Sahana Banerjee

Horror Thriller

3  

Sahana Banerjee

Horror Thriller

ক্রিচর

ক্রিচর

7 mins
323


প্রবল বৃষ্টি কাচা মাটির বুক কেটে মরা পাতার বিসর্জনের রাস্তা বানিয়ে ফেলেছে । বৃষ্টির ঝম ঝম আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না প্রায়। যেমন বৃষ্টি তেমন অন্ধকার। হরিপুরে এরকম রাত অত্যন্ত সাধারণ এক ব্যাপার হলে ও কলকাতা শহরের রাতুল এর কাছে এটা দুর্লভ দর্শন। 

এরকম বৃষ্টি সে কোনো দিন ও দেখেনি আর তার উপর কাদা কাচা মাটির রাস্তা তে চটি পরে হাঁটা ভীষণ কঠিন। বিশেষত সঙ্গে একটা ভারী বস্তা নিয়ে। 


রেনকোট পরা রাতুল মাঝে মধ্যেই নিজের টুপি টা নিচের দিকে টান মেরে মুখ টা কে ঢেকে রাখছে। অজস্র বৃষ্টি তে ও তার মুখের দিকে আলো পড়লে যে কেউ তার বুকের ভয় তার চোখে দেখতে পারবে, সেই ভয় টা সে টুপি দিয়ে ধামাচাপা দিতে চায় । মাটিতে টানতে টানতে নিয়ে আসা সেই বস্তা টার তলা তে লাল রং টা কি ? বলা কঠিন। সাইকেল নিয়ে বেরা বাবু তার পাস থেকে পার হওয়ার সময় টর্চলাইটের আলতো আলোয় সেটা দেখে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন - 

" কি রে রাতুল নাকি!! এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাচ্ছিস" 


থমকে রাতুল বলল, " কোথাও না কাকু, আসলে কাল ভোরে রওনা দেব তাই বাড়ির ময়লা গুলো ফেলতে যাচ্ছিলাম।" 


"হুঁ... বুঝলাম। তবে ওই খালের কাছে যাস না আবার যেন।" 


এই বলে বেরা বাবু নিজের পথে চলে গেলেন। 


রাত সবে 8.30 কিন্তু এরমধ্যে ই রাস্তা ঘাট ফাঁকা। এটা ই সুযোগ রাতুল এর কাছে, পুরোনো প্রাইমারি স্কুলের পাশের খাল টার কাছে যাওয়ার । স্কুল টার কাছে এসেই গেছে, ব্যেস আর দু পা হলেই খাল। 


স্কুলের পাশেই দোলোই বাবুর ঘর, উনি গ্রামের হাই স্কুলের শিক্ষক। এত বৃষ্টি তার উপর পাওয়ার কাট এর জন্য উনি ঘুমোতে পারছিলেন না। নিজের বারান্দায় আরাম চেয়ার এ বসে মোমবাতির আলোয় একটা বই পড়েছিলেন কি এমন সময়ে হঠাৎ একটা আওয়াজ যেন বৃষ্টির আওয়াজ ভেদ করে এল। কিছু একটা উনার বাড়ির পাশের খালে পড়েছে, কিছু ভারী। 

উনি ভাবলেন গাছের ডাল। এ ভেবে আবার নিজের বই তে মনোযোগ দিতে না দিতে আরেক আওয়াজ। তবে এবার আওয়াজ টা একটু চেনা। উনি একটু নড়ে চড়ে বসলেন । বিজ্ঞান এর শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও অলৌকিক জগৎ সম্পর্কে 

অপরিচিত ছিলেন না হরি বাবু । তাই উনি খুব ভাল করে জানতেন কি ওই খাল টার পাশে কী আছে । শুধু সেই কারণেই প্রাইমারী স্কুল টা বন্ধ করতে হয়েছিল এবং গ্রামের সকলেই এ কথা জানতেন এবং মানতেন। 

স্কুলের পেছনের দিকে, খালের পাশে ছিল এক ছোট্ট মাঠ। সেটা দোলোই বাবু দের পৈত্রিক শ্মশান মাঠ। ওখানে রাত বিরেতে যাওয়া নিষেধ। 


দোলোই বাবু নিজের দাদু কে ভীষণ ভালবাসতেন। উনি মাত্র আট বছরের ছিলেন যখন তিনি গত হোন। বিরহ সহ্য করতে না পেরে দাদু কে দেখবে বলে ছোট্ট হারু রাত্রে লুকিয়ে চলে যায় সেই শ্মশান মাঠে। সেই রাতে ও অজস্র বৃষ্টি তে বয় যাচ্ছিল গ্রাম। 


ছোট্ট হারু একটা ছোট্ট টর্চ নিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। দূর থেকে অস্পষ্ট হলে ও শব্দ গুলো বেশ স্পষ্ট, মনে হচ্ছিল যেন কোনো জানোয়ার গোগ্রাসে কিছু খাচ্ছে। মাঠের কাছে পৌঁছাতেই থমকে দাঁড়ালো হারু, সামনে যা দেখছে তা সত্যি কি তার অতি প্রবল কল্পনার ফল সে বুঝতে পারছে না। 


অন্ধকারের চেও কালো তার গায়ের রঙ আর হলুদ চোখের ভেতরে লাল পুতি। চার পেয়ের মত দৃশ্যমান হলেও সে যে চার পেয়ে নয় তা আট বছরের হারু ভাল করেই বুঝতে পারছে। দাদুর চিতা তখন ও নিভে যায় নি আর ওই চিতার ভেতরে সেই পরক প্রাণী নিজের এক হাত ঢুকিয়ে কি যেন টেনে বের করছে। 


এই ভয়ানক দৃশ্য থেকে হারুর ছোট্ট শরীর যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তার গলা যেন শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিজের হার্ট বিট আর সেই প্রাণীর ক্ষুধার্ত হুঙ্কার ছাড়া সে আর কিছুই শুনতে পারছে না। তার টর্চলাইট এখনও সেই প্রাণীর মুখের দিকে। হঠাৎ সেই প্রাণী নিজের অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তন করতে লাগল। সে আস্তে আস্তে নিজের হাত চিতা থেকে বের করে উঠে দাঁড়াল আর তার মুখ কে অনুসরণ করছে হারুর টর্চলাইট আর চোখ। তার বিশাল কায়া দেখে শিথিল হওয়া হারুর হাত থেকে টর্চ টা মাটি তে পরে গিয়ে গড়া গড়ি খাচ্ছে, আর সেই আলোতেই দেখা যাচ্ছে এক এক পা করে এগিয়ে আসছে সেই প্রাণী। 


ইতি মধ্যে হারুর বাবা আর কাকু গ্রামে তাকে খুঁজছে, হারুর মায়ের অনুরোধে তারা চার পাঁচ জন শ্মশানের দিকে যাওয়া স্থির করে। দেরী না করে তারা শীঘ্রই সে দিকে রওয়ানা দেয় । সেখানে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তাদের একত্র টর্চলাইটের আলো তে তারা হারু কে দেখতে পায় আর দেখতে পায় সেই পরক প্রাণীর ক্রমশ এগিয়ে আসা ছায়া। হারুকে জাপটে ধরলো তার কাকা আর কোলে তুলে সকলে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে পালায় সেখান থেকে। 


সে রাতের ঘটনা আজ ও হরি দোলোই এর স্মৃতি তে জলের মত স্পষ্ট আর সেই খালের আওয়াজ এ সেই স্মৃতি আবার যেন নাড়া দিয়ে উঠেছে। 50 বছরের হরি স্যার হঠাৎ আট বছরের হারু হয়ে গিয়েছে। 

আলতো করে মোমবাতি টা নিভিয়ে গুটি পায়ে তিনি শোয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে সকালে প্রথমেই তিনি খালের কাছে গিয়ে দেখবেন ঘটনা টা কী, এখন রাতে সেদিকে যাওয়ার কোনো যুক্তি হয় না। 


পরের দিন সকালে উঠোনে ব্যায়াম করতে বেরিয়ে গ্রামের মানুষের কোলাহল শুনতে পান হরি বাবু। নিঃসন্দেহে সেটা খালের কাছ থেকে। রাত থেকে নিজের উৎসুক মন কে বুঝিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু আর নয় । হন্যে হয়ে তিনি পায়ে কোনো রকমে চটি গলিয়ে এগিয়ে গেলেন খালের দিকে। 


খালের কাছে পৌঁছোতে না পৌঁছাতেই সেই ছোটো বেলার স্মৃতি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেই ঘটনার পর হরি বাবু সেদিকে শুধু নিজের বাবার দাহ করতে গেছিলেন দশ বছর আগে। ওই প্রাণী কে আর কেউ কোনো দিন দেখতে পায়ে নি ওই ঘটনার পর কিন্তু মাঝে মধ্যেই খালের পাশে মরা পশুর হাড় কঙ্কাল পাওয়া যায়। একবার পাশের বাড়ির রাধা বাবুর ছেলের খেত থেকে ফিরতে রাত হয়েছিল। সে অনিচ্ছুক হলেও তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর জন্য ছোটো রাস্তা দিয়ে আসছিল যেটা সোজা স্কুলের পেছন দিয়ে এবং সেই শ্মশান এর মাঠের উপর দিয়ে যায়। সেখান থেকে আসার সময় সন্ধের আলতো আলোয় খালের জলে কিছু লক্ষ্য করে থমকে দাঁড়ায় সে। সেই রাক্ষস এর গল্প সে জানে কিন্তু চোখে কোনো দিন দেখে নি বলে তার কাছে সব টা ই রূপ কথা তবে সেদিন খালের জলে অস্থিরতা দেখে তার বুকের ভেতর টা যেন হিম হয়ে যাচ্ছে। নিজের মন কে বুঝানোর চেষ্টা করে সে - " কোনো মাছ বা বড় সাপ টাপ হবে", এই ভেবে সে পেরোতে যাবে কি হঠাৎ চোখের কোন থেকে সে দেখতে পায় দুটো বড় হলুদ জ্বলজ্বল করা চোখ, আস্তে আস্তে নিঃশব্দে এগোচ্ছে, জলের ভিতরে তার শরীর। সে দিকে ঘুরে তাকানোর সাহস হয় নি তার, রাম নাম করে ছুটে পালায় সে আর কোনো দিন ও সেদিকে যায় নি। 


খালের কাছে পৌঁছাতেই এক ভয়াবহ দৃশ্য হরি বাবু কে গ্রাস করলো। তিনি অনুমান করেছিলেন কোনো পশুর ছিন্ন মৃত দেহের কিন্তু যা দেখলেন তাতে ওনার আর কোনো সন্দেহ নেই মনে যে অত বছর আগে তিনি যা দেখেছিলেন সেটা কোনো প্রাণী নয় সেটা সাক্ষাত অসুর! 


সামনে পড়ে ছিল এক বস্তা, রক্তে মাখা। বস্তার ভেতরে আধা খাওয়া দুটো পা খুব সম্ভবতঃ এক কুকুরের, তার কিছু টা দূরে আধ খাওয়া মাথা টা আর ঠিক তার পর খালের পাশে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রাতুল এর ছিন্ন মস্তক!!! 

কেউ যেন দু হাত দিয়ে টেনে ছিড়ে ফেলেছে তার মাথা, দেহের কোনো চিহ্ন নেই কোথাও, শুধু পড়ে আছে মাথা টার পাশে বাম পায়ের ছেঁড়া স্যান্ডেল। 


গ্রামের পঞ্চায়েত সব টা ই জানেন তবুও পুলিশ কে তো জানাতেই হবে। পুলিশ তদন্তের পর জানা যায় রাতুল হরিপুরে ডীমনোলোজী নিয়ে রিসার্চ করতে এসেছিল এক দু সপ্তাহ আগে। 42 বছর আগের ঘটনার ব্যাপারে সে জানতে পারে আসে পাশের লোকের কাছে। এটা ও জানতে পারে যে মাঝে মধ্যে সেখানে জন্তু দের অবশেষ পাওয়া যায়। সে মাঝে মাঝে সেখানে ফটোগ্রাফি করতে ও যেত। তার ল্যাপটপ এ এক ফুটেজ পায় পুলিশ। দেখে স্পষ্ট যে ক্যামেরা সারা রাত খালের পাশে রাখা ছিল রেকর্ডিং অন করে। দু তিন দিন ধরে রেকর্ড করেছে সে। তৃতীয় দিনের ফুটেজ ছিল রাতুল এর মৃত্যুর আগের রাতের। 

ভিডিও তে তারা দেখেন রাত বারোটা নাগাদ, খালের জলের ভেতর থেকে রাতের অন্ধকারের থেকে ও কালো এক প্রাণী ভেসে উঠছে। তার হলুদ চোখ জ্বলজ্বল করছে তার মধ্যে লাল মণি অনেক টা সাপের মত। জল থেকে চার পেয়ের মত বের হলেও দু পেয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। কিছু ক্ষণ পরে সে ক্যামেরার কভারেজ থেকে বেরিয়ে গেল। তার কিছু ক্ষণ পরে সে আবার দেখা দিল তবে এই বার তার হাতে এক গরুর আধা শরীর যেটা নিমেষে গিলে ফেললো! আর আবার খালের জলে তলিয়ে গেল । 


রাতুল ডায়েরি ও রাখত। সেই ডায়েরি তে তার লাস্ট এন্ট্রি :


"রাতের ফুটেজ দেখে আমার মাথা ঘুরে গেছে। ডীমন্স আর রিয়েল!! আজ রাতে সাক্ষাত করার সাহস করব। আমি পড়েছি ডীমন্স কে তার পছন্দের খাদ্য দিলে সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। আমার অপেক্ষা এবার শেষ, চার বছর ধরে কোমা তে থাকা আমার শ্রেয়া কে আমি আবার সুস্থ দেখতে পারব। শুধু তার জীবন টা সে ফিরে পাক এই আমার কাম্য। "


ঘটনা বোঝার আর কিছু বাকি নেই। কেস ক্লোজ করে দেওয়া হয়। তবে কৌতুহল হেতু ইন্সপেক্টর সুজন চৌধুরী শ্রেয়া কে ট্র্যাক ডাউন করে হতবাক হয়ে যান। 4 বছর কোমায় থাকা শ্রেয়া এখন সুস্থ এবং সবল। ডাক্তাররাও আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন যখন চার দিন আগে শ্রেয়া হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পায়, 

চৌধুরী : ডক্টর, এটা কি স্বাভাবিক? চার বছর কোমায় থাকা রোগী পুরোপুরি নর্মাল? 


 ডক্টর : একদম ই না! শ্রেয়া একটা মিরাকেল! এত সময়ে প্যারালাইজ্ড থাকার পর হাঁটা চলা করা অসম্ভব কিন্তু শ্রেয়ার জ্ঞান ফেরার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে লাগে। এরকম কেস আমি কখনো দেখি নি আর না দেখলে বিশ্বাস ও করতাম না! 

"


চার দিন আগেই তো রাতুল গেছিল খালের কাছে বস্তা তে মরা কুকুর নিয়ে ডীমনের সাথে ডিল করতে, এটা কি কাকতালীয় না সত্য ?!


এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাবেন নাকি?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror