সৃষ্টির গল্প

Abstract Horror Children

2.6  

সৃষ্টির গল্প

Abstract Horror Children

কলকাতার গলিতে

কলকাতার গলিতে

10 mins
199


বিশ্বনাথ পাড়াগাঁয়ের ছেলে।ঘুটঘুটে অন্ধকারে দুপুররাত্রে বাঁশবনের ভেতর দিয়ে সে তিন ক্রোশ অনায়াসে বেড়িয়ে আসতে পারে। অমাবস্যায় গ্রামের সীমানার শ্মশান থেকে মড়া পোড়ানো কাঠ সে কতবার বাজি ধরে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ভয় তার শুধু কলকাতা শহরকে। যেখানে দু’পা এগুতে হলে মানুষের গায়ে ধাক্কা লাগে, ইলেকট্রিক

আর গ্যাস লাইটের কল্যাণে যেখানে দিন কি রাত চেনবার জো নেই বল্লেই হয়, সেইখানেই একরাতে সে যা বিপদে পড়েছিল। বিশ্বনাথ বলে, ‘না, কলকাতা শহরে সন্ধ্যার পর বেরুনো নিরাপদ না।' আমরা হেসে উঠলে বলে, 'না হে না, চৌরঙ্গি, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ- এর কথা বলছি না। কলকাতাটা আগাগোড়া চৌরঙ্গি নয়। শোন তাহলে— ‘সেবার গাঁয়ের লাইব্রেরির জন্যে বই কিনতে কলকাতা গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম একদিন থেকেই বইপত্র সব কিনে রাত্রের ট্রেনে বাড়ি চলে আসব। কিন্তু কলকাতায় গেলে নতুন বায়স্কোপ থিয়েটার না দেখে কেমন করে ফেরা যায়। প্রথম দিনটা তাতেই কেটে গেল। দ্বিতীয় দিনে কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে বই-টই সব কিনে ফেল্লাম। সঙ্গে বিছানাপত্রের বা তোরঙ্গ-বাক্সের ঝঞ্ঝাট ছিল না। শুধু একটি সুটকেস, তাতে বইগুলো ভরে একেবারে সোজা শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে উঠলেই হ'ত। কিন্তু হঠাৎ কি খেয়াল হল, একবার অবিনাশের সঙ্গে দেখা করে যাই।


অবিনাশ আমাদের গ্রামের ছেলে। স্কুলে আমার সঙ্গেই পড়াশুনা করেছে। কলেজেও কয়েক বছর আমরা একসঙ্গে পড়েছিলাম। অবিনাশ বেশিদিন অবশ্য কলেজে থাকেনি। অত্যন্ত খেয়ালী ছেলে— কোনও কাজে বেশিদিন লেগে থাকবার মত ধৈর্য তার ছিল না। ছেলেবেলা থেকেই কেমন যেন তার উড়ুউড়ু ভাব। বাড়ি থেকে যে কতবার সে ছেলেবেলায় পালিয়ে গেছে তার ঠিকঠিকানা নেই। বড় হয়েও তার সে স্বভাব কাটেনি। কথা

নেই, বার্তা নেই— হঠাৎ একদিন হয়ত আমরা শুনলাম অবিনাশ হেঁটে সেতুবন্ধ যাবার জন্যে বেরিয়ে পড়েছে। তারপর হয়তো দু'মাস তার দেখা নেই। আমরা কোন রকমে প্রক্সি দিয়ে হয়ত সেবার তার কলেজের খাতায়

কামাই-এর সংখ্যা কমিয়ে রাখলাম, কিন্তু এমন করে কতদিন রাখা যায়? বছরের শেষে এক্‌জামিনেশনের সময় দেখা গেল অবিনাশ আমাদের প্রক্সি দেওয়া সত্ত্বেও কলেজে এত কম দিন এসেছে যে তার পরীক্ষা দেওয়ার

অনুমতি পাওয়া অসম্ভব। আমরা দুঃখিত হলাম। ছেলেটা এত আমুদে মিশুকে ছিল যে আমরা সবাই তাকে ভালবাসতাম। কিন্তু অবিনাশের যেন স্ফূর্তিই হল। বল্লে, ‘তবে আর কি? ভাই, বর্মাটা একবার ঘুরে আসি।'

তারপর অবিনাশের আর দেখা নেই। আমাদের চেয়ে তার ধাতই ছিলআলাদা। পৃথিবীটা যে মস্ত বড় এই আনন্দেই তার মন ভরপুর হয়ে থাকত।


পৃথিবীর এই বিশালতাকে দেশে দেশে নতুন পথে ঘুরে ঘুরে উপভোগ করে তার আশা আর মিটতে চাইত না। যেসব দেশ সে এখনো দেখেনি তার আকর্ষণের কথা সে মাঝে মাঝে এমন তন্ময় হয়ে বলত যে আমাদেরও

কখনও কখনও মোহ ধরে যেত— কেমন যেন মনে হত এই ছোট্ট শহরের ছোট্ট জানা কটি রাস্তায় দুবেলা যাওয়া আসায় জীবনের কোন সার্থকতাই নেই,—পথ যেখানে অফুরন্ত, আকাশের যেখানে কূল-কিনারা নেই, এমন

জায়গায় বড় করে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে না পারলে যেন বাঁচাই বৃথা। কিন্তু আমাদের এই ক্ষণিক মোহ অবশেষে খানিক বাদেই কেটে যেত,কিন্তু অবিনাশের এই মোহই ছিল সব।

মাস-তিনেক আগে আমার গ্রামের ঠিকানায় এই অবিনাশের একটা চিঠি পেয়েছিলাম বহুদিন বাদে। একটা গলির ঠিকানা দিয়ে লিখেছিল যে,অনেক জায়গা ঘুরে ফিরে সে কলকাতায় এই ঠিকানায় আপাততঃ আছে।


আমি এসে তার সঙ্গে যেন দেখা করি। এতদিন বাদে তাকে সেই ঠিকানায় পাওয়া হয়ত যাবে না জেনেও একবার যেতে ইচ্ছে হল। বাড়ির নম্বরটা ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু গলিটা মনে ছিল। ভাবলাম কলেজ স্ট্রিট থেকে বেশি দূর হবে না। ট্রেনেরও এখন দেরি আছে। একবার দেখা করেই যাই, যদি তাকে পাওয়া যায়।

একটু খোঁজাখুঁজির পর একটা গলিরাস্তায় ঢুকে একজনাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, আর একটু গেলেই অবিনাশ যে গলিতে থাকে তা পাওয়া যাবে।

রাত তখন বেশি নয়। বড়জোর আটটা হবে। কিন্তু গলি দিয়ে খানিক দূর হেঁটেই একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম। গলিই হোক আর যাই হোক,কলকাতার পথ ত বটে। অথচ এই আটটা রাত্রে সেখানে একটি জনপ্রাণি

নেই। ভেবেছিলাম খানিকদূর গিয়ে আবার কাউকে পথ জিজ্ঞাসা করব। কিন্তু লোক কোথায়? তা ছাড়া গলিটাও ফুরোতে চায় না। একবার সন্দেহ হল, হয়ত ভুলপথে এসেছি। কিন্তু যে লোকটা আমায় খবর দিয়েছে, আমার ভুল পথ দেখিয়ে তার লাভ কি? নির্জন রাস্তায় চুরি-ডাকাতি? কিন্তু আমার কাছে কি এমন লাখ পঞ্চাশ টাকা আছে যে

চোরদের ষড়যন্ত্র করতে হবে? আমার সাজপোশাক দেখে বড়লোক বলে ভুল করবার কোনও সম্ভাবনা নেই। তবে? আরো খানিকটা এমনি করেএগিয়ে গেলাম। পথ তেমনি নির্জন, বাতিগুলোও কি এ পথের মিটমিটে হতে হয়! একে গ্যাস-পোষ্টগুলো অত্যন্ত দূরে দূরে, তার ওপর কি কারণে জানি না আলো তাদের এত ক্ষীণ যে রাস্তা আলো হাওয়া দূরের কথা সেগুলো জ্বলছে বুঝতে কষ্ট হয়।


খাস্ কলকাতার ভেতর এমন রাস্তা আছে কে জানত। দুপাশের বাড়িগুলো যেন মান্ধাতার আমলের তৈরি। কোনও রকমে হাড়-বেরুনো ইট-কাঠের জীর্ণ দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। না আছে কোন বাড়িতে একটা আলো, না জনমানুষের একটু শব্দ। সে রাস্তার পাশে সারের পর সার পোড়ো বাড়ির মত সব খাঁ-খাঁ করছে।

ক্রমশঃ মনে হল একটা কেমন যেন ভ্যাপ্‌সা গন্ধ নাকে আসছে। বহুদিন আলো-বাতাস যেখানে ঢোকেনি, মানুষের বাস যেখানে বহুদিন ধরে নেই, এমনি ঘরে ঢুকলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়, গলিটায় ঠিক সেই রকম

একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। লোকটা বলেছিল, কিছু দূর গেলেই ডাইনে গলি পাওয়া যাবে। কিন্তু

জনমানুষহীন জীর্ণ বাড়ির সারের ভেতর ডাইনে-বাঁয়ে কোথাও কোনও পথ নেই।

সামনের পথও খানিক দূর গিয়ে দেখলাম বন্ধ। যে পথে ঢুকেছি,

গলিটার ওই একটি মাত্রই পথ তাহলে বেরুবার রাস্তা! আশ্চর্য ব্যাপার,

লোকটা মিছিমিছি আমায় ভুল পথ দেখাল কেন?

সেখান থেকে ফিরলাম। গলিটা যেন আরো অন্ধকার মনে হচ্ছিল।

এতক্ষণ যে গ্যাসগুলো মিটমিট করে জ্বলছিল, তারই কটা একেবারে

নিভে গেছে দেখলাম। মনে হল, এ গলি থেকে বেরুতে পারলে বাঁচি।

ভীতু আমি নই, কিন্তু কলকাতা শহরের ভেতর এমন অভাবনীয় ব্যাপার

দেখে গা-টা কেমন ছম্‌ছম করছিল।

সবে তো প্রথম রাত। কলকাতা শহরের সমস্ত রাস্তা এখন লোকজনে

গাড়িঘোড়ায় মানুষের শব্দে গগম্ করছে। অথচ এই পথটা কেমন করে

এখন নির্জন নিস্তব্ধ হয়ে গেল! মনে হল, আমি যেন বহুকালের প্রাচীন

একটা শহরে এসে পড়েছি। সে শহরের লোকজন বহুকাল আগে বাড়ি-

ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কত বছর যে মানুষের পা সে শহরে পড়েনি,

কেউ যেন জানে না। আমিও যেন প্রথম সে শহরের নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলাম।

খট্‌খট্‌খট্‌—আমার নিজের পায়ের শব্দ অদ্ভুত ভাবে নির্জন অন্ধকার

বাড়িগুলোর দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আমার চোখের ওপরই কটা

রাস্তার বাতি দপ্‌দপ্ করে নিভে গেল। ভ্যাপ্‌সা গন্ধটা ক্রমশঃ যেন বেড়ে

গিয়ে অসহ্য মনে হচ্ছিল। না, এ গলি থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে

পড়তে পারি ততই মঙ্গল। কাজ নেই আর অবিনাশের খোঁজ করে। পরে

একদিন আবার আসলেই হবে।

খানিকদূর গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এদিকেও গলির পথ যে বন্ধ। কিন্তু তা কেমন করে হতে পারে? আমি একটা পথে যে গলিতে

ঢুকেছি, এ বিষয়ে ত কোন সন্দেহ নেই। এ গলি দিয়ে এগুবার সময়ে আশপাশে কোনও পথই দেখতে পাইনি। তা হলে গলির দু’মুখ বন্ধ কেমন

করে হয়?

ভাবলাম, হয়ত আরো একটা পথ ছিল। যাবার সময় আমার দৃষ্টি

কোন রকমে এড়িয়ে গেছে, এখন আসবার সময় ভুল করে সেইটিতেই

ঢুকে পড়েছি। সেইটেরই মুখ এখানে বন্ধ। কিন্তু এরকম ভুলই বা হবে

কেমন করে? আমি অন্যমনস্ক হয়ে ত ছিলাম না। আগাগোড়াই ত সজাগ

হয়ে চলেছি। রাস্তায় লোক না থাক, একটা বাড়িতে যদি একটা আলো

দেখা যেত! না হয় ডেকেই জিজ্ঞাসা করতাম!

যাই হোক, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই জেনে আমি আবার

ফিরলাম। গলি থেকে বেরুতে হবেই। আবার সেই নির্জন অন্ধকার গলি

দিয়ে শুধু নিজের পায়ের শব্দ শুনতে শুনতে এগিয়ে চললাম। গলিটা যেন

ক্রমশঃ দীর্ঘই হয়ে চলেছে। আমার অজান্তেই কে যেন ইতিমধ্যে সেটা

বাড়িয়ে আরো লম্বা করে দিয়েছে।

এবারও যখন দেখলাম গলির মুখ বন্ধ, তখন সত্যই বুকের ভেতরটা

কেমন করে উঠল। একে আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক। ফাঁকা আকাশ ফাকাঁ

মাঠের মধ্যে মানুষ হয়েছি। শহরে এলে অমনিই আমাদের হাঁফ ধরে। তার

উপর এই ভ্যাপসা গন্ধভরা অন্ধকার গলি— চারিদিক থেকে সে যেন

আমাকে জেলখানার মত বন্দি করে ফেলবার ষড়যন্ত্র করছে। ওপরে চেয়ে

যে একটু আকাশ দেখতে পাবো তারও জো নেই। এমন একটা ধোঁয়াটে

কুয়াশায় বাতাস আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তার ভেতর দিয়ে একটা তারাও

দেখা যায় না।

যত এই অদ্ভুত ব্যাপার ভাবছিলাম, মাথাটা ততই গুলিয়ে আসছিল।

কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। সুটকেসটা বইয়ের ভারে বেশ

ভারীই ছিল। সেটা বয়ে বেশ ক্লান্তই নিজেকে মনে হচ্ছিল। এমনি করে

আর খানিকক্ষণ ঘুরতে হলে ক্লান্তিতেই তো বসে পড়তে হবে।

হঠাৎ বুকটা ধড়াস্ করে উঠল। দূরে একটা মিট্‌মিটে বাতির তলায়

একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে না? তাড়াতাড়ি সেই দিকে এগিয়ে গেলাম—

এই তো আমাদের অবিনাশ! এতক্ষণের ভয়-ভাবনা নিমেষে ভুলে গেলাম।

আনন্দে চীৎকার করে তার নাম ধরে ডাকতেই সে চমকে তাকাল।

বল্লাম, ‘কী আশ্চর্য, তোর খোঁজ করতেই এই এক ঘণ্টা এই গলির ভেতর ঘুরে হয়রান হচ্ছি যে! বাবা, কি অদ্ভুত গলিতে থাকিস্ তুই!

ঢুকে আর বেরুনো যায় না!'

অবিনাশ একটু হেসে বল্লে, ‘এসেছিস্ তাহলে ঠিক!’

বল্লাম, ‘এসেছি আর কই, তোর দেখা না পেলে এই গলির ভেতর

তোর বাড়ি কি খুঁজে বার করতে পারতাম!'

সেকথার কোন উত্তর না দিয়ে অবিনাশ বল্লে, ‘আমায় তা হলে তোর

মনে আছে ভাই!'

‘মনে থাকবে না কেন রে?’

‘না ভাই, মনে থাকে না। অথচ মানুষ যেটুকু মনে করে রাখে তার

ভেতরই আমরা বেঁচে থাকি।'

আমি হেসে বললাম, ‘ছিলি ত ভূপর্যটক, আবার দার্শনিক হলি কবে

থেকে? যাক, এখন তোর বাড়ি চল দেখি। তোর সব গল্প শুনতে চাই।'

অবিনাশ কেমন যেন একটু নিরুৎসাহ হয়ে বল্লে, ‘আমার বাড়ি! আচ্ছা

চল। আমার চিঠি পেয়েছিলি?’

‘হ্যাঁ, সে ত তিন মাসে আগে!'

‘তোর জন্যে কতদিন অপেক্ষা করেছিলাম। তারপর আবার বেরিয়ে

পড়েছিলাম।'

‘আবার! তা হলে ফির্লি কবে?’

অন্যমনস্কভাবে অবিনাশ বল্লে, ‘এই আজ।'

‘এই আজ? এবারে গেছলি কোথায় ??

‘বলছি চল।’

সেই নির্জন গলি দিয়েই তখন আমরা এগিয়ে চলেছি। কিন্তু আর

তখন আগের কথা কিছুমাত্র মনে ছিল না।

অবিনাশ বলতে লাগল, ‘এবারে ভাই গেছলুম বহুদূর। খিদিরপুরের

ডকে বেড়াতে বেড়াতে একদিন সুন্দর একটি জাহাজ দেখলাম। সুন্দর

বলতে নতুন মনে করিসনি যেন। জাহাজটা অনেক পুরানো। নোনাজল

লেগে লেগে তার গায়ের রঙ চটে গেছে। মাস্তুলগুলো বহুদিনের পুরানো।

চিমনিগুলো ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। আগাগোড়া জাহাজটা দেখলেই

মনে হয়, বহুকাল ধরে পৃথিবীর কত সমুদ্রে সে যেন পাড়ি দিয়ে ঝুনো

হয়ে গেছে। তা চেহারাতেই কেমন একটা ভবঘুরে রুক্ষুরুক্ষু ভাব। সেইটিই তার সৌন্দর্য। তার ওপর শুনলাম যে এখান থেকে মাল নিয়ে যাবে

যবদ্বীপে—তখন আর লোভ সামলাতে পারলাম না।

যবদ্বীপ! নারকেল আর তালগাছের সার তার তীর পর্যন্ত এগিয়ে

এসেছে সমুদ্রকে অভ্যর্থনা করতে। বাতাস আর জঙ্গলের মসলাগাছের

গন্ধ। তার উপর গভীর বনের মাঝে তার বোরাবুদর।

একেবারে মেতে উঠলাম, যেমন করেই হোক যেতেই হবে জাহাজে।

জাহাজের ভাড়া দেবার পয়সা নেই। অনেক কষ্টে জাহাজের হেড-

খালাসিকে খোঁজ করে, তার সঙ্গে ভাব করে তাকে কিছু ঘুষ দিয়ে লুকিয়ে

যাবার বন্দোবস্ত করলাম। জাহাজের একধারে বিপদের সময় ব্যবহার

করবার জন্যে ছোট তেরপল-ঢাকা বোট টাঙ্গানো থাকে। ঠিক হল তারই

একটির ভেতর আমি থাক্‌বো। কেউ তাহলে টের পাবে না। খালাসি

কোন এক সময়ে লুকিয়ে এসে আমার খাবার দিয়ে যাবে।

গভীর রাতে জাহাজে চড়ে সেই বোটের ভিতরে গিয়ে হেড্‌-খালাসির

নির্দেশমত লুকিয়ে রইলাম। ভোর হবার আগে জাহাজ ছেড়ে দিল।

তারপর কদিন কি অদ্ভুত ভাবেই না কাটিয়েছি। সারাদিন তার ভেতর

লুকিয়ে থাকি, তেরপল একটু ফাঁক করে আকাশ দেখি আর জাহাজের

শব্দ শুনি। গভ রাতের যখন সব নির্জন হয়ে যায়, জাহাজের খোলে

কজন ইঞ্জিনিয়ার আর ফায়ারম্যান আর ওপরে হাল ঘোরা

একজন নাবিক ছাড়া আর কেউ থাকে না, তখন একবার ক

নির্জন ডেকের একটি কোণে রেলিঙ্ ধরে দাঁড়াই।

এমনি করে কদিন বাদে জাভায় এসে পৌঁছোলাম। আগে ঠিক ছিল,

সবাই নেমে গেলে কোনও এক সময় হেড্‌-খালাসি আমার নামার ব্যবস্থা

করে দেবে। কিন্তু বন্দরে জাহাজ ভেড়াবার আগের বাত্রে সে এসে আমায়

জানিয়ে গেল যে তা হবার উপায় নেই। এখানে মাল নামানো হলেই

জাহাজটাকে সটান ড্রাই ডকে রং করবার জন্যে পাঠানো হবে ঠিক আছে,

সুতরাং সেভাবে নামা যাবে না।

তাহলে উপায়? খালাসি বল্লে, উপায় আছে। সবাই যখন জাহাজ

ভেড়াবার সময়ে সেই কাজে ব্যস্ত থাকবে তখৰ যদি আমি জাহাজ থেকে

জলে পড়ে একটুখানি সাঁতরে যেতে পারি তাহলেই হয়। তাতেই রাজি হলাম!

জাহাজ জেটিতে লাগবার আয়োজন চলছে, এমন সময় সন্তর্পণে আমি

বোটের ঢাকনি সরিয়ে নেমে পড়লাম। পুঁটলিটা আমার পিঠে বাঁধাই

ছিল। রেলিঙের ধারে গিয়ে জেটির উল্টোদিকে ঝাঁপ দিতে আর কতক্ষণ।

কেউ দেখতেও পেল না।

ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম ঠিক, কিন্তু সেই মুহূর্তে জাহাজটা জেটিতে

ভেড়াবার জন্যে পাশে সরতে আরম্ভ করল। জাহাজের বিশাল প্যাডেলের

ঘায়ে জল তোলপাড় হয়ে উঠল, কি ভীষণ তার টান! প্রাণপণেও আর

সে টান ছাড়িয়ে আসতে পারলাম না, সেই ঘূর্ণমান ভয়ঙ্কর প্যাডেলে

ধাক্কা খেয়ে তলার দিকে তলিয়ে গেলাম।'

আমি শিউড়ে উঠে বল্লাম—‘তারপর?

‘তারপর সেই প্যাডেলের ঘা! কি ভয়ঙ্কর লেগেছে দেখবি?

সামনে একটা গ্যাসের বাতি তখনও জ্বলছিল। অবিনাশ তার জামা

তুলে দেখালে।

একি! জামার নিচে যে কিছুই নেই—একেবারে ফাঁকা,

শূন্য!

ভালো করে আবার চেয়ে দেখলাম — দেহ নেই, কিছু নেই; ওধারে

গ্যাসপোস্টটা সে জামার তলা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উপরের দিকে

চাইলাম, সেখানে অবিনাশের মাথা নেই—শূন্য শূন্য সব শূন্য।

অস্ফুট চীৎকার করে সুটকেস হাতে আমি দৌড়াতে সুরু করলাম,

কিন্তু কোথায় যাব? যেদিকে যাই, নির্জন গলির মুখ বন্ধ। চীৎকার করে

একটা পোড়োবাড়ির দরজায় ঘা দিলাম। তার ভেতরে-জানালাগুলো পর্যন্ত

সে আঘাতের প্রতিধ্বনিতে ঝন্‌ঝন্ করে উঠল। কিন্তু কারুর সাড়া নেই।

অন্ধকার। গলি মনে হয় আমার চারিধারে সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। অসহ্য

তার ভ্যাপসা গন্ধ। তারপরে আমার আর মনে নেই।

যখন জ্ঞান হল তখন দেখি কে একজন আমায় বলছে, ‘উৎরিয়ে বাবু,

ইয়ে শিয়ালদা স্টেশন হ্যায়।'

শিয়ালদা স্টেশন্‌! অবাক হয়ে দেখি, আমি আমার সুটকেস সমেত

একটা রিকশ’য় বসে আছি। সামনে শিয়ালদা স্টেশন। নেমে পড়ে তার

ভাড়া ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু কখন কেমন করে যে আমি রিকশ’ উঠেছি,

কিছুই মনে করতে পারলাম না। হ্যাঁ, তারপর খোঁজ নিয়ে জেনেছি—

অবিনাশ দু'মাস আগে জাভার বন্দরে অমনি করে মারা গেছল।

  

              সমাপ্ত



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract