কল্পনা এবং বাস্তব ।
কল্পনা এবং বাস্তব ।
মাইকে সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নামটা বলতেই সবাই অবাক হয়ে গেলাম। ঠিক শুনছি তো? অমলেন্দু স্যার গুটি গুটি পায়ে এসে আমাদের পিঠে হালকা চাপড় মেরে বললেন,.....
----কিরে, …..বলেছিলাম না তোরা পারবি। আজ সাধনপুর স্কুল জেলার সেরা হয়েছে।
স্যারের কথা গুলো শুনে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছিলাম। অনেকেই চোখে জল চলে এল। ভাবতেই পারছিলাম না যে আমরা করে দেখিয়েছি। আমরা সত্যিই পেরেছি।
সাধনপুরের এই স্কুলে ছাত্র সংখ্যা খুব কম, হাতে গোনা। এলাকায় এই স্কুলের সুনামের থেকে বদনাম বেশী। যত বখাটে ছেলেরা নাকি এই স্কুলে। তবে কথাটা খুব একটা মিথ্যে নয়। রোজই ঝুট ঝামেরলা মারামারি লেগেই থাকে ওদের মধ্যে। হেডমাস্টার নিত্যানন্দ গোস্বামী এদের নিয়ে একপ্রকার নাস্তানাবুদ। অভিযোগের পর অভিযোগ পরে চলে এদের নামে। বেশি কিছু বলাও যায় না। এদেরকে বুঝিয়েও লাভ ও হয় না। লাগাম ছাড়া বুনো ঘোড়ার মতো দাপিয়ে বেড়ায় এরা।
এই তো ক- মাস আগের কথা। অঙ্কের স্যার নিতাই বাবু বোর্ডে নল ও চৌবাচ্চার অঙ্ক সেখাচ্ছিলেন। সবাই মনযোগ সহকারেই বোর্ডের দিকে তাকিয়ে। এদিকে কমল লাস্ট বেঞ্চে বসে বিশুর সাথে মুখ চাপা দিয়ে ফিসফাঁস করে যাচ্ছে। আগামীকাল উত্তরপাড়ার মাঠে ফুটবল প্রতিযোগিতা আছে। তাই নিয়েই ওদের গুজ গুজ চলছে। ব্যাপারটা নিতাই স্যারের চোখ এড়ায়নি। এমনিতে তিনি শান্ত স্বভাবের কিন্তু ক্লাস চলাকালীন কেউ অমনোযোগী হলে বেত্রাঘাত অবশ্যম্ভাবী। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সবার সামনেই নিতাইবাবু কমল ও বিশুকে বেশ কয়েকটা বেত্রাঘাত করে কানধরে দাড় করিয়ে দেয়। ফলস্বরুপ পনেরদিনের মধ্যেই নিতাইবাবু মাথায় আধলা খেয়ে হসপিটালে ভর্তি হলেন। তিনমাস পর মাথাটা আটটা সেলাই নিয়ে অবসর গ্রহণ করলেন।
অমলেন্দু ভট্টাচার্য এলেন এই স্কুলে আমাদের নিতাই স্যারের জায়গায় অঙ্কের স্যার হয়ে। ইয়াং, অবিবাহিত, পিছুটানহীন অমলেন্দুর স্যারের তিন কুলে কেউ নেই। কলকাতায় থাকেন। থার্ড পি
রিয়ডে হেডস্যার নিত্যানন্দবাবু সাথে করে ক্লাসে এনে পরিচয় করে দিয়ে গেলেন। প্রথম দিনেই অমলেন্দু স্যার আমাদের মন জয় করে নিলেন। কলকাতা থেকে যাতায়াতের অসুবিধার জন্য সাধনপুরে একটা ঘর নিলেন। আমাদের কুন্তল ই ঘরটা দেখে দিল। দৈনন্দিন বাস্তব সমস্যার মধ্যে ফেলে অঙ্ক শেখাতেন বলে সবাই চট করে তা ধরতে পারতাম। অঙ্কের মত বিষয় গুলিকে নিজের মতো করে তিনি ভাবতে শেখান, কল্পনা করতে শেখান।
তিনি বলতেন,...
----আজ যেখানে বাস্তব, একসময় তা ছিল কল্পনা। কল্পনার ডানায় ভর করে আজ সে দাঁড়িয়ে বাস্তবের মাটিতে।
তিনি স্যার এর থেকে দাদার ভূমিকা পালন করায় নির্দ্বিধায় সব রকম সমস্যার কথা তাকে বলতে পারতাম। ফলস্বরূপ বার্ষিক পরীক্ষায় দু এক জন বাদে সবার রেজাল্ট তাক লাগানোর মত হয়েছিল।
বুঝতে পারছিলাম,....... বেত নয়, অমলেন্দু স্যারের জাদুকাঠীর ছোঁয়ায় আজ আমরা এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি।
সেদিন স্কুলে স্কুল ইন্সপেক্টর এসেছিলেন। সবকটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে তিনি বেজায় খুশি। জানালেন পরের মাসেই জেলায় বিজ্ঞান মেলা। অংশগ্রহণ করা চাই। হেডস্যার অমলেন্দু স্যারকেই ভার দিলেন। অমলেন্দু স্যার আমাদের পনের দিন সময় দিলেন কল্পনা করে কোন দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে এমন একটা বৈজ্ঞানিক মডেল তৈরির জন্য।
অনেক চিন্তা ভাবনার পর লবনের আদ্রতা শুষে নেওয়ার গুনকে কাজে লাগিয়ে আমরা এমন একটা মডেল বানালাম যেখানে বায়ুমন্ডলে আদ্রতা বেড়ে গেলে লবন সেই আদ্রতা শুষে নিয়ে আদ্র হয়ে যায়। এবং তার মধ্যে দিয়ে সহজেই তড়িৎ প্রবাহিত হয়। কল্পনার হাত ধরে সেই মডেল আজ তার পূর্ণতা পেয়েছে আমাদের সবার একত্রিত ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। সাধনপুর স্কুলের মডেল আজ জেলার সেরা মডেল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
অমলেন্দু স্যার যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন এই কাজে। হয়তো উনি না থাকলে এই দুঃসাহস আমরা দেখাতেই পারতাম না।