লাভ থেরাপি
লাভ থেরাপি


মর্নিং কলেজে পড়তাম। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সাতসকালে বেরতে হত। প্রথম প্রথম খুবই কষ্টের ব্যাপার ছিল, বিশেষকরে শীতকালে। একটা সময় পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। দোতলা বাস আমার খুব পছন্দের বাহন ছিল। হাতে সময় থাকলে অন্য বাস ছেড়ে দিয়েও অপেক্ষা করতাম দোতলা বাসের জন্য। তখন কোলকাতায় বিভিন্ন রুটে অনেক ডবল ডেকার বাস চলত। বাসে উঠে দোতলায় গিয়ে টার্গেট থাকত একেবারে সামনের সিটটা। ভোরের দিকে বাস ফাঁকাই থাকত তাই অধিকাংশ দিনই লক্ষ্য পূরণ হয়ে যেত। একেবারে সামনে আর ওপর থেকে ভোরের সদ্য জাগা শহরটাকে দেখতে বড় ভাল লাগত। বাড়ি থেকে কলেজের মিনিট চল্লিশের মত পথ এভাবেই উপভোগ করতাম। একদিন যে কোন কারণেই হোক বাসে একটু ভিড় ছিল। সেদিন সামনের সিট খালি না পেয়ে সিঁড়ির একেবারে পাশের সিটটায় বসেছিলাম। ওখান থেকে বাইরের দৃশ্যের বদলে চোখে পড়ছিল সামনের মানুষগুলোকে। কেউ ঝিমোচ্ছে, কেউ গল্প করছে, কেউ চুপ করে বসে আছে গন্তব্যের অপেক্ষায়। চোখে পড়ছিল যাত্রীদের ওঠা নামা। দুটো স্টপ পরে একটি মেয়ে আমার ঠিক সামনের সিটে এসে বসল। আড়ে আড়ে জরিপ করলাম। মেয়েটি ফর্সা, সুন্দরী, পরনে হালকা নীল রঙের শাড়ি আর কাঁধে ব্যাগ। বয়সে আমার থেকে কিছুটা ছোটই হবে। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যৌবনের এক কুঁড়ি। থেকে থেকেই চোখ চলে যাচ্ছে। আমার দুটো স্টপ আগে নেমে গেল। নামার আগে একবার চোখাচুখিও হয়েছিল।
পরদিন সিট খালি থাকা সত্ত্বেও সামনের মোহ ত্যাগ করে পিছনের দিকে বসলাম। সেও আর এক মোহে, যদি মেয়েটি আবার আসে। পিছনদিকে বসলে তবেই দেখা যাবে। সামনে বসে প্রকৃতি দেখতে গিয়ে এতদিন না জানি কত কিছুই মিস করে গেছি। সেদিনও মেয়েটি এল আর আশেপাশেই বসল। পরিকল্পনার সার্থক রূপায়নে মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠল। তারুণ্যের স্বভাব ধর্মে চোখদুটো একটু লাগামছাড়া ভাবেই সৌন্দর্য আহরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তবে সেদিন আমি একা নয়, বুঝতে পারলাম মেয়েটিও লাজুক চোখে মাঝে মাঝে আমাকে দেখছে বা হয়ত মাপছে। তাই স্বাভাবিক কারণেই বেশ কয়েকবার দৃষ্টি বিনিময় হল। পরদিন আবার এল আর বসল এসে আমার পাশে। তারপর আর একজন যাত্রী আসায় মেয়েটি যতটা সম্ভব আমার দিকে সরে এল। সামান্যতম ফাঁকও আর নেই। মেয়েদের ব্যাপারে আমি খুব একটা সাবলীল ছিলাম না। ফলে মেয়েটির ছোঁয়ায় ভেতরে ভেতরে যতরকমের সুখানুভূতি হোক না কেন একটু আড়ষ্ট হয়ে বসেছিলাম।
মেয়েটি বোধহয় বুঝতে পেরেছিল, মুখটা আমার কাছে এনে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “বসতে অসুবিধে হচ্ছে?” রূপের মত স্বরটাও বড় মধুর।
--না না ঠিক আছে। সাময়িক আড়ষ্টতা কাটিয়ে বলেছিলাম।
নামার সময় সেদিন মেয়েটি বলেছিল “চলি”।
আন্দাজ করেছিলাম ও ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ে। সেদিন বাসটা ট্র্যাফিক সিগন্যালে কিছু সময় দাঁড়িয়েছিল। কলেজের গেট দিয়ে ওকে ভেতরে ঢুকতে দেখে বুঝলাম আমার আন্দাজ একেবারে নির্ভুল ছিল। তন্বীর তনু স্পর্শে বিভোর হয়ে সেদিন আমি আমার কলেজ ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিলাম আরো দুটো স্টপেজ।
লাবণি সবে কলেজে ঢুকেছে, প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ইতিহাসে অনার্স নিয়েছে। থাকে ভবানীপুরের শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটে। মা বাবার একমাত্র সন্তান। আমার নিবাস চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী স্ট্রিটে। মাস খানেক একসাথে যেতে যেতে তথ্য বিনিময় গুলো অতি সন্তর্পণে ধীরে ধীরে হচ্ছিল। ততদিনে কেটে গেছে আমার যাবতীয় আড়ষ্টতা। মোবাইলের যুগ আসতে তখনো অনেক দেরী। বাড়িতে ল্যান্ড ফোন একটা ছিল বটে তবে তা থাকত ড্রইংরুমে, সকলের সুবিধে হয় এমন একটা জায়গায়। সেখান থেকে ভাবের আদান প্রদান একেবারে নামুমকিন, কেউ না কেউ দেখে ফেলবেই। তাই মনের যা কিছু লেনদেন ওই কলেজের পথটুকুতেই সারতে হত। এর বাইরে তখনও ডানা মেলে উড়তে পারিনি। কারণ, সংকোচ, ভয়, ভাল ছেলে ইমেজ। আর এগুলোকে তুচ্ছ করে, অগ্রাহ্য করে, এগিয়ে যাওয়ার মত শক্তি তখনও আমাদের অপরিণত ভালবাসা জেনারেটে করে উঠতে পারে নি।
একটু গায়ে গা লাগিয়ে বসা, লোকের চোখকে আড়াল করে ব্যাগ চাপা দিয়ে হাতে হাত রাখা, দুটো দুষ্টু মিষ্টি বোকা বোকা কথা বলা, কারণে অকারণে হাসা বা গোসা, সে এক স্বর্গসুখ। রোজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম বাসের ওই সময়টুকুর জন্য। তাও কি শান্তি আছে। অন্যের সুখে মানুষের কিসের যে এত কষ্ট জানিনা। দুজনে নিজেদের মত করে একটু খুনসুটি করছি, চোখাচুখি হয়ে গেল পাড়ার রতনদার সাথে। দাদা ডাকলেও ছিল প্রায় আমার কাকার বয়সী।
চোখে চোখ পড়তেই প্রশ্ন—কিরে অজিত, কলেজ চললি?
ইতিবাচক উত্তর দিলাম। পরের প্রশ্ন—দুজনে কি একই কলেজে পড়িস? একের পর এক প্রশ্ন চলতেই থাকল। প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্য করলাম রতনদার চোখ থেকে থেকেই লাবণির সর্বাঙ্গ এক্সরে করছে। পাড়ায় এলাইনে ওর নাম আছে জানতাম তাই আমিও ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেকে একটু সামলে নিল। সেদিনের আমাদের দুর্মূল্য সময়টা ওই আপদ অকারণে গুচ্ছের প্রশ্ন করে খেয়ে নিল। এতেই থামেনি, আমাদের দুজনকে একসাথে বাসে দেখার ব্যাপারটা নিজের মনের মত করে নিষ্ঠা সহকারে বাবার কাছে লাগিয়েছিল। বাবা লোকটাকে তেমন পছন্দ করত না বলে ব্যাপারটা সহজে ম্যানেজ করতে পেরেছিলাম।
দেখতে দেখতে পুজোর ছুটি পড়ে গেল। পুজোর ছুটি কত আনন্দের, কত মজার। কিন্তু সেবার আমার পুজোর ছুটির সব আনন্দ শুষে নিয়েছিল আসন্ন বিরহ।
ছুটির সময় একটু যাতে দেখা হয় তা নিশ্চিত করতে লাবণি জানিয়েছিল ও ওদের পাড়ার পুজো মণ্ডপে কোনদিন কখন থাকবে। পুজোর ভিড়ের আড়ালে একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার লোভ মনে মনে ছিল। ষষ্ঠীর দিন থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ছাড়াও বহুবার ওদের ওই পুজো মণ্ডপে গিয়েছিলাম, কিন্তু একবারের জন্যও লাবণির দেখা পেলাম না। রাগ হল, অভিমান হল। নিজেকে খুব ছোট মনে হল। লাবণির মত মেয়ে আমাকে এভাবে প্রতারণা করবে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল। পুজোটা খুব বাজে ভাবে কাটল। কলেজ খোলার সময় হয়ে এল। ঠিক করলাম যে দেখা হলে নিজে থেকে ওর সাথে আর কোন কথা বলব না। কলেজ খোলার পর প্রথম দিন বাসে উঠে মনের অনেক দ্বিধা দ্বন্দ কাটিয়ে চলে গেলাম দোতলার সেই একদা ফেবারিট একেবারে সামনের সিটে। কিন্তু যাকে অ্যাভয়েড করার জন্য সামনে বসা তাকে খুঁজতেই থেকে থেকে পিছনে তাকাচ্ছিলাম। এতবার পিছন ফিরেছি যে পিছনের লোকটা খানিক বিরক্ত হয়ে একবার বলেই ফেলল—ভাই কি কিছু খুঁজছ? বারে বারে ঘাড় ঘুরিয়ে না দেখে পিছনের দিকে গিয়ে বস না, সিট তো ফাঁকাই রয়েছে।
সেদিন লাবণি আসেনি। সেদিন শুধু নয়, পুরো সপ্তাহটাই এল না। নিশ্চিত হলাম যে লাবণি আর আমার সাথে দেখা করতে চায় না।
রবিবার দিন দুপুরবেলা ঘরে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম। ফোন বাজার আওয়াজ কানে এল। বাবা বা আমি নিরুপায় না হলে চট করে ফোন ধরতে যাই না, ফলে বাধ্য হয়ে মাকেই প্রায় সব ফোনই ধরতে হয়। এদিনও মাই ফোনটা ধরেছিল। আমার ঘরে এসে বলল “তোর ফোন, অরবিন্দ রায় নামে এক ভদ্রলোক ফোন করেছেন”।
--ওই নামে তো কাউকে চিনি না মা।
-- চেনা অচেনা পরে হবে, আগে তো গিয়ে ফোনটা ধর।
‘হ্যালো’ বলতে ওপাশ থেকে ধরা গলায় ভেসে এল ‘আমি লাবণির বাবা বলছি’।
চমকে উঠলাম। ওর বাবার তো আমাকে চেনার কথা নয়। লাবণির কাছ থেকে আমার বা আমাদের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই জানতে পেরছে। আমার নামে কিভাবে কি লাগিয়েছে জানি না। বড় একটা ধমকের আশংকায় মিহি সুরে বললাম ‘বলুন’।
--তুমি একটু সময় করে আজকে আমাদের বাড়িতে আসতে পারবে?
মতলব সুবিধের ঠেকল না। ডেরায় ডেকে গুছিয়ে বানাবে না তো? যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। স্বর যথাসম্ভব নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কি জন্য যদি একটু দয়া করে বলেন।
--মেয়েটার শরীর খুব খারাপ। জ্বরের ঘোরে বারে বারে তোমার নাম করছিল। ওর ব্যাগ থেকে তোমার নম্বরটা পেয়ে ফোন করছি। তুমি তো কাছেই থাক, একটু এস না বাবা।
--আমি এখনি যাচ্ছি মেসোমশাই।
‘কোথায় চললি?’, জামাপ্যান্ট পরে অসময়ে বেরচ্ছি দেখে মা জিজ্ঞেস করল।
‘আমার এক সহপাঠীর খুব শরীর খারাপ, ওকে দেখতে যাচ্ছি’। সবটা বলা যাবে না তাই আংশিক মিথ্যে বলে বাড়ি থেকে বেরলাম।
বাড়ি খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি। দরজা খুললেন লাবণির বাবা। প্রথম দেখা হলেও আমাকে আমি বলে একবারেই চিনলেন। হয়ত আমারই আসার অপেক্ষায় ছিলেন। আমাকে বৈঠকখানায় বসিয়ে উনি ভেতরে গেলেন। অল্প সময় পরেই লাবণির মা এলেন। দু একটা হালকা কথাবার্তার পরে আমাকে ওনার সাথে ভেতরে নিয়ে গেলেন। লাবণি শুয়ে রয়েছে, পাশে ওর বাবা বসে আছেন। আমাকে পাশে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। লাবনিকে ভাল করে দেখলাম। এই ক’দিনে চেহারার এ কি অবস্থা হয়েছে! অত সুন্দর মুখটায় যেন কেউ কালি ঢেলে দিয়েছে। চোখ বন্ধ, মাঝে মাঝে ‘আঃ’ ‘ উঃ’ শব্দে শরীরের জ্বালা যন্ত্রণা প্রকাশ পাচ্ছে।
বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞেস করলেন—মা খুব কষ্ট হচ্ছে?
মেয়ে চোখ বন্ধ করেই মাথা নাড়ল।
--একবার তাকিয়ে দেখ কে এসেছে।
চোখটা একটু খুলে এদিক ওদিক চেয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে মুখের ভাবটাই যেন বদলে গেল।
একটু হেসে খুব আস্তে অতি কষ্টে জিজ্ঞেস করল—ভাল আছ?
“কতদিন পর তোকে একটু হাসতে দেখলাম রে”, মেয়ের খুশির ওই সামান্য বহিঃপ্রকাশ তার বাবাকে অনেক স্বস্তি দিল।
“তোরা গল্প কর আমি বাইরের ঘরে আছি”, বলে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে দেখলাম ইশারায় ওর মাকেও বেরিয়ে আসতে বললেন।
ওঁরা চলে যেতে লাবণির মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললাম—কি অবস্থা করেছ শরীরের!
ও আমার হাতটা চেপে ধরে বলল—আমার ওপর রাগ করোনি তো? কি করব বল, ষষ্ঠীর দিন থেকেই যে বিছানায় শোয়া। তোমার সাথে দেখা করতে না পেরে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। শরীরে কষ্ট, মনে কষ্ট, কিভাবে যে পুজোটা কাটল তা বলার নয়। এতদিন পর তোমাকে দেখে যে কি ভাল লাগছে! এবার আমি ঠিক ভাল হয়ে উঠব।
--ভাল তোমাকে হতেই হবে। তুমি ভাল না থাকলে আমিও যে ভাল থাকব না। তোমার মা বাবার আপত্তি না থাকলে আমি মাঝে মাঝে এসে তোমাকে দেখে যাব।
--মাঝে মাঝে নয়, রোজ আসবে। আমার মা বাবা খুব ভাল, আমার ইচ্ছেয় কখনো বাধ সাধেনি। প্লিজ এস।
এদিক ওদিক দেখে ওর গালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মেয়েটাকে নিয়ে কতই না আবোল তাবোল ভেবেছি। ভালবাসাকে সুদে আসলে ফেরত পেয়ে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। কিছুটা মানসিক উদারতা থাকলেও ওর মা বাবা এই ছাড়পত্র দিয়েছিলেন তাঁদের একমাত্র সন্তানের আরোগ্য কামনায়। অভিভাবকদের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে নিত্য যেতাম লাবণিকে সঙ্গ সাহচর্য দিতে। লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করার যুগে এমন মুক্ত আবহাওয়া দুর্লভ ছিল।
ডাক্তার বদ্যি করেও যাকে তেমন একটা সারিয়ে তোলা যায়নি, সেই মেয়েই লাভ থেরাপির জাদুতে অল্প দিনেই ফিরে এল তার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে।
লাবণির মা বাবা খুব খুশি, খুশিতে
ডগমগ আমরা দুজনেও। খুশির জোয়ারে পাল তুলে তরতরিয়ে ভেসে চলল আমাদের প্রেমের প্রমোদ তরণি।