Sudeshna Mondal

Drama Romance Classics

3  

Sudeshna Mondal

Drama Romance Classics

নীলুপমা

নীলুপমা

23 mins
368



"এসো হে বৈশাখ, এসো হে

এসো হে বৈশাখ, এসো হে।।"


হঠাৎ করে ফোনটা বেজে ওঠায় নীলাদ্রির গান শোনায় ব্যাঘাত ঘটল। নিজের মনেই বলে উঠল - এখন আবার কে ফোন করছে। ফোনের স্ক্রিনে রজতের নম্বরটা দেখে একটু অবাক হল। রজত ওর খুব বিশস্ত কর্মচারী। নীলাদ্রি অব‍শ‍্য ওকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই স্নেহ করে। রজতও ওকে দাদার মতোই শ্রদ্ধা করে। রজতের পরিবার বলতে সেরকম কেউ নেই। শুধু ওর মা আর ও নিজে। তাই নীলাদ্রিই ওদের বাড়ির আউটহাউসটা পরিস্কার করিয়ে রজতদের থাকতে দিয়েছে। তাই রজতরাও ওদের বাড়ির সবার সাথে মিলেমিশে গেছে। এজন্য রজত জানে যে আজকের দিনে অফিসের কোনো কাজ নীলাদ্রি করে না। এমনকি কারোর ফোন করাটাও পছন্দ করে না। আজকের দিনে ও বাড়িতে থাকতেই পছন্দ করে। তাই রজতও এই দিনটায় ওকে বিরক্ত করে না। অফিসের সব কাজ যতটা পারে নিজেই সামলে নেয়। তাও আজ কেন ফোন করছে তাহলে... এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার রজতের ফোন দেখে নীলাদ্রি সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা ধরল। ও কিছু বলার আগেই ওপার থেকে রজতের গলা ভেসে এল।

- সরি স্যার, আমি আপনাকে ফোন করতে চাই নি। কিন্তু বাধ্য হয়ে করছি। আপনি আমার ওপর রাগ করবেন না।

- আগে বলো কী কারণে ফোন করেছ। তারপর বলব রাগ করেছি কি করিনি।

- অফিসে একজন ভদ্রলোক এসেছেন। উনি বলছেন উনি নাকি আপনার বন্ধু। আপনি ওনাকে চেনেন। উনি আপনার বাড়ির ঠিকানা চাইছেন। আপনি কলকাতায় নেই এটা বলাতেও উনি বিশ্বাস করছেন না আমার কথা।

- আচ্ছা, উনার নাম কী ?

- উনার নাম শ্রেয়ান মুখার্জি।

বহুদিন বাদে এই নামটা যে ওকে আবার শুনতে হবে ও সেটা আশা করেনি। তবে এই লোকটা ওর চেনা শ্রেয়ান কিনা তাতে ওর একটু হলেও সন্দেহ ছিল তাও রজতকে বলল ওর ঠিকানাটা দিয়ে দিতে। রজত একটা ভিজিটিং কার্ড লোকটাকে দিয়ে দিল। ফোনটা রেখে দিয়ে নীলাদ্রি ভাবতে লাগল - আজ হঠাৎ এতগুলো বছর পরে... ওতো সবকিছু ছেড়েই চলে গিয়েছিল তাহলে কেন আবার নতুন করে ওর জীবনে ফিরে আসছে ?...


নীলাদ্রি রায় চৌধুরী। কলকাতার আর পাঁচটা নামী বিজনেসম্যানদের মধ্যে একজন। বয়স এিশ। দেখতে কোনো সিনেমার হিরোর থেকে কম নয়। তবে খুব কম কথা বলে। দরকারের বেশি একটা শব্দও বলে না। কেউ কখনো অফিসে হাসতেও দেখেনি। বাড়ির সবাই ভেবে পায় না সব সময় প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি ছেলেটা এত গম্ভীর হয়ে গেল কী করে। তবে একটা জিনিস এখনো বদলায়নি। আগেও যেমন মেয়েরা ওর জন্য পাগল ছিল এখনো আছে। কলেজ লাইফে প্রায় সব মেয়েরাই ওকে পছন্দ করত। এককথায় বলা যায় ওর জন্য পাগল ছিল। কিন্তু ও পছন্দ করত একমাত্র...


- দাদাবাবু তোমার খাবারটা টেবিলে দেব নাকি এখানে দেব ?

নীলাদ্রির ভাবনায় ছেদ পড়ল। ও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল - বাড়ির সবাই চলে গেছে রঘুদা ?

- হ্যাঁ, দাদাবাবু। সবাই বেড়িয়ে পড়েছে। এতক্ষণে মনে হয় পৌছেও গেছে। তুমিও তো যেতে পারো সবার সাথে। সবার ভালোও লাগে। তোমারও পরিবারের সবার সাথে ঘোরা হয়।

তুমি তো জানো আমার কেন ভালো লাগে না কোথাও যেতে। তাও আমাকে কেন বলছ এসব কথা।

- গিন্নিমা সব সময় তোমার চিন্তায় মনমরা হয়ে থাকেন। তুমি সেটা দেখতে পাও না ? আমার আর কি। আমি চাকরবাকর মানুষ। তোমাদের খাই, তোমাদের পড়ি। গিন্নিমার কষ্ট আমি দেখতে পারি না। তাই তোমায় বললাম।

- আচ্ছা, ঠিক আছে। মা বাড়ি ফিরে এলে আমি মায়ের সাথে এই বিষয়ে কথা বলব। তুমি এক কাজ করো, আমার খাবারটা এখানেই দিয়ে যাও। আর শোনো, একজন আমার সাথে দেখা করতে আসবে। সে এলে তুমি তাকে বসতে বলো।

- ঠিক আছে দাদাবাবু। আমি নীচে গেলাম। তোমার কিছু লাগলে আমাকে ডেকো। 

রঘুদা অনেক দিন ধরেই ওদের বাড়িতে কাজ করে। এই বুড়ো মানুষটা নীলাদ্রিকে নিজের ছেলের থেকেও বেশী ভালোবাসে। ও কষ্ট পেলে উনিও কষ্ট পান। তবে ওঁর বলা কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে ও কেন বুঝতে পারে নি মায়ের কষ্টটা। ওকি নিজের দুঃখ-কষ্ট এসব ভুলে থাকার জন্য কাজের মধ্যে নিজেকে এতটাই ডুবিয়ে রাখে যে নিজের আশেপাশের মানুষগুলো ভালো আছে কিনা সেটার খোঁজখবর রাখে না। মায়ের সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও কথা বলবে। খাবারটা খেয়ে নিয়ে নীলাদ্রি গানের ভলিউমটা বাড়িয়ে দিল। গান শুনতে শুনতে পুরোনো স্মৃতির ভাবনায় ডুব দিল। 


ওর আজও মনে আছে সেই দিনটার কথা...


- ওই অনু, দাঁড়া তোর সাথে আমার কথা আছে।

- নাহ, তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই শ্রেয়ান।

আঃ... দেখে চলতে পারেন না। দিলেন তো আমার সব জিনিস ফেলে।

- আরে, আজব মেয়ে তো তুমি। নিজেই কোনো দিকে না তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসতে গিয়ে আমাকে ধাক্কা মারলে। সরি না বলে উল্টে আমাকেই দেখে চলতে বলছ।

- আমি সব তুলে দিচ্ছি, অনু। তুই চিন্তা করিস না।

- তোকে একবার বললাম তো। তোর সাথে কোনো কথা নেই। তোকে কোনো সাহায্য করতে হবে না। আমি নিজেই করে নিতে পারব।

- ও... এতো মিয়া বিবির ঝামেলা। চল নীল, আমাদের এখানে কোনো কাজ নেই।

- হ‍্যাঁ চল। অন‍্যের পার্সোনাল ব‍্যাপারে আমারও কোনো আগ্রহ নেই। কেন যে সবাই পার্সোনাল ব‍্যাপার পাবলিকে নিয়ে আসে কে জানে।

- এই যে শুনুন। আমাদের মধ্যে কোনো পার্সোনাল কিছু নেই। আমরা শুধুই ভালো বন্ধু। আপনার মনে হয় কোনো ভালো বন্ধু নেই তাহলে আপনি জানতেন দুজন ভালো বন্ধুর মধ্যে ঝগড়া আর দুজন ভালোবাসার মানুষের মধ্যে ঝগড়া ঠিক কীরকম হয়। আগে সেটা জানুন তারপর মন্তব্য করবেন। এইপ্রথম নীলাদ্রি একদম ক্লিনবোল্ড হয়ে গেল। ওর মুখ দিয়ে একটাও কথা বেরোল না। ও চুপচাপ তাকিয়ে থেকে অনুপমার চলে যাওয়া দেখতে লাগল। অনুপমার বলা কথা নীলাদ্রি কিছুতেই ভুলতে পারছে না। বারবার অনুপমার কথা মনে পড়ছে। একদিন কলেজ ক‍্যান্টিনে নীলাদ্রি ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছিল তখন ও কয়েকটা মেয়েকে গান করতে দেখে সেইদিকে যায়। ওখানে গিয়ে ও শুনতে পায়...


"আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো

তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো।"


ও জানত না যে মেয়েটা গান গাইছে সে অনুপমা। ও প্রায়ই আসত আর এসে দূর থেকেই গান শুনত। এটা ওর কাছে একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। অনুপমাকে ওর বান্ধবীরা বলেছিল, একটা ছেলে নাকি রোজ এসে ওর গান শোনে। তবে ও এটাকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি। কারণ রবীন্দ্রজয়ন্তির আর বেশী দেরি নেই। যারা নাটক করবে তাদের সব কমপ্লিট হয়ে গেছে। ওদেরও গানের রিহার্সাল হয়ে গেছে। এতকিছুর মাঝে ওর একটা জিনিস এখনো জানা হয়নি। ওদের সাথে যে ছেলেটা গিটার বাজাবে সে কে। শুধু ওর বান্ধবী প্রিয়াঙ্কার কাছে তার নাম শুনেছে, নীলাদ্রি রায় চৌধুরী। প্রিয়াঙ্কা তো নীলাদ্রি সম্পর্কে এত কিছু বলেছে ওতো ভেবেই নিয়েছিল নীলাদ্রি ওর বয়ফ্রেন্ড। সেই ভুলটা অবশ্য প্রিয়াঙ্কাই ভেঙে দিয়েছে। যথারীতি অনুষ্ঠানের দিন সবাই ঠিক সময়ে চলে এসেছে। প্রথমে ওদের প্রিন্সিপাল স‍্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিতে মাল‍্যদান করে মোমবাতি জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ করবেন। তারপর কবিগুরু সম্পর্কে কিছু বক্তব্য রাখবেন। তারপর প্রথম বর্ষের ছেলেমেয়েরা একটা গান পরিবেশন করবে। তারপর তৃতীয় বর্ষের একটা নাচের পরেই ওদের গান। সবাই স্টেজে চলে এসেছে। অনুপমা আজকে খুব সুন্দর হলুদ রঙের একটা শাড়ি পড়েছে, খোঁপায় ফুল লাগিয়েছে। আজকে ওর দিক থেকে চোখই সরানো যাচ্ছে না। হঠাৎ অনুপমা খেয়াল করল হলুদ রঙের পাঞ্জাবী পরা একটা ছেলে গিটার হাতে স্টেজের ওপর উঠে আসছে। কিছুক্ষণ পর ও নীলাদ্রিকে চিনতে পারল। তবে ও এটা জানত না যে এই সেই নীলাদ্রি যার কথা ওকে প্রিয়াঙ্কা বলেছিল। নীলাদ্রিও অবাক হয়েছে অনুপমাকে দেখে। এমনভাবে হা করে অনুপমাকে দেখছিল যে ওর বন্ধু কৌশিক বলেই ফেলল - ভাই নীল, এবার মুখটা বন্ধ কর নাহলে মশা ঢুকে যাবে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে নীল নিজেকে সামলে নেয়। এরপর ওরা গান শুরু করল - 


" আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো

তোমা ছাড়া আমার এ জগতে আর কেহ নাই, কিছু নাই গো।।

তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও---

আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো।।


ওদের গানে হাততালিতে ভরে গেছে পুরো অডিটোরিয়াম হল। নীলাদ্রি তো পুরো অবাক হয়ে গেছে। ও এতদিন রোজ যার গান লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতো সে আর কেউ নয় অনুপমা। এই মেয়েটা ঝগড়া ছাড়াও এত ভালো গান গাইতে পারে সেটা ও ভাবতেও পারিনি। ও ভাবল একবার গিয়ে কথা বলবে। সেইদিন ওইভাবে বলার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নেবে। কিন্তু ও যতবারই কথা বলতে যায় অনুপমা ওকে এড়িয়ে চলে যায়। এর মধ্যে মাইকে ঘোষণা শুনতে পায়। ওদের মূল অনুষ্ঠান শেষ। নাটকের পরে ওরা নিজেদের জন্য ছোট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। যেখানে শুধু ছাত্রছাত্রীরা থাকবে। এবার সেটাই শুরু হবে। প্রথমেই ওরা নীলাদ্রিকে ধরেছে একটা গান গাওয়ার জন্য। এটা দেখে অনুপমা মনে মনে ভাবছে এই হুকোমুকোটা আবার গান গাইতে পারে নাকি। শুধু ভালো গিটার বাজালেই গান গাওয়া যায় না। কেন যে সবাই ওকে বলছে কে জানে। অনুপমা জানত না ওর জন্য কী চমক অপেক্ষা করছে।


আচমকা ও শুনতে পায়---


" আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি

আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি 

বাজে কিনিকিনি রিনিঝিনি

তোমারে যে চিনি চিনি

মনে মনে কত ছবি এঁকেছি।।

ছিলো ভাবে ভরা দুটি আঁখি চঞ্চল 

তুমি বাতাসে উড়ালে ভীরু অঞ্চল।

ওই রূপের মাধবী মোর সংশয়ে রেখেছি।।

আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি 

আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি "


গান কখন শেষ হয়ে গেছে সে দিকে অনুপমার খেয়াল নেই। ও চোখ বন্ধ করে একমনে নীলাদ্রির গান শুনছিল। বলা যায় ওর গানের প্রতিটা কথাকে ও অনুভব করার চেষ্টা করছিল। তাই খেয়াল করেনি নীলাদ্রি একদম ওর সামনে এসে কখন দাঁড়িয়েছে।

- আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিল।

- অ‍্যাঁ ! ওহ আপনি। হ‍্যাঁ বলুন। আপনি তো দারুন গান গাইতে পারেন। আপনাকে দেখে মনে হয় না।

- আচ্ছা তাই নাকি। সে তো আপনাকে দেখেও মনে হয় না আপনি এত ভালো গান করেন।

- ওই অনু, এবার চল। শ্রেয়ান অনেকক্ষণ ধরে গেটের বাইরে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

- হ‍্যাঁ যাচ্ছি। আমি তো ভুলেই গেছিলাম ওর কথা। আচ্ছা, আজ আসি তাহলে। আবার দেখা হবে।

- হ‍্যাঁ, যান। আপনার শুধুই ভালো বন্ধু আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। 

- আপনি তো খোচা দিয়ে কথাও বলতে পারেন। আর কী কী গুন লুকিয়ে রেখেছেন বলুন তো।

- সেটা জানতে গেলে তো আরও একদিন দেখা হওয়াটা জরুরি। সবকিছু একদিনে জানতে নেই। আসতে আসতে জানতে হয়। খোচা দিয়ে কথা কেন বলে জানেন ?

- কেন বলে শুনি। আমি তো জানি না।

- যাতে সেই মানুষটার কথা সবসময় মনে থাকে।

- বাব্বা, আপনি অনেককিছু জানেন দেখছি। আবার কোনো একদিন বাকীটুকু শুনব। আজ চলি।

আজও নীলাদ্রি আগের দিনের মতোই অনুপমার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল। শুধু আজকের অনুভূতিটা অন্য রকম। তাহলে কি ও অনুপমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। 

- ভাই নীল, তুই এই মেয়েটাকে দেখলে এরকম ক‍্যাবলাকান্ত হয়ে যাস কেন বল তো।

- ধুর, কী আবোলতাবোল বকছিস। আমি ক‍্যাবলাকান্ত হতে যাব কেন। ওটা তুই হয়ে যাস যখন তুই ওর বান্ধবী প্রিয়াঙ্কাকে দেখিস। আমি সব জানি তোদের ব‍্যাপারে। চল এবার বাড়ি যাই।


পরের দিন কলেজ ছুটির পরে...

ওই অনু, চল না আজকে আমরা তিনজনে ফুচকা খেতে যাই ? তারপর আমরা একসাথে ইংলিশ কোচিং-এ যাব।

- না রে আজ আমার শরীরটা ভালো নেই। আজকে আমি পড়তেও যাব না। তুই আর শ্রেয়ান যা গিয়ে ফুচকা খেয়ে আয়।

- কী বলছিস তুই ? আমি ঠিক শুনলাম তো। যে মেয়ে ফুচকার নাম শুনে এককথায় রাজি হয়ে যেত, ফাউ ফুচকার জন্য রীতিমতো ঝগড়া করত ফুচকাওয়ালার সাথে সে আজকে বলছে ফুচকা খেতে যাবে না। ওরে শ্রেয়ান, আমি যা শুনলাম তুইও তাই শুনলি তো।

- প্রিয়াঙ্কা, তুই যা। আমি ওকে রাজি করিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। প্রিয়াঙ্কা অবশ‍্য শ্রেয়ানের চলে যেতে বলা সত্ত্বেও ওখানে দাঁড়িয়ে রইল।

- এই অনু, কী ব‍্যাপারটা বল তো তোর। কাল থেকে আমি লক্ষ্য করছি তোর কিছু একটা হয়েছে। কালকে বাড়ি গিয়ে সারাক্ষণ ওই নীলাদ্রি ছেলেটার ব‍্যাপারে বকবক করছিলি। আজকে আবার কিছু ভালো লাগছে না বলছিস। কী হয়েছে তোর ?

- আরে, কী আবার হবে। আজকে আমার ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে না ব‍্যাস। আর কিছুই না। তুই আবার এখানে নীলাদ্রিকে টানছিস কেন। আর ওর সাথে তো আমার কালকেই আলাপ হল। এর আগে তো আমরা একে অন‍্যকে চিনতামই না। কথাটা বলে অনুপমা আর এক মূহুর্তও ওখানে দাঁড়ালো না। সোজা বেড়িয়ে চলে গেল।

এসব শুনে প্রিয়াঙ্কা হঠাৎ বলে উঠল - এদের দুজনেরই একি অবস্থা।

- দুজন মানে ? তুই কাদের কথা বলছিস।

- একজন তো অনু আর একজন হল নীল।

- নীল... মানে নীলাদ্রি রায় চৌধুরী। যে কালকে গান গেয়ে ফাটিয়ে দিয়েছে। ওর আবার কী হল। 

- ও নাকি খালি অনুপমার নামই জপ করছে। 

- তোকে আবার এসব খবর কে দিল শুনি।

- আমাকে ওর বন্ধু কৌশিক বলেছে। কৌশিক... যে সারাক্ষণ নীলাদ্রির আগে পিছনে ঘুরে বেড়ায়। ও বলল আর তুই বিশ্বাস করে নিলি। যা তা লোকজন যতসব আবোলতাবোল খবর দেয় আর তুই সেটা বিশ্বাস করিস।

- এই একদম যা তা লোক বলবি না কৌশিককে। যেটা সত্যি আমি সেটাই বলেছি। তোর বিশ্বাস করতে হলে কর না হলে করিস না। কিন্তু ওদের মধ্যে কিছু তো একটা চলছে।

কথাটা শুনে শ্রেয়ানের খুব রাগ হল। ও একপ্রকার রেগেই বলল - ওদের মধ্যে কিছু চলছে না। আর কিছু হবেও না। তোর মাথা থেকে এইসব ভুলভাল চিন্তাগুলোকে বের করে দে। কথাটা বলে শ্রেয়ানও সেখান থেকে চলে গেল।

প্রিয়াঙ্কা আপনমনে বলল - কিছু হওয়ার আর বাকি নেই। অলরেডি হয়ে গেছে। সেটা কতটা হয়েছে এটা আমাকে জানতে হবে।


শ্রেয়ান বরাবরই একটু রগচটা ধরনের। আর ভীষণ শক্ত মনের ছেলে। ওর একমাত্র দুর্বল জায়গা হল অনু। অনুকে খুব ভালোবাসে কিন্তু আজও মুখ ফুটে সে কথা বলেনি। প্রিয়াঙ্কার বলা কথাগুলো ও কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। আবার অনুকে গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করতেও পারছে না। ও তাই ঠিক করল নীলাদ্রির সাথেই একবার কথা বলবে। পরেরদিন কলেজ গিয়ে ও নীলাদ্রির দেখা পায়নি। নীলাদ্রি সেদিন কোনো একটা কারণে কলেজ আসেনি। তিন দিন বাদে...

- হাই, নীলাদ্রি। 

- হ‍্যালো। কিন্তু তোকে তো ঠিক চিনলাম না। পাশ থেকে কৌশিক বলতে যাচ্ছিল ও কে। কিন্তু শ্রেয়ান হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল - থাক। আমার পরিচয়টা আমিই দিচ্ছি। আমি শ্রেয়ান... শ্রেয়ান মুর্খাজি। অনুপমার বন্ধু। সেই সেদিন দেখা হয়েছিল।

- হ‍্যাঁ মনে পড়েছে। 

- আমার তোর সাথে কিছু কথা ছিল।

- আমার সাথে...হ‍্যাঁ বল কি বলবি।

- এখানে না। আমার সাথে আয়।

- দেখ কিছু বলার হলে এখানেই বল। কৌশিক আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই ওর সামনে বলতে পারিস।

- তুই যদি অনুপমাকে ভালোবাসিস তাহলে ওকে ভুলে যা। কারণ আমি ওকে ভালোবাসি। কথাটা তুই ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নে।

হঠাৎ করে এরকম একটা কথা নীলাদ্রি আশা করেনি। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে শ্রেয়ানের কথাগুলো শুনছিল। এরপর আর চুপ থাকতে না পেরে বলল - দেখ আমরা একে অপরকে পছন্দ করি কিন্তু সেই কথাটা আমরা কেউই কাউকে এখনো পযর্ন্ত বলিনি। ও যদি তোকে ভালোবাসে তাহলে ও তোরই থাকবে। আমি তোদের মাঝে আসব না। আর ও যদি আমাকে ভালোবাসে তাহলে আমি ওকে ছেড়ে কোথাও যাব না। তুই এটা ভালো করে বুঝে নে।

- হা...হা...হা। তুই পাশ করে গেছিস। তুই সত্যিই অনুকে ভালোবাসিস। আমি তো তোর পরীক্ষা নিচ্ছিলাম আর তুই সেই পরীক্ষায় পাশ করে গেছিস।

- হঠাৎ করে শ্রেয়ানের এরকম পরিবর্তন দেখে ওরা অবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর অনুপমাকে ওদের দিকে আসতে দেখে ওরা বুঝতে পারল শ্রেয়ানের হঠাৎ পরিবর্তনের কারণটা।

- কীরে তুই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিস। আর আমি তোর জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি। তুই জানিস না আজকে আমরা কোথায় যাই। তাড়াতাড়ি চল। এমনিতেই অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। ও এতক্ষণ নীলাদ্রিকে লক্ষ্য করেনি। এবার ওকে দেখে বলল - আরে আপনিও রয়েছেন। আমি একদম খেয়াল করিনি। প্লিজ.. কিছু মনে করবেন না। 

- আরে না না। আমি কিছু মনে করিনি।

- আচ্ছা, তোরা এখানে কী কথা বলছিলিস।

- সেরকম কিছু না রে অনু। আসলে সেদিন তুই এতবার ওর কথা বলছিলিস তাই ভাবলাম আজকে ওর সাথে কথা বলি।

- ওহ, আচ্ছা। তাই বল। আমি তো ভাবলাম... ছাড় কিছু না। চল এবার যেতে হবে তো।

- শোন না অনু, বলছিলাম আমাদের সাথে নীলাদ্রিকে নিয়ে গেলে কেমন হয় ? ওর ভালো লাগবে তাছাড়া ওদেরও একজন নতুন বন্ধু হবে।

শ্রেয়ানের প্রস্তাবটা অনুপমার ভালো লাগল। ও বলল - যাকে নিয়ে যাবি বলছিস সে যেতে চায় কিনা সেটা জিজ্ঞেস কর। 

- আমরা একটা জায়গায় যাচ্ছি। সেখানে গেলে তোরও ভালো লাগবে। তুই কি আমাদের সাথে যাবি ?

- ভালো লাগবে যখন বলছিস তখন যাওয়ায় যায়। 

- চল তাহলে... তুই আর কৌশিক আমাদের সাথে। ওরা চারজন মিলে বেড়িয়ে গেল।

অবশেষে ওরা পৌঁছে গেল। এটা একটা বাচ্চাদের অনাথ আশ্রম। এখানে সপ্তাহে দুদিন করে অনুপমা আসে। বাচ্চাদের সাথে কিছুটা সময় কাটায়। ওদের পড়ায়, গান শেখায়। ওর খুব ভালো লাগে এখানে আসতে। শ্রেয়ানও মাঝে মাঝে আসে। আজকে এখানে এসে নীলাদ্রিরও খুব ভালো লেগেছে। ও ঠিক করেছে এবার থেকে অনুপমার সাথে ও সপ্তাহে দুদিন করে এখানে আসবে। এইভাবে আসতে আসতে ওদের ভালোলাগা কবে যে ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেল ওরা কেউ বুঝতেই পারেনি। দেখতে দেখতে আবার একটা রবীন্দ্র জয়ন্তি এসে গেল। নীলাদ্রি ঠিক করেছে অনুষ্ঠানের দিন অনুপমাকে ওর মনের কথা বলবে। ওদিকে অনুপমাও ঠিক করেছে ওর মনের কথাও নীলাদ্রিকে বলবে। দুজনেই মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছে। কখন নিজেদের মনের কথা একে অন‍্যকে বলবে। ওরা কেউই জানত না ওদের জন্য ভগবান অন্য কিছু ঠিক করে রেখেছে।


হঠাৎ ফোনের আওয়াজে নীলাদ্রির ঘুমটা ভেঙে গেল। গান শুনতে শুনতে কখন যে নীলাদ্রির চোখটা লেগে গিয়েছিল ও টের পায়নি। চোখ খুলে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল শতরূপার দশটা মিসড কল। এতবার কেন ফোন করেছে ভেবে ও একটু ঘাবড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শতরূপাকে ফোন করল - তোমরা সবাই ঠিক আছ তো। বাবা-মা ঠিক আছে তো ? তুমি কিছু বলছ না কেন ? তুমি ঠিক আছ তো ?

- তুমি একটু চুপ করলে আমি কিছু বলতে পারি। একসাথে এত প্রশ্ন করলে কোনটার উত্তর দেব।

- সরি সরি। আসলে তোমার এতগুলো মিসড কল দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ফোন করেছিলে কেন ?

- যদি বলি এমনি ফোন করেছিলাম। তোমার সাথে কথা বলব বলে।

- এইসব আজেবাজে না বকে কী বলবে বলো।

- মামনি তোমার সাথে কথা বলবে বলে তোমাকে ফোন করেছিল আমার ফোন থেকে। তুমি ধরো নি তাই অনেকবার করেছিল। আর কিছু না। আমি রাখছি। বাড়ি গিয়ে মামনি তোমাকে বলবে কেন ফোন করেছিল। নীলাদ্রির উত্তরের অপেক্ষা না করেই শতরূপা ফোনটা কেটে দিল।

মা কী এমন কথা বলার জন্য ফোন করেছিল কে জানে। শতরূপাও কিছু বলল না। আজব মেয়ে একটা। কখন রেগে যায় কখন ভালো মুডে থাকে কিছুই বোঝা যায় না। ফোনটা রেখে দিয়ে ও স্নান করতে গেল। 


শতরূপা ওর বাবার বন্ধু, সমরেশ সান‍্যালের মেয়ে। নীল যতটা চুপচাপ রূপা ততটাই চঞ্চল। আর ভীষণ পরোপকারি। ও একটা বাচ্চাদের এন.জি.ও চালায়। এন.জি.ও টা আসলে ওর দিদির, ওর দিদির সাথে মিলে ওরা এটা চালায়। শতরূপা ওর দিদিকে ভীষণ ভালোবাসে। নীল অবশ‍্য চেনে না ওর দিদিকে। রূপার কাছ থেকেই যেটুকু জেনেছে। ওখানে গেলে ওখানকার ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে ও যেন বাচ্চা হয়ে যায়। সবার আবদার মেটানোর চেষ্টা করে। নীলকেও অনেকবার বলেছে যাওয়ার জন্য কিন্তু কাজের চাপে ওর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে রোজ না হলেও সপ্তাহে একবার খবর নেয় ওখানে কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা। নীল যে ওদের এন.জি.ও র জন্য টাকা দেয় সেটা রূপা জানে না। এইসব কাজ অবশ‍্য নীল রজতকে দিয়েই করায়। এরপর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। বাড়ির সবাই ফিরে এসেছে। এর মধ্যে একদিন শতরূপা ওর বাবার সাথে ওদের বাড়ি এল। নীলাদ্রিকে ডেকে ওর মা বলল - বাবু, আজ তোকে একটু সন্ধেবেলা থাকতে হবে। নীলাদ্রি ঠিক আছে বলে চলে গেল। 

সন্ধেবেলা বাড়িতে পুরোহিত মশাইকে দেখে ও জানতে চাইল - বাড়িতে কোনো পূজো হবে কিনা।

- না বাবু। আমি আজ সবাইকে ডেকেছি তোমার আর রূপার বিয়ের তারিখ ঠিক করব বলে। তোমাদের আর্শীবাদের সময় তোমরা দুজনেই কিছুটা সময় চেয়েছিলে অনেক সময় পেয়েছ এবার বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো। মা যে হঠাৎ করেই বিয়ের তারিখ ঠিক করবে ও ভাবতেই পারে নি। ওর মতো শতরূপাও অবাক হয়ে গেছে। নীলাদ্রি ওর মায়ের কথার ওপর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ শুনে গেল। শুধু শতরূপা একবার নীলাদ্রির সাথে কথা বলতে চাইল। ওরা দুজনে নীলের ঘরে গেল।

- তুমি আবার কী বলবে আমাকে।

- দেখ তুমি যদি এই বিয়েটা শুধুমাত্র তোমার পরিবারের লোকের কথায় করছ তাহলে আমি বলব তুমি এই বিয়েটা করো না। আমি জানি এই বিয়েটা ভেঙে গেলে সবাই খুব কষ্ট পাবে। কিন্তু বিয়ের পর যখন সবাই জানবে আমরা এই বিয়েতে খুশি নই তখন আরও বেশি কষ্ট পাবে। তার থেকে বিয়ে না হওয়ায় ভালো।

- দাঁড়াও দাঁড়াও... তোমাকে কে বলল আমি এই বিয়েটা পরিবারের ইচ্ছে করছি।

- তোমার ইচ্ছেতে করছ সেটাও তো বলো নি। আজ পযর্ন্ত কখনও একটু হেসে কথা বলেছ আমার সাথে। কখনও ফোন করে জানতে চেয়েছ আমি কেমন আছি। আমি ফোন করলে কখনও ভালোবেসে কথা বলেছ। আমাদের আর্শীবাদের পর আমরা কোথাও একসাথে ঘুরতে গেছি। এরপরও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে তুমি এই বিয়েটা নিজের ইচ্ছায় করছ। আজও তোমার কাছে কোনো কথা নেই আমাকে বলার মতো। আমি আসছি। তুমি যদি বলতে না পারো আমিই বাপিকে বলে এই বিয়ে ভেঙে দেব। 


আজ প্রথম নীলাদ্রি এতক্ষণ ধরে শতরূপার দিকে তাকিয়ে ছিল। আজ প্রথম ও লক্ষ্য করল শতরূপার হেঁটে যাওয়াটাও ঠিক অনুপমার মতো। কিন্তু ও যে কথাগুলো বলল সেগুলো সব সত্যি। ও তো কোনো দিন শতরূপার সাথে ভালো করে কথাই বলে নি। মেয়েটা ওকে এত ভালোবাসে সেটা ও বুঝতেই পারেনি। সেদিন সারারাত শুধু শতরূপার কথাই ভাবছিল। কখন চোখটা লেগে গিয়েছিল খেয়াল নেই। 


পরের দিন...

অনুষ্ঠানের পর ওরা দুজন দেখা করবে ঠিক করেছিল। সেই মতো নীলাদ্রি অনুপমার সাথে দেখা করবে বলে ব‍্যাক স্টেজের দিকে গেল। কিন্তু ওখানে গিয়ে ও যা দেখল সেটা ও স্বপ্নেও আশা করেনি। অনুপমা শ্রেয়ানের বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে আর শ্রেয়ান ওকে জড়িয়ে ধরে আছে। এইসব দেখে ও নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। ওখান থেকে চলে গেছিল। আর কোনো যোগাযোগ পযর্ন্ত রাখেনি। সবাই অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু ও কারোর কথাই শোনে নি। সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিল।


হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ওই বিচ্ছিরি স্মৃতিটা মনে করে। ও ঠিক করল সব কিছু শেষ হওয়ার আগে ও চেষ্টা করবে ওর ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার। আর কিছুক্ষণ পর সকাল হয়ে যাবে। ও নিজে শতরূপার বাড়ি যাবে। সকালবেলা উঠে কোনো রকমে ব্রেকফাস্ট করে ও বেড়িয়ে পড়ল। কিন্তু ওর বাড়ি গিয়ে ও জানতে পারল শতরূপা কিছুদিনের জন্য শিলিগুড়ি গেছে ওর দিদির কাছে। ওদের এন.জি.ও র প্রোগ্রামের জন্য। রূপার বাবা এই সাতসকালে ওকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন - কী ব‍্যাপার নীল, তুমি জানতে না ও যাবে। ও তোমাকে কিছু বলে নি। সত্যি কথাটা না বলে ও বলল - জানিয়েছিল আমাকে। আমিই কাজের চাপে ভুলে গেছিলাম কবে যাবে। ঠিক আছে। আজ আমি আসি। আমাকে অফিস যেতে হবে। অফিসে বসে ও কাজ করছিল। হঠাৎ রজত এসে বলল - স‍্যার, সেই দিন যিনি এসেছিলেন উনি আজকে এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন। নীল সেই ব‍্যাপারটা একদম ভুলেই গিয়েছিল। রজতকে বলল - পাঁচ মিনিট পরে পাঠিয়ে দিও। ঠিক আছে স‍্যার বলে রজত চলে গেল।


- আসতে পারি ?

- বহুদিন পরেও এই গলার আওয়াজ শুনে ওর চিনতে অসুবিধা হল না ওর সাথে যে দেখা করতে এসেছে সে আর কেউ নয় ওরই পরিচিত একজন। 

- কেমন আছিস, নীলাদ্রি। ভালো আছিস সেটা বুঝতেই পারছি। তাও একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল। সেই যে তুই চলে গেলি আর তো কোনো যোগাযোগই রাখলি না।

- তুই এখানে কেন এসেছিস। কী চাস তুই।

- তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই আজও আমাকে ভুল ভাবিস। তুই সেদিন কী হয়েছিল পুরোটা না জেনে আমাদেরকে ভুল বুঝেছিলিস। আজও সেই ভুলটাই বুঝিস। তুই একবারও সত্যিটা জানার চেষ্টা করিস নি।

- তোর যদি দরকারি কথা বলার না থাকে তাহলে তুই আসতে পারিস। আমার এসব ফালতু কথা শোনার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই।

- তুই খুব ব‍্যস্ত মানুষ আমি সেটা জানি। তোর বেশি সময় আমি নষ্ট করব না। কয়েকটা কথা তোকে জানাতে এলাম।

- কি বলবি বল।

-সেদিনও আমাদের মধ্যে কিছু ছিল না আর আজও কিছু নেই। সেদিনও অনু শুধু তোকেই ভালোবাসত আর আজও বাসে। সেদিন ওর বাবার অ‍্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে ও খুব ভেঙে পড়েছিল। ও তোকে অনেকবার ফোন করেছিল কিন্তু তুই কলেজের অনুষ্ঠানে এতটাই ব‍্যস্ত ছিলিস যে ফোনটা ধরিস নি। তুই যখন এসেছিলিস অনু তখন খুব কান্নাকাটি করছিল আমি ওকে একজন ভালো বন্ধু হিসাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম কিন্তু তুই অন্য কিছু ভেবে নিয়ে আমাদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেলি। একবারও সত্যিটা জানতে চাইলি না। যাকে ভালোবাসলি তাকে তো একটু ভরসা করতে পারতিস তাহলে এতগুলো বছর ধরে এত কষ্ট পেতে হত না। আর একটা কথা... তোর নিশ্চয়ই মনে আছে অনু একটা বাচ্চাদের আশ্রমে যেত। ওর স্বপ্ন ছিল ওই আশ্রমটাকে অনেক বড়ো করবে। ও সেটা করেওছে। কলকাতাতেও ওই আশ্রমের একটা শাখা আছে যেটা ওর বোন দেখাশোনা করে। কালকে ওই আশ্রমকে কেন্দ্র করে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমি চাই তুইও ওখানে আয়। আমন্ত্রণ পত্রটা রেখে গেলাম। 

শ্রেয়ান চলে যাওয়ার পর নীলাদ্রি চুপ করে ওর চেয়ারে বসে রইল। ও ঠিক কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সবকিছু ওর কাছে কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। রজতকে বলে বাড়ি চলে গেল। ও বাড়ি এসে দেখল শতরূপার বাবা এসেছেন। ওকে দেখে ওর মা বলল - বাবু, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। তোমার আর রূপার মধ্যে কিছু হয়েছে ?

- কী আবার হবে। কিছু হয় নি তো।

- কিছু যদি না হয় তাহলে ও এই বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইছে কেন।

এই কথাটা শুনে ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। শতরূপা যে সত্যি সত্যিই এই সিন্ধান্ত নেবে ও আশা করে নি। ও চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল - আমি খুব বাজে একটা মানুষ। সব সময় সব ভুল করি। আমি কারোর ভালোবাসার যোগ্য নয়। অনেক ভেবে ও ঠিক করল - ও যাবে শতরূপাকে ফিরিয়ে আনতে। একবার যে ভুল করেছে সেটা আর করবে না। রজতকে ফোন করে বলল ও কালই শিলিগুড়ি যাবে। 

ও কোনোদিন ভাবিনি একদিন এই ভালোবাসার জন‍্যই ও এখান থেকে চলে গেছিল আবার সেই ভালোবাসার জন‍্যই ও আবার এখানে আসছে। রূপার দিদির আশ্রমের ঠিকানাটা ওর বাবার কাছ থেকে নীল নিয়ে নিয়েছিল বলে খুঁজে পেতে বেশি অসুবিধা হয় নি। এতগুলো বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। ও একটা গাড়ি ভাড়া করে এসেছে। গেটের সামনে ওকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা চলে গেল। ও দেখল গেটের ওপরে লেখা রয়েছে - "নীলুপমা"। ও সোজা ভেতরে চলে এল। একটি মেয়ে ওকে দেখে জিজ্ঞেস করল - স‍্যার, আপনি কী কাউকে খুঁজছেন ?

- হ‍্যাঁ.. আসলে...

- ওই তো ম‍্যানেজার বাবু আসছেন। আপনি ওনার সাথে কথা বলুন।

ও ঘুরে তাকিয়ে পুরো অবাক হয়ে গেছে। ম‍্যানেজার বলে মেয়েটা যাকে দেখিয়েছে সে আর কেউ নয় শ্রেয়ান। শ্রেয়ান তো ভীষণ খুশি নীলকে দেখে। ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে ভেতরে গেল অনুপমার কাছে।


তুমি..? এখানে ? 

ওকে দেখে রূপা প্রশ্ন করে ওঠে। 

একসাথে নিজের অতীত আর বর্তমানকে দেখে নীল স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রূপা যে নীলকে চেনে সেটা দেখে শ্রেয়ানও অবাক হয়েছে। তবে আরও বেশি অবাক হল যখন রূপা বলল - দিদি, ও হচ্ছে নীল,নীলাদ্রি রায় চৌধুরী, বাপি ওনার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক করেছেন, আর ও হচ্ছে আমার দিদি, অনুপমা স‍ান‍্যাল।

- নমস্কার। আপনারা কথা বলুন আমি আসছি বলে অনুপমা শ্রেয়ানকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

- তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না। কেন এসেছ এখানে।

- তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। নিজের ভুলগুলোকে শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ দাও, প্লিজ। বাড়ি ফিরে চলো।

এমন সময় শ্রেয়ান এসে রূপাকে ডেকে নিয়ে গেল। রূপা চলে যাওয়ার পর অনুপমা এসে নীলকে বলল - আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে। ওর সাথে অনুপমা কথা বলবে এটাই ও ভাবেনি। ও যা করেছিল তার পরও... কী কথা বলো।

- আমার বোন তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। ওকে কষ্ট দিও না। সবাই সব কষ্ট সহ‍্য করতে পারে না।

- সরি, অনু। সেদিন কোনো কিছু না জেনে তোমাকে ভুল বুঝে আমার চলে যাওয়া উচিত হয় নি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।

- তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। আমি পুরোনো সব কিছু ভুলে গেছি। মনেও করতে চাই না। তুমিও সব কিছু ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। 

- অনু...।

- একটা কথা মনে রেখো, তুমি আমাকে কোনো দিন সত্যিকারের ভালোবাসোনি। তাই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পেরেছিলে। কিন্তু রূপাকে তুমি সত্যিই ভালোবেসেছ তাই ওর জন্য সবকিছু ছেড়ে এখানে এসেছ। নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে যেতে দিও না।

- তোমার কথাগুলো সারাজীবন মনে রাখব। রূপাকে কোনো কষ্ট পেতে দেব না।

রূপাকে ডেকে নিয়ে এসে ওর হাত নীলাদ্রির হাতে দিয়ে বলল - এই যে ধরুন। এই পাগলিটাকে অনেক সহ‍্য করেছি এবার আপনার পালা।

শ্রেয়ান সবাইকে ডাকতে এল - তাড়াতাড়ি আয়। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল তো।

- শ্রেয়ান দা, তুমি নীলকে নিয়ে যাও। আমার দিদির সাথে কিছু কথা আছে। ওরা দুজন চলে গেলে রূপা অনুকে বলে - দিদি, এবার তুইও বিয়েটা সেরে ফেল। শ্রেয়ানদা কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসে। আর কতদিন তুই বুঝেও না বুঝে থাকবি ?

- হুমম। ঠিক বলেছিস। এবার নিজেকে নিয়েও ভাবা উচিত। এখন তো চল। না হলে অনুষ্ঠানটাই দেখা হবে না।

অনুষ্ঠান খুব ভালো ভাবেই মিটল। তবে বাচ্চাদের একটা অনুরোধ আছে তাদের প্রিয় অনু দিদির কাছে। অনেক দিন ওরা ওদের অনু দিদির গান শোনে নি। 

শ্রেয়ান মাইক নিয়ে ঘোষণা করল - বাচ্চারা আজকে শুধু অনু দিদি নয়, নীল দাদা আর রূপা দিদিও তোমাদের গান শোনাবে।

ওর হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে রূপা বলল - ছোট্ট একটা ভুল হয়ে গেছে। আজকে অনু দিদির সাথে শ্রেয়ান দাদা, নীল দাদা আর রূপা দিদি, সবাই গান গেয়ে শোনাবে। বাচ্চারা সবাই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল।


"আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো।

তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো।।

তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও --

আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো।।

আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস -

দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস।....


(সমাপ্ত)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama