মা এসেছে ফিরে
মা এসেছে ফিরে
#শারদ সংখ্যা
'কে কোথায় আছিস রে, ব্যাগটা ধর, আর পারিনা যে টানতে' বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রমহিলার ডাকে ছুটে এলো চৌধুরী বাড়ির তিন বৌমা|
'মা আপনি ফিরে এসেছেন!' অশ্রুসিক্ত বড়বউমার চোখ|
'দিন, দিন, ব্যাগটা আগে দিন তো... এক্কেবারে ঘেমে গেছেন...' ছোটবৌমা শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিলো ব্যাগটা|
'চলুন মা, ঘরে চলুন তো... ভোর চারটের মহালয়া আর আমাদের শোনা হয়নি আপনার লেখা চিঠি দেখে, আপনার ছেলেদের রেকর্ড করাটাই শুনবো সবাই মিলে চায়ের আসরে' মেজবৌমা বললো|
ঘরে এসে পাখার তলায় বসে জল খেয়ে তবে ঠাণ্ডা হলেন তিন বৌমার শাশুড়িমা|
'ও ছোটবৌমা, নারানের দোকানের আলুর চপ এনেছি, তোমরা খেতে ভালোবাসো.. আমার ব্যাগের থেকে বের করতো, খাও তোমরা চা দিয়ে...'
'আচ্ছা মা বলিহারি আপনি, ওরকম "ছুটি নিলাম" লিখে রেখে কেউ বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে... আমাদের কি অবস্থা হয়েছিল বুঝতে পারছেন!' বললো ছোটবৌ|
'আপনার ছেলেদের খবর দিয়েছি, আসুক তারা আগে, হন্যে হয়ে খুঁজছে যে আপনাকে' বললো বড়বৌ|
'আপনার কি আমাদের ওপর অভিমান হয়েছিলো মা? এরকম হঠাৎ না বলে কোথায় চলে যাচ্ছিলেন?' বললো মেজোবৌ|
'অনেক তো সংসারের ঘানি টানলাম, তাই ভাবলাম আর কেন, কদিন ঘুরে বেড়িয়ে আসি| তোমাদের বললে তো আর যেতে দিতে না, তাই টুক করে বেরিয়ে পড়েছিলাম আর কি'|
'বাহ্ বেশ তো! আপনি ছেলেমানুষ হয়ে গেলেন পুরো!' রাগত কন্ঠে বলে এবার বড়বৌ, 'তা আপনি যে সুস্থ ভাবে ফিরে এসেছেন সেই অনেক' বলে দুহাত কপাল ঠেকিয়ে খানিক প্রনাম ঠুকতে লাগলো|
'আচ্ছা মা, জানেন তো যে মা দুগ্গাও যেখানে যান, সন্তানদের সাথে নিয়ে যান| আপনি আমাদের ছেড়ে কোত্থাও যেতে পারলেন না, বলুন? তাই তো ফিরে এলেন?' বললো মেজোবৌ|
'হ্
যাঁ রে মা, বাস স্ট্যান্ড অবধি যেতেই, ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়াতে মনে পড়লো বড়বউমার কথা.... সক্কাল বেলায় আহা কি সুমধুর কণ্ঠে রেওয়াজ করে, তারপর ঠাকুরঘর ফুলে ফুলে সাজিয়ে পুজো করে.. তবে শাঁখ রোজ আমাকেই বাজিয়ে দিতে হয়.. বড়োই অসুবিধায় পড়বে আমাকে ছাড়া..
ওদিকে সত্যের বইয়ের দোকানটা দেখে মনে পড়লো মেজবৌমা এত বই পড়তে ভালোবাসে, আসার আগে আমার পুঁজি থেকে বইগুলো ওকে দিয়ে আসা হলো না যে.. আর যদি কোনোদিন না ফিরে আসা হয়... নিজে থেকে তো নেবেই না কখনো..
তারপর কুসুমের ফলের দোকানের পেয়ারা-সবেদা সাজানো দেখে ছোটবৌমার কথা মনে হলো... কি ভালোবাসে খেতে মেয়েটা... একদিনও নিজের হাতে করে খাওয়ানো হলো না যে ওকে...
আমার ঘরের অন্নপূর্ণাদের মায়ায় তাই মন কেমন করে উঠল, যেতে পারলাম কই...
তাই তোমাদের সবার জন্য আজ মহালয়ার দিনে পূজার ফুল, বিদ্যার বই আর আহারের ফল নিয়ে ফিরে এলাম নিজের সংসারে|
ও হ্যাঁ, চপ-জিলিপি ও এনেছি...'
'বাহ্ মা, বেশ! বৌমাকন্যাদের টানে ফিরে এলে আর আমাদের কথা এতোটুকু মনে হলো না! এই পক্ষপাতিত্ব একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না!' দরজায় দাঁড়িয়ে বললো ছোটছেলে|
'যাক, ফিরে এসেছিস তোরা, নে চা-চপ সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে' পাত্তাই দিলেন না ভদ্রমহিলা ছেলের কথায়|
তারপর ছোট ছেলের কানটা নাগালের মধ্যে পেতেই টেনে বললেন
'তোরা হচ্ছিস আমার ধন, কিন্তু এরাই হচ্ছে ধনরক্ষক, আমার সম্পদের কোষাধ্যক্ষ, আমাদের সংসারের পূজারিণী, যাদের ছাড়া সব থেকেও শুন্য, বুঝলি? যথার্থ রক্ষক না পেলে ধনের মান হারায়| সর্বোপরি, তোরা সবাই আমার কাছে সমান, আমার ছয় ছেলেমেয়ে!'
বেলা বাড়ে, চৌধুরী বাড়ি থেকে শোনা যায় মহালয়ার মায়াবী শ্লোকধ্বনি|
মা যে ফিরে এসেছেন!