ন-হন্যতে
ন-হন্যতে
(সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ঘটনাকে অনুসরণ করে এই কাহিনীর সূত্রপাত। যেহেতু এটা ঘটনা, তাই এর অনেক কিছু নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায় - সবার আচরণ ও চিন্তাধারা সম্পূর্ণ ঠিক ও আদর্শমত নাও তো হতে পারে। প্রশ্নগুলো আমার মনেও এসেছিলো - আমিও তার উত্তর খুঁজলাম। দেখি তার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু হয়।)
মেঘা খুব ছোট থেকেই বুঝে গিয়েছিলো, তার নিশ্চয়ই কিছু সমস্যা আছে। স্কুলবাসের আঙ্কেল তাকে সুযোগ পেলেই চেপে ধরে। টিউটর স্যারও তাই!
খেলার সুযোগ হয় না তার। তবু যদি বাবাই দাদার সঙ্গে খেলতে ওঠে ছাদে - খেলা ফেলে তার গায়ে কেমন কাতুকুতু দেয় সারাক্ষণ!
বাসে ট্রেনে যাতায়াতের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ শরীরে অনুভব করে সে এখনও। কলেজে পড়ার সময় তার বয়ফ্রেণ্ড একদিন বলেছিলো - চলো না আরও একটু ক্লোজ হই?
তার ইশারাটা বুঝতে পেরে ভয়ানক রেগে গিয়েছিলো মেঘা। যাকে জীবনসঙ্গী করে বাঁচার কথা ভাবছিলো মনে মনে, সেও? প্রচণ্ড জোরে তার গালে চড়টা সেদিন মেরেছিলো মেঘা।
সেদিনই তার মনে পড়েছিলো, এই একই অনুভুতি হয়েছিলো তার - যেদিন টিউটর স্যারের মাত্রাতিরিক্ত গায়ে পড়ায় বিরক্ত হয়ে কাকুকে গিয়ে বলেছিলো সে কথাটা।
কাকুও সেদিন যা করেছিলো, তা ঐ টিউটরের থেকে কিছু কম নোংরা ছিলো না। মা বাপ মরা মেঘার জীবন যেন বাস্তবিকই নরক হয়ে উঠেছিলো।
বয়ফ্রেণ্ডের সাথে সেদিনই তার ব্রেকআপ হয়ে যায়। যে কাজটা বহুদিন আগেই তার করা উচিত ছিলো, অন্যদের সাথে তা না করে উঠতে পারলেও, আজ সেটা করতে পেরে খুব শান্তি অনুভব করছিলো সে।
সেদিন রাতে, অনেক দেরী করে ঘুমালো সে। হোস্টেলের ঘরে তার রুম পার্টনার না থাকায় তার সুবিধাই হয়েছিলো। অনেক রাত অবধি ভেবে সে এক মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিলো।
পরদিন গিরীশ পার্ক মেট্রোয় নেমে, সোজা গিয়ে হাজির হলো - দুর্বার মহিলা সমিতির অফিসে। সে অফিসিয়ালি মেম্বারশিপ নিতে চায় তাদের কাছে।
তার সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা, পরিবার সম্পর্কে সব তথ্য নিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে তাকে কিছু দিনের জন্য ফিরিয়ে দেয়। পরে তার ঠিকানায় গিয়ে তারা খোঁজখবর করেও কিছুই জানতে পারেনি।
বাকি আর কোনো কিছু নিয়েই তাদের অভিযোগ করার মত কিছু ছিল না। তাই এক সপ্তাহ পর যখন মেঘা আবার হাজির হলো তাদের কাছে, তাকে মেম্বারশিপ দিলো তারা।
এরপর, প্রচণ্ড অভিমান, আর সমাজের ওপর এক রাশ ক্ষোভ নিয়ে, সেই মার্জিতা, ট্যালেন্টেড ছাত্রী থেকে মেঘা শোভাবাজারের দেহপসারিনী হয়ে উঠলো।
তার শরীর যা কখনও নানা অজুহাতে ছুঁয়ে দেখার জন্য হাত বাড়াতো স্কুলবাসের খালাসি থেকে শুরু করে তার নিজের কাকাও - আজ সেই শরীর নিয়ে খেলে বুভুক্ষু কামার্ত পুরুষের দল!
ভালোবাসার ছোঁয়া সে আগেও পায়নি, আজও পায় না। তবে কি, তার বয়ফ্রেণ্ডের মত প্রেমের অভিনয় করে, এখানে কেউ তার শরীরটাকে ভোগ করতে আসে না।
ওর সহকর্মিনীরা হাসাহাসি করে তাকে বলে - তোর যা রূপ, রঙ, গতর মেঘা, তাতে, আমাদের তো না খেয়ে মরতে হবে রে। এটা সত্য, তার চাপও একটু বেশিই ছিল তখন অন্যদের তুলনায়।
দূর্গাপুজোর আগে, যেদিন কুমারটুলির কুমোর এলো তাদের বাড়ির মাটি নিতে, মেঘা জিজ্ঞাসা করেছিলো - যাদের জন্য সমাজে সম্মানজনক কোন ঠাঁইই নেই, তাদেরই বাড়ির মাটি নিয়ে কেন করতে হয় তোমাদের সবথেকে বড় উৎসব?
কি উত্তর তাকে দিয়েছিলো কুমোর জানা নেই, কিন্তু সেদিন তার ঘরে আগতদের নিষ্ঠুর পৌরুষ, তাকে মারণ যন্ত্রণা দিয়েছিলো। এত যন্ত্রণা যে সে বাধ্য হয় বিষপান করতে।
সেদিন বাড়িতে কাকার ঐ ব্যবহারের পর থেকেই নিজের সাথে একটু বিষ রাখতো মেঘা - সবসময়। কখন দরকার পরে, নিজের ইজ্জত রক্ষার স্বাধীনতা সে শুধু মৃত্যুর অধীনতাতেই হারাতে চেয়েছিলো।
সেই অভ্যাস পতিতালয়ে এসেও ত্যাগ করেনি সে। যাই হোক, তার শবদেহ ময়না তদন্তে গেলো। লাশকাটা ঘরে আজও পড়ে তার বেওয়ারিশ শরীরটা।
ওদিকে, তার ঘরে এসেছে নতুন নারী - মাত্র বারো বছরের এক কিশোরী। বাংলাদেশ থেকে পাড়ার দাদার হাত ধরে কাজ করতে এসেছিলো - এদেশে। ঠাঁই হলো তার মেঘার সেই ঘরে।
ক্রমশঃ