Pintu Naskar (পিন্টু নস্কর)

Classics Crime Others

4.5  

Pintu Naskar (পিন্টু নস্কর)

Classics Crime Others

মাস্টারমশাই

মাস্টারমশাই

6 mins
723



   “স্যার, আশির্বাদ করবেন যেন একদিন আপনার মত হতে পারি,” প্রণাম করার পর বলে ওঠে ক্লাস ফাইভের দুষ্টু মেয়ে সুদ্বীপা। আরও বেশ কয়েকজন ফুটফুটে ছেলেমেয়ে হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে। 

   “আমার মত হবি কি রে! আমার থেকেও অনেক বড় হবি তোরা – মানুষ হবি – মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় তাদের পাশে দাঁড়াবি। আর, তোরা কি এখন সবাই মিলে প্রণাম করতে শুরু করবি নাকি! আমার আশির্বাদ সবসময় তোদের সাথে আছে রে।” সুদ্বীপার কাঁধে হাত রাখে কাজী নজরুল বিদ্যামন্দিরের ইংরেজির মাস্টারমশাই সুশোভনবাবু। 


   প্রতিবছর শিক্ষক দিবসের এই দিনটাতে স্কুলটা গমগম করে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের হাসি-কলরবে। সকাল বেলায় প্রার্থনা সংগীত শেষ হতেই টিচার্স রুমে একের পর এক ছেলেমেয়ে ভীড় করতে থাকে। ফুল, মিষ্টি, কেক, পেন – আরও নানান রকম উপহারে ভরিয়ে দেয় ছাত্র-ছাত্রীরা। এই একটা দিন স্কুলে পড়াশোনা, নিয়ম-কানুনের বালাই নেই – আজ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছুটি। উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরাই ক্লাস নেবে তাদের ভাই বোনদের। গান, গল্প, ক্যুইজ – এসবের মধ্যেই হইহই করে কাটিয়ে দেবে দিনটা। 


   আজ প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল গ্রামের এই ছোটোখাটো স্কুলটাতে চাকরি করছেন সুশোভনবাবু। কত ছেলেমেয়েকেই যে তিনি নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন তা এখন আর মনেও থাকে না ঠিক। বার্ধক্যের নির্মম অত্যাচারে অনেক কিছুই এখন ভুল হয়ে যায়। ক্লাসে পড়ানোর সময়ও এখন করে গুলিয়ে ফেলছেন অনেক কিছু। কিন্তু হঠাৎ রাস্তার মোড়ে যখন কোনো ছেলে বা মেয়ে সাইকেল থেকে নেমে টুক করে প্রণাম করে বলতে শুরু করে, “ভালো আছেন স্যার? আমি চাকরি পেলাম গত মাসে। চিনতে পারছেন না আমাকে! আমি সেই…”, তখন বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে সুশোভনবাবুর – চোখদুটো ছলছল করে ওঠে। গ্রামের মানুষও তাকে যথেষ্ট সন্মান করে। যেকোনো সমস্যার সমাধানে বা অনুষ্ঠানে মাস্টারমশাইকে ছাড়া তাদের চলে না। বিয়ে-টিয়ে আর করে ওঠা হয়নি তার। সারাজীবনটা এই স্কুলকেই তার বাড়ি ভেবে এসেছেন, আর ফুটফুটে ছেলেমেয়েগুলো তার সন্তান। তাই আজ বয়স তাকে কাবু করে ফেললেও, স্কুল ছাড়ার কথা ভাবলেই তার বুকের ভেতরটা কেমন টনটন করে ওঠে। 


   টিচার্স রুমে ছাত্র-ছাত্রীদের ভীড় হালকা হয়ে এলে, স্কুলের দীর্ঘদিনের কর্মচারী প্রহ্লাদ চা দিয়ে যায় সবাইকে। প্রহ্লাদের জীবনটাও এখন অনেকটা সুশোভনবাবুর মতই নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে। ছোটোখাটো একটা সংসার তার ছিল বটে, কিন্তু প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়ই মৃত্যু হয় তার স্ত্রী সরলার। মাধবপুরের মত এরকম অজ পাড়াগাঁয়ে কত মানুষই যে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যায় তার ঠিক নেই। প্রহ্লাদের মেয়েটা অবশ্য বেঁচে গেছিল সে যাত্রায়। দু-এক বছর পড়েও ছিল এই স্কুলে। তারপর তো কোথায় যেন বিয়ে হয়ে গেল তার। তখন থেকেই প্রহ্লাদের জীবনে আছে বলতে খালি এই স্কুলটাই। বুড়ো বটগাছের মত সেও শিকড় গেড়ে পড়ে আছে এখানে। 


“কী হে সুশোভনবাবু… আজ কি একটু তাড়াতাড়ি ফিরবেন নাকি?” পাশের টেবিল থেকে বাংলার শিক্ষক অরিন্দমবাবুর গলা ভেসে আসে। 

“না ভাই! বিকেল বেলাতেই ফিরব।”

“হ্যাঁ, সে আপনি রাতটাও কাটিয়ে দিতে পারেন।” অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে গোটা টিচার্স রুম। 

   

   টেবিলের ওপর রাখা খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে গরম চায়ে চুমুক দেন মাস্টারমশাই। প্রহ্লাদের হাতে জাদু আছে। ওর মত চা এ তল্লাটে আর কেউ বানাতে পারবে না। চা শেষ করে চেয়ারে শরীরটা হালকা এলিয়ে দেন তিনি। বাইরে চারদিক থেকে ভেসে আসছে ছেলেমেয়েদের কন্ঠস্বর। আকাশটা আজ কেমন মুখ ভার করে আছে সকাল থেকে। ধূসর রঙের মেঘ যেন পাইচারি করছে সারা আকাশ জুড়ে। হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি যখন তখন পরিস্কার করে দিয়ে যাচ্ছে গাছের মলিন পাতাগুলোকে। জানালা থেকে মাঝে মাঝে ঠান্ডা বাতাস এসে যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সুশোভনবাবুর সাদা চুলগুলোতে। 


   চোখ বুঁজে সুশোভনবাবু ফিরে যান তার শৈশবের দিনগুলোতে, যখন তিনি সবেমাত্র শুরু করেছেন তার নিজের পড়াশোনার জীবন। ছোটবেলায় তিনি দুষ্টু ছিলেন না বটে, কিন্তু তার মত গাধা কমই ছিল গ্রামে। তার স্কুলে যাওয়া নিয়ে কত যে ঝামেলা পোহাতে হত তার পরিবারকে, তা তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলতে পারবেন না। সকাল বেলায় স্নান, খাওয়া-দাওয়ার পর স্কুলের পোশাক পরার সময় থেকে মুখটা হাঁড়ি হতে শুরু করতো ছোট্ট সুশোভনের। দাদুই তাকে স্কুলে নিয়ে যেত রোজ। দশ মিনিট হাঁটার পর, প্রাইমারি স্কুলের ঠিক আগের মোড়টা এলেই শুরু হয়ে যেত কান্না আর চেঁচামেচি। স্কুলের সামনে আসা মাত্রই দিদিমনিরা বেরিয়ে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিত ক্লাসরুমে। দাদু আর বাড়ি ফিরত না। স্কুলের তিন-চার ঘন্টা সময় মহাদেব কাকার মুদিখানার দোকানেই কাটিয়ে দিত। চিৎকার-চেঁচামেচি একসময় শান্ত হয়ে এলেও, সুশোভনের পড়ায় মন থাকত না কখনোই। ছোট্ট জানালা দিয়ে সে বাইরের মাটির রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকত। পাড়ার কাউকে ওই রাস্তায় দেখলেই শুরু হয়ে যেত তার কান্না আর ছোটাছুটি। গ্রামের লোকজনও ব্যাপারটা ভালোই জানত। তাই তারা সাইকেলটা জোরে চালিয়ে বেরিয়ে যেত রাস্তাটুকু। 


   মহাদেব কাকার দোকান স্কুল থেকে বেশি দুরে ছিল না। দোকানের সামনে ছোটোখাটো একটা বাঁশের মাচা ছিল। দাদু সেখানে আরও কয়েকজন বৃদ্ধের সাথে আড্ডা দিত আর মুড়ি-বাতাসা খেত। স্কুল ছুটির ঠিক দু-মিনিট আগে সে হাজির হয়ে যেত স্কুলের পাশে ঠিক রাস্তার ওপারের সবেদা গাছের নিচে। দৌড়ে এসে সুশোভন ব্যাগটা দিয়ে দিত দাদুর হাতে, আর একটাই অভিযোগ করত রোজ, “তুমি বড় দেরি করে আসো দাদু। কখন ছুটি হয়ে গেছে আমার!” মুচকি হেসে দুটো তেঁতুল লজেন্স ধরিয়ে দিত দাদু। 


   এরপর আসল গল্প শুরু হয় সন্ধ্যে বেলা। সুশোভনের প্রথম গৃহ শিক্ষক ছিল তার মা। রোজ সন্ধ্যে বেলা দুধ-বিস্কুট খেয়ে তাকে পড়তে বসতে হত মায়ের কাছেই। শিশু সুশোভনের সমস্যা ছিল একটাই – সে বোকা। লিখতে বললে খাতার ওপর পেন্সিল চেপে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত মায়ের মুখের দিকে। ফলে মারধর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যেত। এই ব্যাপারটা বাড়ির সবার ঠিক পছন্দ হত না। ঠাকুমা গজগজ করতে করতে উঠোন থেকে চলে যেত। বাড়ির ছেলে এরকম মার খাবে রোজ তা হয় নাকি! বাবা-বাছা বলে যতদূর লেখা-পড়া হয় হল, নাহলে দরকার নেই। জমিজমা, ধানক্ষেত আছে – ভাতের অভাব হবে না। আর ঠিক এইসময় বুদ্ধির পরিচয় দিত সুশোভন। আশেপাশে ঠাকুমাকে দেখতে পেলেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিত। তাই মাঝে মাঝেই বাড়িতে ঝগড়া লেগে থাকত। কখনো কখনো বিশালাকার ধারন করত এই ঝামেলা। একবার তো মাকে বের করেই দেওয়া হয়েছিল বাড়ি থেকে। বড় জেঠিমা ফিরিয়ে আনে বুঝিয়ে সুঝিয়ে। কিন্তু এসব কোনো কিছুই দমাতে পারেনি মাকে – জেদ ধরে বসেছিল সে। কিছুতেই হার মানবে না। আর হয়ত সেই কারনেই হাঁদা সুশোভন একদিন হয়ে ওঠে গ্রামের সবার প্রিয় মাস্টারমশাই। 


   ধীরে ধীরে একসময় ক্লাস থ্রি তে উঠে যায় সুশোভন। আগের থেকে বুদ্ধি-সুদ্ধি একটু হয়েছে এখন। পড়া মনে রাখতে পারে ভালোই – পরীক্ষাতেও এমন কিছু খারাপ ফল করছে না। তবে সন্ধ্যে বেলায় মায়ের হাতের চড় মাঝে মাঝেই ফিরে আসে। এরকম এক সন্ধ্যেতে সুশোভন কিছুতেই একটা পড়া তৈরি করে উঠতে পারছে না। মায়ের মাথা আগুন হয়ে যায় কিছুক্ষণ পর। কাঠের লম্বা স্কেল দিয়ে সুশোভনের ঊরুতে দাগ বসিয়ে দেয়। শুরু হয়ে যায় ছেলের চিৎকার আর ঠাকুমার ফোঁস-ফোঁসানি। এক কথায়, দু কথায় ভয়ঙ্কর রূপ নেয় মা-ঠাকুমার ঝগড়া। হঠাৎ মা তীব্র গলায় বলে ওঠে, “আমার ছেলেকে কীভাবে শাসন করবো সে আমার ব্যাপার। আপনার ছেলেগুলোর মত অশিক্ষিত গরু করে রাখতে পারব না।” গা জ্বলে যায় ঠাকুমার। হাতের কাছে পিতলের জলের ঘটি পেয়ে সেটাই ছুড়ে দেয় সজোরে। মা বুঝে ওঠার আগেই ঘটিটা এসে লাগে তার কপালের শেষ দিকটায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মা মারা গেল। প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায় সবাই। তারপর সেই রাতেই তাকে গ্রামের শেষ প্রান্তে ধানক্ষেতের মাঝখানে খালপাড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আর মৃত্যুটাকে আত্মহত্যা বলে রটানোর জন্য মুখে বিষ ঢেলে দেয় ঠাকুমা নিজেই। এক রাতেই সব শেষ। সে যুগে পুলিশ-টুলিস বিশেষ নজর দিত না অজ পাড়াগাঁয়ের এসব ঘটনা – আকছার ঘটত এই ধরনের কান্ড। কিছুদিন লোকের মুখে মুখে ঘোরার পর একসময় চাপা পড়ে যেত। সবকিছু ভুলে পৃথিবী আবার নিজের মত করে চলতে শুরু করত। 


   হঠাৎ কাঁধের ওপর শক্ত কিছুর চাপ অনুভব করে চমকে ওঠেন সুশোভনবাবু। চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছেন অরিন্দমবাবু।

“সত্যিই কি রাতটা কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি স্যার? বাইরে তাকিয়ে দেখুন সন্ধ্যে হয়ে এল তো।”


   সুশোভনবাবু জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। সত্যিই ঘন কালো মেঘে চারদিক অন্ধকার করে এসেছে। মাঝে মাঝে প্রচন্ড গর্জনে যেন আকাশ ফেটে পড়তে চাইছে। বাইরে বেরিয়ে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ান মাস্টারমশাই। ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ায় ভূতের মত মাথা দোলাচ্ছে স্কুলমাঠের নারকেল গাছগুলো। ছাত্র-ছাত্রীরাও কখন যেন বাড়ি চলে গেছে। হঠাৎ ঝুপ করে প্রচন্ড বৃষ্টি নেমে আবছা করে দেয় সামনের সবকিছু। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগতে থাকে সুশোভনবাবুর পুরু চশমার কাঁচে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics