Sonali Basu

Drama

3  

Sonali Basu

Drama

মুক্তির স্বাদ

মুক্তির স্বাদ

6 mins
1.1K



আজ বহু বছর পর মৌপিয়া দিঘা এলো বেড়াতে যদিও এটাই বেশীরভাগ বাঙালিদের সপ্তাহ শেষে বা দু তিনদিনের পাওয়া ছুটি কাটানোর সব থেকে আদর্শ স্থান। এসেই এক নামী হোটেলে উঠেছে সমুদ্র দেখতে পাওয়া যাবে সেইরকম ঘরে। স্নান সেরে ক্লান্তি ঝরিয়ে পর্দা সরিয়ে সমুদ্রের অগুন্তি ঢেউয়ের আসা যাওয়া লক্ষ্য করেছে। পরেরদিন পায়ে হেঁটে ঘুরেছে টোটোতে ঘুরেছে আর যেখানে যা মন গিয়েছে খেয়েছে। অভি আর বড় বৌমা সহেলি দুজনেই ঘনঘন ফোন করে জেনে নিয়েছে কেমন আছে সে বেড়ানো কেমন হচ্ছে কোনরকমের অসুবিধে হচ্ছে কিনা সব। জয় তো রাগারাগি করেছে একা আসার জন্য। ও বলেছিল ও আসবে কিন্তু মৌ বারণ করেছে ছেলেকে। বলেছে “অনেকদিন তো যাঁতাকলে পিষলাম এবার অন্তত আমি ছুটি চাইছি” ছেলে কিছু বলে উঠতে পারেনি কিন্তু আর ওর যাওয়ার মাঝে বাগড়া দেয়নি। বেশ লাগছে ঘুরে ফিরে দেখতে কিনতে।


মৌও একসময় খুব আসতো এখানে ছুটি কাটাতে, তখন সাথে থাকতো সবুজ। আর আজ? একা! কলেজে পড়াকালীন সবুজের সাথে আলাপ আর বাকি পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতোই। সবুজের চেহারা আলাদা করে আকর্ষিত হওয়ার মতো ছিল না তবে ওর কবিতা আবৃত্তি করার স্টাইল ছিল ভালো গান গাইতো দারুণ তার ওপর আঁকার হাত অপূর্ব। সোজা কথায় ওর এইসব গুণের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মৌ ওর প্রেমে পড়লো। সবুজও ওকে কাছে টেনে নিলো। কলেজের বছরগুলোতে চুটিয়ে প্রেমালাপ করে ওরা বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লো। দু পক্ষের বাবারাই বলেছিলেন আর কিছুদিন ধৈর্য্য ধরতে কিন্তু তখন ওরা একজন আরেকজনকে পাঁচ মিনিটও না দেখে থাকতে পারে না। তাই বিয়ে করে ওরা চিরদিনের জন্য একে ওপরের হল।

বিয়ের পর ওরা দিঘা এলো মধু চন্দ্রিমায়। কি আনন্দ যে করেছিলো ওরা যে তিনদিন ছিল তা মৌ আজও ভুলতে পারে না। সারা দিঘা ঘুরে দেখেছে দিনের আলোয় রাতের জ্যোৎস্নায় ছবি তুলেছে প্রচুর, এঁকেছেও অনেক। দারুণভাবে কেটেছে ওই তিন দিন। তারপর আবার ফিরে এসেছে নিজেদের ছোট্ট নীড়ে। এরপর প্রতিদিনের সাংসারিক দায়িত্ব কাঁধে উঠে এলো দুজনের। অথচ তখন দুজনের একজনও স্বাবলম্বী নয় যে সংসারের দায়িত্বগুলো ঠিকমতো কাঁধে নিতে পারবে। সবুজ ঠিক করলো ছবি আঁকবে, ওর ছবির যা কদর, তাতে এঁকে, বিক্রি করে সংসারে ভালো টাকাই তুলে দিতে পারবে। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তব এক জিনিস নয়। যতটা সহজ মনে করেছিলো সবুজ ছবি বিক্রি করে আয় করা বাস্তবে দেখা গেলো ততটাই কঠিন। মৌ এদিকওদিক ঘুরে একটা স্কুলে চাকরি নিলো। যা রোজগার করতে শুরু করলো ও তাতেই সংসারের জোয়াল টেনে নিয়ে চলল। সবুজ মাঝেমধ্যে ভেঙে পড়লেও মৌ ওর সাহস জুগিয়ে গেছে।

এর মধ্যে দুর্যোগ ঘনিয়ে এলো মৌয়ের বাপেরবাড়ির সংসারে। ওর বাবা চাকুরিস্থলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। মৌয়ের ছোটাছুটি ব্যস্ততা বাড়লো কারণ এই আকস্মিক ঘটনায় মা কেমন যেন হয়ে গেলো আর ওর বোন মিমি তখনও বেশ ছোট। ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো ভালো হাসপাতাল কোনটাই কাজে লাগলো না। এতো চেষ্টার পরেও উনি সপ্তাহ শেষে মারা গেলেন। সবই করতে হল মৌকে। শ্রাদ্ধশান্তি শেষ হওয়ার পর এবার বাবার অফিসে যোগাযোগ করলো মৌ। বাবার টাকাপয়সা কি পাওয়া যাবে জানতে কারণ সেগুলো ব্যাঙ্কে রেখে মা বোনের খাওয়াপড়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে তো। অফিসে গিয়ে বাবার সিনিয়ারের সাথে দেখা করতে মৌ জানতে পারলো টাকাপয়সা তো পাবে কিন্তু সেই সাথে বাবার চাকরিটাও পাবে। কারণ ওর বাবার তখনও আরও বছর দশেকের চাকরি মেয়াদ বাকি ছিল। আনন্দে ওর মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। ও সাথেসাথেই বাড়ি ফিরে এসে মাকে সব জানালো। ততদিনে ওর মা কিছুটা শোক সামলে উঠতে পেরেছেন। মাকে সব জানিয়ে মৌ বলল “মা চাকরিটা তুমি নিয়ে নাও। তোমাদের খাওয়া আর মিমির পড়াশোনা ভালোভাবে চলে যাবে। তাছাড়া কোয়ার্টারটাও এখন ছাড়তে হবে না” মৌ তো আন্দাজ করতে পারছিলো মাথার ছাদ আর খাওয়ার সংস্থান একসঙ্গে হারালে কি হতে পারে। আত্মীয়স্বজনরা যারা ওদের বিপদে ওদের পাশেপাশে ছিল তারা সবাই বললো “তোমার বদলে মৌয়ের উচিত কাজটা নেওয়া”

মৌ ভাবলো সবাই বুঝি ওর শ্বশুরবাড়ির করুণ দশা জানতে পেরে ওকে সহানুভূতি দেখাতে এই কথা বলল তাই ও প্রতিবাদ করলো “না না আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে, আমি কেন চাকরিটা নিতে যাবো, মা নেবে”


তখন সবাই বোঝালো “মৌ তুমি বুঝতে পারছো না তোমার মায়ের বয়েস হয়েছে, কাজটা বেশীদিনের জন্য ধরে রাখতে পারবেন না। সে হিসেবে তোমার বয়েস কম। তোমার পক্ষে খুব সম্ভব বেশীদিন ধরে কাজ করা”

“কিন্তু......”

“কোন কিন্তুই নেই। রোজগার করা মাইনে মায়ের হাতে তুলে দেবে তাহলেই হল”

একটু ভেবে ও রাজি হয়ে গেলো। স্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে এলো কারখানার অফিসে। সবুজ কিন্তু ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে নিলো না। তার স্ত্রী অন্যের চাকরি পেয়ে খাটবে আর সংসার অবহেলিত হবে এই ছিল তার প্রথম বক্তব্য। মৌ বোঝালো মাকে সাহায্য করার সাথে সাথে ওর সংসারেও কিছু সুরাহা হবে তখন নিমরাজি হয়ে মেনে নিলো সবুজ। মৌ ভালো কাজের জন্য উন্নতিও করলো তাড়াতাড়ি। অফিসের পরিচিতি কাজে লাগিয়ে সবুজের জন্য অন্য এক অফিসে কাজের জোগাড় করে দিলো মৌ। এবারও বাগড়া দিলো সবুজ। কি না স্ত্রীর সুপারিশে পাওয়া চাকরি করা তার পোষাবে না। কিন্তু আপত্তি থাকলে তো সংসার চলে না তাই বাধ্য হয়ে নিয়েই নিলো চাকরি। চাকরি নেওয়ার পর কিন্তু বেশ খুশমেজাজেই দেখা গেলো সবুজকে। প্রতিদিন সময়ে বেরোয় (কোন কোন দিন আগেও) ফিরতে বরং একটু রাত হয়ে যায়। মৌ জিজ্ঞেস করলে বলে “নতুন ধরণের কাজ শিখছি একটু সময় তো লাগবেই” 

এরপর সংসার বেশ গড়িয়ে যেতে থাকলো আর মৌও সংসারে নিজেকে আটকে ফেললো। দুই যমজ ছেলের মা হল ও। চাকরি সংসার (নিজের এবং মায়ের) ছেলেদের মানুষ করা এতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ও। কিন্তু এসবের ফাঁক গলে কখন যে সবুজ একটু একটু করে সরে গেলো ওর জানাই হল না। যখন জানলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। সবুজ নিত্যনতুন মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে ওদের নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে একসাথে রাত কাটাচ্ছে আরও অনেক কিছুই কানে এলো ওর। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো ও। ভাবতেই পারছিলো না যে পুরুষকে ও ভালোবেসে গ্রহণ করেছিলো সে ওকে এইভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে মন থেকে। ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলো ও কিন্তু কারো সাথেই ও ওর মনের কথা খুলে বলতে পারেনি। একবার ভেবেছিলো সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যায় কিন্তু মা বেঁচে এখনো মিমির বিয়ে দিতে হবে। জয় আর অভি তো এখনো ছোট তাছাড়া ওরা কোন অন্যায় করেনি, ওদের এভাবে ফেলে রেখে ও যাবেই বা কোথায়। মুখ বুজে সয়ে গিয়েছিলো সব অন্যায় অবিচার।


আস্তে আস্তে বয়েসও বাড়লো, বোনেরও ভালো ঘরে সুপাত্রে বিয়ে দিলো। মাও স্বর্গে গেলো বোনের বিয়ের ঠিক এক বছরের মাথায়। এর মধ্যে ওর আরও পদোন্নতি হল ছেলেরা স্কুল কলেজ পেরিয়ে গেলো। এখন দুই ছেলেই যে যার নিজ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন আর কোন পিছুটান নেই। ছেলেরা স্বাবলম্বী হতে ও সবুজের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সবুজ অবশ্য আটকানোর কোন চেষ্টাও করেনি শুধু শাসিয়েছে “একবার বেরিয়ে গেলে আর কিন্তু ফিরতে পারবে না”

ও উত্তর দেয়নি শুধু নিজের সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে এসে ভাড়া বাড়িতে উঠেছে। হাতে অঢেল সময়, মৌ তাই বেড়াতে এসেছে দিঘা।        

       সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকতে থাকতে স্মৃতির পাতা ওলটাচ্ছিলো মৌ। সন্ধ্যে নেমে আসছে। দিগন্তটা কি সুন্দর অপার্থিব লাগছে, জলে আকাশে অস্ত যাওয়া সূর্যের আলোর ছটা এখনো কুচিকুচি ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ডাকলো “আরে আপনি মৌপিয়া না”

ও তাকিয়ে দেখে চিনতে পারলো শিখাকে কিন্তু না চেনার ভান করলো। এই সেই মেয়ে যে প্রথম সবুজকে ওর নামে অনেক অকথা কুকথা বলে ওর মন বিষিয়ে দিয়েছিলো তারপর সুযোগ বুঝে ওর কাছে এসেছিলো। শিখা দোষী কিন্তু সবুজ তো নির্দোষ নয়। দোষ দিতে হলে ও দুজনকেই দেবে। কিন্তু সে ঘটনা মনে রেখে লাভ কি যখন সেই মানুষটাকেই ও ছেড়ে আসতে পেরেছে। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল “হ্যাঁ আমি মৌ... আপনি?”

“আমাকে চিনতে পারছিস না... আমি শিখা রে তোর ছোটবেলার বান্ধবী আর চাকরিকালে তোর স্বামীর কলিগ”

“না ঠিক মনে পড়ছে না ভাই। বোধহয় আপনি ভুল করছেন। চলি... রাত হয়ে আসছে” বলে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে ও হাঁটতে শুরু করলো হোটেলের দিকে। না তাকিয়েও বুঝতে পারলো শিখা হতভম্বের মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আজ ও মুক্ত, ওর হোঁচট খাওয়ার ভয় চলে গেছে।  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama