Soma Dutta

Tragedy Inspirational

4.0  

Soma Dutta

Tragedy Inspirational

মিঠির নববর্ষ

মিঠির নববর্ষ

5 mins
309



 গাঙ্গুলি বাড়িতে সকাল থেকেই আজ তুমুল অশান্তি শুরু হয়েছে।গাঙ্গুলি বাড়ির কর্তী রমলা তার একমাত্র পুত্রবধূকে যা ইচ্ছা তাই বলে অপমান করে যাচ্ছে।কিন্তু পুত্রবধূটি নীরবে সব অপমান সহ্য করে যাচ্ছে।এতো বাক্যবানের পরিবর্তে টুঁ শব্দটি করেনি সে।এতে রমলার রাগ সপ্তমে চড়েছে।সে বলছে,,,রমলা:- এই ছোটোলোকের মেয়েকে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে নিজের বাড়িতে আনাই আমার ভুল হয়েছে গো।ভেবেছিলাম বিয়ের পর আমার পায়ের কাছে পরে থাকবে।আমি যা বলবো তা অক্ষরে অক্ষরে

পালন করবে।কিন্তু তা না করে আমার মুখে মুখে তর্ক করছে ছোটোলোকের বেটি।এই শ্যামল এদিকে আয়।

এই বলে নিজের ছেলেকে ডেকে এনে বলে,,,

রমলা:- শোন শ্যামল আজই ঐ পাপটাকে ঘরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে আয়।না জানি কে না কে নিজের কুকর্ম ঢাকতে ঐ পাপটাকে আস্তাকুড়ে ফেলে গেছে।তার দ্বায়ীত্ব আমরা নেবো কেনো? ও যেমন ছিলো তেমন করেই রেখে আসগে যা।তাতে শিয়াল- কুকুরে নিয়ে যায় যাক।

কথাটা বলেই কটাক্ষ করলো এক দিন চারেকের মেয়ে শিশুর প্রতি।যাকে রমলাদেবীর পুত্রবধূ মালা নিজের কন্যাজ্ঞানে বুকে জড়িয়ে আছে ।তবে চলুন বিস্তারিত ঘটনায় আসা যাক।

রমলাদেবীর একমাত্র পুত্র শ্যামলের সাথে এক নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে মালার দেখাশোনা করেই বিয়ে হয় ।মালা খুব শান্ত স্বভাবের একটি মেয়ে।বিয়ের পর সব কাজ রমলাদেবী মালাকে দিয়ে করাতো ।আর মালাও তেমনি নিজের শত কষ্ট সত্বেও সব কাজ মুখ বুজে করে যেতো।শ্যামল সব কিছু দেখেও নির্বিকার থাকতো।সে মালাকে ভালোবাসতো না এমনটা নয় কিন্তু সে মা কে মালার চেয়ে অধিক ভালোবাসতো তাই

মায়ের উপর কথা বলার জোর তার ছিলো না।এভাবেই কেটে যাচ্ছিল মালার জীবন।যখন খুব কষ্ট হতো মালা

নিজের মনে কাঁদতো আর তার বিয়ের আগের সব কথা মনে পড়তো।পড়াশোনায় কত ভালো ছিলো সে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের কত ভালো ফল করেছিলো ।ইচ্ছা ছিল আরও পড়ার।কিন্তু আর্থিক অভাবের জন্য বাধ্য হয়েই এই বিয়েটা করতে হয়েছিল তাকে।সেই থেকে দেখতে দেখতে চার বছর পেরিয়ে গেছে,কিন্তু মালার জীবন সেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।রমলাদেবী তো মালাকে সবসময় অপমান করে ।এমনকি গায়েও হাত তুলেছে কতবার।তাছাড়া বিয়ের চার বছর হয়ে গেলেও বাচ্ছা না হওয়ার জন্যও কথা তাকেই শুনতে হয় ।এইসব মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলো

সে।তার জীবনে বেঁচে থাকাটা বড়োই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো।তার দুঃখের কথা সে কাউকে বলতো না এমনকি নিজের বাবা- মা কেও না,পাছে তারা কষ্ট পায়।তবে এই তিনদিন আগে তার জীবনে একটা পরিবর্তন ঘটেছে।শ্যামলের সাথে ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার পথে অপেক্ষাকৃত নির্জন একটা জায়গায় একটা আস্তাকুড় থেকে সদ্যজাত বাচ্ছার কান্নার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে যায় মালা।গিয়ে দেখে তার আনুমানই ঠিক।কেউ তার সদ্য শিশুকে ফেলে গেছে এই আবর্জনার মধ্যে।মালা বাচ্ছাটাকে কোলে তুলে নেয়।সেদিন শ্যামলও চেয়েছিলো বাচ্ছাটাকে নিজের কাছে রাখতে।কিন্তু বাড়ি ফেরার পর থেকেই এই অশান্তি শুরু হয় ।প্রথম দুদিন মালা রমলার কথা কানে তোলেনি তাই আজ রমলা এমন মূর্তি ধারণ করেছে।এতক্ষণ সবকিছু মুখ বুজে শোনার পরেও মালা চুপ করেই ছিলো।কিন্তু যেই রমলাদেবী বলে উঠলো--

রমলা:- তবে আমাকেই দে আমিই ঐ পাপটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসি।

ঠিক তখনই মালার সব ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো।যে শাশুড়ির দিকে সে চোখ তুলে কথা বলতো না তার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে শান্ত অথচ তীব্র গলায় বলে উঠলো- খবরদার,একদম এক পা ও এগোবেন না।


মালার কথা শুনে রমলা আর শ্যামল দুজনই স্তম্ভিত হয়ে গেলো।শ্যামল কিছু বলতে গেলে মালা বললো-- এতক্ষণ যখন চুপ করে ছিলে এরপরেও চুপ করেই থাকবে।আর মা শুনুন,আপনি ওকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কথা বলছিলেন না? ওতো এখন আস্তাকুড়ের উপর বসে থাকা ওর মা মানে আমার কোলে আছে।হ্যাঁ ও অনাথ নয় ,কোনো পাপ নয় ,ও আমার মেয়ে,আমার মিঠি।আর এই বাড়িটা হলো আসল আস্তাকুড় কারণ আপনাদের মতো কিছু নীচ আর নোংরা মনের মানুষের বসবাস এইখানে।আমার নিষ্পাপ মিঠি এই নোংরা জায়গায় বেশিক্ষণ থাকলে ওর শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে।তাই আপনি কি ওকে ছুঁড়ে ফেলবেন আমি আর আমার মিঠিই আপনাদের দুজনকে আমাদের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাবো আজ,এক্ষুনি।এই বলে মিঠিকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মালা।তারপর বলে--

আরও একটা কথা বলার আছে।আমি বন্ধ্যা নই বন্ধ্যা আপনার ছেলে।সে বাবা হতে অক্ষম ।এতদিন আমি এই কথা লুকিয়ে রেখেছিলাম কারণ আমি আপনাকে মা বলে সম্বোধন করতাম।আমি চাইতাম না একথা পাঁচকান হোক।আর তথাকথিত আপনার এই সমাজ যেখানে দুবেলা গিয়ে আমি যে অপয়া,অলক্ষী,বন্ধ্যা এই কথা বলে আসেন ,সেখানে আপনার মান- সম্মান নষ্ট হোক।কিন্তু আপনি তো মা হওয়ার যোগ্যই নন।তাই আপনাকে মা ডেকে আমি মা শব্দটার অপমান করতে আর পারবো না।তবে আপনার ছেলে বাবা হতে পারবে না বলে আমি ওকে ছেড়ে যাচ্ছি তা কিন্তু নয় ,সেটা হওয়ার হলে কবেই চলে যেতাম।মিছিমিছি শেষ দুবছর এতো কষ্ট সহ্য করে এখানে পরে থাকতাম না।আমি ওকে ছেড়ে দিচ্ছি কারণ আজ আপনার কথাগুলো শুনেও ও চুপ ছিলো ,কোনো কথা বলেনি।তাই এই লোকটার প্রতি আজ প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে আমার।আর যার প্রতি এতটা ঘৃণা জন্মায় তার সাথে সংসার করা যায় না।তাই আমি চললাম।আর আপনার ছেলে যে বাবা হতে পারবে না সেটা আপনার ছেলেও জানতো তবু কিছু বলেনি কোনোদিন।বিশ্বাস না হলে আমাদের ঘরের ড্রয়ারে ওর দু বছরের পুরোনো রিপোর্টটা আছে দেখে নেবেন।আর হ্যাঁ এখান থেকে যাওয়ার কিছু দিন পরে ডিভোর্স পেপারটা আপনার বাড়ি পৌঁছে যাবে।আপনার এই অপদার্থ ছেলেকে বলবেন যেন সাইন করে দেয়।


এইবলে মালা তার মিঠিকে নিয়ে বছরের শেষ দিনে শশুরবাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলো চিরদিনের মতো।পিছনে স্থির দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকিয়ে ছিলো রমলা আর শ্যামল।বলাবাহুল্য শ্যামলের বাবা শ্যামলের বিয়ের কিছুবছর আগেই মারা যায়।মালা চলে যাওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই রান্নাঘরে লক্ষীর ছবিটা মেঝেতে পরে ভেঙ্গে গেলো।তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে শ্যামল বলে উঠলো-- বছরের শেষে লক্ষী আমাদের বাড়ি ছারলো মা।


আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো।কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো সে।আর অন্যদিকে মালা মিঠিকে বুকে করে নিয়ে হেঁটে চলেছে আর আপন মনে বলে চলেছে--- মিঠি তুই আমার মেয়ে।তোর জন্য আমি সব করতে পারি।তুই আমার মাতৃত্বের অপূর্ন স্বাদকে পূর্ণ করেছিস।তুই আমাকে নতুন জীবন দিয়েছিস।ঐ বন্দীজীবন থেকে মুক্ত করেছিস।আমিও তোকে আজ কথা দিচ্ছি তোর জীবনে আলোর অভাব কোনোদিন হবে না।কাল নববর্ষের দিন,আর কাল থেকে তোর জীবনেও নববর্ষ শুরু হবে।তোর জীবনটাকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার।আমি তোকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।তখন দেখবি তোকে কেউ আস্তাকুড়ের মেয়ে বলে অপমান করবে না।উল্টে সবাই তোর পায়ে প্রণাম জানাবে।

সত্যিই কাল থেকে মালার জীবনে নববর্ষের সূচনা হবে,আর সেটা হবে শুধুমাত্র মিঠির কারণে।তাই এই নববর্ষ শুধু মিঠির।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy