মুখোমুখি
মুখোমুখি
বনমালী কলেজের সেমিনারে অনেকটা দেরী হয়ে গেল। হাওড়া পৌঁছতেই রাত হয়ে যাবে, তারপর আজকাল কলকাতায় ট্যাক্সির যা সমস্যা! উবের বুক করে রাখলে হয়, পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই বিরক্তি নেমে এলো, নেটওয়ার্ক ইস্যু, এই এক ঝামেলা ,যত মেদিনীপুরের দিকে এগোবে কলকাতা সিমগুলো তত অকেজো হবে। থাক বাগনান ছেড়ে আর একবার ট্রাই করা যাবে।
সাউথ ইস্টার্ন জোনের ট্রেনগুলোর যা অবস্থা! নো ডিসিপ্লিন নো টাইমিং!
ধুত্তোর!
পাঁশকুড়া আজ অদ্ভুত শান্ত!
একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে, ডিপার্চার টাইম উইন্ডোস্ক্রিনে দেখে নিলেন দেবাশীষ, নটা সাত। দেবাশীষ ট্রেনে ওঠেন, ও বাবা! ট্রেন যে পুরো বস্তাবোঝাই, সব প্যাসেঞ্জার ঝেঁটিয়ে কলকাতা চললো নাকি! দেবাশীষের আগেই বোঝা উচিত ছিল প্লাটফর্ম ফাঁকা দেখে, যাকগে যাক, কী করা যাবে, ফিরতে যখন হবে!
এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, বসার সিট পান কিনা, শেষ সিটের থেকে একটি ছেলে উঠে দাঁড়ায়, এগিয়ে আসে, "স্যার, আপনি এখানে বসতে পারেন!"
দেবাশীষ ঘাড় এলিয়ে দেখে নিলেন, পিছনে একটি মাত্রই সিট, তিনি বসে পড়লে ছেলেটি কি পুরো রাস্তা দাঁড়িয়ে যাবে?
মুখে বলেন, "ইটস ওকে, ইউ প্লিজ এনজয় ইওর জার্নি!"
ছেলেটি দেবাশীষর ইতস্তত ভাব বুঝতে পেরে হেসে ফেলে বলে, "চিন্তা নেই , ওখানে আপনি বসার পর আমিও কুলিয়ে যাবো..." বলেই সিটটার দিকে এগিয়ে গিয়ে "দাদা একটু চেপে বসুন তো "বলতেই আরো কয়েক ছটাক জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। দেবাশীষের পাশে ছেলেটিও বসলো। এবার কি ছেলেটাকে ধন্যবাদ জানান উচিত?
অবশ্যই, দেবাশীষ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসেন, "অনেক ধন্যবাদ!"
শুধু ধন্যবাদ একটু জেলো লাগলো না?
জিজ্ঞেস করা উচিত ,কোথায় নামবে?
দেবাশীষ কেজো চোখে তাকালে ছেলেই নিজেই বললো, "আপনার 'বিয়ন্ড দ্য এন্ড', আমার খুব পছন্দের, আর আপনার 'থরো রিডিং অফ শেক্সপিয়ার' আমায় অনেক হেল্প করেছে নিজের নোট বানাতে। তাই যেদিন জানলাম, এবারের সেমিনারে আপনি আসছেন, মিস করিনি"! দেবাশীষ এবার জিজ্ঞাস করলেন, "আপনি কি এই কলেজেই...!"
-"প্লিজ স্যার আমাকে আপনি বলবেন না, হ্যা, ফাইনাল চলছে।"
হয়তো আলোচনার ইতি এখানেই হত, কিন্তু গলায় কী যেন একটা বাধছে দেবাশীষের, কী? ধন্যবাদজ্ঞাপন?
অবশ্য এরকম স্তুতিবাক্য তো কতই শুনতে হয় তাঁকে, বড্ড ক্লিশে লাগে, মেকি লাগে।
দেবাশীষ তবু বললেন, "তুমি থাকো কোথায়?"
-"উলুবেড়িয়া!"
-"উলুবেড়িয়ায় থেকে কলকাতার কলেজে না গিয়ে এখানে?"
ছেলেটির চোখে অভিযোগ, "ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি মার্কস খুব কম দেয় স্যার, আর আপনি তো জানেন, মার্কস এখন কতটা ইম্পরট্যান্ট, পিতৃপরিচয়ের চেয়েও!"
'পিতৃপরিচয়ের চেয়েও' ... কী বলে ছেলেটা! এইবয়সী একটা ছেলের মুখে এরকম শুনতে কেই বা অভ্যস্ত!
দেবাশীষ ফোনটা বের করেন আবার.. ধুর! একটাও নেটওয়ার্ক নেই।
ট্রেনটাও হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। কোন স্টেশন এটা, একটু আগেও তো মেছেদা ক্রস করলো, কোনো স্টেশন তো নয়!
অনেক্ষন দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনটা। দেবাশীষ পাশের দিকে তাকায়, কারোর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, যে যার শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে পিছনে হেলান দিয়ে আর পাশের ছেলেটা কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে।
উহ! ভীষণ গরম লাগছে। একটু জল পেলে... কিন্তু জল এখানে কোথায়, কাউকে যে চাইবে... তাও হাইজিনের প্রশ্ন, দেবাশীষ ছেলেটিকে বলে, "এক্সকিউজ মি, গান শুনছো?"
ছেলেটি ঘোর লাগা চোখে তাকায়, "না স্যার! গান শোনার বিলাসিতা কই, নোটগুলো পড়ে রেকর্ড করে রাখি, যখন সময় পাই শুনি, শুনে শুনে মনে গেঁথে নেওয়া আর কি!"
দেবাশীষ অবাক! কী বলছে ছেলেটা!
এরমধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হলো। ফুলেশ্বরে লাইন সরে গেছে, ট্রেন তাই উলুবেড়িয়া পর্যন্ত যাবে, তারপর..
কী হবে ? উলুবেড়িয়া থেকে বাস পাবে? কিভাবে পৌঁছবেন বাড়ি দেবাশীষ?
এই ছেলেটি হেল্প করতে পারবে নিশ্চয়ই। তাঁর লেখা নোটবুক পড়ে এত উপকার পাচ্ছে আর গুরুদক্ষিণা দেবে না?
উলুবেড়িয়ায় খালি হয়ে গেল ট্রেনটি। দেবাশীষ প্লাটফর্মে নেমে দাঁড়িয়েছেন, ছেলেটি এগিয়ে আসে। "এতরাতে তো অটো পাবোনা স্যার, হাইরোড পর্যন্ত হাঁটতে হবে তারপর বাস!"
অগত্যা! হাতি পাঁকে পড়লে টিকটিকিরও ল্যাজ ধরতে হয়। হাঁটতে হাঁটতেই কথাটা পারলো ছেলেটি, "জানেন স্যার, আপনার আর আমার বাবার নাম একই, তবে টাইটেল আলাদা। তবে আজ আপনাকে চাক্ষুস দেখে বাবার মুখের সঙ্গেও অনেক মিল পাচ্ছি।"
অদ্ভুত! দেবাশীষ ছেলেটিকে যত দেখছেন অবাক হয়ে যাচ্ছেন, "কী করেন তোমার বাবা?"
ছেলেটি ভাবলেশহীন চোখে তাকায়, "চোখেই দেখিনি বাবাকে, শুনেছি আমার জন্মের আগেই মারা গেছেন।"
প্রায় একঘন্টা দাঁড়িয়েও বাস এলোনা যখন, ছেলেটি বললো, "কষ্ট করে আজকের রাতটা আমার বাড়ি কাটিয়ে দেবেন স্যার, কাল ভোরে বারাসাত বাসে আপনাকে তুলে দেব, এতদূর আসারও দরকার নেই, আমাদের বাড়ির সামনেই লোকাল বাসস্ট্যান্ড, ওখানেই পেয়ে যাবেন। চলুন।"
দেবাশীষের উত্তরের অপেক্ষা না করে ছেলেটি কোথা থেকে একটা ভ্যান ডেকে আনে। ভ্যানওয়ালাকে এগোতে বলে।
দেবাশীষ খুব অপ্রস্তুত, "তোমার নামটা জানা হলো না!"
-"অনুরাগ, অনুরাগ বেরা।"
-"বাবা তো নেই বললে, বাড়িতে আর কে কে আছেন?"
-" আমি আর মা! বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিলেন মা, কেউ মেনে নেননি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবার এক্সিডেন্ট, তখন আমি নাকি মার পেটে। অনেক কষ্ট করে মা আমায় বড় করছেন, প্রচুর টিউশনি পড়িয়েছেন, সেলাই করেছেন, ঠোঙা বানিয়েছেন, মা এখনও টিউশন পড়ান, সকালে। রাতে অন্ধকারে ভালো করে দেখতে পাননা, সারাজীবন কেঁদেছেন তো!
তাইতো দিনরাত এক করে পড়াশুনা করি, নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে, আমার মার চোখদুটো খুব সুন্দর জানেন স্যার, ওদুটো সারিয়ে তুলব একদিন, তুলবই।"
বছর ছাপান্নর ব্যক্তিত্বময় স্বনামধন্য প্রফেসর দেবাশীষ সরকারের মাথাটা আপনা থেকেই এই নামগোত্রহীন ছেলেটার কাছে নিচু হয়ে গেল।
ঘরের ভিতর বোধহয় একটাই বাল্ব জ্বলছে। কড়া নাড়তে দরজাটা খুললো, হালকা ঝিম ধরা আলোয় দেবাশীষ দেখলেন একটা রংজ্বলা শাড়ি বেরিয়ে এলো বাইরে, বাল্বের আলোয় মুখটা স্পষ্ট নয় তবু আদলটা ভীষণ চেনা।
কোথায় দেখেছেন?
অনুরাগ দেবাশীষকে ভিতরে ডাকেন, মার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, "মা, তোমাকে এনার কথাই বলতাম, এনার নোটবইই আমাকে অনেক হেল্প করে!"
কৃতজ্ঞতা ভরা আবঝা চোখদুটো দেবাশীষের দিকে তাকিয়ে জ্বলে উঠলো যেন, দেবাশীষও ওই কম আলোয় দেখলেন...পারমিতা!
খোলা চুল পুরু করে কাজল পরা এককালের পাগল করা সেই মুখটা আজ এরকম!
হঠাৎ জ্বলে ওঠা চোখদুটো নিভে গেল আবার, "অনি, ওনাকে বাথরুম দেখিয়ে দাও, অনেক ক্লান্ত উনি, খেয়ে বিশ্রাম নিন!"
হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকে দেওয়ালে টাঙানো একটি ছবি দেখে থমকে যান দেবাশীষ। অনুরাগ ছবিটি চিহ্নিত করে বলে, "আমার বাবা, আসুন স্যার, খেতে আসুন, মা বসে আছেন।"
বাবা! অনুরাগের বাবা! কিন্তু এটাতো দেবাশীষের ছবি, কলেজ ফেস্টের সময় তোলা!
কয়েকটা ঝাপসা ছবি স্পষ্ট হচ্ছে, একবিকেলে দৌড়ে এসেছিল পারমিতা, "বিয়ে করবে আমায়? বাড়ির সবাই তোমার কথা জেনে গেছে, ওরা মেনে নেবেনা, অন্যকোথাও বিয়ে দিয়ে দেবে আমায়, তুমি আমায় ফিরিয়ে দিয়োনা!"
দেবাশীষের মাথাটা গরম হয়ে যায়, "সামনে আমার পরীক্ষা তুমি জানো, বাইরে যাওয়ার কথাটাও তুমি জানো, এখন এসব পাগলামো করোনা, বাড়ি যাও সবাইকে বোঝাও!"
সেদিন কি কেঁদেছিল মিতা?
মাথায় একটা হিসেব চলে আসে, অনুরাগের বয়স এখন কুড়ি, সেদিনটা তো ছিল নিরানব্বই সাল, আর হ্যা, মিতার বাবারবাড়ির পদবী তো 'বেরা'ই! তাহলে, অনুরাগ... দেবাশীষের ছেলে?
দেবাশীষ বাঁধানো ছবিটার সামনে দাঁড়ায়, ছিপছিপে সরু গোঁফ চশমা ছাড়া একটা ছবি। এখনকার পৃথুল শেভ করা চোখে মোটা ফ্রেমের মুখের সাথে মিলটা প্রায় চোখেই পড়েনা।
চোখের কোন দিয়ে দুফোঁটা অভিমান ঝরে পড়ে দেবাশীষের; মিতার কাছে সে মৃত!
খুব সামান্য আয়োজন, মাটিতে কাপড়ের আসন বিছিয়ে স্টিলের থালায় রুটি আর ছোলা দিয়ে কুমড়োর তরকারি। দেবাশীষ রুটি ছেঁড়েন। বাটিতে করে হালুয়া এগিয়ে দেন পারমিতা, "অনির বাবা হালুয়া খেতে খুব ভালোবাসতেন। এত রাতে তো দোকান খোলা নেই, অথচ আপনি প্রথম বাড়িতে এলেন, তাই বানালাম।"
থালার পাশে ছোট্টবাটিতে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে হালুয়া, একসময় চেটেপুটে খেতেন দেবাশীষ। আজ পারবেন তো এককালের লোভাতুর জিনিসটা তৃপ্তি করে খেতে?