মনকেমনের সংযোগ
মনকেমনের সংযোগ
-- দিশা! আজ থেকে পথটা তাহলে আলাদা হয়েই গেল?
-- তা হয়তো হওয়ারই ছিল অর্ক...
-- হুঁ সে ঠিক, ভালো থেকো... মাঝে মধ্যে কথা বলো, সম্ভব হলে।
-- আচ্ছা বেশ।
-- একটা অনুরোধ ছিল, রাখবে?
-- বলো...
-- আজ একসাথে বাড়ি ফিরবে, তারপর নাহয় আমার বাড়ি থেকেই আমার বাড়ির লক্ষ্মীকে সাদরে বিদায় করবো।
-- আচ্ছা বেশ।
রাত আটটা বাজে। কোর্ট চত্বর থেকে বেরোতে পাঁচটা বেজেই গিয়েছিল। দিশা তার প্রাক্তন স্বামী অর্কর বাড়ি যাবে কি না, এই দোটানায় পড়ে কিছুটা সময় অতিবাহিত করে ফেলেছে গঙ্গার ঘাটে বসে। তার প্রাক্তন স্বামী এখনও তার সুরক্ষার দায়িত্ব পালনে ব্রতী, একা ছাড়েনি তাকে। দেখতে দেখতে একটা বছর কিভাবে যে কেটে গেল বুঝতেই পারেনি দুজনে।
বিয়েটা করার ইচ্ছে ছিল না দিশার। সে অন্য এক ছেলেকে ভালোবাসতো কিন্তু ভালো পাত্র পেয়ে জোর করেই বিয়েটা দিয়েছিল তার বাবা-মা। দিশা সেই অভিমানে বিয়ের পর থেকে আর বাপের বাড়ি যায়নি। অর্ককে সে কোনোদিন মেনে নিতে পারবে না সেটা সে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, বিয়ের কিছুদিন পরই ডিভোর্স ফাইল জমা দেয় কোর্টে আর আজ ডিভোর্সটা সাকসেস হয়।
তাদের এই এক বছরে স্বামী স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও বন্ধুত্ব খুব ভালো মতোই হয়েছিল। অর্ক আশা করেছিল এক বছরে হয়তো কিছুটা হলেও সঠিক স্থানে দাঁড়াবে, সে মেয়েটার কথার বিচক্ষণতায়, ঠোঁটের হাসিতে, ভাসা ভাসা কালো চোখগুলোর গভীরতায় কখন যে ডুব মেরেছে বুঝতেই পারেনি। বন্ধুত্বের থেকেও বেশি কিছু সে চাইতো কিন্তু বারবার নিরাশ হতো। দিশা হয়তো কখনই বুঝতেই পারত না তার চিরাচরিত ঠোঁটের হাসির গভীরে এক মুঠো দুঃখ কখন ছড়িয়ে দিত, তার প্রেমিকের নানান রকম প্রসঙ্গ তুলে।
আজ বড্ড বেশী চঞ্চল হয়ে উঠেছিল অর্কর অবুঝ হৃদয়টা। ডিভোর্স ফাইলটাই সই করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, “কলমটা যদি এখানেই থেমে যেত, কি এমন ক্ষতি হতো! হয়তো ভালই হতো, নাইবা তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর ভালোবাসা পেল, কাছে তো থাকবে... কিন্তু ভাগ্য! ভাগ্য সেই সাথ দিল না, কলমটা থামলো না কিছুতেই, একটা কলমের আঁচড় একটা সম্পর্কের ইতি টেনে দিল।"
অর্ক তার প্রাক্তন স্ত্রীর সামনে বসে এইসবই ভাবছিল এতক্ষণ। দিশা যে কোন ভাবনায় মগ্ন সেটা তার মুখ দেখে বোঝা যায় না। হয়তো সে আজ খুব খুশি, তার বহুদিনের আপন করে রাখা পুরুষটির কাছে সে পুনরায় ফিরতে পারবে এই ভেবে। অর্কর মাঝে মাঝে খুব হিংসে হয়, দিশার প্রেমিকের উপর। মাঝে মাঝে তার মনে হয় স্বার্থপর হয়ে যায়, নিজের স্ত্রীকে অন্য কারোর কাছে কেন দেবো এই ভেবে। কিন্তু যতই হোক, মানুষের মনকে তো বাঁধা যায় না, নিজের কাছের মানুষদের কে না ভালো চাই, তাই হয়তো সেও নিজের কথা না ভেবেই দিশাকে নতুন পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
দিশার বরাবরই আত্মসম্মানটা খুব বেশি, বোঝে অর্ক। তাই হয়তো দোটানায় পড়ছে এখন কোথায় যাবে এই ভেবে! তাই সে ইতস্তত করে বলেই ফেলল, আজ একসাথে বাড়ি ফিরবে। আজ রাতটাই তো সামনে পাবে মেয়েটাকে, তারপর কে কোথায় থাকবে তার কি ঠিক আছে! আর হয়তো কোনোদিন দেখা হবে না। তাই আজকের সান্নিধ্যটা সে হারাতে চাই না।
-- অর্ক, চলো। ট্যাক্সি ড্রাইভার অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে।
-- হুঁ, হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।
-- তোমার বাড়ি নিয়ে যেতে ইতস্তত করছো নাকি?
-- এ মা, না না...
-- কোন খেয়াল মগ্ন ছিলে?
-- কিছুনা, ওঠো... আমি সামনে বসছি।
-- কেন, আমার পাশে বসবে না আজ!
-- তুমি কমফোর্ট ফিল করবে কি না!
-- আমি তো বলছি, বসো আমার পাশেই।
-- আচ্ছা, যখন বলছো তখন...
-- থাক, আর কিছু বলতে হবে না।
ট্যাক্সি তার গতিতে চলতে শুরু করেছে। মহানগরীর জ্যাম পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে তাদের এখন প্রায় দুই ঘণ্টা সময় তো লেগেই যাবে। এই ভেবেই অর্ক সিটে এলিয়ে দিল গা টা। সারাদিনের দৌড় ঝাঁপ, মানসিক চাপের কারণে কিছুক্ষনের মধ্যেই চোখ বুজে এলো ঘুমে।
দিশা কাল থেকে এক নতুন জীবনে পা রাখবে। এই উত্তেজনা নাকি ভয়ে সে নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। কখনো প্রশ্ন উঠছে নিজে নিজেই, “যার জন্য সুখের সংসারের ইতি টানলাম সে মেনে নেবে তো!" উত্তর নেই... হটাৎ করেই তার চোখ চলে গেল পাশে বসে থাকা মানুষটির দিকে। দিশা মানুষটির কাজকর্মে, তার দায়িত্ত্ববোধে, কর্তব্যে মোহিত হয়নি তা নয়। তবে কোথাও যেন বহুদিন আগে প্রতিশ্রুতি দেওয়া মানুষটির অপেক্ষারত মুখটা মনে করে তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু আজ সব প্রতিশ্রুতি ছিন্ন করে এতোদিন যে মানুষটি পাশে থেকে আগলে রেখেছে তার কাছেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে, কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে সামনে থাকা মানুষটিকে ছেড়ে সে ভালো থাকবে তো! বোঝে দিশা, অর্কর ঠোঁটের হাসির গভীরে লুকোনো ক্ষতটা, কিন্তু সে নিরুপায়। আর কিছু ভাবতে পারলো না দিশা, সামনে থাকা মানুষটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখের কোন বেয়ে দু ফোঁটা জল নিজে থেকে বেরিয়ে গেল। কিসের জন্য তা জানা নেই, সহানুভূতি নাকি কোনোদিন অর্কর জন্য তার মনে দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল!
কিসের ঘোরে যেন দিশা পাশের মানুষটির ঘুমন্ত মুখশ্রীটা বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো। কপালে এক জোড়া ঠোঁটের স্পর্শ দিল, তারপর তার দুই চোখ থেকে অবিরত বারিধারা বয়ে যেতে লাগলো। মনে মনে সে বলল, “তোমার জন্য কখনই কিছু করতে পারলাম। তুমি আমার জন্য যতটা সেক্রেফাইজ করেছো তার একটুও তোমায় ফিরিয়ে দিতে পারবো না, ভালো থেকো প্রিয়। তোমার মতো করে কখনও ভালোবাসতে পারবো না জানি, তবুও অন্তত একজন বন্ধু হিসেবে তোমার ভালো সবসময় চাই। কাল কি হবে জানিনা, তবে তুমি আমার মনে সর্বদা বাস করবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তোমায় যেন ভালো রাখে, তোমার জীবনে এমন এক মেয়ে আসুক যে তোমায় খুব ভালোবাসবে।" আর কিছু বলতে পারলো না দিশা, দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্নাকে আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে গেল।
*
*
*
গাড়িটা অর্কের বাড়ির সামনে আসতেই দিশা ভাবতে লাগলো ওকে ডাকবে কি না। ঠিক তখনই অর্কের ঘুমটা একটা ঝাঁকুনিতে ভেঙে গেল। দিশা তাকে ধিমি স্বরে ডেকে বলল, “অর্ক চলো বাড়ি চলে এসেছি।"
-- হুঁ, হ্যাঁ চলো।
দুজন নেমে, পেমেন্ট করে দিতেই গাড়ির চালক ট্যাক্সিটা নিয়ে অন্ধকারে বিলুপ্ত হয়ে গেল।
বাড়িতে ঢুকে কেউ কোনো প্রকার কথা না বলে নিজের নিজের রুমে চলে গেল। আগের থেকেই ওরা সেপারেশনে থাকতো, এরপর পুরোপুরি আলাদা হয়ে যাবে।
সকাল প্রায় ছয়টা বাজে, রুম লাগোয়া ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে দিশা। সকালবেলার মনোরম পরিবেশের মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে এসে লাগছে। পাশের গাছটায় কত পাখি কিচির মিচির করছে, হয়তো তাদের আর সারাদিন দেখা হবে না তাই এই বিদায় বার্তার পর্ব চলছে। মনে পড়ে যায় তারও তো আজ বিদায়ের পালা, মনটা অজান্তেই খারাপ হয়ে যায়, একটা চাপা কষ্ট যেন গলা টিপতে আসে। নিজের মনে মনেই সে বলল, “না, এইভাবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকলে বেশি মনকেমন করবে, বরং ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্টটা বানায়, আজকেই তো শেষ, আর কি জানি অর্কের সাথে দেখা হবে কি না!"
ফ্রেশ হয়ে সে নিচে নেমে দেখতে পেল, অর্ক তার আগেই ব্রেকফাস্ট বানিয়ে টেবিলে সাজাচ্ছে।
তাকে দেখতে পেয়েই অর্ক সকালের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে উঠলো, “এসো বসো, খাবার রেডি।"
“গুড মর্নিং, হুঁ বসছি। তুমি বসো..."
দুজনেই বসে পড়লো খাবার টেবিলে, দুজনেই বেশ নিরব। অর্ক কিছু বলার জন্য উসখুশ করছে দেখে দিশা বলল, “কিছু বলবে তুমি?"
“না... না তো... কিছুনা। খাও, খাবার ভালো হয়েছে?"
“তোমার হাতের রান্না তো বরাবরই ভালো অর্ক, এতে নতুন করে কিছু বলার থাকে না আমার। খুব টেস্টি হয় খাবারগুলি, খুব মিস করবো।"
“শুধু খাবার গুলোই মিস করবে! আমাকে মনে পড়বে না!" প্রথমের কথাটি শোনা গেলেও পরের কথাটি ঠিক মতো শুনতে পেল না দিশা।
“সত্যি তোমার হাতের রান্না খুব মিস করবো।"
“আচ্ছা।"
আবার সবকিছু নিস্তব্ধ। এই নিরবতা ভেঙে অর্ক বলে উঠলো, “আজকেই চলে যাচ্ছ তাহলে!"
“আর কতদিন তোমায় জ্বালাবো বলো! এমনিতেই একদিন থেকে গেলাম। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো আজীবন অর্ক।"
“একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তোমার সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করা উচিৎ। তা কোথায় উঠবে এরপর, তুমি যে ফ্ল্যাটটা দেখে রেখেছ সেটা তো এখনও কমপ্লিট হয়নি।"
“শুধুই কি শুভাকাঙ্ক্ষী!"
“হ্যাঁ তো তার বেশি আর কি আছে বলো! যাই হোক কোথায় থাকবে বললে না তো!"
“তুমি জেনে কি করবে? ঠিক একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নেব।"
“তোমার সুরক্ষার ব্যাবস্থা করার দায়িত্ব এখনও কিছুটা হলেও আমার আছে, তাই জানাটা জরুরি।"
“কোন অধিকারে জানতে চাইছো?"
“একজন শুভাকাঙ্ক্ষী কিংবা একজন বন্ধু হিসেবেও বলতে পারো।"
দিশা নিজেকে সংযত করে নিল। তার তো মানায় না এমন অভিমান করা। অর্ক ভালোবাসলেও কি বলবে? না কখনোই না, কারণ সে সবসময় তার সুখের কথায় ভেবে এসেছে। এমন মানুষ কি আর কোথাও আছে? যে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েও অন্যের সুখের কামনা করে? কই শুভও (দিশার প্রেমিক) তো এইরকম নয়... অর্ক সবার থেকে আলাদা...
“কোন ভাবনায় ডুবে গেলেন ম্যাডাম! কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম উত্তর দেবে না!"
“হুঁ... হ্যাঁ কি বলো..."
“কোন খেয়ালে মগ্ন ছিলেন? শুভ বাবুর নাকি!"
“ না না... শুভ নিউটাউনে দু'কামরার একটা ফ্ল্যাট রেন্টে নিয়েছে ছয়মাসের জন্য সেখানেই আপাতত থাকবো।"
“আচ্ছা, খুব ভালো। ভালো থেকো তোমরা। আমি উঠলাম বুঝলে, কিছু কাজ আছে একটু করে নিই।"
অর্ক তাড়াহুড়ো করে উঠে সোজা সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল। দরজাটাই হেলান দিয়ে বসে পড়লো সেখানেই, হাঁটু মুড়ে বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিলিংয়ের দিকে। চোখ দুটো থেকে অনবরত জল পড়তে লাগলো।
আর পারছে না সে, ভালোবাসার মানুষটিকে এইভাবে বিদায় দেওয়া কত কষ্টকর সেটা সে ছাড়া আর কে বুঝবে! সবাই তো বলে ছেলেরা অনেক কঠিন হয়, তাদের কাঁদতে নেই। কিন্তু অর্ক কিভাবে পারবে দিশাকে ছেড়ে থাকতে, সে ছাড়া যে তার আর কিছুই নেই, পুরো জগৎ যেন শূন্য, কেউ কোথাও নেই। ভালোবাসলে বুঝি এত কষ্ট পেতে হয়? হয়তো শুধু ভালোবাসা হলে অর্ক দিশাকে যেতে দিতে পারতো, কিন্তু কেউ যদি প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়। সকাল থেকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবধি তার সাথে একটা খুনসুটি, অভিমান চলে তাহলে সে এখন একা কিভাবে থাকবে?
দিশার গলা দিয়েও কিছু নামলো না আর। প্লেটগুলো রান্নাঘরের যথাস্থানে রেখে নিজের রুমে গিয়ে গোছগাছ শুরু করলো। আজকেই ওকে শিফট করতে হবে, সকাল এগারোটার দিকে শুভ নিতে আসবে বলেছে। এখন কিভাবে সে বলবে, আমি আর তোমার সাথে যেতে চাই না, আমি এই স্বর্গের মতো শান্তির স্থান ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। সে বুঝবে না হয়তো। একটা ঝড় জীবনের কতকিছু বদলে দেয়, সত্যি বোঝা মুশকিল।
সকালের পর অর্ককে আর দেখেনি দিশা। তার রুমের কাছে গিয়েছিল কিন্তু দরজা বাইরে দিক থেকে লক দেখেছিল। আগে কোথাও গেলে অর্ক বলে যেত, কিন্তু আজ কিছুই বলে যায়নি।
এইদিকে শুভ এসে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে বসে আছে। দিশাকে তাড়া দিচ্ছে। সে পাঁচ মিনিট ওয়েট করতে বলে নিজের রুমের মধ্যে বারবার পায়চারি করছে, বারবার অর্ক এর নম্বরে ডায়াল করছে কিন্তু প্রতিবার সুইচ অফ বলছে। অর্ক এমন বেপরোয়া নয়, তাহলে আজ সে কোথায় গেল? সে ঠিক আছে তো? এইসব চিন্তা দিশাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
আর অপেক্ষা করার মতো সময় নেই, শুভ রেগে যাবে এরপর। তাই নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। সাজানো গোছানো সংসারটাকে বিদায় দিতে হবে আজই। দিশার মনে হটাৎ প্রশ্ন জাগে, “আদৌ কি সংসার পেতেছিল সে!" উহু না তো, অর্ককে তো কোনোদিন স্বামীর স্থান দেয়নি। অর্ক কতবার তার কাছে এসেছে, কিন্তু সে বারবার নিজের পায়ে পিষে ফেলেছে তার মূল্যবান ভালোবাসাকে। তবে শেষের দিকে বন্ধুত্বটা খুব দৃঢ় হয়েছিল। চোখ থেকে তার টপ টপ করে দু-ফোঁটা নোনা জল বেরিয়ে এলো, শুভ দেখার আগেই তাড়াতাড়ি মুছে নিল। মেইন দরজা দিয়ে বেরিয়ে চাবিটা লাগিয়ে আবার ভিতর দিকে ছুঁড়ে দিল। চাবিটা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বৃথা সে জানে। কোন মুখে সে আবার ফিরবে। ফোনের গ্যালারিতে অসংখ্য ছবির মাঝেই নাহয় অর্কর স্মৃতিগুলো সীমাবদ্ধ থাকুক। যে নতুন পথে পা বাড়িয়েছে সেই সম্পর্কটা এখন সযত্নে আগলে রাখতে হবে।
অর্ক পারেনি তার প্রাণপ্রিয় মানুষটির বিদায় দেখতে। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে এসেছে বাড়ির সামনের একটা মন্দিরে। সেখানে বসে থেকে ঠাকুরকে কতবার বলেছে দিশা যেন না যায় কোথাও, তার যেন আর যেতে ইচ্ছে না করে। জানে তার বলা কথাগুলো ব্যর্থ, কিন্তু ক্ষনিকের মনের শান্তি এই যা। এখন তো তার ঘরটা তাকে শুধু গিলে খাবে তার থেকে মন্দিরের পাশের গাছের ছায়ায় বেদীতে বসে আছে, একা, নিশ্চুপ ভাবে। বড্ড একাকীত্ব ঘিরে ধরেছে আজ তাকে, কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। নিজের সমাধি চাইছে অর্ক, অবিলম্বে। কিন্তু তার কথা কেই বা শুনবে। অদৃষ্ট যদিও শুনতে পান, তিনি কি তার সন্তানের ক্ষতি চাইবেন! হয়তো না...
অর্কের একটা আশা যেন তাকে বারবার বলছে ‘যা বাড়ি যা তোর দিশা তোকে ছেড়ে যেতে পারে না।' নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে ওঠে সে। তার দিশা... না না দিশা তার নয়, দিশা শুধুমাত্র শুভর। শুভ অনেক ভাগ্যবান তাই দিশার মত একজন মানুষের সঙ্গ পেয়েছে। কখনো কখনো বড্ড হিংসা হয় শুভর উপর, দিশার সাথে তার যদি আগে দেখা হতো তাহলে হয়তো তারই থাকতো সে। আর ভাবতে পারে না সে মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ির পথের দিকে হাঁটা দিলো, ভীষণ এলোমেলো ভাবে হাঁটছে সে। আজ তার কোনদিকে খেয়াল নেই, সব কেমন যেন অন্ধকার লাগছে, পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেছে মনে হচ্ছে তার। রোড ক্রস করবে, হটাৎ করে একটা যান্ত্রিক শব্দ, তারপর সব অন্ধকার। পাশাপাশি লোক মুখের ক্ষীণ আওয়াজ অর্ক শুনতে পাচ্ছে, “কানা নাকি লোকটা, এতবার করে ডাকলাম, ট্রাকটা জোর গতিতে আসছে রাস্তা পারাবার হবেন না, কিন্তু কোনো কথা শুনলোই না লোকটা।"
এখানেই কি সব শেষ! দিশা নিজেকেই প্রশ্ন করলো। শুভ আর ও একসাথেই গাড়িতে যাচ্ছে কিন্তু দিশার মন অন্য কোথাও আছে। বারবার মনটা কু ডাকছে, অর্ক ভালো আছে তো? একবার তাকে দেখা দিতে পারলো না, শেষের সময়। ভয়ের সাথে সাথে অভিমানের স্তরটাও বড্ড গাঢ় হতে লাগলো তার।
*
*
*
সব শেষ! আস্তে আস্তে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো, অন্ধকার, চারদিকে শুধু অন্ধকার। শুধু মাত্র একটা ক্ষীণ আলোর শিখা দেখা যাচ্ছে বহুদূরে, সে হয়তো দিশা... আর কখনো ফিরবে না...!
মনটা বড্ড উচাটন হয়ে আছে দিশার, তখন থেকে অর্ককে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু লাগছেই না ফোনটা। শুভকে একটু দাড়িয়ে যেতে বললো ওর সাথে দেখা করার জন্য কিন্তু তার অফিস বলে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলে এলো, কিন্তু বাড়িতে এসে সে দিব্য সোফায় বসে ফোন ঘাটছে। বড্ড বিরক্তি লাগছে দিশার। কই অর্কর সাথে থাকার সময় তো এত বিরক্ত লাগেনি, যা এই কয়েক ঘন্টা সময়ে শুভর সাথে থেকে লাগছে।
আরেকবার অর্কর ফোনে কল লাগাতেই রিং হতে লাগলো, বুকটা ভীষণরকম ঢিপ ঢিপ করছে। কেউ পিক করেছে কলটা, কিন্তু এ কার গলা... ওই পাশ থেকে আওয়াজ আসছে, “হ্যালো... হ্যালো... শুনতে পাচ্ছেন? আপনি কি অর্ক বসুর কেউ হন?"
“হ্যালো... কে বলছেন?" খানিকটা ভীত কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলো দিশা।
“অর্ক বসুর খুব বড়ো একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, আমি স্থানীয় বাসিন্দা। যত তাড়াতাড়ি পারেন ওনার বাড়ির লোককে খবর দেবেন প্লীজ... ডক্টর বলেছেন কন্ডিশন খুব খারাপ, অপারেশন করতে হবে। বাকি কথা এখানে এসে জেনে নেবেন... প্লীজ আসুন তাড়াতাড়ি...", উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে গেল অপর পাশের লোকটি কিন্তু এই দিকের মানুষটির কি অবস্থা সেটা সে ছাড়া আর ভালো কে জানবে। কখন যে হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেছে সে নিজেও বুঝতে পারেনি, পায়ের তলার মাটিটা যেন খানিকটা নড়ে উঠলো, ধপ করে বসে পড়লো মেয়েটা।
ঐপাশ থেকে এখনও, হ্যালো হ্যালো আওয়াজ আসছে, দিশা নিজেকে একটু সামলে ফোনের ব্যক্তিটিকে বলল, “আমি আসছি এক্ষুনি, কোন নার্সিংহোম একটু লোকেশনটা এই নম্বরে সেন্ড করবেন প্লীজ! আমি ওনার স্ত্রী বলছি..."
“ওকে, আমি সেন্ড করে দিচ্ছি..." তারপর কেটে গেল কলটা।
মাত্র কয়েকঘন্টায় জীবনটা কেমন একেবারে ওলোট-পালোট হয়ে গেল। না এইসব ভেবে এখন লাভ নেই আমাকে যেতে হবে, অর্ককে যেমন করেই হোক বাঁচাতে হবে, ওর মা-বাবাকে যে কথা দিয়েছিলাম, ওকে ভালো রাখবো। কিন্তু... না না এখন ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। নিজেই নিজেকে শান্ত করে, চোখ মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো দিশা।
শুভ নির্বিকার, কানে হেডফোন গুঁজে মোবাইলের দিকে এখনও তাকিয়ে, কার কি হলো কোনো আওয়াজ সে পায়নি। রেডি হয়ে দিশা, বেরোনোর জন্য তাড়াহুড়ো করছে তখন শুভ তাকে দেখে বলল, “কোথায় যাবে এখন, একটু আগেই তো এলে!"
“প্রয়োজন আছে, আমাকে যেতে হবে।", নিজের ব্যাগ চেক করতে করতে বলল দিশা।
“আমাকে বলা যাবে না নাকি? আমাকে না বললে কোথাও যাওয়া হবে না।", শুভ নিজের বক্তব্য পেশ করল।
“তুমি আজ আমায় আটকাতে পারবে না। অর্কর কিছু হবে আর আমি যাবো না এটা হতে পারে না..." দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো দিশা।
“যতসব ঢং, কিছু হয়নি। যাও ঘরে যাও, পারলে কিছু খাবার বানাও, খিদে পেয়েছে..."
“আমি এখন কিছু পারবো না, আমাকে যেতে হবে; বুঝলে! বাই..." ,আর কোনো কথার অপেক্ষা না করে গটগট করে বেরিয়ে গেল দিশা।
এইদিকে শুভ নিজের ব্যর্থতায় সোফায় হাতটা ঠুকে দিল। নিজের রাগকে সংযম করতে না পেরে, অর্ককে কয়েকটা গালিগালাজও করতে লাগলো, দিশাও বাদ গেল না সেই অপ্রকাশিত রাগ থেকে।
*
*
“ম্যাম অর্ক বসু... অর্ক বসুর কেবিন নম্বর কত?", নার্সিংহোমে দৌড়ে ঢুকেই রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলো দিশা, শ্বাস নিতে নিতে।
“ম্যাম দেখছি... ২০৩... আপনি ওনার কে হন?", রিসেপশনের মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো।
“আমি ওনার স্ত্রী, আমাকে এখন যেতে হবে। থ্যাংক ইউ..." , বলেই দিশা আবার দৌড় দিল অর্কর কেবিনের দিকে। সে জানে না তাই জিজ্ঞেস করে কিরে যাচ্ছে।
সেখানে পৌঁছাতেই দেখল দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তাকে দেখেই দুজন উঠে দাঁড়ালো। তাকে বসতে বলে, জল দিল। একটু শান্ত হওয়ার পর, ভদ্রলোক দুজন তাকে জিজ্ঞেস করলে সে তার পরিচয় দিল এবং তারা চলে গেল তাদের ফোন নম্বর দিয়ে প্রয়োজন পড়লে তাদের যেন খবর দেয় এই বলে।
কেবিনের বাইরে সে আকুল নয়নে দাঁড়িয়ে আছে, কখন মানুষটাকে একটু দেখতে পাবে এই ভেবে। ডক্টরদের আনাগোনা লেগেই আছে, দিশা শুধু শুনেছে ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন, এখনও চোখে দেখতে পায়নি, খুব ভয় হচ্ছে ওর। ছেড়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে একেবারে ছেড়ে দিক এটা তো ও কখনই চাইনি। বারবার ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছে যেন কিছু না হয় অর্কর। অর্কর মা বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারাও কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।
“ম্যাম... ম্যাম... আপনি কি অর্ক বসুর বাড়ির লোক?"
এখন নার্স এসে তাকে জিজ্ঞেস করলে তার ধ্যান ভঙ্গ হয়, তারপর সে খানিকটা চকিত স্বরেই বলে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি ওনার স্ত্রী।"
“পেশেন্ট মাথায় গভীর চোট পেয়েছেন, অপারেশন করতে হবে। আপনাকে একটা বন্ডে সই করতে হবে...", নার্স ওনার বক্তব্য পেশ করতেই দিশা চমকে ওঠে, তারপর ভীত কণ্ঠে বলে, “ওর... ওর কিছু হবে না তো..."
ডক্টর কেবিন থেকে বেরিয়ে পাস কেটে যেতেই দিশা দৌড়ে ওনার কাছে গিয়ে আকুল কণ্ঠে বলে ওঠে, “ডক্টর আমি অর্ক বসুর স্ত্রী, বলছিলাম যে, ওর অপারেশন করলে ঠিক হয়ে যাবে তো, কিছু হবে না তো ডক্টর?"
“মিসেস বসু, চিন্তা করবেন না আমরা আমাদের বেষ্টটা দিয়ে চেষ্টা করবো, আপনি শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যান... এর বেশি আর কিছু বলতে পারলাম না। ফর্মালিটিগুলো পূরণ করে দিন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করা দরকার নয়তো জীবনের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।"
“আমি সব করে দিচ্ছি ডক্টর, আপনারা সব ব্যাবস্থা করুন।" দিশা বলতেই ডক্টর এক্সকিউজ মি বলে নিজের কর্তব্য পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
চার ঘণ্টা হয়ে গেছে অর্ককে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু এখনও কোনো খবর পাইনি দিশা, বারবার চিন্তায় পায়চারি করছে নার্সিংহোমের করিডোরে, অর্কর মা বাবা অনেকবার বলেছে ওকে একটু শান্ত হতে বসতে কিন্তু সে পারছে না, নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে দিশার। তার সাথে যদি ডিভোর্স না হতো অর্কর তাহলে এই জীবন নিয়ে টানাটানি খেলা চলতো না। বারবার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে সে, যেন আগের মত ঠিক হয়ে যায় অর্ক। আর সে ভুল করবে না, মন যা চায় সেটাই করবে, শুধু অর্ককে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুল আবেদন করছে মেয়েটা ঈশ্বরের কাছে।
অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টর, নার্সদের বেরোতে দেখেই দিশা সেইদিকে ছুটলো। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এখুনি কিছু বলা যাচ্ছে না, তবে আমাদের বেস্টটা আমরা দিয়েছি, জ্ঞান ফিরতে এখন সময় লাগবে, কিছুক্ষন পর নরমাল কেবিনে দেওয়া হচ্ছে। বলেই তারা চলে গেলেন।
*
*
কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন, শুভ বহুবার দিশাকে নিতে এসেছে, কিন্তু সে যেতে নারাজ। অর্ক এখন মোটামুটি সুস্থ, সেও বলেছে ওকে চলে যেতে, অর্কর মা-বাবাও কোনো বাধ সাধেনি, কিন্তু দিশা নিজের জেদে রয়েই গেছে।
অর্কর অপারেশনের পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টার পর জ্ঞান ফিরেছিল, সকলে ভেবেই নিয়েছিল আর বাঁচবে না সে। কিন্তু দিশা একবারের জন্যও মন থেকে ভাবেনি যে অর্ক আর জীবন ফিরে পাবে না, ঈশ্বরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল যদি অর্ক ফিরে আসে তাহলে সে সারাজীবন তার কাছেই থাকবে। কত যে চোখের জল মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে ওই দুদিনে সে তার চেয়ে বেশি কে জানবে! কই এতদিন তো সে বুঝতে পারেনি এতটা ভালোবাসে ছেলেটাকে, দূরে গেলেই বুঝি ভালোবাসা হাজার গুন বেড়ে যায়? কি জানি, তাই হয়তো হয়। কথায় তো আছে দূরে না গেলে নাকি কাছে আসা যায় না, তাই হয়তো দুদিনের এই দূরত্ব অর্ক আর দিশাকে অনেকটা কাছে এনে দিয়েছে।
অর্কর জ্ঞান ফেরার খবর পেয়েই মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে কেবিনের দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল। অর্কর মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার কুলোইনি, অনেক বলে কয়ে পাঠানো হয় তাকে। কেবিনে প্রবেশ করেই অর্কর অবস্থা দেখে বুকের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটা, বারবার অর্কর মুখে চোখে ছুঁয়ে দেখছিল, স্বপ্ন নাকি সত্যি? যখন বাস্তবের সত্যকে সে স্বপ্ন ভাবছে স্বপ্ন তখনই অর্ক তার ক্ষীণ কণ্ঠে দিশাকে ডেকে উঠলো। দিশার ধ্যান ফিরতেই মনে হলো এটা কি করছে সে? তারপর ভাবলো মানুষটাকে তো এইভাবেই কাছে চাই সে, তাহলে ভুল কোথায়? কিন্তু অপর পাশের মানুষটা কী চাই? সেটা তো ওর মুখ থেকে শোনেনি কখনও। নিজেকে সংযত করে বুক থেকে উঠে বসলো দিশা, এখনও মাথাটা নিচু করে আছে।
অর্ক ক্ষীণ অথচ খানিকটা অভিমানী কণ্ঠে বলে উঠলো, “দিশা তুমি আবার ফিরে এলে? আমার কিছু হবে না গো, তুমি যেখানে ভালো থাকবে সেখানে ফিরে যাও গো।"
“কেন? তুমি আমাকে গ্রহণ করবে না আর? যদি বলি কোথাও যেতে চাই না আমি, তোমার কাছেই থাকতে চাই...!", দিশা দৃঢ় কন্ঠে বলল।
“তা হয়না গো, তুমি আমার সাথে ভালো থাকতে পারবে না। আমাকে ভালবাসতে পারবে না!", অর্ক ক্লান্ত স্বরে বলে উঠলো।
”আমি তোমার সাথেই থাকতে চাই, ভালোবাসি কি না জানিনা তবে তুমি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছ, আর আমি এই অভ্যাস বদলাতে চাইনা। তুমি যদি আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে তাহলে তোমার জীবনে আমার ছায়া কখনই মাড়াবে না...", কথাগুলো বলেই সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। এই শেষের লাইনটা বলতে যে তার কত কষ্ট হয়েছে তা দিশার অনবরত অশ্রুধারা পড়তে থাকা দুটি চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
মেয়েটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে অর্ক ডাকতে চেয়েও ডাকতে পারে না কোথাও যেন বাঁধে। নিজের মনেই ভাবতে থাকে সে,“না না, এটা আমি স্বপ্ন দেখছি, দিশা কখনই আমার হতে পারে না, সে তো শুভর। ভালোবাসতে তো ত্যাগ থাকে, তাহলে আমি কেন বারবার মোহতে জড়িয়ে পড়ছি? সে কি আদৌ আমার, সে কি সত্যিই ফিরে আসবে আমার জীবনে? আমার জীবনে এলে তো আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবে না, তারপর ঈশ্বরের ইচ্ছা।", ক্লান্ত চোখদুটো বন্ধ হয়ে এলো অর্কর।
*
*
*
আজ হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ পেল অর্ক। সেদিনের পর থেকে দিশা আর অর্কর সাথে কথা বলেনি, খেয়াল রেখেছে, যত্ন করেছে কিন্তু মুখে টু শব্দটি করেনি। সেদিনের বলা কথাটির জন্য বড্ড অভিমান জন্মেছে মনে মনে। নিজের অধিকার যে নিজে বুঝে নিতে পারে না তার সাথে কথা বলবে কেন? সত্যি তো। একবার তো বলেছে দিশা তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না, তবুও বোঝে না মানুষটা এটাই সবচেয়ে বেশি অভিমানের।
বাম পায়ে একটা হাড় ভেঙেছিল, সেই ব্যাথাটা এখনও আছে এবং মাথার ব্যান্ডেজগুলো এখনও খোলা হয়নি, ঘা গুলো ঠিকমতো শুকোয়নি তাই দিশা ওকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে সযত্নে শুইয়ে দিল। একটা কড়া আদেশ দিয়ে গেল, যেন বিছানা থেকে একপাও না নড়ে। অর্কর ঠোঁটের কোণে একটা আলতো হাসি খেলে গেল। একটা মেয়ের কত রূপ থাকে, কখনও সে বন্ধু হয়ে পাশে থাকছে, কখনও স্ত্রী হয়ে সেবাযত্ন করছে, আবার কখনো মায়ের মত স্নেহ করে খাইয়ে দিচ্ছে। এই সবগুণ গুলোই দিশার মধ্যে বিরাজমান। নিজে নিজেই হেসে উঠলো সে। কিন্তু একটু খারাপও লাগছে অর্কর, কয়েকদিন থেকে ঠিকমতো কথা বলেনি তাই। তবুও তার দিশুর এই রূপটা দেখতে বড্ড ভালো লাগে।
অর্কর মা বাবা জানতো না তাদের ডিভোর্সের কথা, যখন জানলো তারা আশাহত হয়ে পড়েছিল কিন্তু দিশা যখন বলল যে তাকে ছাড়া কোথাও যাবে না সে, চাইলে আবার সাতপাকে বাঁধা পড়তে পারে তবে ওই একটা মানুষের সাথেই। শুনে ওনারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।
আজ সেই শুভদিন অর্ক আর দিশা আবার সাতপাকে বাঁধা পড়তে চলছে। এতদিন খেয়াল রাখা যত্ন নেওয়ার মাঝেই অর্ক দিশার মনের কথা বুঝেই ফেলেছিল তাই নিজেকে আর গুটিয়ে রাখতে চাইনি, মেলে ধরেছে মেয়েটির কাছে। বারবার সুযোগ আসে না, তাই সে হেলায় পায়ে ঠেলতে চাইনি সে। বড্ড ভালোবাসে মেয়েটাকে আর মেয়েটা কতটা ভালোবাসতে পারে তা তার প্রতিটি ব্যাবহারে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম। মুখে না বললেও ভালোবাসাকে গভীর থেকে অনুভব করা যায়, সেটা অর্ক বোঝে তাই সেও প্রকাশ করে না যতটা সম্ভব মেয়েটাকে আগলে আগলে রাখতে চাই। এখন সে অনেকটাই সুস্থ, আর মেয়েটাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইনা, তাই যতটা সম্ভব কাছে টেনে নেওয়ার পুনঃপ্রচেষ্টা করছে। তাই এই ঘরোয়া এবং আইনি বিবাহের আয়োজন করেছে ওর বাবা-মা।
এই কয়েকদিন শুভ বেশ কিছু কাণ্ড করেছে দিশাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু সে যেতে নারাজ। এমনকি থানা পুলিশের ঝক্কিও তাকে সইতে হয়েছে। অবশেষে মানহানির মামলা করার ভয় দেখিয়ে শুভকে আটকানো গেছে। সত্যি তো মন যার কাছে থাকলে শান্তি পাই, নিরাপদ মনে হয় তার কাছেই তো থাকা উচিৎ। আর সেই নিরাপদের স্থানটা দিশা অর্কর কাছে পেয়েছে, শুভ নয়। এমন অনুভব শুভর কাছে সময় তো কখনো হয়নি তার। বড্ড বেশি শাসন ছিল তাতে। মানুষ হয়তো বেটার কিছু পেলে আগের মানুষটির দোষ ধরতে ভালই পারে। দিশা নিজেই নিজেকে কেমন স্বার্থপর মনে হতে লাগলো। না আর ভেবে কাজ নেই, জীবন অন্য কিছু চাই, তাই সেই পথ আপন করে নেওয়াই ভালো, এটা হয়তো মণকেমনের সংযোগ। বিধাতা হয়তো এটাই চান। তাই তো হারিয়েও আবার ফিরে এলাম অর্কর কাছে।
-- দিশু কী ভাবছো এত?
-- ভাবছি কতটা জড়িয়ে পড়েছি তোমার মায়ায়, কতটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছ তুমি... ভালোবাসি তোমায়...
-- শুভ...
-- প্লীজ নো, ওকে ভালোবাসতাম, এখনও হয়তো তার জন্য সুপ্ত অনুভূতি রয়েই গেছে মন গোপনে, কিন্তু তুমি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছ, আর আমি চাইনা এই অভ্যাস ত্যাগ করতে।
-- জানো এখনও মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি...
-- এবার ভেবে নাও এটা সত্যি, সারাজীবন আমার জ্বালানো সহ্য করো এরপর।
-- তুমি থাকলে সব সহ্য করতে পারি।
-- তাই!
-- হুঁ মায় দিশু বেবি...
-- কীহ!
-- কিছুনা...
অর্ক বলেই দিশাকে অবাক করে দিয়ে তার গালে টুক করে একটা কিস করে নিল। তারপর কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতার পর, দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে সারাজীবন ভালোবেসে পাশে থাকার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হলো।
একেই হয়তো বলে বিধাতার সংযোগ। ভালো থাকুক অর্ক-দিশা এর মত হাজারো প্রেমিক পুরুষ।

