর বেশ কয়েকঘন্টা প্রোজেক্টের কাজ করতাম। মাঝে মাঝে আরও গভীর জঙ্গল থেকে আমরা বাঘ ও অন্য বিভিন্ন বন্য জন্তুর ডাক শুনতে পেতাম। মাঝে মাঝে হরিণ, নীলগাই,লান্গুর,হাতি এইসব বিভিন্ন জন্তু আমরা দেখতে পেতাম। বাঘের গর্জন শুনলে গা ছমছম করতো।

এইভাবে একসপ্তাহ পার হয়ে গেল। সবার প্রোজেক্টের কাজ প্রায় শেষ। আমরা ঠিক করলাম আর এক দুদিন এখানে থেকে আমরা ইউনিভার্সিটি ফিরে যাব।

একদিন রাতের বেলা খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা রান্নাবান্না শেষ করে রাতে খাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি কৌশিকের খাবারটা নিয়ে তার তাবুতে গেলাম গিয়ে দেখি কৌশিক সেখানে নেই। আমি চিন্তা করতে থাকলাম এত রাতে এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কৌশিক কাউকে কিছু না বলে গেল কোথায়।

বেশ কিছুক্ষণ পর কৌশিক একদম ভিজে অবস্থায় ফিরে এলো।

আমি কৌশিককে জিজ্ঞাসা করলাম " কিরে কোথায় গিয়েছিলি এই ঝড়বৃষ্টির রাতে?"

কৌশিক বলল " তোকে পরে সব বলবো। এখন আমি খুব ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পরবো।"

একটু পর আমিও শুয়ে পরলাম।

পরদিন সকালে অনেক লোকজনের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। তাবু থেকে বের হয়ে দেখি অনেক গ্রামবাসী আমাদের কেম্পে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করছে।

আমি তাদের বললাম " কি ব্যাপার আপনারা এই ভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন কেন?"

ওদের মধ্যে একজন সামনে এগিয়ে এসে বলল " কাল রাতে আপনাদের মধ্যে কেউ একজন নিকষা মাইয়ের মুর্তির মাথায় আঘাত করেছে তাই মুর্তির কপালের একপাশে একটা ফাটল দেখা যাচ্ছে।"

আমি তাদের বললাম " আপনারা পুলিশে খবর দিন। পুলিশ খুঁজে বার করবে কে এই কাজ করেছে। যদি আমাদের মধ্যে কেউ হয়ে থাকে তাহলে পুলিশ তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে।"

সেই গ্রামবাসিটা বলল " আমরা পুলিশে খবর দেব না আর আমরা নিজেরাও কিছু করব না। যে এই জঘন্য কাজটা করেছে তাকে নিকষা মাই নিজের হাতে শাস্তি দেবেন।"

এই কথাগুলো বলে গ্রামবাসীরা চলে গেল।

তারা চলে যেতেই আমি কৌশিককে বললাম " আমি জানি তুই ছাড়া এই কাজ কেউ করতে পারে না। এই জন্যই তুই কাল রাতে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বের হয়ে গিয়েছিল আর এত রাত করে কেম্পে ফিরে এসেছিল। বল তুই কেন এটা করলি।"

কৌশিক তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল " বেশ করেছি ওই অশিক্ষিত লোকদের ওই পাথরের মুর্তি নিয়ে বারাবারি আমার একদম সহ্য হয় না। তাছাড়া কাল সকালে তো আমরা এখান থেকে চলেই যাচ্ছি আর পুলিশের ঝামেলাও হয়নি এত ভয়ের কি আছে।"

আমি বললাম " তুই খুব অন্যায় কাজ করেছিস তুই ওদের বিশ্বাসে আঘাত করেছিস।"

কৌশিক বলল " বিশ্বাস মাই ফুট যত্তসব কুসংস্কার। আমি তো মুর্তিটার কপাল ফাটিয়ে দিয়েছি। মুর্তিটা তো আমার কিছুই করতে পারে নি। ওই নির্জীব পাথরের মুর্তি আবার কি করবে।"

আমি চুপ হয়ে গেলাম কৌশিককে আর কিছু বললাম না।

সেদিন কোন ছাত্র জঙ্গলের ভিতর যেতে রাজি হল না তাদের মতে এখন তো প্রোজেক্টের সব কাজ শেষ জঙ্গলে গিয়ে আর কাজ নেই আজকের দিনটা বিশ্রাম করে কাল সকাল সকাল এখান থেকে ফিরে যাবে সবাই।

কৌশিক বলল " আমার একটু কাজ বাকি আছে। আমি ওই ব্যঙগুলোর কয়েকটা ছবি তুলতে চাই আর হয়তো এখানে আর আসা হবে না তাই একটা দিন বাকি আছে আমি সেটাও কাজে লাগাতে চাই।"

আমি বললাম " তুই একলা জঙ্গলে যাস না আমিও তোর সাথে যাব।"

আমাদের গাইড অনচন বলল " আজকে জঙ্গলে না গেলেই ভাল করতেন। নিকষা মাই আজ কুপিত আছেন।"

কৌশিক বলল " আমি এইসব বিশ্বাস করি না। আমি জঙ্গলে যাবই।"

আমরা তিনজন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাকি ছাত্ররা কেম্পেই রয়ে গেল।


জঙ্গলে পৌঁছে কৌশিক খুব মন দিয়ে কাজ করতে লাগল। আমিও সময় নষ্ট না করে ব্যঙগুলোকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।

দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে এল।

আমি কৌশিককে বললাম " কৌশিক সন্ধ্যা হয়ে গেছে এই বার কেম্পে ফিরে চল।"

কৌশিক বলল " আমারও কাজ শেষ। তাহলে এবার কেম্পে ফেরা যাক।"

আমরা জিনিষপত্র সব গুটিয়ে ফিরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর থেকে জোরে জোরে পশু পাখিদের ডাক ভেসে আসছিল। মনে হচ্ছিল তারা যেন কোন কিছু দেখে খুব ভয় পেয়ে জোরে জোরে ডাকছিল।

কিছুক্ষণ পর আমরা দেখলাম কিছু লোক হাতে মশাল নিয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। লোকগুলো আকারে বিরাট লম্বা ও মোটা যা স্বাভাবিক মানুষ কখনো হতে পারে না, লোকগুলো দেখতে বিভৎস তাদের চোখগুলো লাল, তাদের বিরাট লম্বা লম্বা চুল দাড়ি চুলগুলোতে জট পাকানো। তাদের পরনে ছিল পশুছাল।লোকগুলো আমাদের দেখে ভয়ঙ্কর জান্তব আওয়াজে হুংকার দিতে লাগল হুংকার দেওয়ার সময় আমি তাদের মুখের ভিতর বড় বড় লম্বা দাঁত দেখতে পাই এরকম দাঁত কখনো কোন মানুষের হতে পারে না।

এইসব দেখে অনচন ভয়ে কাঁপতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে সে বলল " এরা কেউ মানুষ নয় এরা রাক্ষস।"

হঠাৎ ওই রাক্ষসগুলোর পিছন থেকে একজন ভয়ঙ্কর দর্শন মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালো। মহিলাটিও দেখতে বিকট আকৃতির ও বিভৎস। মহিলাটিরও পরনে ছিল পশুছাল। মহিলাটির কপালের এক পাশ ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন খুব শক্ত কিছু দিয়ে জোরে আঘাত করে তার কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে । মহিলাটির ভয়ঙ্কর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ক্রোধ আর নিষ্ঠুর জিঘাংসা।

অনচন মাটিতে বসে প্রণাম করে বার বার বলতে লাগল " নিকষা মাই ক্ষমা কর ক্ষমা কর।"

আমি বুঝতে পারলাম এই মহিলা আর কেউ নয় সয়ং নিকষা ছাড়া।

মহিলাটি আঙ্গুল তুলে কৌশিকের দিকে ইশারা করল আর জান্তব আওয়াজে গর্জে উঠল। ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে সেই রাক্ষসগুলো আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

আমরা পালাবার চেষ্টা করেও পালাতে পারলাম না মনে হচ্ছিল আমাদের পা যেন মাটির সাথে লেগে আছে। আমরা একটুও নরাচরা করতে পারলাম না।

লোকগুলো আমাদের সামনে এসে কৌশিককে তুলে নিয়ে গেল। এরপর তারা হুংকার দিতে দিতে জঙ্গলের মধ্যে মিশে গেল। আমরা আর জলন্ত মশালের আলো দেখতে পেলাম না।

অনচন তখনো ভয়ে কাঁপছিল সে কাঁপতে কাঁপতে বলল " কৌশিক বাবুই নিকষা মাইএর মুর্তির কপাল ভেঙ্গেছিল তাই রাক্ষসরা কৌশিকবাবুকে তুলে নিয়ে গেল। কৌশিকবাবুকে আর কোনদিন খুঁজে পাবেন না রাক্ষসরা তাকে মেরে তার মাংস খেয়ে নেবে।"

আমি ভয় বিস্ময় ও বেদনা নিয়ে কেম্পে কোনমতে ফিরে গেলাম।

রাতে আমার প্রচন্ড জ্বর শুরু হল।

পরদিন অতিকষ্টে দিল্লি ফিরে আসি। দিল্লিতে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আমি সুস্থ হবার পর কৌশিকের বাবা মা ও পুলিশ আমার সাথে কৌশিকের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে আসে।

পরে কৌশিকের মা বাবা ও পুলিশ কৌশিককে অনেক খুঁজে কিন্তু কৌশিকের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।

আমি দিল্লি ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে আবার বাংলায় ফিরে আসি আর আবার সেই পুরোনো স্কুলের চাকরি জয়েন করি।


রাজীবদা গল্পটা শেষ করলেন। একটা বাজ পরার শব্দে আমি আবার বাস্তব জগতে ফিরে এলাম। আমি রাজীবদার গল্পের মধ্যে একদম হারিয়ে গিয়েছিলাম।

বৃষ্টি কমতেই রাজীবদার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হাঁটা দিলাম।



विषय का मूल्यांकन करें
लॉग इन

Similar bengali story from Horror