STORYMIRROR

Rinku Karmakar Chowdhury

Abstract Drama Others

3  

Rinku Karmakar Chowdhury

Abstract Drama Others

কুহু

কুহু

7 mins
5


ঈপ্সিতের ঘুম থেকে উঠে সবথেকে বড় কাজ হল রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাস জ্বালিয়ে জল গরম করা,এরপর সেই উষ্ণ গরম জলে ভালো করে ঘষে ধুয়ে নেওয়া তিন বছরের মেয়ের দুধের বোতল আর নিপল্।তারপর আরেক প্রস্থ জল গরম করে দুধ গুলে বোতলে ভরে, নিপলের ফুঁটো থেকে পিচকিরির মত হাতের তালুতে ফেলে জিভ দিয়ে চেখে নেওয়া দুধের উষ্ণতা আর ঘনত্ব। এটাই ওর প্রত্যেকদিনের দিনলিপির প্রথম কাজ। 


এরপর ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে তুলে পাল্টে নেয় বাসি ডায়পার। নতুন ডায়পার দিয়ে, মুখে গুঁজে দেয় দুধের বোতলের নিপল। আড়াই বছরের ঘুমন্ত মেয়েকে দুধ খাইয়ে,বিছানায় শুইয়ে দিয়ে,স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নাকে মুখে গুঁজে ছুটবে অফিসের জন্য।ঈপ্সিত নামী কোম্পানিতে বড় চাকুরে। এর মধ্যে মেয়ে কুহুর আয়া এসে যায়।ও শান্তির নিশ্বাস ফেলে। এভাবেই চলছে ঈপ্সিতের আড়াই বছরের পিতৃত্বযাপন।


কুহুর মা আবৃত্তি কুহুর জন্মের সময় মারা যায়।দশ বছরের প্রেম, আর আড়াই বছরের বিয়ের ভারাক্রান্ত স্মৃতি হিসেবে ঈপ্সিত সযত্নে বুকে জড়িয়ে রেখেছে কুহু কে। আরেক জনও কুহু কে প্রচন্ড ভালোবাসে,কাছ ছাড়া করতে চায় না। পরের মেয়ে জেনেও পরম যত্নে ওকে বুকে জড়িয়ে রাখে। কুহুর আয়া,প্রতিভা।


সামনের নভেম্বরে কুহু তিন পূর্ণ করবে। প্রতিভারও চাকরীর বয়স হবে দু বছর। আবৃত্তির মারা যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন আবৃত্তির মা কুহুর দেখাশোনার জন্য ঈপ্সিতের কাছে ছিলেন।কিন্তু তার পক্ষে নিজের সংসার ফেলে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিল না।তাই আবৃত্তির মা তাঁর চেনাশোনা এক আয়া কে নাতনীর জন্য রেখে ফিরে গেছিলেন নিজের বাড়ি।।সেই আয়া অবশ্য তিন সপ্তাহের বেশী থাকেনি। পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছে বলে ছেড়ে দিয়েছিল চাকরী। পরে ঈপ্সিত বুঝেছিল, চোট পাওয়াটা আসলে গল্প। ঘরের অনেক টুকটাক জিনিষপত্রই মিসিং। শাশুড়ি কেও আর এই ব্যাপার নিয়ে কিছু জানায়নি ও। এরপর নিজেই বিভিন্ন আয়া সেন্টারে খোঁজ করে প্রতিভা কে পায়। প্রতিভা সৎ,কর্মঠ, নরম মনের মেয়ে।কুহু কে খুব আগলিয়ে রাখে। ঈপ্সিতের কোনদিন ফিরতে দেরী হলে সে থেকেও যায়। রাতে কুহুর সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। যেসব দিন প্রতিভা থাকে, ঈপ্সিতের কাজ অনেকটাই কমে যায়। সকালের চা,ব্রেকফাস্টও সেদিন হাতের কাছে পায়। মাঝে -মাঝে ওর মনে হয়, নারীর উপস্থিতি বড়ই মূল্যবান পুরুষের জীবনে। আর আবৃত্তির মারা যাওয়ার পর ওর জীবন তো এখন খাঁ -খাঁ মরুপ্রান্ত।



প্রতিভার বাড়িতে ও একাই থাকে।বাড়ি বলতে বস্তির একফালি ঘর। পিছুটান বলতে কিছু নেই ওর। স্বামী ছিল একজন, বছর পাঁচেক হল সে নিঁখোজ। সন্তানও এসেছিল। কিন্তু তার জন্মের আগেই সে হারিয়ে গেছে। এ পৃথিবীতে প্রতিভার যদি কেউ বড় আপন থাকে সে হল কুহু। কুহুকে সে নিজের সন্তানের জায়গা দিয়ে ফেলেছে। আরেকজন কেও সে নিজের অনেকখানি দিয়ে বসে আছে। জানে এসব ভ্রান্ত,স্বপ্ন।তবু স্বপ্ন দেখতে কে না চায়। রোজ রাতে ফিরে বস্তির এই একফালি ঘরে,রাতে শুয়ে সে স্বপ্ন দেখে।কুহু, তার, আর ঈপ্সিতের সংসার হয়েছে। 


প্রতিভা এখন তিরিশ।সুন্দর স্বাস্থ্য, রুপও আছে। বস্তির অনেকেই ওকে পেতে চায়।কিন্তু ও যে ভেসে গেছে অন্য কিছুর টানে। লোভ হয়, বড় লোভ।একটা সংসারের, শিশুর,ভালোবাসার মানুষের লোভ। এত দুর্ভাগ্যে ঘেরা ওর জীবন। ও জানে হাত বাড়ালে এই স্বপ্নটাও ভেঙে যাবে। তাই দূর থেকে দেখে ওদের। দূর থেকে ও সাজিয়ে নিয়েছে মিথ্যে সংসার।



ঈপ্সিত কলকাতায় আসার আগেই ওকে ছেড়ে একে একে চলে গেছে ওর বাবা-মা। পড়াশুনার জোরে দারুন একটা চাকরী জুটিয়ে নেয় ও। তারপর ওর গ্রাম বেলদায় গিয়ে সমস্ত জমিজমা,পৈতৃক ভিটে বিক্রী করে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে শুরু করে।


 কলেজের পড়তে পড়তে ঈপ্সিতের প্রেম আবৃত্তির সাথে। চাকরী পেয়েই আবৃত্তির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব রাখে ঈপ্সিত। আবৃত্তির হিসেবী মা, এমন রূপবান,গুণবান ছেলে পেয়ে আর দেরী করেননি।আর তার ছোট মেয়েটিকে শ্বশুরগৃহে থাকতে হবে না ভেবেও কিছুটা শান্তি পেয়েছিলেন। তার বড় মেয়ে নিয়তি যে বিয়ের পর খুব ভালো নেই,তা তিনি জানেন।তাই ছোট মেয়ের ভাগ্যে সেসব নেই দেখে মনে -মনে শান্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু কথায় আছে,মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। মাত্র আড়াই বছরের সংসার ফেলে আবৃত্তি সকল কে ছেড়ে হারিয়ে গেল মহাশূন্যে।



কিছুদিন হল আবৃত্তির মা নাতনীর কাছে এসে আছেন। উনি শ্যেনদৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখছেন সংসারের খুঁটিনাটি দিকে। প্রথমদিন প্রতিভা কে দেখে ওর ভ্রু কুঁচকে গেছিল। তিনি যে আয়াটি কে রেখেছিলেন তিনি বয়স্কা। কুহুর এই অল্প বয়সী আয়াটা কে তার ঠিক পছন্দ হয়নি। কুহুর প্রতি প্রতিভার ভালোবাসা,টান যত্ন নিয়ে সন্দিহান না হলেও, তার সুদর্শন জামাইয়ের প্রতি এতটুকু দুর্বলতা আছে কিনা সে বিষয়ে উনি তীব্র দৃষ্টি রাখছেন। কিন্তু প্রতিভার একভাবে কাজ করে যাওয়ায়,কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তাই এবার জামাইয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে শুরু করলেন। সেখানেও কোন সঠিক উত্তর না পেয়ে, ঈপ্সিত কে একদিন সরাসরি গিয়ে বললেন,ঈপ্সিত তখন অফিসের কাজে মগ্ন।

 'দেখো, ঈপ্সিত আমার মনে হয় তোমার নতুন আয়া রাখা উচিৎ। প্রতিভা কে ছাড়িয়ে দাও তুমি।

ঈপ্সিত মাথা না তুলেই উত্তর দিল, 'কেন ও তো কুহুকে বেশ ভালোই যত্ন করে। খুব ভালোবাসে কুহুকে প্রতিভা।'

'হ্যাঁ, কিন্তু বয়স্কা মহিলা যা পারে, অল্পবয়স্কা মেয়ে তা পারে না।'

'হুম। আপনার দেওয়া বয়স্কা মহিলা তো আমার মেয়ে কে না দেখে,ঘরের জিনিষপত্রগুলো বড় ভালোভাবে দেখেছিল।'

আশানুরূপ ফল না পেলে ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন বিমর্ষ মুখে ঘুরে বেড়ায়, আবৃত্তির মা ও তেমনি বিমর্ষমুখে বললেন'ঈপ্সিত আমি ভাবছি কাল ফিরে যাব।'

ঈপ্সিত মাথা তুলে মুচকি হেসে বলল,'বেশ,আমি ড্রাইভার কে বলে দেব,আপনাকে পৌঁছে দেবে।'



কুহু ইদানীং টুকটুক করে কথা বলে,আধোআধো, অবোধ্য কথাগুলি শুনতে খুব ভালোবাসে ঈপ্সিত। প্রতিভা থাকাকালীন বাড়িতে যতক্ষন থাকে ঈপ্সিত, ওদের মধ্যে তেমন কোন কথাই হয় না। যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে। প্রতিভা নিঃশব্দে ওর চা,জলখাবার,এগিয়ে দেয়। ছুটির দিনে নানারকম খাবার বানায় ও ইপ্সিতের জন্য।তারপর চুপচাপ ঈপ্সিতের পাশে রেখে চলে যায়।ঈপ্সিত কাজ সারতে- সারতে খেয়ে নেয় সেসব।মুখে কিছু না বললেও,মনে মনে প্রশংসাই করে। আগে প্রতিভা বাড়ি থেকে টিফিন আনতো, ঈপ্সিতের প্রচণ্ড রাগারাগি তে ও এখন ওদের সাথেই খায়।আলাদা খাবার বানিয়ে আনে না বাড়ি থেকে। একরকম অলিখিত পরিবার যেন ওরা। এক রবিবার,কুহুর সাথে খেলতে-খেলতে, কুহু কে কথা বলতে দেখে ঈপ্সিত চেঁচিয়ে উঠেছিল প্রতিভার নাম ধরে,'দেখে যাও প্রতিভা, কুহু কেমন টুকুরটুকুর কথা বলছে।' প্রতিভাও ছুটে এসেছিল,রান্নাঘর থেকে।



কুহুর হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা,দাঁত ওঠা এসব অনেক কিছুর সাক্ষী প্রতিভা।কুহু কে জড়িয়েই ওর জীবন। ও এখন বড় সুখী।সারাটা দুপুর ওকে বুকের কাছে নিয়ে ঘুমোয়।স্নান করায়,খাওয়ায়। পুতুলখেলার সংসারটাকেই বড় আপন করে নিয়েছে। 


সেদিন সন্ধ্যেবেলা, ঈপ্সিত প্রতিভা কে ফোন করেছিল। প্রতিভা তখন কুহু কে নিয়ে সবে ঘরে ঢুকেছে। রোজ বিকেলে কুহু কে নিয়ে সামনের পার্কে যায় ও। ঘরে ঢোকার মুখেই প্রতিভার মোবাইল বেজে ওঠে। কুহু কে এক কোলে নিয়ে দরজা খুলে ঢুকে ফোনটা রিসিভ করতেই গলা পেল  ঈপ্সিতের। ঈপ্সিতের গলা পেয়ে ওর শরীরটা ঝন ঝন করে বেজে উঠল,নিজেকে সামলিয়ে প্রতিভা বলল, হ্যাঁ বলুন। ও প্রান্তে ঈপ্সিত বলল, 'প্রতিভা আজ একটু থেকো,তোমাকে কিছু বলার আছে।'

'আচ্ছা,বলে ফোন রেখে দিল প্রতিভা।' তারপর শুরু হল এক দুঃসহ প্রতীক্ষা। প্রতিভা কি এই কিছু বলার আছেটাই শুনতে চাইছিল এতদিন ধরে।নিজেকে বারবার প্রশ্ন করছে, কুহুকে কোলে তুলে গুনগুন করে গান গাইছে। সারাটা বাড়ি যেন অদ্ভুত এক সুগন্ধে মম করছে। 



রাত সাড়ে ন'টা নাগাদ ঈপ্সিত ফিরল, প্রতিভা দরজা খুলে দিল অন্যদিনের মত। ঈপ্সিত জুতো খুলে বসার ঘরের সোফার ল্যাপটপটা নামিয়ে একটু বসল। প্রতিভা ততক্ষনে এক গ্লাস ঠান্ডা সরবৎ বানিয়ে নিয়ে চলে এসেছে। ঈপ্সিতের দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, 'নিন খেয়ে নিন।'

ঈপ্সিত ঢকঢক করে সরবৎ টা খেয়ে, গ্লাসটা প্রতিভা কে দিয়ে বলল, 'রেখে এসো,কথা আছে।'

প্রতিভা গ্লাসটা রেখে আসতে, ঈপ্সিত ওকে বসতে বলল, প্রতিভা সোফায় বসে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। ঈপ্সিত ওর বামহাত টা নিজের হাতের উপর তুলে নিল। প্রতিভা কেঁপে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না।


ঈপ্সিত প্রতিভার হাতটা ধরেই আছে, তারপর এক সময় মৌণতা ভেঙে বলল, 'তোমাকে কিভাবে কথাটা বলব জানি না, কথাটা শুনলে তুমি হয়তো বড় আঘাত পাবে।কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার কিছু করার নেই। তুমি আমার আর কুহুর জন্য অনেক কিছু করেছো। তুমি এই দুবছরে আমাদের পরিবার হয়ে উঠেছো।তাই তোমাকে বলাটা খুব দরকার।প্রতিভা সরাসরি ঈপ্সিতের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথাটা নামিয়ে নিল। ঈপ্সিত কি বলতে চাইছে প্রতিভার তার কিছুই বুঝতে পারছে না। ঈপ্সিত ধীরে ধীরে বলল, 'প্রতিভা আমার প্রোমোশন হয়েছে, আমি আর কুহু বিদেশে চলে যাচ্ছি।'

প্রতিভার ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটে গেছে যেন, অদ্ভুত একটা নেতিয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো প্রতিভা।তারপর ঈপ্সিতের দিকে তাকিয়ে বলল,' কাল থেকে তবে আর আমি আসবো না।' আপনি একটু সেন্টারে জানিয়ে দেবেন দয়া করে। ঈপ্সিত বলল, না আমার যেতে একটু দেরী আছে তোমাকে আমি আগেই জানিয়ে দিলাম,তোমাকেও তো নতুন একটা কাজ খুঁজতে হবে,তাই হাতে সময় নিয়ে জানালাম। প্রতিভা বলল,'হ্যাঁ!নতুন একটা কাজ তো খুঁজতেই হবে, নইলে আমাদের মত মানুষদের পেট কি করে চলবে স্যার।' আজ তবে আসি স্যার।' 'কুহু ঘুমোচ্ছে স্যার,দেখবেন।' আসি আমি। বলে চলে গেল প্রতিভা। ঈপ্সিত অবাক হয়ে ওর চলে যাওয়া দেখল। 



মাস তিনেক হল ঈপ্সিত নিউ জার্সি তে এসেছে,বাপ আর মেয়ের সংসার এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে ওঠেনি।একজন ন্যানি খুঁজছে ঈপ্সিত কিন্তু পাওয়া যায়নি।তাই আপাতত ঈপ্সিত কে যেন তেন ভাবে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। এক রবিবার মেয়ের সাথে খেলতে খেলতে, ঈপ্সিত মোবাইল বের করে পুরোনো ছবিগুলো দেখছিল,মেয়ে কে দেখাচ্ছিল। একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল, প্রতিভা আর কুহুর ছবি। প্রতিভা কুহু কে কোলে নিয়ে আছে। ঈপ্সিতের মনে পড়ল, আসি বলে চলে যাওয়ার পর আর আসেনি প্রতিভা।মাইনেটা অবধি নেইনি।ওর সেন্টারে আসার আগে টাকাটা দিয়ে এসেছিল ঈপ্সিত। অদ্ভুত মেয়ে।

হঠাৎ ঈপ্সিত কে চমকে দিয়ে কুহু প্রতিভার ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,"মা"। এতদিনের অবোধ্য কথাগুলোর মধ্যে এই প্রথম কচি ঠোঁট দুটো,স্পষ্ট ভাবে বলে উঠছে, "মা,মা,মা।"



 পৃথিবীর অপর প্রান্তে, দূরে বহুদূরে কলকাতার এক ফুটোফাটা বস্তিতে এক নারী বদ্ধ ঘরের মধ্যে কাপড়ের পুঁটলি বুকে জড়িয়ে সুর করে গান গাইছে,

'আমার খুকু রাগ করেছে, ভাত খাইনি কাল।' 


Rate this content
Log in

More bengali story from Rinku Karmakar Chowdhury

Similar bengali story from Abstract