Soma Halder

Classics Others

4  

Soma Halder

Classics Others

মন্দাকিনীর হাওয়া

মন্দাকিনীর হাওয়া

25 mins
421


    এই কাহিনীটা হল অরিন্দম.... মানে অরিন্দম সেনগুপ্তর । অরিন্দমের বয়স এখন সাতাশ বছর । বাবা কাকাদের পৈতৃক ব্যবসায় সামলাচ্ছে ও । যাইহোক অরিন্দমদের এখন এমনই অবস্থা যে , তাকে কলকাতায় ব্যাবসার সব কাজ ছেড়ে দাদুর পৈতৃক ভিটে বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে যেতে হচ্ছে । ওদের আদি বাড়ি জনাইতে , হুগলির জনাই রোড স্টেশন থেকে ওই আধঘন্টার পথ । প্রায় দু আড়াই ঘণ্টার পথ নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে অরিন্দম এসে পৌঁছাল তাদের পৈতৃক বাড়িতে । এই বাড়িটির দেখাশোনা করার জন্য একজন লোক আছে , তার নাম রমেশ । রমেশের বয়স অন্তত ষাট পয়ষট্টি তো হবেই । সেই কুড়ি বছর বয়স থেকে এই বাড়ির দেখা শোন করছেন ।


   

   অরিন্দমদের ব্যবসায় বেশ কয়েকমাস ধরে মন্দা চলার কারণে , বাড়ি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওদের গ্রামের আদি বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হবে । সেটা বিক্রি করে বেশ মোটা অংকের অর্থ হাতে পাওয়া যাবে । তখন সেই টাকা দিয়ে পাওনাদারদের ও দেনা শোধ করা যাবে , আবার কিছুটা ব্যাবসার মূলধন হিসেবেও কাজ লাগানো যাবে । বেকার এখানে বাড়িটা পড়ে আছে কোনো কাজে লাগে না । ওরা কেউ এখানে ঘুরতে আসার ও সময় পায়না , তাহলে শুধু শুধু রাখা কেন ! বিক্রি করে দিলে অন্তত একটা কাজে তো লাগবে । এই ভেবেই অরিন্দমের এখানে আসা । বাড়িতে বাবা ছাড়া আরেক কাকা আছেন । তার এক মেয়ে এক ছেলে , বয়সেও অরিন্দমের থেকে বেশ ছোটো তারা ; তাই ওকেই এই কাজের জন্য এখানে আসতে হলো । বাড়ির বড়ো ছেলে বলে কথা ।


   বাড়িতে আসতেই অরিন্দমের সাথে রমেশের অনেক দিন পর দেখা হলো । অরিন্দম অনেক ছোটো ছিল , শেষবার যখন সে এখানে এসেছিল । তবে রমেশ কিন্তু , অরিন্দম কে দেখে পুরো চমকে যায় । কেন ? সেটাই বলছি । অরিন্দম তার ঠাকুরদার ছোটো ভাই , মানে তার ছোটো ঠাকুরদার মতো দেখতে । অবিকল মুখ ও চেহারার গঠন তারই মতন । রমেশকে চুপ থাকতে দেখে , অরিন্দম এবার নিজে থেকেই বলল ,

---- কী... রমেশ জেঠু ! আমায় দেখে চিনতে পারছো না... বুঝি ! কি কেমন দেখতে হয়েছে আমায় ? 

---- খুব সুন্দর বাবা ! আর তার থেকেও বেশি তোমার মনটা সুন্দর । বাইরের সৌন্দর্য্য কি আসল সৌন্দর্য্য ! অন্তরটা যার সুন্দর সেই তো প্রকৃত অর্থে সুন্দর ! 


  আচ্ছা ছাড়ো ওসব কথা ! তুমি এখন যাও তো দেখি আগে , স্নান টা আগে সেরে নাও । কতটা পথ এলে ! আগে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হও । তারপর আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি । সকাল দিয়ে তো কিছু পেতে পড়েনি যা দেখছি । রমেশের কথা গুলো শুনে অরিন্দম রেডি হতে চলে গেলো । 


   কিছুক্ষন পর খাওয়ার টেবিলে বসে , রমেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো অরিন্দম । 

----  উফফ্ ! মাংসটা যা রেধেছো ! কি বলবো , পুরো অমৃত ! 

---- তোমার ভালো লেগেছে তো দাদাবাবু ! এই নাও আরেকটু । 


   খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর , অরিন্দম ছাদে দাঁড়িয়ে কিছু জরুরি ফোন কল করছিলো । ঠিক এমন সময় , একটা লোক এসে গেটের সামনে কিছু কথা বলে চলে গেলো । অরিন্দম ওপর থেকে রমেশকে দেখে বুঝতে পারলো , কিছু একটা খারাপ খবর আছে । তাই ও তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো । নিচে নেমে রমেশকে জিজ্ঞাসা করতেই । ও বলল , 


----  দাদাবাবু , আমার নাতিটার বড্ড শরীর খারাপ ! ধুম জ্বর , তার ওপরে শুনছি পায়খানা বমিও করছে । ওইটুকু ছেলেটাকে আমার হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে মনে হচ্ছে ! যদি তুমি একটি বার ছুটি দাও । ছেলেটাও আমার শহরে গেছে । কাল সকালের আগে আসবে না । এই বুড়ো মানুষটাকেই যেতে হবে বাবা !


---- একি বলছো তুমি রমেশ জেঠু ! তাড়াতাড়ি যাও । আগে ওকে ডাক্তার দেখাও । আর শোনো , এই নাও কটা টাকা রাখো । ওখানে কতো কি লাগবে ! বলে চারটে পাঁচশো টাকার নোট হাতে গুজে দিল ।


  রমেশ যেতে যেতে বলে গেলো , তোমায় এখানে একা রেখে যাচ্ছি । আমার যে কি দুশ্চিন্তা হবে তা তোমায় আমি বলতে পারবো না ! সাবধানে থেকো দাদাবাবু ! আমি দেখি , কাউকে জোগাড় করে দিয়ে যেতে পারি কিনা ! 


---- তুমি আমার খাওয়া দাওয়ার চিন্তা করছো ? ও যা হোক কিছু একটা খেয়ে নেবো । তুমি আগে নাতিকে দেখো । 


---- নাহ্ ! দাদাবাবু তোমায় এই বাড়িতে একা রেখে যেতে আমার সত্যিই খুব চিন্তা হচ্ছে । ভগবানের কাছে এই প্রার্থনায় করি , " ভগবান তোমার মঙ্গল করুক !"


   রমেশ চলে গেছে আধঘন্টা হয়ে গেছে । এদিকে সন্ধেও নেমেছে । তার ওপরে আকাশও মুখ ভার করে বসে আছে । মনে হচ্ছে , আজকে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হবে । এদিকে অরিন্দম অনেকক্ষণ ধরে একা বসে আছে জানলার ধারে । রমেশও নেই , যে ও একটু কথা বলবে । এই এতবড়ো বাড়িতে ও একা !  রমেশ জেঠুকেও ওদিকে বড়োমুখ করে বলল , ও একা ম্যানেজ করে নেবে । কিন্তু , এখন যা ওর অবস্থা ! তাতে এই বাড়িটাই না ওকে আসতো চিবিয়ে খেয়ে নেয় । তাও আবার কড়মড় করে ! এমনিতেই ওর এই বাড়িতে থাকার অভ্যাস নেই । তার ওপরে এই বাড়িতে তো আজ কতো বছর হলো , পা পর্যন্ত রাখেনি । এমন সময়ে " মরার ওপর খাড়ার ঘা " হয়ে , লোডশেডিং হয়ে গেলো । বাইরের আবহাওয়াও সুবিধের নয় । কখন বলতে কখন বৃষ্টি নামে । এমন সময় ছাদের ওপর কি একটা ধড়াস করে আওয়াজ শুনতে পেল । একবার ভাবলো ছাদে গিয়ে দেখবে । কিন্তু , নাহ্ ! সাহস হলো না । তাই চুপচাপ ডাইনিংয়েই একটা মোমবাতি ধরিয়ে বসে রইলো । 


  এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর , দরজায় ঠক ঠক করে বেশ কয়েকবার শব্দ হলো । এবার অরিন্দমের অবস্থা " আত্মারাম খাঁচাছাড়া " হবার উপক্রম ! ও ভূতের সিনেমায় দেখেছে এভাবেই ভূতেরা আসে । ও দরজা খুলবে না ! দরজা খুললেই যদি ভুত এসে গলা টিপে ধরে , তাই কোনোমতেই দরজা খুলবে না । আবারও বেশ কিছুক্ষণ পর , দরজার ওপরে ঠকঠক করে শব্দ হলো । তবে এবার দরজার ওপার থেকে একটি নারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল । 


---- "দাদাবাবু দরজাটা খুলুন ! আমাকে রমেশ মামা পাঠিয়েছে "।


 এবার একটু ভরসা হলো অরিন্দমের নাহ্ ! এ ভুত নয় । গিয়ে দরজাটা খুলতেই অরিন্দমের চোখ স্থির হয়ে রইলো । তার মুখ থেকে যেনো আর কোনো কথা বেরোলো না । সে অবাক দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেই অপরূপা রমনীর দিকে । মেয়েটির বয়স আঠেরো ঊনিশ বছর হবে , চাপা গায়ের রঙ , তবে উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি ঠিক যেন মাছের মতো , পদ্মফুলের মতো ভরা মুখখানি , একমাথা চুল কোমর চাপিয়ে পড়ছে , লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে । তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো তার লালিমালিপ্ত মুখের হাসি ।


  বেশ কিছুক্ষণ পর সেই মেয়েটিই বলল , বাবু আমাকে রমেশ মামা পাঠিয়েছেন । ওই আপনি রাত্রে কি খাবেন .... ! সেই সব করে দেওয়ার জন্য । তার তো নাতির বড্ড অসুখ । মেয়েটির কথা শেষ হতেই অরিন্দম বলে উঠলো ,

--- ও হ্যাঁ ...! হ্যাঁ ! আসো । রমেশ জেঠু যাওয়ার সময় বলে গেছিলো বটে । আচ্ছা ! তা তোমার নাম কী ? ডাকতে সুবিধা হবে সেই জন্য জিজ্ঞাসা করছি ? 


   " মন্দাকিনী " অরিন্দমের প্রশ্নের উত্তরে বলল মেয়েটি । নামটি শুনে অরিন্দম ও বেশ প্রশংসা করলো । অপূর্ব নামটি তোমার ! যেমন দেখতে তেমন নাম । বলেই নিজেকে সামলে নিলো । আর মনে মনে ভাবল , কি সব বলছিস অরিন্দম নিজেকে কন্ট্রোল কর । নিজের ফিলিংস গুলো কেউ বলতে বলেনি তোকে , কি ভাববে মেয়েটা ইসস !

  

   মেয়েটা ঘরে ঢুকতেই লাইট টা দুবার জ্বলে আবার আবার পাওয়ার কাট হয়ে গেল । বিরক্তির সুরেই অরিন্দম বলল , আজকে কারেন্টটা প্রচন্ড জ্বালাচ্ছে । যাইহোক , মেয়েটি আরেকটা মোমবাতি ধরিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল । অরিন্দমের মেয়েটির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল ঠিকই ; কিন্তু , বিষয়টা কেমন খারাপ দেখাবে বলে কিছু বলল না । অরিন্দমের মেয়েটিকে বেশ পছন্দ হয়েছে । আগে কাউকে এতটা ভালো লাগেনি ওর । একটা কেমন যেন আকর্ষণ বোধ করছে ওর প্রতি ।


  কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটা রান্না ঘর থেকে খাবার দাবার গুলো খাবার টেবিলে এসে রাখলো । আর অরিন্দম উদ্দেশ্য করে বলল , নিন খেয়ে নিন । অরিন্দম বলে উঠলো , এত তাড়াতাড়ি ! সবে তো আটটা বাজে । তার থেকে বরং , আমরা এখানে বসে কিছুক্ষন কথা বলি । তারপর নাই খাওয়া যাবে । কিন্তু , মন্দাকিনী একটু জেদ করেই বলল , আগে আপনি খেয়ে নিন । খেতে খেতে নাই কথা বলা যাবে । আর তাড়াতাড়ির কি আছে ! " এমনিতেও আজকে আপনার তাড়াতাড়ি ঘুমানোই দরকার !" কথাটা যেনো একটু গম্ভীর শোনালো অরিন্দমের কাছে । বুকের মধ্যে যেনো ধড়াস করে উঠলো । তবুও মন্দাকিনীর কথা শুনে খেতে বসে পড়লো । 


   অরিন্দম খেতে খেতে নিজের ব্যাপারে সব বলতে থাকলো মন্দাকিনীকে । এই যেমন ও কে ? কি করে ? কেন এখানে এসেছে ? তারপর মন্দাকিনীকেও জিজ্ঞাসা করে তার সম্মন্ধে । কিন্তু , সে সেটার উত্তর না দিয়ে উল্টে ওকেই প্রশ্ন করে ।

--- আচ্ছা ! উনি কে ? মন্দাকিনী দেয়ালের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলো ।

--- ওহ্ ! উনি আমার ছোটো ঠাকুরদা । আমার ঠাকুরদার ভাই । জবাবে বলল অরিন্দম । 


  ওদিকে মন্দাকিনী কথাটা শুনে বলল , আপনি তো একদম ওনার মতো দেখতে ! অরিন্দম কথাটা শুনে মন্দাকিনীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো । আর বলল , 

--- হ্যাঁ । বাড়িতে সবাই বলে , উনি আমার মধ্যে দিয়েই আবার এই বাড়িতে ফিরে এসেছেন । কথাটা শেষ করে মন্দাকিনীর দিকে তাকাতেই দেখলো , মন্দাকিনীর চোখের মনি কোথায় ? তার জায়গায় দুটো আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছে । কোথায় সেই লালিমালিপ্ত মুখ ? এই অদ্ভুত ভয়াবহ দৃশ্য দেখেই চোখটা নামিয়ে নিলো অরিন্দম । আবারও মনের জোর একত্রিত করে ওর চোখের দিকে তাকাতেই দেখলো , কই ? সেরকম কিছু তো নেই । মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি আমার ? নিজের মনেই প্রশ্ন করতে থাকলো অরিন্দম । খাবার টেবিল থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে , আবার এসে বসলো খাবার টেবিলের সামনে ।এবার তুমি খেয়ে নাও । আর তোমার ব্যাপারে তো কিছু বললেই না , বলো এবার ?


   আমার ব্যাপারে জানতে চান ! তাহলে শুনুন , এই গ্রামেই আমি থাকতাম একসময় । আমি একজন চাষীর মেয়ে ।

--- থাকতে মানে ? এখন থাকো না বুঝি ? প্রশ্ন করলো অরিন্দম । 

কাহিনীটা পুরোটা শুনলেই বুঝতে পারবেন আমি কোথায় থাকি ? তবে আপনার আমাকে নিয়ে বড্ড কৌতূহল মনে হচ্ছে । 


--- তোমার মতোন একটা মেয়েকে নিয়ে কৌতুহল হবে না বলছো ! তুমি এত রহস্যময়ী , তোমাকে নিয়ে তো কৌতূহল হবেই । তোমার ব্যাপারে জানতে পারলে আমি খুশিই হবো । 

--- দেখো , সত্যিই খুশি হতে পারো কিনা । বলেই নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করলো । এই গ্রামের প্রায় সব মানুষই আমায় খুব ভালোবাসত । আর সবথেকে বেশি ভালোবাসতো " যোগীবাবু " । 


  যোগীবাবুটা কে ? প্রশ্ন করলো অরিন্দম । সেই প্রশ্নের উত্তরে একটু মৃদু হাসলো মন্দাকিনী । কিন্তু , তাতে একটু মনটা খারাপই হলো অরিন্দমের । আবারও বলা শুরু করলো মন্দাকিনী । যোগীবাবু আমাকে খুব ভালোবাসতেন , আমায় বিয়েও করবে বলে ছিলেন । তিনি এই গ্রামেরই এক বড়ো ব্যবসায়ীর ছেলে ছিল । কিন্তু , এত ধনী হওয়ার পরেও তিনি আমাকেই ভালোবাসতেন । এভাবেই বছর দুই কেটে যায় । আমাদের সম্পর্ক আরো নিবিড় হয় । ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও হয় । এক সময় আমি জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি । তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে । মনের মধ্যে শুধু একটাই কথা ঘোরে , যোগীবাবুকে সব ঘটনা জানাতে হবে । নাহলে আমি সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবো না । একদিন তাই নদীর ঘাটে দেখা করতে গেলাম ওনার সাথে । ওনাকে সব ঘটনা খুলে বলতেই , উনি আমায় অস্বীকার করলেন । বললেন দুদিন বাদে ওনার বিয়ে পাশের গ্রামের , কোন বড়োলোকের মেয়ের সাথে । আমি তাকে এতবার করে বললাম , পায়ে পর্যন্ত ধরলাম , তারপরেও তিনি আমাকে অস্বীকার করলেন । আমার ভালোবাসাকে অস্বীকার করলেন । এমনকি আমার গর্ভের সন্তানকেও । উনি বললেন ," কি করবো আমি । আমি এই বিয়ে থেকে পিছতে পারবো নাহ ! ওটা দুদিনের ভালোবাসা তোমার মতো একটা হাঁ ঘরের মেয়েকে আমি বিয়ে করবো ! আমার মরণ নেই ! তার চেয়ে ভালো তুমিই মরে যাও । না থাকবে তুমি না থাকবে তোমার বাচ্ছা ! " 


  আমি তখন রেগে গিয়ে বললাম ওনাকে , আপনি যদি আমায় আর আমার সন্তানকে না মেনে নেন । আমি আপনার বাবা আর দাদাকে সব বলে দেবো , দেখি তারপর আপনি কি করে বিয়ে করেন । এই কথা শুনতেই উনি আমায় জোর করে নদীতে ধাক্কা মারে । 


---- কী ...! আপনি বাঁচলেন কিভাবে ? আর আপনার সন্তান ? আর ওই লোকটার এতো সাহসী বা হয় কী করে ? আপনার সাথে এতবড়ো অন্যায় করার । দেশে আইন কানুন আছে , আমি আপনাকে সুবিচার দেবো । আপনি ওনার পুরো নামটা বলুন একবার । কি মনে করেছে লোকটা ! মেয়েদের জীবন এতই সস্তা ! অরিন্দমের মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে গেলো । ও এমনিতেই অন্যায় সহ্য করতে পারে না । তার ওপরে এতো পাপ ! 


  মন্দাকিনী বলল , আর কি সুবিচার চাই দাদাবাবু ? আমার তো সব শেষ হয়ে গেল । পেটের টাও গেলো আর যাকে প্রাণের ভাবতাম সেও এভাবে ঠকালো । আমি নাহ্ , " বড্ড ভালোবাসার কাঙাল ! ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চাই নাহ ! "  মন্দাকিনীর গলার স্বর যেন এখন , ঠাণ্ডা হিমের পরশের মতো শোনালো । গোটা ঘরটা যেন এক অজানা আশঙ্কা আর নিস্তব্দতায় ভরে গেলো । অরিন্দমের যেনো হটাৎ করেই একটা অস্বস্তি অনুভব হলো । মন্দাকিনীর চোখ মুখ স্বাভাবিক লাগছে না কেন ? তবুও মনের মধ্যে জোর এনে আবারও জিজ্ঞাসা করলো , আচ্ছা তোমার ওই যোগী বাবুর পুরো নামটা কি ? 


   " যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত " নামটা শোনা মাত্রই । কি ? কি নাম বললে তুমি ? বলেই অরিন্দমের মাথাটা ঘুরতে শুরু করলো । সে কোনো মতে টাল সামলে আবার চেয়ারে বসে পড়লো । ওর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোতে পারছে না । ও শুধু এই টুকুই বুঝতে পারলো , সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে ও বসে আছে । আর এখন থেকে বেরোবার আর কোনো রাস্তা নেই ; কারণ , যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আর কেউ নাহ্ ! ওর " ছোটো ঠাকুরদা " ।


  সুবিচার আর দেবে কিভাবে " দাদাবাবু "? সবাই তো নাকি বলে , যোগীন্দ্রনাথ তোমার মধ্যে দিয়ে ফিরে এসেছে । অরিন্দমের যেনো মনে হতে লাগলো , ওর টুটিটা কেউ চেপে ধরেছে । ও প্রাণপণে ছাড়াবার চেষ্টা করছে , কিন্তু কোনো হাতই তো নেই ! ও ছাড়াবেটা কার হাত ? মন্দাকিনী তো এখনও নিজের জায়গাতেই বসে আছে । শুধু ওর চোখটা আবার , স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছে । মন্দাকিনী এখনও কথা বলে যাচ্ছে , আমি সত্যিই ভালোবাসার কাঙাল ! তোমায় যতক্ষণ না আমি শেষ করতে পারি , আমার ভালোবাসা সফল হবে না ! 


   অরিন্দমের প্রাণ বায়ু এখন যেনো কিনারায় এসে ঠেকেছে । মায়ের মুখটা ওর এখন বড়ো মনে পড়ছে । মাকে কথা দিয়েছিল , দুদিনের মধ্যে কাজ সেরে ও বাড়ি ফিরে যাবে । আর বাড়ি যাওয়া হবে না ওর ! ঠিক তখনই কে যেনো বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করে , তার ব্যাগ থেকে কিছু মাটি ছুড়ে দিল মন্দাকিনীর দিকে । মন্দাকিনী চিৎকার করতে থাকল , আর সেই মাটি লাগা হাতটা অরিন্দমের কপালে এসে ছোঁয়ালো । 


   " রমেশ জেঠু " তুমি ! বলে চিৎকার করে কেঁদে ফেলল অরিন্দম । রমেশ চোখের ইশারায় আশ্বাসন দিয়ে আবারও মাটি ছুড়ে দিল মন্দাকিনীর দিকে । এবার মন্দাকিনীর অতৃপ্ত আত্মাটা চিৎকার করতে করতে বাস্পের আকারে কোথায় যেন উবে গেল । 


   অরিন্দম সব কিছু খুলে বলল রমেশ জেঠুকে । আর জিজ্ঞাসা করলো , তুমি কি করে জানলে আমার এখানে বিপদ ? 

--- আমি তো বলেই ছিলাম বাবা ! তোমাকে নিয়ে আমার ভীষণ চিন্তা হবে । তোমায় যখন দেখে ছিলাম , তখনই বুঝেছিলাম কিছু একটা তো ঘটবেই । তারপর যখন নাতির অমন অসুখ শুনলাম , তখন বিশ্বাস আরো প্রকট হলো । কিন্তু কি করবো যেতে তো হবেই ! তাই নতিটাকে হাসপাতালে ভর্তি করে আসবো ভাবছিলামই , তখনই ছেলেটা আমার ফিরে আসে । এ হলো বাবা " বীরেশ্বর " এর কৃপা । আমাদের শিবতলার মাটি খুব পবিত্র ও জাগ্রত । নাতির জন্য মাটি নিতে গিয়ে তোমার জন্যেও নিলাম বাবা ! 


  আজ তুমি না এলে আমায় আর কালকের সূর্য দেখতে হতো নাহ্ ! তবে এটাও সত্যি মন্দাকিনীর সাথে যেটা হয়েছে সেটা অন্যায় , আর সেটা আমাদের পরিবারের জন্যই । ছোটো ঠাকুরদা যদি এতো বড় অন্যায় না করতেন ওর সাথে , তাহলে এতবড়ো কলঙ্ক আমদের বংশের হতো না ; আর মেয়েটাও বাঁচতে পারতো । ওনাকে আমার ঠাকুরদা বলতেও ঘৃনা করছে । আর নিজের এই মুখটাকেও এখন ঘৃনা হচ্ছে রমেশ জেঠু । যে ওনার মতন আমায় দেখতে । কেঁদো না বাবা ! আমি তোমায় বলেছিলাম না , তোমার রূপটার থেকেও মনটা বেশি সুন্দর ! তুমি তোমার ছোটো ঠাকুরদা মতো দেখতে হলেও , তোমার মনটা কিন্তু , তোমার বড়ো ঠাকুরদার মতোই । তারই মতো দেবতুল্য ও পবিত্র মন তোমার । 

--- কিন্তু ! আমিতো এই ঘটনাটা মানতে পারছি না ! রমেশ জেঠু , ছোটো ঠাকুরদা শাস্তি পাওয়ার কি দরকার ছিল না ! 

--- তোমার ছোটো ঠাকুরদা তার শাস্তি পেয়েছিলেন । বিয়ের ঠিক একমাসের মধ্যে ওনার স্ত্রী মারা যান । তার কিছু মাসের মধ্যেই ওনারও যক্ষ্মা ধরা পড়ে । তখন তিনি তার দাদাকে সব কথা খুলে বলেন , আর এও বলেন ওনার এই দুষ্কর্মের জন্যই ভগবান এই শাস্তি দিচ্ছে । ওনার মৃত্যুর পর তোমার ঠাকুরদা আর এখানে থাকতে চাননি পাছে তার সন্তানদের কোনো ক্ষতি হয় । শাস্তি তো ভগবান দিয়েছে ওনাকে , তুমি আর কি করবে বাবা ! ভুলে যাও সব কিছু , একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে । 


  অরিন্দম চেয়ার থেকে উঠে রমেশ জেঠুকে জড়িয়ে ধরে বলল , " পৃথিবীতে সবাই বলে রক্তের সম্পর্ক সবথেকে বড়ো হয় । কিন্তু , আমি বলছি আত্মার সম্পর্ক তার থেকেও বড়ো ! যেটা তোমার সাথে আমার " । 

এই কাহিনীটা হল অরিন্দম.... মানে অরিন্দম সেনগুপ্তর । অরিন্দমের বয়স এখন সাতাশ বছর । বাবা কাকাদের পৈতৃক ব্যবসায় সামলাচ্ছে ও । যাইহোক অরিন্দমদের এখন এমনই অবস্থা যে , তাকে কলকাতায় ব্যাবসার সব কাজ ছেড়ে দাদুর পৈতৃক ভিটে বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে যেতে হচ্ছে । ওদের আদি বাড়ি জনাইতে , হুগলির জনাই রোড স্টেশন থেকে ওই আধঘন্টার পথ । প্রায় দু আড়াই ঘণ্টার পথ নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে অরিন্দম এসে পৌঁছাল তাদের পৈতৃক বাড়িতে । এই বাড়িটির দেখাশোনা করার জন্য একজন লোক আছে , তার নাম রমেশ । রমেশের বয়স অন্তত ষাট পয়ষট্টি তো হবেই । সেই কুড়ি বছর বয়স থেকে এই বাড়ির দেখা শোন করছেন ।


   

   অরিন্দমদের ব্যবসায় বেশ কয়েকমাস ধরে মন্দা চলার কারণে , বাড়ি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওদের গ্রামের আদি বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হবে । সেটা বিক্রি করে বেশ মোটা অংকের অর্থ হাতে পাওয়া যাবে । তখন সেই টাকা দিয়ে পাওনাদারদের ও দেনা শোধ করা যাবে , আবার কিছুটা ব্যাবসার মূলধন হিসেবেও কাজ লাগানো যাবে । বেকার এখানে বাড়িটা পড়ে আছে কোনো কাজে লাগে না । ওরা কেউ এখানে ঘুরতে আসার ও সময় পায়না , তাহলে শুধু শুধু রাখা কেন ! বিক্রি করে দিলে অন্তত একটা কাজে তো লাগবে । এই ভেবেই অরিন্দমের এখানে আসা । বাড়িতে বাবা ছাড়া আরেক কাকা আছেন । তার এক মেয়ে এক ছেলে , বয়সেও অরিন্দমের থেকে বেশ ছোটো তারা ; তাই ওকেই এই কাজের জন্য এখানে আসতে হলো । বাড়ির বড়ো ছেলে বলে কথা ।



   বাড়িতে আসতেই অরিন্দমের সাথে রমেশের অনেক দিন পর দেখা হলো । অরিন্দম অনেক ছোটো ছিল , শেষবার যখন সে এখানে এসেছিল । তবে রমেশ কিন্তু , অরিন্দম কে দেখে পুরো চমকে যায় । কেন ? সেটাই বলছি । অরিন্দম তার ঠাকুরদার ছোটো ভাই , মানে তার ছোটো ঠাকুরদার মতো দেখতে । অবিকল মুখ ও চেহারার গঠন তারই মতন । রমেশকে চুপ থাকতে দেখে , অরিন্দম এবার নিজে থেকেই বলল ,

---- কী... রমেশ জেঠু ! আমায় দেখে চিনতে পারছো না... বুঝি ! কি কেমন দেখতে হয়েছে আমায় ? 

---- খুব সুন্দর বাবা ! আর তার থেকেও বেশি তোমার মনটা সুন্দর । বাইরের সৌন্দর্য্য কি আসল সৌন্দর্য্য ! অন্তরটা যার সুন্দর সেই তো প্রকৃত অর্থে সুন্দর ! 


  আচ্ছা ছাড়ো ওসব কথা ! তুমি এখন যাও তো দেখি আগে , স্নান টা আগে সেরে নাও । কতটা পথ এলে ! আগে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হও । তারপর আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি । সকাল দিয়ে তো কিছু পেতে পড়েনি যা দেখছি । রমেশের কথা গুলো শুনে অরিন্দম রেডি হতে চলে গেলো । 


   কিছুক্ষন পর খাওয়ার টেবিলে বসে , রমেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো অরিন্দম । 

----  উফফ্ ! মাংসটা যা রেধেছো ! কি বলবো , পুরো অমৃত ! 

---- তোমার ভালো লেগেছে তো দাদাবাবু ! এই নাও আরেকটু । 


   খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর , অরিন্দম ছাদে দাঁড়িয়ে কিছু জরুরি ফোন কল করছিলো । ঠিক এমন সময় , একটা লোক এসে গেটের সামনে কিছু কথা বলে চলে গেলো । অরিন্দম ওপর থেকে রমেশকে দেখে বুঝতে পারলো , কিছু একটা খারাপ খবর আছে । তাই ও তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো । নিচে নেমে রমেশকে জিজ্ঞাসা করতেই । ও বলল , 


----  দাদাবাবু , আমার নাতিটার বড্ড শরীর খারাপ ! ধুম জ্বর , তার ওপরে শুনছি পায়খানা বমিও করছে । ওইটুকু ছেলেটাকে আমার হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে মনে হচ্ছে ! যদি তুমি একটি বার ছুটি দাও । ছেলেটাও আমার শহরে গেছে । কাল সকালের আগে আসবে না । এই বুড়ো মানুষটাকেই যেতে হবে বাবা !


---- একি বলছো তুমি রমেশ জেঠু ! তাড়াতাড়ি যাও । আগে ওকে ডাক্তার দেখাও । আর শোনো , এই নাও কটা টাকা রাখো । ওখানে কতো কি লাগবে ! বলে চারটে পাঁচশো টাকার নোট হাতে গুজে দিল ।


  রমেশ যেতে যেতে বলে গেলো , তোমায় এখানে একা রেখে যাচ্ছি । আমার যে কি দুশ্চিন্তা হবে তা তোমায় আমি বলতে পারবো না ! সাবধানে থেকো দাদাবাবু ! আমি দেখি , কাউকে জোগাড় করে দিয়ে যেতে পারি কিনা ! 


---- তুমি আমার খাওয়া দাওয়ার চিন্তা করছো ? ও যা হোক কিছু একটা খেয়ে নেবো । তুমি আগে নাতিকে দেখো । 


---- নাহ্ ! দাদাবাবু তোমায় এই বাড়িতে একা রেখে যেতে আমার সত্যিই খুব চিন্তা হচ্ছে । ভগবানের কাছে এই প্রার্থনায় করি , " ভগবান তোমার মঙ্গল করুক !"


   রমেশ চলে গেছে আধঘন্টা হয়ে গেছে । এদিকে সন্ধেও নেমেছে । তার ওপরে আকাশও মুখ ভার করে বসে আছে । মনে হচ্ছে , আজকে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হবে । এদিকে অরিন্দম অনেকক্ষণ ধরে একা বসে আছে জানলার ধারে । রমেশও নেই , যে ও একটু কথা বলবে । এই এতবড়ো বাড়িতে ও একা !  রমেশ জেঠুকেও ওদিকে বড়োমুখ করে বলল , ও একা ম্যানেজ করে নেবে । কিন্তু , এখন যা ওর অবস্থা ! তাতে এই বাড়িটাই না ওকে আসতো চিবিয়ে খেয়ে নেয় । তাও আবার কড়মড় করে ! এমনিতেই ওর এই বাড়িতে থাকার অভ্যাস নেই । তার ওপরে এই বাড়িতে তো আজ কতো বছর হলো , পা পর্যন্ত রাখেনি । এমন সময়ে " মরার ওপর খাড়ার ঘা " হয়ে , লোডশেডিং হয়ে গেলো । বাইরের আবহাওয়াও সুবিধের নয় । কখন বলতে কখন বৃষ্টি নামে । এমন সময় ছাদের ওপর কি একটা ধড়াস করে আওয়াজ শুনতে পেল । একবার ভাবলো ছাদে গিয়ে দেখবে । কিন্তু , নাহ্ ! সাহস হলো না । তাই চুপচাপ ডাইনিংয়েই একটা মোমবাতি ধরিয়ে বসে রইলো । 


  এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর , দরজায় ঠক ঠক করে বেশ কয়েকবার শব্দ হলো । এবার অরিন্দমের অবস্থা " আত্মারাম খাঁচাছাড়া " হবার উপক্রম ! ও ভূতের সিনেমায় দেখেছে এভাবেই ভূতেরা আসে । ও দরজা খুলবে না ! দরজা খুললেই যদি ভুত এসে গলা টিপে ধরে , তাই কোনোমতেই দরজা খুলবে না । আবারও বেশ কিছুক্ষণ পর , দরজার ওপরে ঠকঠক করে শব্দ হলো । তবে এবার দরজার ওপার থেকে একটি নারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল । 


---- "দাদাবাবু দরজাটা খুলুন ! আমাকে রমেশ মামা পাঠিয়েছে "।


 এবার একটু ভরসা হলো অরিন্দমের নাহ্ ! এ ভুত নয় । গিয়ে দরজাটা খুলতেই অরিন্দমের চোখ স্থির হয়ে রইলো । তার মুখ থেকে যেনো আর কোনো কথা বেরোলো না । সে অবাক দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেই অপরূপা রমনীর দিকে । মেয়েটির বয়স আঠেরো ঊনিশ বছর হবে , চাপা গায়ের রঙ , তবে উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি ঠিক যেন মাছের মতো , পদ্মফুলের মতো ভরা মুখখানি , একমাথা চুল কোমর চাপিয়ে পড়ছে , লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে । তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো তার লালিমালিপ্ত মুখের হাসি ।


  বেশ কিছুক্ষণ পর সেই মেয়েটিই বলল , বাবু আমাকে রমেশ মামা পাঠিয়েছেন । ওই আপনি রাত্রে কি খাবেন .... ! সেই সব করে দেওয়ার জন্য । তার তো নাতির বড্ড অসুখ । মেয়েটির কথা শেষ হতেই অরিন্দম বলে উঠলো ,

--- ও হ্যাঁ ...! হ্যাঁ ! আসো । রমেশ জেঠু যাওয়ার সময় বলে গেছিলো বটে । আচ্ছা ! তা তোমার নাম কী ? ডাকতে সুবিধা হবে সেই জন্য জিজ্ঞাসা করছি ? 


   " মন্দাকিনী " অরিন্দমের প্রশ্নের উত্তরে বলল মেয়েটি । নামটি শুনে অরিন্দম ও বেশ প্রশংসা করলো । অপূর্ব নামটি তোমার ! যেমন দেখতে তেমন নাম । বলেই নিজেকে সামলে নিলো । আর মনে মনে ভাবল , কি সব বলছিস অরিন্দম নিজেকে কন্ট্রোল কর । নিজের ফিলিংস গুলো কেউ বলতে বলেনি তোকে , কি ভাববে মেয়েটা ইসস !

  

   মেয়েটা ঘরে ঢুকতেই লাইট টা দুবার জ্বলে আবার আবার পাওয়ার কাট হয়ে গেল । বিরক্তির সুরেই অরিন্দম বলল , আজকে কারেন্টটা প্রচন্ড জ্বালাচ্ছে । যাইহোক , মেয়েটি আরেকটা মোমবাতি ধরিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল । অরিন্দমের মেয়েটির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল ঠিকই ; কিন্তু , বিষয়টা কেমন খারাপ দেখাবে বলে কিছু বলল না । অরিন্দমের মেয়েটিকে বেশ পছন্দ হয়েছে । আগে কাউকে এতটা ভালো লাগেনি ওর । একটা কেমন যেন আকর্ষণ বোধ করছে ওর প্রতি ।


  কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটা রান্না ঘর থেকে খাবার দাবার গুলো খাবার টেবিলে এসে রাখলো । আর অরিন্দম উদ্দেশ্য করে বলল , নিন খেয়ে নিন । অরিন্দম বলে উঠলো , এত তাড়াতাড়ি ! সবে তো আটটা বাজে । তার থেকে বরং , আমরা এখানে বসে কিছুক্ষন কথা বলি । তারপর নাই খাওয়া যাবে । কিন্তু , মন্দাকিনী একটু জেদ করেই বলল , আগে আপনি খেয়ে নিন । খেতে খেতে নাই কথা বলা যাবে । আর তাড়াতাড়ির কি আছে ! " এমনিতেও আজকে আপনার তাড়াতাড়ি ঘুমানোই দরকার !" কথাটা যেনো একটু গম্ভীর শোনালো অরিন্দমের কাছে । বুকের মধ্যে যেনো ধড়াস করে উঠলো । তবুও মন্দাকিনীর কথা শুনে খেতে বসে পড়লো । 


   অরিন্দম খেতে খেতে নিজের ব্যাপারে সব বলতে থাকলো মন্দাকিনীকে । এই যেমন ও কে ? কি করে ? কেন এখানে এসেছে ? তারপর মন্দাকিনীকেও জিজ্ঞাসা করে তার সম্মন্ধে । কিন্তু , সে সেটার উত্তর না দিয়ে উল্টে ওকেই প্রশ্ন করে ।

--- আচ্ছা ! উনি কে ? মন্দাকিনী দেয়ালের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলো ।

--- ওহ্ ! উনি আমার ছোটো ঠাকুরদা । আমার ঠাকুরদার ভাই । জবাবে বলল অরিন্দম । 


  ওদিকে মন্দাকিনী কথাটা শুনে বলল , আপনি তো একদম ওনার মতো দেখতে ! অরিন্দম কথাটা শুনে মন্দাকিনীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো । আর বলল , 

--- হ্যাঁ । বাড়িতে সবাই বলে , উনি আমার মধ্যে দিয়েই আবার এই বাড়িতে ফিরে এসেছেন । কথাটা শেষ করে মন্দাকিনীর দিকে তাকাতেই দেখলো , মন্দাকিনীর চোখের মনি কোথায় ? তার জায়গায় দুটো আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছে । কোথায় সেই লালিমালিপ্ত মুখ ? এই অদ্ভুত ভয়াবহ দৃশ্য দেখেই চোখটা নামিয়ে নিলো অরিন্দম । আবারও মনের জোর একত্রিত করে ওর চোখের দিকে তাকাতেই দেখলো , কই ? সেরকম কিছু তো নেই । মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি আমার ? নিজের মনেই প্রশ্ন করতে থাকলো অরিন্দম । খাবার টেবিল থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে , আবার এসে বসলো খাবার টেবিলের সামনে ।এবার তুমি খেয়ে নাও । আর তোমার ব্যাপারে তো কিছু বললেই না , বলো এবার ?


   আমার ব্যাপারে জানতে চান ! তাহলে শুনুন , এই গ্রামেই আমি থাকতাম একসময় । আমি একজন চাষীর মেয়ে ।

--- থাকতে মানে ? এখন থাকো না বুঝি ? প্রশ্ন করলো অরিন্দম । 

কাহিনীটা পুরোটা শুনলেই বুঝতে পারবেন আমি কোথায় থাকি ? তবে আপনার আমাকে নিয়ে বড্ড কৌতূহল মনে হচ্ছে । 


--- তোমার মতোন একটা মেয়েকে নিয়ে কৌতুহল হবে না বলছো ! তুমি এত রহস্যময়ী , তোমাকে নিয়ে তো কৌতূহল হবেই । তোমার ব্যাপারে জানতে পারলে আমি খুশিই হবো । 

--- দেখো , সত্যিই খুশি হতে পারো কিনা । বলেই নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করলো । এই গ্রামের প্রায় সব মানুষই আমায় খুব ভালোবাসত । আর সবথেকে বেশি ভালোবাসতো " যোগীবাবু " । 


  যোগীবাবুটা কে ? প্রশ্ন করলো অরিন্দম । সেই প্রশ্নের উত্তরে একটু মৃদু হাসলো মন্দাকিনী । কিন্তু , তাতে একটু মনটা খারাপই হলো অরিন্দমের । আবারও বলা শুরু করলো মন্দাকিনী । যোগীবাবু আমাকে খুব ভালোবাসতেন , আমায় বিয়েও করবে বলে ছিলেন । তিনি এই গ্রামেরই এক বড়ো ব্যবসায়ীর ছেলে ছিল । কিন্তু , এত ধনী হওয়ার পরেও তিনি আমাকেই ভালোবাসতেন । এভাবেই বছর দুই কেটে যায় । আমাদের সম্পর্ক আরো নিবিড় হয় । ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও হয় । এক সময় আমি জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি । তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে । মনের মধ্যে শুধু একটাই কথা ঘোরে , যোগীবাবুকে সব ঘটনা জানাতে হবে । নাহলে আমি সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবো না । একদিন তাই নদীর ঘাটে দেখা করতে গেলাম ওনার সাথে । ওনাকে সব ঘটনা খুলে বলতেই , উনি আমায় অস্বীকার করলেন । বললেন দুদিন বাদে ওনার বিয়ে পাশের গ্রামের , কোন বড়োলোকের মেয়ের সাথে । আমি তাকে এতবার করে বললাম , পায়ে পর্যন্ত ধরলাম , তারপরেও তিনি আমাকে অস্বীকার করলেন । আমার ভালোবাসাকে অস্বীকার করলেন । এমনকি আমার গর্ভের সন্তানকেও । উনি বললেন ," কি করবো আমি । আমি এই বিয়ে থেকে পিছতে পারবো নাহ ! ওটা দুদিনের ভালোবাসা তোমার মতো একটা হাঁ ঘরের মেয়েকে আমি বিয়ে করবো ! আমার মরণ নেই ! তার চেয়ে ভালো তুমিই মরে যাও । না থাকবে তুমি না থাকবে তোমার বাচ্ছা ! " 


  আমি তখন রেগে গিয়ে বললাম ওনাকে , আপনি যদি আমায় আর আমার সন্তানকে না মেনে নেন । আমি আপনার বাবা আর দাদাকে সব বলে দেবো , দেখি তারপর আপনি কি করে বিয়ে করেন । এই কথা শুনতেই উনি আমায় জোর করে নদীতে ধাক্কা মারে । 


---- কী ...! আপনি বাঁচলেন কিভাবে ? আর আপনার সন্তান ? আর ওই লোকটার এতো সাহসী বা হয় কী করে ? আপনার সাথে এতবড়ো অন্যায় করার । দেশে আইন কানুন আছে , আমি আপনাকে সুবিচার দেবো । আপনি ওনার পুরো নামটা বলুন একবার । কি মনে করেছে লোকটা ! মেয়েদের জীবন এতই সস্তা ! অরিন্দমের মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে গেলো । ও এমনিতেই অন্যায় সহ্য করতে পারে না । তার ওপরে এতো পাপ ! 


  মন্দাকিনী বলল , আর কি সুবিচার চাই দাদাবাবু ? আমার তো সব শেষ হয়ে গেল । পেটের টাও গেলো আর যাকে প্রাণের ভাবতাম সেও এভাবে ঠকালো । আমি নাহ্ , " বড্ড ভালোবাসার কাঙাল ! ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চাই নাহ ! "  মন্দাকিনীর গলার স্বর যেন এখন , ঠাণ্ডা হিমের পরশের মতো শোনালো । গোটা ঘরটা যেন এক অজানা আশঙ্কা আর নিস্তব্দতায় ভরে গেলো । অরিন্দমের যেনো হটাৎ করেই একটা অস্বস্তি অনুভব হলো । মন্দাকিনীর চোখ মুখ স্বাভাবিক লাগছে না কেন ? তবুও মনের মধ্যে জোর এনে আবারও জিজ্ঞাসা করলো , আচ্ছা তোমার ওই যোগী বাবুর পুরো নামটা কি ? 


   " যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত " নামটা শোনা মাত্রই । কি ? কি নাম বললে তুমি ? বলেই অরিন্দমের মাথাটা ঘুরতে শুরু করলো । সে কোনো মতে টাল সামলে আবার চেয়ারে বসে পড়লো । ওর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোতে পারছে না । ও শুধু এই টুকুই বুঝতে পারলো , সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে ও বসে আছে । আর এখন থেকে বেরোবার আর কোনো রাস্তা নেই ; কারণ , যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আর কেউ নাহ্ ! ওর " ছোটো ঠাকুরদা " ।


  সুবিচার আর দেবে কিভাবে " দাদাবাবু "? সবাই তো নাকি বলে , যোগীন্দ্রনাথ তোমার মধ্যে দিয়ে ফিরে এসেছে । অরিন্দমের যেনো মনে হতে লাগলো , ওর টুটিটা কেউ চেপে ধরেছে । ও প্রাণপণে ছাড়াবার চেষ্টা করছে , কিন্তু কোনো হাতই তো নেই ! ও ছাড়াবেটা কার হাত ? মন্দাকিনী তো এখনও নিজের জায়গাতেই বসে আছে । শুধু ওর চোখটা আবার , স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছে । মন্দাকিনী এখনও কথা বলে যাচ্ছে , আমি সত্যিই ভালোবাসার কাঙাল ! তোমায় যতক্ষণ না আমি শেষ করতে পারি , আমার ভালোবাসা সফল হবে না ! 


   অরিন্দমের প্রাণ বায়ু এখন যেনো কিনারায় এসে ঠেকেছে । মায়ের মুখটা ওর এখন বড়ো মনে পড়ছে । মাকে কথা দিয়েছিল , দুদিনের মধ্যে কাজ সেরে ও বাড়ি ফিরে যাবে । আর বাড়ি যাওয়া হবে না ওর ! ঠিক তখনই কে যেনো বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করে , তার ব্যাগ থেকে কিছু মাটি ছুড়ে দিল মন্দাকিনীর দিকে । মন্দাকিনী চিৎকার করতে থাকল , আর সেই মাটি লাগা হাতটা অরিন্দমের কপালে এসে ছোঁয়ালো । 


   " রমেশ জেঠু " তুমি ! বলে চিৎকার করে কেঁদে ফেলল অরিন্দম । রমেশ চোখের ইশারায় আশ্বাসন দিয়ে আবারও মাটি ছুড়ে দিল মন্দাকিনীর দিকে । এবার মন্দাকিনীর অতৃপ্ত আত্মাটা চিৎকার করতে করতে বাস্পের আকারে কোথায় যেন উবে গেল । 


   অরিন্দম সব কিছু খুলে বলল রমেশ জেঠুকে । আর জিজ্ঞাসা করলো , তুমি কি করে জানলে আমার এখানে বিপদ ? 

--- আমি তো বলেই ছিলাম বাবা ! তোমাকে নিয়ে আমার ভীষণ চিন্তা হবে । তোমায় যখন দেখে ছিলাম , তখনই বুঝেছিলাম কিছু একটা তো ঘটবেই । তারপর যখন নাতির অমন অসুখ শুনলাম , তখন বিশ্বাস আরো প্রকট হলো । কিন্তু কি করবো যেতে তো হবেই ! তাই নতিটাকে হাসপাতালে ভর্তি করে আসবো ভাবছিলামই , তখনই ছেলেটা আমার ফিরে আসে । এ হলো বাবা " বীরেশ্বর " এর কৃপা । আমাদের শিবতলার মাটি খুব পবিত্র ও জাগ্রত । নাতির জন্য মাটি নিতে গিয়ে তোমার জন্যেও নিলাম বাবা ! 


  আজ তুমি না এলে আমায় আর কালকের সূর্য দেখতে হতো নাহ্ ! তবে এটাও সত্যি মন্দাকিনীর সাথে যেটা হয়েছে সেটা অন্যায় , আর সেটা আমাদের পরিবারের জন্যই । ছোটো ঠাকুরদা যদি এতো বড় অন্যায় না করতেন ওর সাথে , তাহলে এতবড়ো কলঙ্ক আমদের বংশের হতো না ; আর মেয়েটাও বাঁচতে পারতো । ওনাকে আমার ঠাকুরদা বলতেও ঘৃনা করছে । আর নিজের এই মুখটাকেও এখন ঘৃনা হচ্ছে রমেশ জেঠু । যে ওনার মতন আমায় দেখতে । কেঁদো না বাবা ! আমি তোমায় বলেছিলাম না , তোমার রূপটার থেকেও মনটা বেশি সুন্দর ! তুমি তোমার ছোটো ঠাকুরদা মতো দেখতে হলেও , তোমার মনটা কিন্তু , তোমার বড়ো ঠাকুরদার মতোই । তারই মতো দেবতুল্য ও পবিত্র মন তোমার । 

--- কিন্তু ! আমিতো এই ঘটনাটা মানতে পারছি না ! রমেশ জেঠু , ছোটো ঠাকুরদা শাস্তি পাওয়ার কি দরকার ছিল না ! 

--- তোমার ছোটো ঠাকুরদা তার শাস্তি পেয়েছিলেন । বিয়ের ঠিক একমাসের মধ্যে ওনার স্ত্রী মারা যান । তার কিছু মাসের মধ্যেই ওনারও যক্ষ্মা ধরা পড়ে । তখন তিনি তার দাদাকে সব কথা খুলে বলেন , আর এও বলেন ওনার এই দুষ্কর্মের জন্যই ভগবান এই শাস্তি দিচ্ছে । ওনার মৃত্যুর পর তোমার ঠাকুরদা আর এখানে থাকতে চাননি পাছে তার সন্তানদের কোনো ক্ষতি হয় । শাস্তি তো ভগবান দিয়েছে ওনাকে , তুমি আর কি করবে বাবা ! ভুলে যাও সব কিছু , একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে । 


  অরিন্দম চেয়ার থেকে উঠে রমেশ জেঠুকে জড়িয়ে ধরে বলল , " পৃথিবীতে সবাই বলে রক্তের সম্পর্ক সবথেকে বড়ো হয় । কিন্তু , আমি বলছি আত্মার সম্পর্ক তার থেকেও বড়ো ! যেটা তোমার সাথে আমার " । 


©️Soma Halder.


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics