ক্রিকেট বিশ্বকাপ আর ধর্ম
ক্রিকেট বিশ্বকাপ আর ধর্ম
বলা হয় আমাদের দেশে ক্রিকেট একটা ধর্ম। ইট ইস এ রিলিজিয়ান। আর বিশ্বকাপ বলতে বুঝতেই পারছেন একটা উৎসব। এই কিছুদিন হল শুরু হয়েছে ওয়ার্ল্ড কাপ। এবারের বিশ্বকাপে বিশেষজ্ঞদের মতে নাকি ইন্ডিয়া ই অনেক এগিয়ে। তা সে সব তোহ খাতায় কলমে। শুরুতেই প্রথম ম্যাচে হার। তার আগে নাকি প্র্যাক্টিস ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধেও হার। বলা বাহুল্য খাতায় কলমে চ্যাম্পিয়ন হওয়া আর মাঠে খেলা অনেক আলাদা।
এবারের নিজের পরিচয়ে আসা যাক। আমি একজন মদ্ধবিত্ত ঘরের ছেলে। চাকরি করছি তিন বছর হল। বেসরকারি একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে। তবে আপাতত আমাকে এ দেশের কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যে একজন ধরতে পারেন।
এই ফার্স্ট টাইম ওয়ার্ল্ড কাপের সময় আমি অফিসে। কাজের চাপ তাই প্রথম ম্যাচ দেখা হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলায় দেখতাম দোকানে দোকানে রাস্তা ঘিরে ভিড়, তাদের মধ্যে বহু লোক ই থাকত যারা কাজের পর বাড়ি ফিরছে। দোকানে বা যেখানেই হোক, রেডিও তে ট্রেনে বসে স্কোরের আপডেট নেয়া। এখন সেই রেডিও বদলে স্মার্ট ফোন হয়ে গেছে। একটু ভাল ইন্টারনেট থাকলে লাইভ ম্যাচ ও দেখা যায় মোবাইলে। যুগ বদলেছে কিন্তু ওয়ার্ল্ড কাপ ম্যাচ কি মোবাইলে দেখতে ভাল লাগে!
আজ ও ইন্ডিয়ার খেলা আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। উইক ডে তাই আজ ও অফিস ছিল। কাজ অল্প সেরে তারাতারি বেরিয়ে পরলাম। বাকি কাজ কাল এসে দেখা যাবে। ডে নাইট ম্যাচ এটা। তাই মিস যাবে না বেশি। এখন পনে একটা বাজে, বাড়ি পৌঁছাতে দুটো শোয়া দুটো বাজবে। খেলা শুরু আড়াইটা থেকে। অফিস থেকে বেরোনোর সময় দেখলাম আমি একা নই। অনেকেই বেরোচ্ছে তখন। বাড়ি ফিরে খাব। বেশ খিদে পেয়েছিল যদিও, কিন্তু কচুরির দোকানে এত ভিড় দেখে আর যেতে সাহস করলাম না। একটু হেঁটে একটা অটো তারপর বাস বা শাটল ধরে বাড়ি।এই সময়টা শাটল কম ই থাকে। দেখি।
অটো এ উঠলাম একটু হেটে গিয়ে। দেখলাম আমার সহযাত্রী দুজন স্কুল পড়ুয়া কিশোর।
“আজকে বিজয়কে ক্লাবে ঢুকতে দেবনা। ও ভীষণ অপয়া... যখন ই ক্লাবে ম্যাচ দেখে ইন্ডডিয়া হারে!" পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠল, “হ্যা ও যেই ঢুকল অমনি এক ওভারে দুটো উইকেট পরে গেল।“
আমার বেশ হাসি পেল আর মজা ও লাগল। ভাবলাম এসব ছেলেখেলা । কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল এখন এসব ভাবছি কিন্তু আগে আমিও এরকম করেছি। শুধু ওয়ার্ল্ড কাপ না , নরমাল ম্যাচেও.. আমার হাতে বই আর ক্রিকেট ব্যাট টা বাড়ির সোফার ওপরে, অথবা সারা ম্যাচ ঘুরে বেড়ানো.. বসা চলবে না। পা ব্যথা হলে ওভার শেষে অল্প শুতে পারো। নিজের মনেই একটু হাসলাম আবার।
বোঝা ই যায় যে ক্রিকেট আমাদের দেশে একটা ধর্মের মতন আর ধর্ম যেখানে তার সাথে টুকিটাকি কুসংস্কার তো থাকবেই। এই নিয়ে ই আছি। এই অপয়া , ক্রিকেট আর ক্লাব ঘর শুনে আমার একজন এর কথা মনে পরে গেল। কমল দা।
আমাদের পাড়ার কমল দা , মাঝ বয়সী ভদ্রলোক, বাজারে একটা সায়া ব্লাউজের দোকান আছে। বেশ মিশুকে মানুষ। ছোট বড় সবার প্রিয়। বয়সে বেশ বড় হলেও দাদা ই ডাকি।সবাই তাই ই ডাকে।এখন ছোট বাচ্চা গুলো ও তাই ডাকে। তা এই কমলদার সাথে ক্লাব এ খেলা দেখা মানে একটা কান্ড।
আজ ও মনে আছে উনি নাকি ইন্ডিয়া শ্রীলঙ্কার কোন একটা ম্যাচ এ একটা ছাগল কে ধরে এনে ক্লাব ঘরের সামনে বেধে রেখেছিল। আর সারা ম্যাচ সেই ছাগল টা চেচিয়ে গেল, কিন্তু কমলদা ওখানেই রাখবে। আর ম্যাচ টা ইন্ডিয়া জিতেছিল ও। তার সব কৃতিত্ব কিন্তু একা কমলদাই কুড়িয়ে নিয়েছিল, “ দেখ এই টোটকা গুলো না করলে, কি জেতা যেত!” , ভেবেই হাসি পায়।
আরেকদিনের ঘটনা বলি। সেদিন আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। দু হাজার তিন বিশ্বকাপ এর ফাইনাল। ক্লাবে সবাই খেলা দেখছি। কমলদা ও ছিল। সেদিন তার টার্গেট ছিল মানিকদা। মানিকদার মানে মানিকদার বাবার একটা ফটোস্টুডিও কাম রিচার্জের দোকান আছে পাড়ার গলির মুখে।মানিকদা ই চালায়। যাই হোক সেদিন বোলিং টা একদমই ভালো করেনি ইন্ডিয়া। সবাই ধরেই নিয়েছিল ইন্ডিয়া হারবে। আর শুরুতেই শচীন এর উইকেট চলে যাওয়ার কারণে আরো হতাশ সবাই। কমলদা কিন্তু কিছু একটা ভেবেই যাচ্ছে।আমরা যারা চিনি কমলদা কে, খেলার সময় ওর দিকে তাকাই না। কি জানি বাবাঃ, তাকালাম আর অমনি দুটো ছয় মেরে দিল, ব্যাস বলবে নোরবিনা আমার দিকে তাকিয়ে থাক। প্রায় এরোমি ঘটল সেইদিন। মানিকদা ক্লাবে ছিলোনা। কোথাও থেকে ফিরছিল, ফেরার পথে ক্লাবের দরজায় উকি মেরেছে স্কোর দেখার জন্য অমনি দুটো ছয়। “এই তুই ওভাবেই থাক” , চেঁচিয়ে উঠল কমলদা। ব্যাস হয়ে গেল মানিকদার বাড়ি যাওয়া। মানিকদার তখন এক পায়ে জুতো, বা হাত টা দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই হেসে উঠেছিলাম।
“কি দাদা হাসছেন? নামবেন না? এটাই লাস্ট” – অটো আলার আওয়াজে আবার বর্তমানে ফিরে এলাম। হ্যা ভাই নামবো, এই যে ভাড়াটা ধরো। বলে অটো থেকে নেমে রাস্তা পার হলাম। ওদিক থেকে একটা শাটল ধরে নেব। দশ মিনিট দাঁড়াতে একটা এলো। বেশিক্ষন দাঁড়াতে হলো না। ভাগ্যটা ভালো। হাত দেখিয়ে দার করালাম। ...“এক নম্বর?” ...“ হ্যা বসুন”। গাড়িতে উঠে বসলাম।
যাই হক আবার দু হাজার তিন এ ফেরা যাক। তিনটে ওভার কেটে গেল। মানিকদা তখন ও একভাবে দাঁড়িয়ে। “ আরে কমলদা বাড়ি ফিরতে হবে.. হাতে রুটি ঠান্ডা হয়ে যাবে!”
“এহ! নোরবিনা একদিন ঠান্ডা রুটি খাবি কিছু হবেনা!” আরো পাঁচ ওভার এরম কাটলো। ঠিকই যাচ্ছিল। প্রত্যেক ওভারে একটা দুটো চার হচ্ছিল। হঠাৎ মানিকদার ফোন বেজে উঠল।
“হ্যালো .. হ্যা আসছি আমি… এই তো রাস্তায়” ফোনটা রেখে আরেকপা এ জুতো পরলো। অমনি একটা রানআউট আপিল। কমলদা কটমট করে তাকালো মানিকদার দিকে। “বেহায়া! কূপমুন্ডকে!” “হ্যা কমল ঠিক! আর সন্ত্রাসবাদিও” , পেছন থেকে পলাশ কাকু বলে উঠল।
“তুই থাম!” কমলদা পলাশকাকুর দিকে তাকিয়ে বলল। মানিকদা তখন জুতো গলিয়ে বেরিয়ে পরেছে ক্লাব থেকে, অমনি লাল আলো জ্বলে উঠল। শেবাগ আউট।
“ঢুকবিনা তুই ক্লাবে আর। ব্যাটা দেশদ্রোহী! আবার হাসছে? কি বেহায়া লোক!” তারপর আর অনেক টোটকা চেষ্টা করেও সেদিন ম্যাচটা আর জেতা হয়নি”
কমলদা মানিকদার দিকে তাকাতো না বেশ কিছুদিন। মানিকদা ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয়নি বলেই মনে করি। সন্ধে বেলা, টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে জগাদার চায়ের দোকানে বসে থাকতে দেখতাম মাঝে মাঝেই, মানিকদা কমলদা আরো কয়েকজন। কমলদা মুখ সিরিয়াস করে মানিকদার উদ্দেশ্যে কিছু বলে আর তার উত্তরে মানিকদা কমলদার ঠাট্টা ওড়ায়ে। এক কি দের মাস পরে কমলদা আবার ঠিক হয়েছিল।
ট্যাক্সি থেকে নামলাম। কিছুটা হাঁটলেই আমার বাড়ি।রাস্তায় এক প্যাকেট মুড়ি আর চানাচুর কিনলাম। দোকানের ভেতরে টিভি চলছে। ইন্ডিয়ার ব্যাটিং লাইনআপ দেখাচ্ছে।জিজ্ঞেস করলাম, “টস হয়েগেছে?”
“হ্যা অনেক্ষন” ... “কে জিতল?” “ভারত এই তো নামছে এক্ষুনি, ব্যাটিং নিয়েছে।” “আরাইটে থেকে শুরু হওয়ার কথা তো?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম। “না না দুটো” .. “সেকি এই নাও জলদি টাকাটা ধর” , বলে দৌড় লাগলাম বাড়ির দিকে।
বাড়ি ঢুকে জুতো টা কোনোরকমে খুলে টিভি অন করলাম। দুটো বল হয়ে গেছে ততক্ষনে। একটা চার... টিভি খুলতেই। বেশ ব্যাপার তো টিভি অন করতেই চার। এক ওভার খেলাটা ওভাবেই দেখলাম। এগারো রান হল। তারপর জামা ছাড়তে ছাড়তে খেলা দেখছি, মুখ টা ধুলাম। ফিরে এসে দেখি একটা আউট। সোফায় বসলাম। খাবার রাখা ছিল, মাইক্রোভেন এ গরম করতে দিলাম। দুই মিনিট এর টাইমার। ভাত আলু ভাজা আর ডিমের ডালনা। এনে টিভির সামনে বসলাম। পর পর দুটো আউট। এক ওভারে এগারো রান থেকে পাঁচ ওভারে ১৫ রানে তিন উইকেট। খাওয়া তাড়াতাড়ি শেষ করলাম, তখন স্কোর আট ওভারে বাইশ রান। নিজের অজান্তেই সোফা থেকে নেমে বসেছি। হাত মুখ ধুইনি। দুটো ভালো ওভার গেল ইন্ডিয়ার পক্ষে। আট রান আর চোদ্দ রান এলো। এখন স্কোর এগারো ওভারে একান্ন রান। মাটিতে শুয়ে খেলাটা দেখতে থাকলাম। বা হাত টা মাথায় ভর দিয়ে। ডান হাতে ডাল ভাত লেগে, শুকিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। এভাবেই দেখতে থাকলাম ম্যাচটা । এভাবে দেখলেই ইন্ডিয়া জিতবে!