মৃত
মৃত
নাম না জানা এই জায়গাটা খুব ভালো লাগে ঝন্টুর।প্রতিদিন বিকেলে অন্যান্য ট্যুরিস্টদের মত সেও এখানে আসে।ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা তাদের বাবা মায়ের হাত ধরে এসেছে এই অপরূপ সুন্দর জায়গাটা দেখতে!আর একটু সন্ধ্যা হলে বাচ্চাগুলো চলে যাবে,আর ঠিক তখনই আগমন হবে যৌবন-উন্মত্ত কিছু কপোত-কপোতির!জোড়ায় জোড়ায় দাঁড়িয়ে তারা মেতে উঠবে এক অলীক স্বপ্নের মূর্ছনায়!.....ঝন্টু একটু দূরে দাঁড়ায়!দূর থেকে দেখলে আরও সুন্দর দেখায় জায়গাটা!সন্ধ্যা নামবে একটু পরে।বাতিগুলো সব জ্বলতে শুরু করেছে।লাল-নীল-সবুজ আলো এসে ঝন্টুর মনকে উদ্বেলিত করছে।সহসা ঝন্টু হারিয়ে যায় এক অন্য জগতে।
একটা নদী বয়ে চলেছে এই জায়গাটার উপর নদীর নামটা বড্ড মিষ্টি,’টিয়া’।ষোড়শী কিশোরীর মত চঞ্চল হৃদয় ছিল টিয়ার।সারাদিন নিজের খেয়ালে,নিজের ছন্দে নেচে নেচে বেড়াত।আশে-পাশে থাকা গাছেদের পেট পুরে জল দিত।ছোট বড়ো প্রতিটা মানুষকে বৈশাখের ফুটিফাটা রোদ্দুরে ঠান্ডা জলে স্নান করতে দিয়ে দুদন্ড শান্তি দিত।সুখে কাটছিল জীবন!কিন্তু “কপালে সবার সুখ সয় না।“এক উচ্চপর্যায়ের অফিসার 'মানুষ'-এর একদিন টিয়ার উপর নজর পড়ল।টিয়ার অবশ্য প্রথম থেকেই লোকটির নজর পছন্দ হয়নি,কিন্তু তার তো হাত পা বাঁধা!সে যে অবলা!
মোটামুটি পাঁচ বছর লাগল কাজ শেষ হতে।টিয়া আজ মরে গেছে!তাকে মেরে দিয়েছে কিছু অর্থ পিশাচ মানুষ!টিয়ার মৃতদেহের উপর এখন কংক্রিটের বাঁধ তৈরি হয়েছে।টিয়ার দুটো পার আজ মিশে গেছে এক যান্ত্রিকতার বন্ধনে।সেই বাঁধের উপর দিয়ে সাধারণ মানুষ বিকেল থেকে সন্ধ্যাবেলা হাঁটে!ব্যাপারটা ঠিক ব্রিজের মত।সমস্ত জায়গাটা সাজানো হয়েছে লাল-নীল-সবুজ আলো দিয়ে!পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সেই বাঁধের উপর হাঁটে সবাই।বাঁধটা অনেকটা উঁচু করে বানানো।জল এসে জমা হয় বাঁধের একদিকে।তারপর অনেকটা জল জমে গেলে তা ছেড়ে দেওয়া হয় ইচ্ছে মত।মোট কুড়িটা গেট করা আছে বাঁধে।গেট যখন খুলে দেওয়া হয়,তখন সে দৃশ্য দেখার মত।অসংখ্য মানুষ বাঁধের উপর থেকে তা দেখতে ভিড় করে।এখানেই শেষ নয়,সেখানে চাষ করা হয় নানারকম মাছ।জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করাও হয়।এখন গ্রামের বিদ্যুৎ চলে তার থেকেই।
ঝন্টু এখানে মাস খানেক হল এসেছে।বাজারে বিভিন্ন দোকানে যখন সে চা আর পাউরুটি খায় তখন অনেকেই এইসব গল্প করে।এখন এ অঞ্চলের অনেক নাম-ডাক হয়ে গেছে।কিছুদিন পর নাকি মুখ্যমন্ত্রী আসবে এই জায়গাটা দেখতে।…..সে মুখ্যমন্ত্রী আসুক আর প্রধানমন্ত্রী আসুক,ঝন্টুর তাতে কোন মাথাব্যথা নাই।তার শুধু একটা কথা মনে হয়,টিয়াকে এভাবে খুন করল সবাই?টিয়া কি আর বাঁচবে না?
ঝন্টু মাটিতে বসে পড়ে।রেলিং দিয়ে ঘেরা আছে মৃত টিয়ার দুপার।রেলিংয়ে হাত রাখে সে।চোখ জুড়িয়ে আসে।মৃদু হওয়া বইছে এখন।ওপার থেকে আসা জল অনেকটা জমে গেছে।হয়তো ছেড়ে দেওয়া হবে আজ-কাল!ঝন্টু মন দিয়ে ঘুম চোখে মৃত টিয়ার বুক ভেদ করে চলে যাওয়া একটা কংক্রিটের মস্ত বড় ছুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে।কোথায় যেন সে শুনেছিল,প্রাকৃতিক হিরের চেয়ে কৃত্রিম হিরের দাম অনেক বেশি।মৃদু হাসে ঝন্টু।
***
হঠাৎ চিৎকারের কারণ বুঝতে পারেনা ঝন্টু।শত মানুষের কোলাহলে তার ঘুম বোধহয় ভেঙে যায়।বাঁধের উপরে থাকা সমস্ত মানুষ চিৎকার করতে করতে চলে যাচ্ছে সেখান থেকে।দু-একজন মহিলা তো প্রায় ঝন্টুর গায়ের উপর দিয়ে চলে যায়!সাধারণত তারা ঝন্টুর দশ হাত দূর দিয়ে নাকে কাপড় দিয়ে যায়।হাসে ঝন্টু।বিপদে পড়লে মানুষের ঘেন্না,ভয় যেন কোন চুলোয় চলে যায়!ঝন্টু শুনতে পায় মাইকে এখানকার অফিস থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে,"আপনারা কেউ ভয় পাবেন না,আতঙ্ক ছড়াবেন না।আস্তে আস্তে আপনারা বাঁধের উপর থেকে সরে যান,এবং নদীর আশে-পাশের জনবসতি কে সরে চলে যেতে বলা হচ্ছে!"....... এক ঘেয়ে লাগে ঝন্টুর।একই কথা বারবার বলে চলেছে।সে ছুটন্ত মানুষের থেকে চোখ সরিয়ে টিয়ার দিকে তাকায়।
আজ এক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে।হঠাৎ করে বাঁধের এক দিকে জলের পরিমান কিভাবে যেন বেড়ে গেছে।এখনো প্রচুর জল তাদের বিপুল শক্তি নিয়ে ধাক্কা মারতে আসছে টিয়ার ওই কংক্রিটের গায়ে।পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর তর হয়ে উঠেছে।এই মুহূর্তে সমস্ত গেট খুলে দিলে সেকেন্ডের মধ্যে বন্যায় ভেসে যাবে নদীর দু'পাড়।অথচ জলকে না যেতে দিলে উন্মত্ত সে ভেঙে দেবে মানুষের সমস্ত কৃত্রিমতা!টিয়ার মৃত আত্মার মধ্যে পুষে থাকা সমস্ত রাগ আজ সে প্রকাশ করবে!
আশে-পাশের প্রায় সমস্ত মানুষ এলাকা ছেড়েছে,দু-একজন বেকার যুবক ছাড়া।তারা এলাকাবাসীকে সাহায্য করছে এখন থেকে চলে যেতে!......ঝন্টুর কোন ইচ্ছে নেই এখান থেকে যাওয়ার!সে মন দিয়ে টিয়াকে দেখছে।সামনে আর তার নদী নেই,দাঁড়িয়ে আছে ঠিক মা দুর্গার মত দেখতে একজন কিশোরী!তার চুল আলু-থালু,কাপড় আলগা!কপালের সিঁদুরের টিপ ধেবরে গেছে!সে তার মুখ থেকে জলের স্রোত বের করছে আর তার নিশ্বাসের সময় নাক থেকে বেরোচ্ছে আরো আরো জলরাশি!.....নিমেষে ভেঙে যায় সেই বাঁধ!গেটগুলো জলের তোরে ভেঙে চলে যায় কোনদিকে!অফিসের সমস্ত লোক প্রাণ নিয়ে চলে যায় অন্যদিকে!একা ঝন্টু দাঁড়িয়ে থাকে!টিয়া আবার বেঁচে উঠেছে!সে আবার বয়ে চলেছে তার আপন ছন্দে!কোন মানুষ,কংক্রিটের বাঁধ তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি!এর থেকে বড় আনন্দ আর কি আছে ঝন্টুর?
********
"ওই লেখক পাগলা,ওই লেখক পাগলা......আরে ওই ঝন্টু পাগলা....উঠ"-চির পরিচিত ডাক শুনতে পায় ঝন্টু!এতক্ষন তবে সে স্বপ্ন দেখছিল?.....না ঝন্টু স্বপ্নের আকস্মিক ছন্দ পতনে দুঃখ পায় না!রামু খাবার নিয়ে এসেছে!রাত অনেকটা বেড়ে গেছে!....চোখ খুলেই টিয়ার দিকে তাকায় ঝন্টু!না স্বপ্নের মত কিছু আর হচ্ছে না! টিয়া এখন শান্ত!.....দুঃখ পায় না ঝন্টু!খাবার হাতে নিয়ে সে চিৎকার করে উঠে,"নতুন গল্পের প্লট পেয়ে গেছি!এবার আমাকে নোবেল পাওয়া থেকে কে আটকায়?"রামু হাসতে হাসতে চলে যায়!এটা তার কাছে নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা!