মা
মা


কাজরী চুপ করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দরজাটা একটা বিশাল হলঘরের, যে হলঘরের ভেতর আজ সেরা ছাত্রদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। হলের ভেতরে লোকেলোকারণ্য। সেরা ছাত্রছাত্রীদের মা বাবারা এসেছেন অনুষ্ঠানটা সামনে থেকে দেখতে, হাততালি দিয়ে নিজেদের গর্বিত করতে। কাজরীও খবর পেয়েছিলো আজ জয়ী সেরার শিরোপা পেতে চলেছে। জয়ী স্মাজে অন্য নামে পরিচিত তবে ো ওর কাছে সবসময়ই জয়ী হয়ে থাকবে। তাই ও লোভ সামলাতে পারেনি, লুকিয়ে দেখতে এসেছে কি হয়। একজন একজন করে নাম ডাকা চলছে আর সেই নামধারী ছাত্র বা ছাত্রী উঠে আসছে মঞ্চে তারপর প্রধান অতিথির হাত থেকে সেই সম্মান গ্রহণ করছে। তারপর সবাইকেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কিছু বলার জন্য। মাইক ধরে যার যা বক্তব্য বলছে তারপর নেমে যাচ্ছে। পরপর অনেক কটা নামই পেরিয়ে গেলো কিন্তু জয়ীর নাম এখনো নিলো না ওরা। তবে কি ও ভুল খবর পেয়েছে, জয়ী সত্যি সত্যি সেরা হতে পারেনি? আশঙ্কায় মনটা কেঁপে উঠলো কাজরীর। কিন্তু তনুময়বাবু যে বলে গেলেন। উনি কি আর মিথ্যে বলবেন? না না।
কাজরীর মনে পড়ে যাচ্ছিলো আজ থেকে কুড়ি বছর আগের ঘটনা। তখন ও সদ্য যুবতী। বাবা ছিল দিনমজুর আর মা লোকের বাড়ির ঝি। অভাবের সংসারে সোমত্ত মেয়েকে কেউ বেশীদিন রাখতে চায় না, কে জানে কখন কোন বিপদ এসে হাজির হয় তাছাড়া ওর পরে আরও দুই বোন রয়েছে, তাদেরও গতি করতে হবে। বিয়ে হয়ে গেলো ওর কাটোয়ার বনমালীর সাথে। বনমালী রঙের মিস্ত্রির কাজ করে, বেশীরভাগ সময় ভিন শহরে থাকে। যখন আসে তখন সংসার খরচের টাকা দিয়ে যায় মায়ের হাতে। শ্বাশুড়িমা বেশ দজ্জাল মহিলা, বড় দুই বৌমাকে পায়ের তলায় রাখে শুধু ছোটটা তার প্রিয় পাত্রী। কাজরী বাড়ির মেজবৌ কাজ করেও মরে, কথা শুনেও মরে। প্রথম প্রথম কথা শুনত কারণ অনেক বছর ওর ছেলে বা মেয়ে হয়নি। শ্বাশুড়ি যখন ওকে বাঁজা বলে ছেলের আবার বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় করছে তখন ও মা হল কিন্তু এক মেয়ে সন্তানের। বাঁজা নাম ঘুচলে কি হবে বংশরক্ষা হল কই। তাই আবার তোড়জোড় দ্বিতীয়বার মা হওয়ার। সময় পেরিয়ে আবার সন্তান এলো কোলে তবে সেই মেয়ে। শ্বাশুড়ি আর স্বামী দুজনেই ক্ষেপে আগুন। বলেই দিলো “এবার আবার মা হতে হবে, আমাদের ছেলে চাইই চাই কিন্তু ছেলের বদলে যদি মেয়ে হয় তাহলে সেটাকে নুন খাইয়ে মেরে দেবো আর সেই সাথে তোমারও আর এ বাড়িতে জায়গা হবে না”
কাজরীর বুকের ভেতর আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। ও তো আবার পোয়াতি কিন্তু ছেলে হবেই এ ও আগে থেকে জানবে কি করে, যদি না হয় তাহলে কি হবে তা ভেবেই ওর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে থাকলো। কিন্তু নিজের সন্তানকে বাঁচাবে কি ভাবে তাও ভেবে উঠতে পারলো না।
দশ মাসে পরার আগেই ও পেট ব্যাথা বলে ভর্তি হল বড় হাসপাতালে। এই হাসপাতালটা বাড়ি থেকে বেশ
দূরে তাই বাড়ির লোক প্রতিদিন আসার সময় পায় না। দু একদিন অন্তর অন্তর দেখে যায়। এতে সুবিধাই হল কাজরীর। ও শরীর ভালো থাকলেই ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলো কার নতুন বাচ্চা হয়েছে কারো বাচ্চা হতে গিয়ে মারা দিয়েছে কি না, এসব। কিন্তু নতুন মা অনেকেই হল কিন্তু কারো বাচ্চা মারা যায়নি। কি হবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ও পায়ে পায়ে হাসপাতালের সুপারের ঘরে উঁকি দিলো এক দুপুরে। উনি তখন সবে দুপুরের খাবার খেয়ে এসে বসেছেন। ঘরটাও সেই মুহূর্তে ফাঁকা। কাজরী ভয়ে ভয়ে উঁকি মেরে বলল “আসবো স্যার”
উনি গম্ভীর গলায় বললেন “আসুন” তারপর ওকে দেখে বলল “তুমি না এখানে ভর্তি হয়েছ”
“হ্যাঁ স্যার”
“তাহলে বেড ছেড়ে এখানে এসেছ কেন?”
“স্যার আপনাকে আমার একটা কথা বলার আছে। যদি একটু শুনতেন তাহলে আমার ভালো হতো”
“বলো” কাজরী সব খুলে বলেছিলো ওনাকে।
“শ্রীময়ী ঘোষাল মঞ্চে উঠে এসো”
কাজরীর ধ্যান ভেঙে গেলো, ও তাকালো সামনের দিকে। কি সুন্দর লাগছে দেখতে! জয়ী এমন দেখতে হবে ও আশা করেনি। সৌন্দর্য্য পড়াশোনার জ্ঞান আর বুদ্ধিমত্তা সব মিলিয়ে শ্রীময়ীকে দারুণ উজ্জ্বল লাগছে দেখতে। যথারীতি ও প্রধান অতিথির হাত থেকে সম্মান গ্রহণ করলো। ওকেও বলার জন্য মাইক এগিয়ে দেওয়া হলো। শ্রীময়ী বলল “মাননীয় প্রধান অতিথি স্কুলের হেডস্যার আর সব স্যার আর দিদিমণিদের আমার প্রণাম জানাচ্ছি। আমার এই সাফল্যের জন্য এই স্কুল এখানকার সব স্যার দিদিমণি আমার বাবা মা সবার অবদান আছে আর তার কারণে আমি সবার কাছেই কৃতজ্ঞ। তবে আজ আমি এমন একজনের কথা বলবো যে না থাকলে আমি এখানে আজ আসতেও পারতাম না। সে হল আমার জন্মদাত্রী মা কাজরী। পুত্র সন্তান পাওয়ার কারণে আমার জন্মদাতা বাবা আমাকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছিলো। মা আশঙ্কা করেছিলো বলেই হাসপাতালের সুপারকাকু তনুময়কে অনুরোধ করে আমার জন্য একটা সুরক্ষিত ব্যবস্থা করতে। সব শুনে উনি কথা দেন আমার জন্য কিছু অবশ্যই করবেন। তিনি এক নিঃসন্তান দম্পতিকে আমায় দত্তক দিয়ে দেন। মায়ের সাহসিকতা আর আমার বাপি মামণির আদরে ভালোবাসায় আজ আমি এখানে” খানিক থেমে ও বলল “আমি সেই জন্মদাত্রীকে মঞ্চে উঠে আসার অনুরোধ করছি। মা এসো”
বিমান আর রজনী ঘোষাল ততক্ষণে দরজার কাছে এসে কাজরীর সামনে দাঁড়িয়েছে। রজনী মুখে বললেন “চলো তোমার মেয়ে ডাকছে। এসো এসো” কাজরীর চোখে জল চলে এলো। মঞ্চে উঠে ও শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সবাই অনুরোধ করলো ওকে কিছু বলতে কিন্তু ও কিছু বলতেই পারলো না শুধু মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিলো। মনে মনে বলল “তুমি সারা বিশ্ব জয় করো জয়ী আমার”