কথা দিলাম
কথা দিলাম
বিগত দশ বছর পর ত্রিধা আজ মামারবাড়ি যাচ্ছে। বাবার চাকরির জন্য ত্রিধা কে এবং ওর মাকে দেশ ছেড়ে বিদেশে থাকতে হয়েছে বহু বছর। এখন ত্রিধার সমস্ত এডুকেশন কমপ্লিট তাই গত সপ্তাহে দেশের বাড়ি তে ফিরেছে পাকাপাকি ভাবে। আর বিদেশে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। আসলে দেশের মাটি খাঁটি। বিদেশে থাকার সময় ত্রিধা যখন
"ও.... আমার..... দেশের........ মাটি...... তোমার পরে..... ঠেকাই..... মাথা....."
গানটা শুনেছে যতবার নিজের দেশের জন্য মনটা কেঁদে উঠেছে আর চোখের সামনে একটা মুখ ভেসে উঠেছে সেটা হল ত্রিধার ওম দাদার মুখ। যদিও আজ ত্রিধা মামার বাড়ি যাচ্ছে তার পিছনে এই মুখটার প্রবল টান। কারন ত্রিধা যে কথা দিয়েছিল তার ওম দাদাকে, সে ঠিক ফিরে আসবে।
ত্রিধার মামাদের প্রতিবেশী ছিল ওমরা। আসলে ত্রিধার মামার বাড়ির পরের বাড়িটা ছিল ওম দের। ওমের বাবা স্কুল মাষ্টার ছিলেন। ওমের মা অনেক ছোট্ট বয়সে মারা গিয়েছিল। ত্রিধার দিদা ওমকে খুব ভালোবাসতেন তাই ত্রিধার মামার বাড়িতে ওমের অবাধ যাতায়াত ছিল। আর প্রত্যেক গরমে এবং শীতে আর পূজোর ছুটিতে ত্রিধা মামার বাড়ি যেত ছুটি কাটাতে। এই ছুটির কটা দিন শহরের কোলাহল ছেড়ে গ্রামে সবার সাথে থাকতে ত্রিধার বেশ মজা লাগত। তাই ত্রিধা সবসময় এই দিন গুলোর অপেক্ষায় থাকত। ছোট থেকেই ওমের প্রতি ত্রিধার একটা অসম্ভব জোর এবং অধিকার বোধ কাজ করত। ত্রিধাও সবসময় তার ওম দাদার পিছন পিছন ঘুরে বেড়াত। পুতুল খেলার সঙ্গী হোক, অথবা গ্রাম ঘুরতে যাওয়া হোক ত্রিধা সবসময় তার ওম দাদার সাথে। এই নিয়ে মামার ছেলে মেয়েদের সাথেও খুব ঝগড়া, মারামারি হত কিন্তু ত্রিধা কিছুতেই তার ওম দাদাকে কারোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারতনা।
আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে চলল তার নিজের গতিতে। বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই খেলার সঙ্গী যে কখন ত্রিধার মনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল ত্রিধা নিজেও বুঝতেও পারেনি। আসলে কেউ কোনদিন মুখ ফুটে কাউকে কিছুই বলেনি শুধুমাত্র নীরবে সবসময় একে অপরের পাশে থেকেছে। কিছু কিছু সময় সব কথা হয়তো মুখ ফুটে প্রকাশ করতে লাগেনা মন আপনা আপনি সেই কথা বুঝে নেয়। তাই ত্রিধা বিদেশ যাওয়ার আগে মামার বাড়ি গিয়ে সবার সাথে দেখা করে এসেছিল।
আর ওম দাদার সামনে দাঁড়িয়ে ত্রিধা যখন বলেছিল আসছি,তখন ওম ত্রিধা কে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস ত্রিধা? তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচব? ত্রিধা সেই প্রথম ওম দাদার চোখে জল দেখেছিল। ত্রিধা ওম দাদার হাত ধরে কান্নাভেজা গলায় বলে এসেছিল আমি ঠিক ফিরে আসব ওম.... দাদা...., তুমি দেখ আমি..... ঠিক ফিরে আসব!!
আজ সত্যিই ত্রিধা তার কথা রাখতে পেরেছে। ত্রিধা যখন তার মামার বাড়ির গ্রামের মাটিতে পা দিল তখনই ত্রিধার মুখটা হাসিতে ভরে উঠল। ত্রিধার মন আনন্দে যেন ময়ুরের মত পাখা মেলে নেচে উঠল। ত্রিধার চোখ যেন ছটফট করছে সেই কাঙ্খিত মানুষটাকে দুচোখ ভরে দেখার জন্য। ত্রিধা যখন মামার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তখন নিজের অজান্তেই ত্রিধার চোখ চলে গেল তার ওম দাদার বাড়ির দিকে। কিন্তু বাড়িটার অবস্থা দেখে ত্রিধার মনের আনন্দ এক নিমেষেই কান্নায় পরিনত হল। কারন বাড়িটার ভগ্নপ্রায় অবস্থা। দেখেই মনে হচ্ছে এখানে কেউ থাকেনা বহু বছর। বাড়ির জীর্ণ ছাদের মাথা দিয়ে গাছ বেড়িয়ে গেছে। দেওয়াল ধসে গেছে। আগাছা আর আবর্জনা ঘিরে ধরেছে চারিদিক থেকে। ত্রিধার মনের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধল তাহলে কি ওর ওম দাদা ওকে ভুলে গেছে চিরদিনের মত।
কিন্তু বিদেশ থেকে যতবার মামার বাড়িতে ফোন করেছে ততবার সবার খোঁজ নিয়েছে। তখন তাহলে কেউ কিছু বলেনি কেন? না,,..... আমি কষ্ট পাবো বলে চেপে গেছে। ওম দাদা কি এই গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় নিজের দুনিয়া সাজিয়ে নিয়েছে!! না চাইতেও ত্রিধার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল জলে। এই বাড়িটাকে এবং ওম দাদা কে নিয়ে যে ত্রিধা মনের কোনে অনেক রঙিন স্বপ্ন এঁকে ছিল। তাহলে কি.... সব স্বপ্ন স্বপ্ন হয়েই রয়েগেল ত্রিধার মনে!! হঠাৎ করে কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে ত্রিধা চমকে উঠল। চোখের মধ্যে জমে থাকা জলটা আর বাঁধ মানলোনা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। ত্রিধা পিছন ঘুরে সামনের মানুষটাকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরে বলল দিদুন কেমন আছো? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। তুমি তো বুড়ি থুতথুরি হয়ে গেছ।
ত্রিধার দিদুন প্রভাদেবী আভিমান করে বললেন হ্যাঁ..... এত দিনে আমার কথা মনে পড়ল তোমার। এই যে আমি এখনও বেঁচে আছি এই অনেক। আমি তো ভেবেছিলাম মরার আগে তোদের আর দেখতে পাবোনা।
ত্রিধা সাথে সাথে কান ধরে বলল, ও.... ডার্লিং...... এই রকম করে কেন বলছ। এই দেখ চলে এসেছি আর কোথাও যাবনা তোমাকে ছেড়ে। আর আমিকি যেতে চেয়েছিলাম বলো তোমাদের ছেড়ে!
প্রভা দেবী ত্রিধার হাত ধরে বলল হয়েছে হয়েছে আর ড্রামা করতে হবেনা ভিতরে চল এবার।
ত্রিধা এক মুখ হাসি নিয়ে প্রভাদেবী কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল এইনা হলে আমার সুইট.... ডার্লিং। ত্রিধা প্রভাদেবীর সাথে বকবক করতে করতে ভিতরে ঢুকল। মামা, মামী, দাদা, দিদি, ভাই, বোন সবার সাথে এত বছর পরে দেখা হওয়ায় ত্রিধার গল্পের ঝুড়ি আর শেষ হচ্ছেই না। ত্রিধা বকবক করেই চলেছে। কিন্তু মনের মধ্যে ত্রিধার একটা কষ্ট আছে, কিন্তু ওম দাদার কথা মুখ ফুটে কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও পারছেনা। ভীষন রকম লজ্জা লাগছে। আর পুরানো দিনের সব কথা উঠলেও কেউ ওম দাদার প্রসঙ্গ তুলছেনা। ত্রিধা ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছেনা।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, এবং দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল কিন্তু ত্রিধা এখনও ওর ওম দাদার ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি। ত্রিধা আর থাকতে না পেরে গুটিগুটি পায়ে দিদুনের ঘরে ঢুকে দিদুনের পাশে গিয়ে বসল।
প্রভাদেবী ত্রিধার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন কিছু বলবি?
ত্রিধা দিদুনের কোলে মাথা রেখে বলল আচ্ছা দিদুন ওম দাদারা কি এখন আর এখানে থাকে না?
প্রভাদেবীর মুখে হাসি ফুটে উঠল, কারন প্রভাদেবী জানেন ত্রিধা ঠিক ওমের কথা জানতে চাইবে। আসলে ওম পড়াশোনা এবং কাজের জন্য বছর তিনেক আগে কলকাতায় থাকতে শুরু করেছে। তবে ওমও প্রত্যেক সপ্তাহে কলকাতা থেকে একবার করে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে সবার কথা শুধু মুখ ফুটে ত্রিধার নামটা নিতে পারেনা তাই বারবার করে জিজ্ঞাসা করে দিদুন সবাই ঠিক আছে.....তো?আসলে আমি বলতে চাইছি সবার কথা। প্রভাদেবী তখন হাসতে হাসতে উত্তর দেন হ্যাঁ....রে.....সবাই ঠিক আছে আর ত্রিধাও ঠিক আছে। কারন ওদের ভালোবাসার বন্ধন যে খুব দৃঢ়। প্রভাদেবী হাসিটাকে চেপে বলল তুই ঠিক কার কথা বলছিস বলতো?
ত্রিধা দিদুনের কোল থেকে মাথাটা তুলে অবাক হয়ে বলল তুমি.... ওম দাদাকে ভুলে.... গেছ দিদুন....?
প্রভাদেবী বলল ও হ্যাঁ.... হ্যাঁ.... মনে পড়েছে। আসলে ওরা তো কোলকাতা চলে গেছে তাই মাথাতে নেই। আর বয়স হয়েছে তো মাথার আর কি দোষ। তা হঠাৎ তুই কেন জিজ্ঞাসা করছিস ওমের কথা?
ত্রিধা নিজের কষ্টকে কোন রকমে চেপে মাথাটা নিচু করে বলল ঐ এমনি জিজ্ঞাসা করলাম। আসার সময় বাড়িটা দেখেই মনে হল কেউ থাকেনা তাই।
প্রভাদেবী কিছু বলতে যাবেন তার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। প্রভাদেবী হাসি হাসি মুখে বলে উঠলেন ঐ..... এসেগেছে।
ত্রিধা বলল কে... এসেছে গো..... দিদুন?
প্রভাদেবী বলল তুই এই ঘরে একটু বোস আমি আসছি। প্রভাদেবী হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
ত্রিধা খাঁট থেকে উঠে ঘরের জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দূরে ল্যাম্পপোষ্টে আলো জ্বলছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। দূর দূর থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছে। ত্রিধার চোখটা কষ্টে জলে ভরে এসেছে। ত্রিধা মনে মনে বলে উঠল আমি আমার কথা রেখেছি ওম দাদা, কিন্তু তুমি তো কথা রাখলেনা। আসলে তুমি তো আমাকে কোন কথায় দাওনি তাই আমাকে ভুলে গেলে কিন্তু আমি কি করে ভুলব তোমাকে! তুমি যে আমার সঙ্গে মিশে আছ। ত্রিধা নিজের মনের সাথে কথা বলে চলেছে। আর ত্রিধার চোখের জল খরস্রোতা নদীর মত গাল বেয়ে পড়ে চলেছে।
হঠাৎ পিছন থেকে প্রভাদেবী বলে উঠলেন এই দেখ ত্রিধা কাকে নিয়ে এসেছি।
ত্রিধা চোখের জলটা মুছতে মুছতে কান্নাভেজা গলায় বলে উঠল কে... এসেছে গো.... দিদুন? বলে পিছন ঘুরে দেখল দিদুনের পাশে একজন দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিধার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল ওম..... দাদা......
প্রভাদেবী বলে উঠলেন এই নে তোকে তোর ওম দাদা দিয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি কথা বলে চলে আসিস সবাই তোদের অপেক্ষায় বসে আছে। প্রভাদেবী হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
ত্রিধা দৌড়ে এসে তার ওম দাদার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল এবং সাথে সাথে কান্নার বেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হল। আসলে এতদিন পর নিজের কাছের মানুষ কে কাছে পেয়ে নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারেনি ত্রিধা। তার ওপর মনের মধ্যে প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার একটা ভয়ও জন্ম নিয়েছিল। ওমও তার প্রিয়তমাকে ভালোবেসে বাহুডোরে আবদ্ধ করল।
ত্রিধা কান্নাভেজা গলায় cবলতে লাগল, জানো আমার কত কষ্ট হচ্ছিল ওম দাদা, তোমাদের বাড়িটা দেখে। আমি তো ভেবে নিয়ে ছিলাম তুমি আমাকে ভুলেই গেছো।
ওম নিজের বুক থেকে প্রিয়তমার মুখটা তুলে আলতো করে চোখের জলটা মুছিয়ে দিয়ে বলল আমি কি এই পাগলীটাকে ভুলতে পারি। তোকে ভুলে গেলে যে আমি নিজেকেই ভুলে যাব। আর তোর মুখ থেকে একদম দাদা শুনতে চাইনা আমি। শুধু ওম... বলবি।
ত্রিধা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিয়ে একটু সরে দাঁড়াল। কারন এতক্ষনে ত্রিধা বুঝতে পেরেছে অবেগের বসে কি করে ফেলেছে।
ওম ত্রিধার কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের দুহাত দিয়ে ত্রিধার মুখটা তুলে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল।
ত্রিধা ধীর কন্ঠে বলল, ঐ ভাবে কি দেখছো ওম দাদা।
ওম ত্রিধার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে বলল আমার প্রিয়তমাকে দেখছি। কতদিন এই মুখটাকে দেখিনি। খুব কষ্ট হয়েছেরে তোকে ছাড়া। আর এক মুহুর্তের জন্য আমি তোকে কাছ ছাড়া করবনা। তুই আবার আমাকে দাদা বলছিস। আমি কিন্তু তাহলে তোর সাথে কথা বলবনা।
ত্রিধা আবার লজ্জায় মুখটা নামিয়ে নিল। এবং আস্তে করে বলল আর বলবো না। আসলে ছোট বেলাকার অভ্যাস একটু টাইম লাগবে। আমি চেষ্টা করব। আর বাইরে থেকে সবার একসাথে হাসির আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল।
পূর্ণিমা তাই আকাশে গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে। চারিদিক আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। প্রকৃতিও যেন নিজেকে চাঁদের রূপালি আলোয় সাজিয়ে তুলেছে। আর এদিকে দুটো মনের মধ্যেও হাজার জোনাকির আলো জ্বলে উঠেছে যে আলো এতদিনের জমে থাকা সব কষ্টের অন্ধকারকে দূর করে দিয়ে নতুন করে সবকিছুকে সাজিয়ে তুলবে।
••••••••••••••••সমাপ্ত•••••••••••••••

