নববর্ষের কুঁড়ি (পর্ব - ৪)
নববর্ষের কুঁড়ি (পর্ব - ৪)


কয়েকদিন ধরেই গুল্লি বলছে ওর কোমরের কাছে খুব ব্যথা। দেবরূপের দেওয়া ওষুধ ও খাচ্ছে বটে, কিন্তু লাভ খুব একটা হচ্ছে না। সেদিন অর্পিতা গুল্লিকে কাছে ডেকে বলে, "দেখি কী হয়েছে তোর?" ওকে পেছন ঘুরিয়ে ফ্রকটা তুলতেই চমকে ওঠে অর্পিতা। কোমরের ঠিক ওপরে একটা লম্বা কাটা দাগ। অর্পিতা নিশ্চিত যে ওটা অপারেশনের দাগ। সঙ্গে সঙ্গে রাজুর জামা তুলতে একই ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ে ওর। দেবরূপ তখনও হাসপাতাল থেকে ফেরেনি। তাহলে কী ও যা সন্দেহ করছে, সেটাই সত্যি? চমকে ওঠে অর্পিতা।
গত পরশু দেবরূপ বাড়ি ফিরলে ওকে এসব কথা বলে না অর্পিতা। ওয়াশ রুমে ও ফ্রেশ হতে যাওয়ার সাথে সাথে ওর ফোনটা চেক করতে শুরু করে অর্পিতা। পাগলের মতো ম্যাসেজগুলো হাতড়াতে থাকে ও। 'টার্গেট সাকসেসফুল', 'অপারেশন ডান', 'ফিফটিন লাখ এগেইন' - এসব কী দেখছে ও! চ্যাটের কথোপকথনগুলো ওর সন্দেহটাকেই সত্যি প্রমাণিত করে। মানুষটার ওপর তীব্র ঘেন্না জন্মে যায় ওর মনে। কী করে একটা মানুষ এতটা নীচ হতে পারে! কত টাকা চাই? টাকার জন্যে এতটা নীচে নামা যায়! এন.জি.ও'র এই অনাথ শিশুগুলো আসলে দেবরূপের স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম! ঘরভর্তি সার্টিফিকেট গুলো মিথ্যে, বানানো, মেমেন্টো গুলো কেনা। ও তো কোনওদিন সম্মানিতই হয়নি। নিজের পেশাকে বৃত্তি করে এই বাচ্চাগুলোকে ও দিনের পর দিন কাজে লাগিয়েছে, এরা ওর সীমাহীন লোভের শিকার। ও আর তাকাতে পারে না দেবরূপের মুখের দিকে, তবু রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখায় না।
বছরের শেষ রাত, দেবরূপ সারাদিন পার্টিতে মত্ত। এর মধ্যে অর্পিতার হাতে সমস্ত তথ্য প্রমাণ। ও চূড়ান্ত দোটানার শিকার। আগামীকাল ওদের বিয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি। কী করবে ও? স্বার্থপরের মতো সবটা গোপন করে যাবে নাকি মানুষের পাশে মান আর হুঁশ নিয়ে মানুষ হয়ে দাঁড়ানোর ব্রতে অব্যাহত থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে? ছোটবেলা থকেই শুনে এসেছে, 'পতিসেবাই পরম ধর্ম। শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের আসল বাড়ি।' নিজের স্বামীর বিরুদ্ধাচরণ করবে ও! এ যে নিজের সাথে নিজের সংগ্রাম! একটা ভীষণ অন্তর্দ্বন্দ্ব। সারাদিন দরজা বন্ধ করে কেঁদে চলে ও। অবশেষে মনে মনে সিদ্ধান্তটা নিয়েই নেয়।
রাজু আর গুল্লিকে সাথে নিয়ে ও হাজির হয় পুলিশ স্টেশনে। দেবরূপের ফোন থেকে কপি-পেস্ট করা সমস্ত ম্যাসেজ নিজের মোবাইলে ইনস্পেক্টরকে দেখায় অর্পিতা।
আজ নতুন বছরের পয়লা জানুয়ারি। দেবরূপ ভুলেই গেছে যে ওদের আজ প্রথম বিবাহবার্ষিকী। টাকার নেশা ওকে পাগল করে দিয়েছে। এমন ডাক্তার সমাজের অভিশাপ। 'দেবরূপ' নাকি অসুররূপী নরপিশাচ? অর্পিতা তাকিয়ে থাকে নতুন মেমেন্টোটার দিকে। আসলে দরিদ্র কারা? এই পথশিশুরা নাকি দেবরূপের মতো মানুষের হীন মানসিকতা আর মাত্রাতিরিক্ত লোভের দাপট?
কলিং বেলের শব্দে দরজাটা খোলে দেবরূপ। বাইরে পুলিশ। সঙ্গে গুল্লি আর রাজু। ওয়ারেন্ট নিয়ে পুলিশ অ্যারেস্ট করতে এসেছে দেবরূপকে।
"কী করেছি আমি?" দেবরূপের ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রশ্ন।
"কী করেছেন! এন.জি.ও'র নামে পথশিশুদের জীবন নষ্ট করেছেন। কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত আপনি। আপনাদের মতো ডাক্তার তো কসাইদের চেয়েও নিষ্ঠুর।" গর্জে উঠলেন ইনস্পেক্টর।
হাতকড়া পরা দেবরূপ রেগে তাকিয়ে থাকে অর্পিতার দিকে।
- এটা কী তুমি ঠিক করলে?
- তোমার মতো মানুষ সমাজের কলঙ্ক। এটা তোমার প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর উপহার, দেবরূপ।
সংগ্রামের অপর নামই তো জীবন। নতুন বছরের প্রথম দিনটা যেন পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলে সেই আলোর হাতছানি। অশুভ বিনাশে শুভ সূচনা। বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজটায় সই করে রাজু আর গুল্লির হাত ধরে বেরিয়ে এল অর্পিতা। আজ থেকে ওরাই ওর ছেলে-মেয়ে। আজ থেকে এই পথশিশুদের সঙ্গে নিয়েই ওর প্রতিষ্ঠান 'প্রস্ফুটিত কুঁড়ি'র যাত্রা শুরু....