Pintu Naskar

Classics Inspirational Others

3.8  

Pintu Naskar

Classics Inspirational Others

মালতি মাসি

মালতি মাসি

4 mins
1.3K


দৌড়াদৌড়ি করে শেষমেষ ট্রেনটা ধরেই ফেলল মালতি। সকাল বেলায় এই ক্যানিং লোকালটা ধরার জন্য তাকে মাঝে মাঝেই এই কষরত টুকু করতে হয়। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বাবলুকে খাইয়ে, স্নান করিয়ে, স্কুলে পাঠিয়ে, এই ট্রেন ধরতে তাকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় রোজ। ট্রেনের ভীড় ঠেলে কোনোরকমে ভিতরের দিকে আজ সে একটা বসার জায়গা পেয়ে গেল। তবু তো আজ ভীড়টা অনেকটাই কম কারণ আজ ১৫ই আগস্ট - স্বাধীনতা দিবস। অফিস-কাছারি সব আজ বন্ধ। তবে এতদিন ট্রেনে যাওয়া-আসা করে একটা কথা সে ভালোই বুঝেছে - তাদের মতো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে এইসব স্বাধীনতা দিবস এককথায় অর্থহীন। এসব উৎসব-আয়োজন শুধুমাত্র সমাজের উঁচু তলার মানুষদের জন্যই বরাদ্দ। একদিন কাজে না গেলে যাদের খাওয়া হবে না তাদের আবার স্বাধীনতা! তার ওপর সেই খেটে খাওয়া মানুষ যদি হয় মহিলা, তাহলে তো স্বাধীনতার বারোটা তার জন্মের দিনই বেজে গেছে। এই ট্রেনেই কি কম ঝক্কি পোহাতে হয়! দৌড়ঝাঁপ করে তো সবসময় লেডিস কম্পার্টমেন্ট পাওয়া যায় না -- সামনে যা আসে সেখানেই উঠে পড়তে হয় কোনোরকমে। ভীড়ের মধ্যে কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে থাকতে হয় বুকের ওপর; এমনিতে ঘামের গন্ধে নাক পাতা দায়, তার মধ্যেই কেউ আবার খৈনি বানাতে শুরু করে, তার গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে; কেউ আবার চেঁচিয়ে ওঠে, "ব্যাগটা কেউ ওইভাবে নেয়...একে এই ভীড়!" পরের মুহূর্তেই মালতি কারুর হাতের ছোঁয়া পায় তার পেটের কাছে, পেছনের দিকে। গা শিরশির করে ওঠে, কিন্তু সে চুপ করে থাকে।


কার সাথে লড়াই করতে যাবে সে -- এই সমাজটাই তো এরকম। কাজে তো তাকে রোজই যেতে হবে। ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে যাতে বড়ো হয়ে সে এই জন্তু গুলোর একটা না হয়ে ওঠে। দামি স্কুলে হয়ত সে পড়াতে পারবে না, কিন্তু মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা তাকে দিতে হবে। তাই মালতির হাতে এখন অনেক কাজ -- এইসব ট্রেনের ছোটোখাটো ব্যাপার সে গায়ে মাখতে চায় না। নিজের বাড়িতেই কি তাকে কম হেনস্থা হতে হয়েছিল! মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাবলুর বাবা কতবারই তার ওপর জোর-জুলুম করেছে -- মারধর করেছে অমানুষের মতো। তারপর একদিন মদই তাকে শেষ করেছে। শাস্তি পেয়েছে হাতে-নাতে। মালতি তার এই ছোটোখাটো জীবনে অনেক কিছুই দেখে ফেলেছে। তাই এসব নিয়ে সে আর মাথা ঘামায় না। যার কর্ম যেমন, তার ফল তেমন -- এই সাধারণ একটা কথায় সে বিশ্বাস করে এসেছে সারাজীবন। 


মালতি এখন শহরে একটা বাবুর বাড়িতে কাজ করে। সেই বাড়ির বড় বাবুর ছোট্ট মেয়ে মিঠিকে সে সারাদিন দেখাশোনা করে। বাবা-মা সকালবেলা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মিঠিকে তার হাতে দিয়ে যায়। তারপর প্রায় সন্ধ্যে পর্যন্ত সে এই মেয়েকে নিয়ে পড়ে থাকে। খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে গল্প বলা, খেলা করা -- এসব করতেই দিন কেটে যায়। মিঠিকে সে তার নিজের ছেলের থেকে কিছু কম ভালোবাসে না। যতটা সময় সে বাবলুর সাথে কাটাতে পারে, তার চেয়ে হয়ত মিঠিই তাকে বেশি করে পায়। ছোট্ট মেয়েটাও মালতিকে বেশ কাছের করে নিয়েছে -- এখন তো খেতেও চায় না তার হাতে ছাড়া। কিন্তু এই বাড়িতেও সে রেহাই পায়নি। মেজবাবুর চাহনিতে যেন বিষ আছে। কতবারই সুযোগ পেলে সে ছুঁতে চেষ্টা করেছে মালতিকে। তাই মালতি মাঝে মাঝেই ভাবে, সে তো একটা পরের বাচ্চাকে আপন করেই নিয়েছে, সবাইকে খুশি করতে চেয়েছে সবসময়, তাহলে এই পৃথিবী তাকে কেন আপন করে নিতে পারে না? 


এসব অস্বস্তিকর ঘটনা মালতি আর পাত্তা দেয় না। জীবনের সুন্দর দিক গুলো নিয়েই সে বেঁচে থাকতে চায়। ছোট্ট বাবলুটাকে তার মনের পুরো অংশটা জুড়ে রাখতে চায়। এই একজনকে নিয়েই তো এখন তার যত স্বপ্ন। বাবলুর কথা মনে এলেই একটুকরো হাসি খেলা করে যায় তার ঠোঁটের কোণে। মালতির মনের মধ্যে একমাত্র তার এই ছেলেরই অবাধ বিচরণ। তার অন্তরের গভীরে এই নিভৃত স্থানটুকুতে সে তার সমস্ত স্বাধীনতা খুঁজে নেয়। বিশাল এই পৃথিবীতে এইটুকুই জায়গা তার একান্ত নিজের -- এখানে আর অন্তত অন্য কারুর বিরক্ত করার অধিকার নেই। আজ কত ভোর ভোর উঠেই সে ফুল তুলতে বেরিয়ে গেছিল বন্ধুদের সাথে। স্কুলের আন্টি নাকি সবাইকে ফুল নিয়ে যেতে বলেছেন স্বাধীনতা দিবসের জন্য। পতাকা উত্তোলনের জন্য, বা মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবিতে মালা পরানোর জন্য লাগবে এই ফুল। বাবলু তো একটা কবিতাও আবৃত্তি করবে স্কুলে - "আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?" কত করে বলেছিল মাকে তার সাথে যাওয়ার জন্য। বন্ধুদের বাবা-মাও আসবে-- কত মজা করবে ওরা। কিন্তু বাবলুর সরল মন কি আর এই জটিল পৃথিবীর হিসেব নিকেশ বোঝে! একদিন কাজে না গেলে যে মায়ের মাইনে কাটা যেতে পারে, সে কি আর তার পক্ষে বোঝা সম্ভব! করুন মুখ করে বাবলু স্কুলে চলে যায়। মালতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিন্তু সে মনে মনে ভাবে, এইসব ত্যাগ স্বীকারের জন্যই হয়ত সে তার ছেলেকে একদিন অনেক বড় জায়গায় দেখতে পাবে। আর সেদিন তার চোখ জলে ভরে যাবে, গর্বে ফুলে উঠবে তার বুক, সব কষ্ট সার্থক হবে সেদিন।


মালতির স্টেশন প্রায় এসেই গেছে। ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে গলাটা একটু ভিজিয়ে নেয় সে। ট্রেন এখন অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেছে। মালতি উঠে দাঁড়ায়। ক্লান্ত অবসন্ন পথিকের মতো ধীরে ধীরে ট্রেনটা স্টেশনে এসে থামল। মালতি নেমে যায়। কাছের কোনো ক্লাব বা স্কুল থেকে ভেসে আসছে দেশাত্মবোধক গান -- "মা তুঝে সেলাম।"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics