লিপি
লিপি
“লিপি দেখত, ভাতটা সেদ্ধ হয়েছে কিনা।“ দোতলা থেকে চিৎকার করলেন রমাবৌদি।
“ আর একটু বাকি।“ নীচে থেকে উত্তর দিল লিপি।
এমন সময় কলিং বেলটা বাজলো ।
“লিপি দেখত কে এলো।“
“মা...... দাদার বন্ধুরা এসেছে।“
“ওদের বলে দে ওর পরীক্ষা, যেন বিরক্ত না করে।“
কিছুদিন হল আমরা এই পাড়ায় বাড়ী ভাড়া নিয়ে এসেছি। আসলে আমার শ্বশুরবাড়ীটা ভেঙ্গে ফ্ল্যাট হচ্ছে। তাই কয়েক মাস এখানে থাকতে হবে। এখানে আসার পর থেকেই আমাদের রমা বউদিদের বাড়ী খুব যাওয়া আসা। আমাদের বাড়ীর পাশের দোতলা বাড়ীটা ওদের। যাওয়া আসা আরও বেশী কারণ রমাবউদির মেয়ে লিপি আমার বড় কন্যা টুয়ার সমবয়সী। ওদের দুজনের খুব ভাব হয়ে গেছে। আমার দুটি মেয়ে, টুয়া আর মাম্পি ।
লিপি পাড়ার স্কুলে পড়ে। পড়াশোনায় বেশ মাথা আছে মেয়েটার। কিন্তু রমাবৌদি মানসিকভাবে এখনও বিংশ শতাব্দীতে পড়ে আছেন। ওনার ছেলে রতন একটি নামী ইংরাজি মধ্যমের স্কুলে পড়ে।
আজ রবিবার। আমি অনেকক্ষণ ধরে পাশের বাড়ীর থেকে মা মেয়ের এই কথাবার্তাগুলো শুনছি। আমি জানি কাল লিপি আর ওর দাদা রতন দুজনেরই পরীক্ষা। কিন্তু ওর মা লিপিকে সমানে বিরক্ত করে যাচ্ছে।
আমি একটা স্কুলে পড়াই। আর সহ্য করতে না পেরে রমা বৌদিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম,” বৌদি লিপির কি কাল পরীক্ষা নেই?”
“ হ্যাঁ আছে তো!”
“তাহলে ও পড়বে কখন? আপনি তো সমানেই ওকে...”
“ ও ঠিক পাশ করে যাবে। আরে ওকে তো আর চাকরি বাকরি করে সংসার চালাতে হবে না। রতনকে হবে।“
“ দেখুন বৌদি আজকাল ছেলে মেয়ে সমান।...”
“ হ্যাঁ বাবা জানি জানি...... পরে এ নিয়ে কথা হবে।“ আমাকে শেষ না করতে দিয়েই রমা বৌদি দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
এ ব্যাপারে রমাবউদির সঙ্গে আমার বহুবার বচসা হয়েছে। কিন্তু যুক্তিতে যখন উনি পেরে ওঠেন না তখন আমায় সোজা ধমক লাগান, “ তোমার তো আর ছেলে নেই, তুমি কি বুঝবে?”
এরপর আর কোন কথা চলে না। আসলে আমার লিপির জন্যে খুব খারাপ লাগতো। বড় মাছটা, দইয়ের মাথাটা, দুধটা, ঘীটা সব সময় রতন পেত। রতনের যদি কিছু দরকার হত তাহলে বোনকে নির্দ্বিধায় হুকুম করত। আর যদি লিপি কখনো প্রতিবাদ করত তো রতন শাসাতো, “ ঠিক আছে বনু আমি কিন্তু সব মাকে বলে দেব।“
লিপি জানত এটা ফাঁকা আওয়াজ নয়। রতন সত্যি গিয়ে মাকে নালিশ করবে। আর তার ফল লিপির পক্ষে খুব একটা সুখকর হবে না।
বছর খানেক পর ওই বাড়ী থেকে আমার নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে যাই। তারপর ওদের সঙ্গে আর বিশেষ যোগাযোগ ছিল না।
প্রায় দশবারো বছর কেটে গেছে। ইতিমধ্যে আমার দুই মেয়ে তাদের পড়াশোনা শেষ করে একজন ব্যাঙ্কে আর একজন একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করছে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
সামনের মাসে ছোট মেয়ের বিয়ে। বিয়ের বাজার করতে গিয়ে হঠাৎ লিপির সঙ্গে দেখা। আমি তো ওকে চিনতেই পারিনি। রীতিমত গিন্নীবান্নী হয়ে গেছে। হাতে একটা ব্যাগে অনেক জিনিষ নিয়ে রিক্সায় উঠতে যাচ্ছিল। আমাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ডাকল,” কাকিমা ও কাকিমা ! চিনতে পারছ?”
আমি একটু থেমে বলে উঠলাম ,” আরে লিপি যে। তুই এখানে কি ব্যাপার?”
“আমি তো কাছেই থাকি। এখানেই আমার বিয়ে হয়েছে। তুমি কেমন আছো?”
“ ভালো রে। আসলে মাম্পির বিয়ে। তাই বাজার করতে এসেছিলাম।“
“ তাই মাম্পির বিয়ে? চল না আমার বাড়ী একটু চা খেয়ে যাবে। মার সাথেও দেখা হয়ে যাবে। “
আমি অনেক কিছু বলে কাটাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু লিপি একেবারে নাছোড়। অগত্যা ওর সাথে রিক্সায় চড়ে বসলাম।
একটা মধ্যবিত্ত পাড়ায় লিপির শ্বশুর বাড়ী। বাড়ীর একতলায় লিপি থাকে আর দোতলায় শ্বশুর শাশুড়ি। লিপি একটা স্কুলে অফিস স্টাফের চাকরি করে। ওর বর কর্পোরেশনের ক্লার্ক। লিপির একটি মেয়ে। তার বয়স বছর চারেক।
আমায় নিয়ে গিয়ে যত্ন করে বসাল ওর বাইরের ঘরে। আমি সোফায় বসতেই মেয়েটি আমার কোলের কাছে চলে এলো। আমি ওকে আদর করে জিজ্ঞাসা করলাম ,” তোমার নাম কি?”
“নয়নতারা। তুমি তো মিষ্টি দিদা। আমি জানি মা বলেছে।“ বলল ও।
“তোমার সঙ্গে গল্প জুড়েছে? ভীষণ বকবকি কিন্তু! তুমি চা খাও আমি মাকে ডাকছি।“
“ মা মানে রমা বৌদি? তোর এখানে এসেছে বুঝি?”
“ মা তো আমার কাছেই থাকে। বছর দুয়েক হল। দাদা আই আই টি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে বড় চাকরি নিয়ে মুম্বাই চলে গেল। এখন বিয়ে করে ওখানেই সেটল্ড। বাবা মারা গেলেন বছর তিনেক আগে। তারপর মায়ের পক্ষে একা ওই বাড়ীতে থাকা বেশ মুশকিল হচ্ছিল। তাই আমার বর বলল মাকে এখানে নিয়ে চলে আসতে। “
লিপি বেরিয়ে গেলো ওর মাকে ডাকতে।
আমি নয়নতারাকে জিজ্ঞাসা করলাম,” কোন স্কুলে পড়?”
“ দোলনা ডে।“
“ বাহ! এটা তো খুব ভালো স্কুল!”
আমার কথা শুনে নয়নতারার চোখদুটো খুশীতে জ্বলজ্বল করে উঠলো।
“ হ্যাঁ গাদা গাদা টাকা খরচা করে মেয়েকে ইংরিজি মিডিয়াম ইশকুলে পড়াচ্ছে।“ রমা বৌদির গলা শোনা গেল।
আমি দেখলাম একটা লাঠিতে ভর দিয়ে কোনোরকমে রমাবউদি ঘরে ঢুকছে। লিপি মাকে ধরে ধরে নিয়ে এসে সোফার ওপর বসিয়ে দিল।
“ কেমন আছো বৌদি?” জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“ আর থাকা। চলে যাচ্ছে কোনোরকমে। এই বাতের ব্যথাটা......”
“ হ্যাঁ আপনাকে একেবারে কাবু করে দিয়েছে দেখছি।“
“আসলে এখানে এই একতলায় থাকাটা আমার একেবারে সহ্য হয় না। ও বাড়ীতে তুমি তো জানো আমি সবসময় দোতলায় থাকতাম।“
আমি দেখলাম লিপির মুখটা করুণ দেখাচ্ছে। বেচারি মেয়েটা মাকে কখনই খুশী করতে পারলো না। জিজ্ঞাসা করলাম,” রতন কেমন আছে?”
রতনের নাম শুনতেই রমা বৌদির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “ খুব ভালো আছে। মুম্বাইতে বিরাট ফ্ল্যাট। এইতো কিছুদিন হল গাড়ী কিনেছে। আর রতনের ছেলেটা যে কি সুন্দর হয়েছে কি বলব। আমি তো তাই লিপিকে বলি। তোর এবার একটা ছেলে হোক। “
“ আমার চাই না মা।“ বলে উঠল লিপি।
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম লিপির কঠিন কণ্ঠস্বরে। কোনদিন লিপিকে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। চিরকাল ও মেনেই নিয়েছে। নিজের ওপর অত্যাচার মানুষ মেনে নেয় কিন্তু সন্তানের ওপর বোধহয় পারেনা। রমা বৌদি দেখলাম কিরকম কুঁকড়ে গেছেন। তবুও মিনমিনে স্বরে বললেন,” মেয়ে তো পরের বাড়ী চলে......”
ওনাকে শেষ করতে দিল না লিপি, ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো,” হ্যাঁ হ্যাঁ জানি , ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। মেয়ে তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। ছেলে দেখবে। দেখছে তোমার ছেলে? আমার অমন ছেলে চাই না। আমার মেয়েকেই আমি এমন ভাবে মানুষ করব যে দশটা ছেলের সমান হবে।“ নয়নতারাকে কোলে টেনে নিয়ে কেঁদে ফেলল লিপি।