কখন তোমার আসবে টেলিফোন
কখন তোমার আসবে টেলিফোন
"রেডিও মির্চি, নাইনটি এইট পয়েন্ট থ্রি এফ এম...
বাংলা সাহিত্যের রোমাঞ্চকর কিছু গল্প দিয়ে সাজানো আমাদের এই বিশেষ নিবেদন, সানডে সাসপেন্স, আজকের গল্প; বঙ্কু বাবুর বন্ধু...(আবহ সঙ্গীত)...."
নোট ফাইভের ভলিউম আরো কয়েক ঘাট বাড়িয়ে দিল প্রমিত।
এমনিতে টিভি সিরিয়াল কিংবা সিনেমার তেমন একটা আগ্রহ নেই ঠিকই, তবে রেডিওর এই অনুষ্ঠানটা প্রমিতের বেশ লাগে। গল্পের বইয়ে শুধু গল্প পড়া যায়। তবে এই অনুষ্ঠানটায় আর.জে রা যেভাবে অভিনয় করে পাঠ করে, মনে হয় যেন, বেশ একটা অডিও মুভি দেখছি।
পড়ার টেবিলের সামনের কাঠের চেয়ারটায় প্রমিত টানটান হয়ে বসে....
"বঙ্কু বাবুকে কেউ কোনোদিন রাগতে দেখেনি, সত্যি বলতে কি, তিনি রাগলে যে কিরকম ব্যাপারটা হবে,কি যে বলবেন বা করবেন তিনি,সেটা আন্দাজ করা ভারী শক্ত...."
...প্যেহেলা নাশা প্যেহেলা খুমার, ন্যায়া প্যার হ্যায়, ন্যায়া ইন্তেজার...
মির্চি পজ হয়ে রিংটোন; বিরক্তিকর! এই সময় আবার কে ফোন করলো? এই সময়েই করতে হলো?
আননোন নাম্বার! কাটতে গিয়েও কি মনে করে রিসিভ পয়েন্টের সবুজ সার্কেলটা টানলো প্রমিত, "হ্যালো..."
-"হ্যা, কে বলছেন? না আসলে, দাদাভাই, মানে রঞ্জন বসাক আমায় এই নম্বরটা দিয়েছিল, কল করতে বলেছিল..."
-" আমি প্রমিত বিশ্বাস বলছি। হ্যা,রঞ্জন আমার বন্ধু। আপনি রঞ্জনের বোন? রঞ্জন আমায় বলেছিল ওর কয়েকটা বায়োলজির বই লাগবে ওর বোনের জন্য, আপনি কি সে ব্যাপারেই...
-" হ্যা, হ্যা, আমি ওই জি এন এম নার্সিং ট্রেইনিংয়ের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম..
-" বেশ, এই মুহূর্তে আমার কাছে আছে কয়েকটা কপি, আপনার কি শুধু ফিজিওলজি পোর্শন টাই চাই, নাকি পুরো বায়ো...
প্রমিতকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলে, "আমাকে আপনি বলবেননা প্লিজ..."
-" বেশ, তুমি, তোমার নাম কি?"
-" তুলিকা, তুলিকা বসাক।"
আরও কয়েকটা কথার পর ফোনটা ডিসকানেক্ট করেও, প্রমিতের কানে তুলিকার রিনরিনে গলাটা লেগে রইলো অনেক্ষন।
হঠায় মনে পড়তে রেডিও অন করতেই শুনলো, "এতক্ষন আপনারা শুনলেন..."
যাহ! শেষ হয়ে গেল?
ঘড়িতে একটা। বাড়িতে থাকলে, এটাই প্রমিতের লাঞ্চের সময়। প্রমিতের মাও ,যতই কাজ থাক,ঠিক একটাতেই প্রমিতের ভাত বেড়ে দেন।
ছুটির দিনে প্রমিত নিজের হাতে বাজার করে।
আজ মেন্যুতে মাটন। প্রমিত মাটন ভালোবাসেনা। কিন্তু সুমিতটা খুব পছন্দ করে। ছেলেটা এখনও চাকরির জন্য লড়ছে। রোজগার নেই বলে ভাইটা পছন্দের খাবার পাবেনা! নিজে পছন্দ না করলেও প্রমিত ভাইয়ের জন্য মনে করে মাটন কিনে নিয়ে আসে।
খাওয়া সেরে বোনের ঘরের দিকে উঁকি দেয় প্রমিত। ইতি টেবিলে মুখ গুঁজে পড়ছে। তিন বছর ধরে মেয়েটা জয়েন্টে বসছে, চান্স পায়নি। এবছর লাগিয়েই ছাড়বে। বোনকে আর ডিস্টার্ব না করে প্রমিত নিজের ঘরে যায়।
বইয়ের আলমারি খুলে স্পেসিমেন কপিগুলোয় হাত বোলাতে থাকে। পাবলিশার্সরা অনেক কপিই স্কুলে দিয়ে যায়, স্পেসিমেন হিসেবে। সেগুলো তো আছেই। মাস্টার্স করে প্রমিত নেটে বসেছিল, তখনকার বেশ কয়েকটা স্পেশাল কপিও রয়েছে। আরও আছে, ইতি যেহেতু মেডিকেলে বসতে চায়, ওরও কয়েকটা...আচ্ছা, তুলিকা এখন কি পড়ে, মানে জি এন এম মানে তো এইচ এস কোয়ালিফাইড ট্রেনিং। গ্রাজুয়েশন লেভেলের কপি ও বুঝবে তো?
যাহ! জিজ্ঞেসই তো করা হলো না, তুলিকার এইচ এস এ সাইন্স ছিল কিনা...
ফোন করবে একবার?
করা ঠিক হবে?
রঞ্জনকে বরং...
... দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়েলড ইজ কারেন্টলি সুইচড অফ!
রঞ্জন ব্যাটা এই ভর দুপুরে সুইচ অফ রেখেছে কেন?
লিস্ট খুলে তুলিকাকেই ফোনে ধরলো প্রমিত।
**************
-"এই, কমলা লেবু কত করে? "
-" বারো টাকা পিস।"
-" ঠিক আছে, দশ করে দুটো দাও। একটু ভালো দেখে দিয়ো।"
-" দার্জিলিং কমলা আছে স্যার, নিশ্চিন্তে নিন, আপনাকে ঠকাবোনা, আর কিছু নেবেন স্যার?"
স্কুলে ঢুকে কব্জি উল্টে ঘড়িটা দেখে নেয় প্রমিত। দশটা কুড়ি, অ্যাটেন্ডেন্স খাতায় সময় লেখে।
স্টাফ রুম এখনও খালি।যাক! জয়েন করা থেকে কখনও স্কুলে আসতে এতটুকুও দেরি করেনি প্রমিত।
নিজের লকার খুলে ক্লাস টেস্টের খাতা বের করে। আজই চেক করে জমা দিতে হবে।
প্রমিত কাজে ডুবে যায়।
দশটা তিরিশ, পঁয়ত্রিশ, স্টাফ রুম ভরতে থাকে।প্রমিতের পাশের সিটটা এখনো খালি।
দশটা আটচল্লিশ।রশিদদা ধপাস করে প্রমিতের পাশের সিটটা দখল করেন।
প্রমিত খাতা থেকে মুখ তোলে, "কি ব্যাপার, আজও লেট?"
রশিদদা রসিক মানুষ। চোখ টিপে বলেন, "সুখী মানুষ আমি ভায়া, বউ ছাড়তেই চায় না..."
প্রমিতের চোখে ধমক, "কি হচ্ছে দাদা, এটা স্কুল।"
-" তো, স্কুলে কি বউএর নাম নিতে নেয়, নাকি বউএর আদরের নাম নিতে নেই?"
পাশের টেবিলের সম্রাট প্রমিতের দিকে ইশারা করে, "যাদের আছে তারা নেবে, যার নেই সে কিকরে নেবে দাদা?"
রশিদদা এবার প্রমিতের কাঁধে হাত রাখেন, "হ্যা, এইটে কিন্তু সম্রাট একদম খাঁটি কথা বলেছে। তা হ্যা ভায়া, এতদিনেও একটা মেয়ে জোগাড় করতে পারলে না? আজকাল তো শুনি, ফোনে ফোনেই প্রেম হয়ে যায়!"
ম্যাথের সম্রাট আপাতত ফেসবুক প্রেমে মশগুল। কেউ সাক্ষাৎ করেনি অথচ দিনে কুড়ি ঘন্টা ফোনাফানি চলে। এমনকি, কথা বলতে বলতে এতটাই বেআক্কেলে হয়ে যায় সম্রাট, ক্লাসও মিস করে ফেলে মাঝে মাঝে।
রশিদ দা সম্রাটের দিকে তাকিয়ে গান ধরলেন, ''তারে আমি চোখে দেখিনি..."!
প্রমিত লজ্জা পায়, "আমার মত কেবলুস ছেলেকে কোন মেয়ে পাত্তা দেবে রশিদ দা, চন্দন, সম্রাট এদের মত ব্যক্তিত্বও কই আমার?
আর কাউকে না দেখে, না মিশে কি করে তার প্রেমে পড়বো? অসম্ভব।
তাছাড়া সম্রাটের মত আমার দূরদর্শিতাও নেই, লুকও নেই, গলার ওমন প্লিডও নেই।"
রশিদ দা সরাসরি তাকান প্রমিতের দিকে, "মেয়েরা আজকাল ওসব লুক টুক দেখেনা, দেখে সিকিউরিটি , বুঝলে?
আর পারসোনালিটি কথা বলছো? চুপ করে গম্ভীর থাকাকেই যদি ব্যক্তিত্ব বলে, ওই যে ওই দেখো ওই গরুটা চুপ করে গম্ভীর হয়ে জাবর কাটছে। কি বলবে, ওর হেব্বি পারসোনালিটি?
তিন বছর চাকরি করছো, এখনো বুঝলে না?"
রশিদদার কথায় হোহো হেসে ওঠে সবাই।
এই মানুষটাকে খুব ভালো লাগে প্রমিতের। কোনো জড়তা নেই, কোনো কমপ্লেক্স নেই, সারাক্ষণ হাসি মশকরাতে মেতে আছেন।
রশিদ দার আরো একটা গুণ খুব ভালো লাগে প্রমিতের। বৌদির প্রতি রশিদ দার ভালোবাসা।
সেদিন বৌদি টিফিনে ঘুগনি দিয়েছিলেন, গরমে কিছুটা নষ্টও হয়ে গিয়েছিল। প্রমিত দেখেছিল, রশিদদা সেটাই তৃপ্তি করে খাচ্ছেন।
জিজ্ঞেস করতে বলেছিলেন, "বউএর ভালোবাসা এটা, ছিটেফোঁটাও নষ্ট করবো না।"
প্রমিতেরও ইচ্ছে করে রশিদ দার মতোই সেও তার বউকে এতটাই ভালোবাসবে।
**************
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। প্রমিত অস্থির হয়ে ওঠে।
সময় হয়ে গেছে।
মোবাইল বাজে... প্যেহেলা নাশা....
প্রমিত কেটে দেয়, তারপর ডায়াল করে,
-হ্যালো....
আজকাল এটাও একটা রুটিন হয়ে গেছে। তুলিকার সঙ্গে কথা বলা। কি যে আছে মেয়েটার মধ্যে, কখনও দেখেনি, শুধু গলা শুনেই প্রমিত কেমন চাতক পাখির মত বসে থাকে ওর একটা ফোনকলের আশায়!
তুলিকা সম্পর্কে যেটা জেনেছে প্রমিত, তুলিকার কাছ থেকেই; সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, বাংলা অনার্স।একমাত্র মেয়ে, বাবা ইঞ্জিনিয়ার।
মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ চিন্তা বাবার, তাই নার্সিং ট্রেনিংয়ের জন্য পরীক্ষায় বসাচ্ছে। হ্যা, ওটাই তো একমাত্র গ্যারান্টিযুক্ত ট্রেনিং, তাও শিশুমঙ্গল থেকে, অ্যাডমিশন টেস্টে একবার উৎরে গেলেই ব্যাস। তিন বছরের ট্রেনিং শেষে দুই বছরের প্র্যাকটিস, সঙ্গে স্টাইপেন্ড। তারপর যেকোনো সরকারি হাসপাতালে, গ্রামীণ হেলথ সেন্টারে অ্যাপ্লাই করলে প্রিভিলেজ পাবেই।
কিন্তু তুলিকার ইচ্ছেটা অন্য। সে যে লিখতে চায়, মনে যা আসবে, হাবিজাবি, অনর্গল লিখে যাবে।তুলিকা ঝর্ণার মত কথা বলে যায়। আজ অমুক প্রফেসর এই বললো, ওই ম্যাডাম ওই করলো।
বাড়িতে কাতলার মাথা দিয়ে ডাল খেলো, বিকেলে ফুচকা খেলো।
ফোনের এপ্রান্তে বসেও প্রমিত তুলিকার মনের সন্ধান পায়, একেবারে স্বচ্ছ নদীর মত, কোনো জটিলতা নেই।
*************
আজ স্কুলের পর ম্যানেজিং কমিটি মিটিং ডেকেছিল। এমনিতে প্রমিত পৌনে ছটার মধ্যে বাড়ি ফেরে, আজ সাড়ে ছটা বাজলো।
মিটিংয়ে ছিল বলে ফোনটাও সাইলেন্ট মোডে ছিল। খেয়াল করেনি, বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, সাড়ে পাঁচটায় একটা ম্যাসেজ,তুলিকার, "কল মি, ইটস্ আর্জেন্ট, এক এক্সিডেন্ট হো গ্যায়া হ্যায়...."
তুলিকা তো তাকে মেসেজ করে না, তাও এই রকম, বুকটা ধড়াস করে উঠলো প্রমিতের। সঙ্গে সঙ্গে ডায়াল করে তুলিকাকে, "তুলি, কি হয়েছে তোমার, কোথায় এখন তুমি...?"
-''কেন বাড়িতে, কি আবার হবে?"
-"তাহলে কি সব মেসেজ করেছ উল্টোপাল্টা?"
খিলখিল হেসে ওঠে তুলিকা,"গঙ্গারাম, পুরোটা পড়ো, ওটাতো একটা জোক...!"
পটাং করে ফোন কেটে দেয় প্রমিত। রাগে। মেসেজ খুলে দেখছে, প্রথম লাইনের পর অনেকটা স্পেস, শেষে লেখা,..... তুমহারে হি গ্রূপ কা ব্লাড চাহিয়ে, নেহি তো গাদ্ধে মর জায়েগি😊!!
ফোন বাজছে....প্যেহেলা নাশা...
-"পড়লে?"
-"হুম!"
-"রাগ কমেছে? আচ্ছা পুরোটা না পড়ে তুমি এত ঘাবড়ে গেলে কেন? আমার যদি সত্যিই কিছু হত, আমি তোমায় মেসেজ করতে পারতাম?"
-"তোমায় একটা কথা বলার ছিল।"
তুলিকা তখনও হাসছে, "বলো"!
-"আমি কখনও ভাবিনি তুলি, কাউকে না দেখেও ভালোবাসা যায়, মন দেওয়া যায়...
তুলিকা মাঝখানেই বলে ওঠে, "ওয়েট ওয়েট, কার প্রেমে পড়লে? কবে?"
-" কবে জানিনা, তবে কার প্রেমে বলতে পারি, তোমাকেই বলতে পারি, তুলি, আমার মা আমার জীবনে একমাত্র মেয়ে, যার কাছে আমি মাথা নোয়াতে পারি, আর পারি তার কাছে,"
-" কার কাছে?"
-"তোমার কাছে!"
কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা।
-"কি হলো তুলি, আমি কি কিছু ভুল বললাম?"
-"কিন্তু তুমি তো আমায় দেখইনি!"
-"তুমি যেমনই হও, কালো ফর্সা লম্বা বেঁটে সুন্দর কুৎসিত, আমি তোমাকেই ভালোবাসি, বাসবও, আজীবন।"
তুলিকা চুপ।
-"কি হলো, বলো কিছু..."
-"সামনের রবিবার দেখা করতে পারবে?"
-"পারবো!"
**************
এই প্রথম কোনো মেয়েকে ডেট করতে যাচ্ছে প্রমিত। ভীষণ নার্ভাস লাগছে।
তুলিকা যেমনই হোক, সে যে দুর্দান্ত কথা বলে, কথার জালে প্রমিতকে নাস্তানসবুদ করে তোলে। আজ যদি তাকে ঠিক সেরকমই কোনো সিচুয়েশনে পড়তে হয়, যদি কিছু সঠিক প্রত্যুত্তর দিতে না পেরে ব্যোম হয়ে যায় প্রমিত, ক্যাবলা হয়ে যায়...
কেউ একজন সঙ্গে থাকলে ভালো হত। কাকে নেবে?
প্রথম ডেটে যাচ্ছে, তাও কাউকে সঙ্গে নিয়ে, এটাও কি ভালো দেখায়?
ভাবতে ভাবতেই বাসস্ট্যান্ড থেকে দুটো বড় চকলেট নিলো প্রমিত।
জায়গাটা কিন্তু দারুন চুজ করেছে তুলি। একটা পার্ক। পার্ক না বলে একটা বাগানবাড়ি বলা চলে। চারিদিকে সবুজ গাছালি। একদিকে একটা পুকুর। সবজে কালো টলটলে জল। সেখানেই একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুলি।
একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। কি গভীর চোখ দুটো! মাথা ঝাঁপিয়ে কোঁকড়া চুলের ঝুরো পড়েছে কপালে। একটা বেবি পিঙ্ক কুর্তি পরেছে তুলি, সঙ্গে লাইট ইয়েলো লেগিংস। ফর্সা তেলতেলে মুখ। অপরূপা নয়, তবু ভারী আকর্ষণীয় তুলির মুখখানা। একটা ছবি নিতে হবে, না জানিয়েই, ঠিক এই পোজেই।
****************
"দেখ তো ইতি ছবিটা কেমন?" মোবাইল থেকে তুলিকার ছবিটা বোনকে দেখায় প্রমিত।
ইতি ছবিটা দেখে, বলে, "কে রে?"
-"রঞ্জনের খুড়তুতো বোন!কেমন বলনা, ভালো?"
ইতি ফোনটা ফেরত দিয়ে হাত ওল্টায়, "তোর জন্য ঠিকই আছে!"
কেন এমন বললো ইতি?
যাওয়ার আগে কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার অছিলায় ইতি প্রমিতের কাছে আসে, "দাদা, ল্যাপটপটা... দিবি তো?"
প্রমিত বোনের মাথায় হাত রাখে, "দেব দেব। পুজোর গিফট ঠিক পেয়ে যাবি!"
ইতি চলে গেছে।
তুলিকেও তো এবার পুজোয় কিছু একটা দিতে হয়। কি দেবে? দামি সালোয়ার, একটা সোনার আংটি? কি দেবে?
***************
রেস্টুরেন্ট কাউন্টার থেকে দুটো এগচিকেন রোল নিয়ে প্রমিত তুলির মুখোমুখি বসে। আজ কেমন যেন অন্যমনস্ক লাগছে ওকে!
একটা রোল ধরিয়ে দেয়।
খুব ধীরে গতিতে খাচ্ছে তুলি। হঠাৎ একটা দুস্টু বুদ্ধি খেলে যায় প্রমিতের মাথায়। নিজের রোলটা ঝটপট মুখে পুড়ে তুলির এঁটো রোলটায় একটা কামড় বসায়, "শুনেছি এঁটো খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে!"
বলেই নিজের মনে বেশ লজ্জা পেয়েছে প্রমিত।
কি ব্যাপার! তুলির কোনো রেসপন্স নেই। কেমন যেন গুম মেরে রয়েছে।
তুলির হাতে হাত রাখে প্রমিত, "কিছু হয়েছে? মুড অফ কেন?"
তুলির ছলছল চোখ প্রমিতের দিকে, "আজ থেকে একবছর আগে আমার দীপ্তর সাথে ব্রেক আপ হয়ে যায়। দীপ্ত এখন ঈশানির সঙ্গে এনগেজড।ভেবেছিলাম ভুলে যাবো, নিজেকে নানান কাজে ব্যস্ত করে ফেলি, তোমার সাথে কথা বলা শুরু করি, কিন্তু আমার মনে হয় আমি তোমায় ঠকাচ্ছি। আমি কোনদিন ওকে ভুলতে পারবো না।আই এম সরি প্রমিত!"
*************
বালিয়াড়ির বুকে দারুন ভীড়। ঝালমুড়ি, আলুকাবলি, পাপড়িচাট, ভেলপুরী র সম্ভার সাজিয়ে রয়েছে অসংখ্য চলমান দোকান।
সমুদ্রে অনেকেই স্নান করছে, জোড়ায় জোড়ায় হাত ধরে ঢেউয়ের মুখোমুখি। ঢেউ এলেই ঢেউয়ের সঙ্গে লাফ। কেউ কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, নোনা জল বালি ঘাঁটছে। দারুন শোরগোল এখন সৈকতে।
কেবল প্রমিত নিশ্চুপ। বালিয়াড়ির মত। সবাই তাকে ঘিরে মজা করছে, কিন্তু বালিয়াড়ি, নিজের মত একা।
তুলির সঙ্গে আর কথা হয়না। তুলি আর ফোন করে না। তুলি ভালোবাসেনা প্রমিতকে, সে ভালোবাসে তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে, দিপ্তকে।
তাহলে প্রমিতই বা কি করে ভুলে যাবে তুলিকে? ভোলা যায়? টানা এই একটা মাস তুলিকে ঘিরে কি সুন্দর স্বপ্নই না সে গেঁথেছিলো!
সুখী সংসারের স্বপ্ন; খুব সকালে তুলি স্নান সেরে যখন প্রমিতের ঘুম ভাঙাতে আসবে, প্রমিত ঝটকায় তুলিকে বুকে টেনে নেবে, তুলির ভিজে চুল, গায়ের গন্ধ মেখে প্রমিত দিন শুরু করবে। তুলি নিজের হাতে তাকে টিফিন গুছিয়ে দেবে, ঠিক রশিদ দার বউএর মত, যেমনই হোক, প্রমিত তৃপ্তি করে খাবে।
স্কুলে বেরোনোর আগে তুলিকে জড়িয়ে ধরে গভীর একটা চুমু...
বিকেলে ফিরেই তুলিকে নিয়ে বেরোবে। রোজ না হলেও মাঝেমাঝে। সন্ধ্যেবেলা রান্নাঘরে ইচ্ছে করে তুলিকে জ্বালাবে প্রমিত। তুলি রেগে যাবে, ঠোঁট ফোলাবে, প্রমিত সোহাগ করে বউএর রাগ ভাঙাবে। হ্যাঁ, বউ,-এই নামেই এতদিন তুলিকে দেখেছে স্বপ্নে।তুলিকে সবসময় সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে প্রমিত।
-"কি ভায়া, একা একা কি বিড়বিড় করছো?"
রশিদদার ঠেলায় প্রমিতের স্বপ্ন ভাঙ্গে।
মন খারাপ থাকলে প্রমিতের ব্যবহারে তা প্রকাশ পায়। তুলি চলে যাওয়ার পর, স্কুলে খুব মন মরা হয়ে থাকতো। পুজোর ছুটিতে রশিদদাই জোর করে তাঁদের সঙ্গে প্রমিতকে দিঘায় এনেছেন। হওয়া বদল যদি ছেলেটার মুড বদলে দেয়!
*************
ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে প্রমিত, ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই, কান্না পেলেও চেপে রাখতে হয় প্রাণপণ, কেউ না দেখতে পায়, নাহলে আর পুরুষমানুষ কি?
প্রমিত যখন এইটে পড়ে, প্রমিতের দাদু মারা যান, প্রমিতের মনে পড়ে, বাবার চোখ দুটো লাল হয়ে উঠছিল। বাবা বারবার চোখের পাতা ফেলছে, চোখের কোনে জল তবু বারবার যেন পলক ফেলে চোখের জল চোখেই শুষে নিচ্ছে বাবা। প্রমিত বাবাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, "বাবা তুমি কাঁদছো?"
বাবা ভাঙা গলায় বলে, "ধুর পাগল, ছেলেদের কাঁদতে আছে? চোখে কি একটা পড়েছে, তাই...!"
প্রমিতের চোখেও কিছু একটা পড়েছিল, তাই বোধয় বারবার চোখ জ্বালা করে উঠে, চোখ ভিজে যায় , কিন্তু ছেলেদের যে কান্না বারণ, সবার থেকে তাই পালিয়ে বেড়ায় প্রমিত। কিন্তু দিনের শেষে যখন নিজের বিছানায়, তখন চোখের জল আর বাগ মানে না, বালিশ ভিজিয়ে দেয়। এই কদিনেই তুলিকে এতো ভালোবেসে ফেলেছিল প্রমিত!
প্রমিতদের বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা খালি।মা আগে শীতের সবজি বসাতো। কিছুদিন হলো বেশ কয়েকটা মরশুমি ফুলের চারা এনেছে প্রমিত। যত্ন করে বাগান করে। ছুটির দিন, কিংবা স্কুল ফেরত বাকি অলস সময়টা বেশ ভালোই কেটে যায়।
সন্ধ্যেবেলা এখন অনেক্ষন ছাদে কাটায় প্রমিত। হালকা হওয়ায় প্রমিতের যত্নে ফোটা ফুলের গন্ধ আর পুরোনো দিনের গান, প্রমিতের একাকীত্ব অনেকটা ঘোচায়।
একদিন ইতি এসে ধরলো প্রমিতকে, "কি ব্যাপার দাদা, রঞ্জন দার বোনের খবর কি? আর তোকে ফোন করেনা?"
প্রমিত সাবধান হয়। কিছুতেই বাড়ির কারোর কাছে তুলিকে খারাপ হতে দেবেনা। রঞ্জনের এবাড়িতে ভালো যাতায়াত আছে, বাড়ির সবাই তুলির ব্যাপারটা জানতে পারলে, রঞ্জনকেও সবাই খারাপ ভাববে। তাছাড়া প্রমিত তার তুলিকে কারোর চোখে খারাপ হতে দেখতে পারবেনা।
বোনের প্রশ্নের উত্তরে বলে, "আরে,ওই রঞ্জনের কাছ থেকেই ছবিটা পেয়েছিলাম, ওর তো এখন বোধহয় ফাইনাল ইয়ার, পড়াশোনা করছে হয়তো, রঞ্জনের সঙ্গে আর সেভাবে কথা হয়না রে!"
বোনের কাছ থেকে পালিয়ে এসে প্রমিতের খেয়াল হয়, তাই তো, তুলির নার্সিং ট্রেনিংয়ের অ্যাডমিশন এতদিনে নিশ্চয়ই হয়ে গেছে, রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে, কই খবর নেওয়া হলো না তো?
রঞ্জনকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
*****************
গতকাল রাতে মা খেতে বসে বলছিল, "পিসিমা একটা সম্বন্ধ এনেছেন, আমাদের পাল্টি ঘর, সামনের রবিবার ফাঁকা রাখিস বাবু।"
মায়ের মুখের ওপর কথা বলতে পারেনি প্রমিত, কেবল ভেবেছে, তুলির সঙ্গে একবার কথা বলতেই হবে।
আজ সন্ধ্যেবেলা অনেক দোলাচালের পর তুলিকে ফোনটা করেই ফেলে প্রমিত, ওপারের সেই পাঁজর ফালাফালা করা কণ্ঠ, "কি ব্যাপার, জ্ঞানদারঞ্জন, রাগ কমতে একবছর কাটিয়ে দিলে?"
-" আমি তোমার ওপর রাগ করার কে?"
-" ঠিক, তুমি রাগ করবে কেন, তুমি তো শুধু জ্ঞান দিতেই জানো, তাই না জ্ঞানদারঞ্জন?"
এবার প্রমিত হেসে ফেলে, "রঞ্জনের কাছ থেকে তোমার র্যাঙ্কিংএর খবরটা শুনলাম, কংগ্রাচুলেসন, ওতো বড় একটা জায়গায় তুমি চান্স পাচ্ছো, খুব ভালো।"
-"কিন্তু আমি তো যাচ্ছি না।"
প্রমিত অবাক, "কেন? এত বড় অপরচুনিটি কেউ হাতছাড়া করে?"
-"করে করে, তুলিকা বসাক করে, আরে আমার যে রক্ত দেখলেই মাথা ঘোরে, ইনজেকশনে বমি পায়, আর আমি হবো নার্স? ও বাবা জোর করেছিল তাই পরীক্ষায় বসেছিলাম, বাড়ি ফিরে এমন ভুজুং ভাজুং দিয়েছি, বাবাও বেঁকে বসেছে"...
-"বুঝলাম, ভুজুং ভাজুং দিতে ভালোই পারো, তা, আমাকেও কখনো দিয়েছিলে নাকি?"
খিলখিল হেসে ওঠে তুলি। প্রমিত আবার গোলে যায়, মোমের মত, তুলির উষ্ণতায়।
***************
মার থেকে আরো কটা মাস সময় চেয়ে নেয় প্রমিত। মিথ্যে করে বলে, "আবার একবার নেটে বসবো ভাবছি, তারপর নাহয়...!"
বাড়িতে আপাতত প্রমিতের জন্য মেয়ে দেখা স্থগিত। সুমিত চাকরির পরীক্ষায় বসছে, ইতি প্রিপারেশন নিচ্ছে, আর প্রমিত, সেই আগের মতোই, স্কুল বাড়ি, বই, বাগান, বিছানা, ঘুম।
হঠাৎ একদিন তুলির ফোন, "ঋককে খুঁজে পাচ্ছিনা প্রমিত..."
-"ঋক আবার কে?"
-" ঋক, আমার সঙ্গে কলেজে পড়ে, অনেকদিন থেকে আমায় ঝাড়ি মারছিল। গতমাসে আমায় প্রপোজ করে, আমি না করি, তারপর থেকে ও মিসিং"
-" কি করে হয়, জলজ্যান্ত একটা ছেলে হারিয়ে যাবে?তুমি ওর অ্যাড্রেস জানো? চলো আমিও তোমার সাথে ওকে খুঁজতে যাবো!"
এসব কি বলছে প্রমিত, তুলির রিজেক্টেড বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজতে তুলির সঙ্গে বেরোবে তুলিরই আর এক রিজেক্টেড বয়ফ্রেন্ড!
বেশ মজার তো? হোক, তবু আবার তুলির সাথে দেখা তো হবে, সময় কাটানো তো হবে...
না, ঋককে আর খুঁজতে যেতে হয়নি।দুদিনের মধ্যেই ঋক স্বশরীরে হাজির হয়েছে, এবং হাজির হওয়ার কারণটা আরও বিস্ময়কর। তুলি ঋকের প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করার পরেই নাকি ফিরেছে সে।
প্রমিত আবারও ধন্ধে। তাহলে দীপ্ত? যাকে ভুলতে না পেরে তুলি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সে দীপ্তকেই ঋক ভুলিয়ে দিলো?
তবু কেন তুলিকে খারাপ ভাবতে পারছে না প্রমিত? কেন মনে হয়, তুলি আবার ফিরে আসবে, আবার কথা বলবে?
*******************
রঞ্জনের বিয়ে। প্রমিতের বাড়ির সবাই নিমন্ত্রিত। বিয়ে বাড়ি এসে অব্দি প্রমিত খুঁজছে তুলিকে।
তুলির বাবা মার সাথে দেখা হয়েছে,কথা হয়েছে, অথচ তুলি কোথায়?
অনেক্ষন পর তুলি এলো। হলুদ রঙের শাড়ি পরে। মাথায় খোঁপা, খোঁপায় গোলাপ।
প্রমিত চোখ ফেরাতে পারেনা।
তুলি কাছে এসে দাঁড়ায়, "জ্ঞানদারঞ্জন, হাঁ এ যে মাছি ঢুকে যাবে!"
প্রমিত মাথা চুলকে মুগ্ধতা দমন করে, "তা তোমার ঋক কোথায়? আলাপ করাবে না?"
তুলি মুচকি হাসে, "ঋক! ওর মত হ্যালহ্যালে ছেলে হবে আমার বয়ফ্রেন্ড? ছ্যাঃ!"
প্রমিত তুলির কানে কানে বলে, "তাহলে, প্রেজেন্ট টেন্স আর কারও সাথে কন্টিনিউ করছো? নাকি দীপ্তর পাস্ট এখনও লাস্টিং করছে?"
তুলির চোখটা ছলছল করে উঠলো কি? দেখতে পেলোনা প্রমিত।
*******************
স্কুল ফেরত সম্রাট আজ পাকড়াও করেছে প্রমিতকে। ধর্মতলায় যেতে হবে। সামনে ভ্যালেন্টাইন ডে, অদিতির জন্য একটা হ্যান্ডব্যাগ নেবে।
ফুটের ওপর অনেক দোকান। সব ফেলে সম্রাট প্রমিতকে নিয়ে শ্রীলেদার্সএ ঢোকে। সামনেই জুতোর স্টোরস। সম্রাটের আবার একটু জুতো ম্যানিয়া আছে। ভালো জুতো দেখলেই হামলে পড়ে, অন্য কিছু মনেই থাকেনা তখন। এখান থেকেও বেছে বেছে দুইজোড়া কিনলো।
তারপর পাক্কা একঘন্টা পনের মিনিট ধরে সতেরোটা ব্যাগ খুলে টেনে দেখে অবশেষে একটা ছোট্ট হ্যান্ড ব্যাগ পছন্দ হলো।
প্রমিতের ভ্রুতে বিরক্তি,"পারও বটে!"
বিজ্ঞের মত সম্রাট বলে, "নয়তো কি, টাকা দিয়ে কিনছি, বেছে বুছে নেব না? যেটা পছন্দ হবে, তার যেন এতটুকুও খুঁত না থাকে, থাকলেই মুশকিল, লস হয়ে গেল ভেবে ভেবেই দিনটা মাটি!"
-"কিন্তু ধরো যেটা এত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কিনলে, পরে যদি বোঝো, ঠকে গেছো, তাহলে?"
-"সেই জন্যই তো এত যাচাই, আগে যেটা কিনেছিলাম, যেটা প্রায় দুবছর চলেছিল, এটার লেদারটা ঠিক সেটার মতোই তো? এইসব ভেবেই তো একঘন্টা পার। আর বাকিটা কপাল! আরে ব্যাগই তো, বউ তো নয়!"
প্রমিতের চক্ষু চড়কগাছ, "কার সাথে কার তুলনা!"
সম্রাট ভ্রু নাচায়, "তবে ভাই জিনিস ই বলো আর বউই বলো, এত বাছাবাছির পরেও কিন্তু একটা রিস্ক হ্যাজ। কথায় বলে না,নো রিস্ক, নো গেইন!"
একটা যেন জট খুলে গেল প্রমিতের মাথা থেকে। দারুন একটা আইডিয়া এলো মাথায়, নো রিস্ক নো গেইন!!
******************
ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ। আজকেই লাস্ট পেপার ছিল। ট্রেনের জানালার পাশে বসে তুলি অন্যমনস্ক তাকিয়ে ছিল দূরে।
রেজাল্ট বেরোতে এখনো তিন মাস। এর মধ্যে একদিন কলেজস্ট্রিট যেতে হবে, ব্যোমকেশ সমগ্র পুরোটাই উঠিয়ে আনতে হবে। নিজের ঘরে নিজের হাতে গড়া লাইব্রেরিটার ওপর র্যাকটা ভরিয়ে ফেলতে হবে।
আরও একটা কাজ করতে হবে। ভ্যাবলুরামটাকে সরি বলতে হবে।
বিগত একটা বছর খুব জ্বালিয়েছে তুলি প্রমিতকে।
কি করে স্কুলে পড়ায় কে জানে, একটা মেয়ের ইশারা বোঝে না?
অবশ্য না বুঝে একদিকে সুবিধেই হয়েছে তুলির। কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে পেরেছে প্রমিতকে।
পৃথিবী টাই তো এখনও হিপোক্রিট। নাহলে সেই স্কুল থেকে যে দীপ্তকে ভালোবেসে এসেছে তুলি, সেই কিনা কলেজে উঠে বদলে গেল, তুলিকে ভুলে গেল?
অভিমান করে তুলিই চেয়েছিল দূরে চলে যেতে, তাই তো জিএনএমের ফরম ফিল আপ, প্রিপারেশন, পরীক্ষা দেওয়া, আর এরই মধ্যে প্রমিতের সঙ্গে আলাপ।
দাদাভাই ই বলেছিল প্রমিতের কথা, বায়োলজির টিচার, খুব হেল্পফুল।
এতটুকু মিথ্যে বলেনি দাদাভাই, তুলি যখনই ফোন করেছে প্রমিতকে ,নির্দ্বিধায় হেল্প করেছে।
কোনোদিন বিরিক্ত হয়নি। তুলি বুঝেছিল, খুব সরল এই মানুষটা। তুলি এও বুঝেছিল, প্রমিত তাকে মনেমনে ভালোবাসে, সেদিনই বুঝেছিল, যেদিন ওই মজার মেসেজটা তুলি পাঠিয়েছিল। চোখে না দেখেও ফোনে তুলি প্রমিতের আকুতি টের পেয়েছিল।
পরে প্রমিতের আত্মভোলা চাহনি, উস্কোখুস্কো চুল, সামনের দুটো বিজড়ে দাঁত সব মিলিয়ে, দীপ্তর পর এই প্রথম কোনো ছেলেকে মন থেকে ভাললেগেছিলো তুলির।
তাই তো এত যাচাই, যেন এই ভালোলাগাটাও দীপ্তর মত ব্যভিচার না করে বসে!
হোক সাদামাটা, হোক হাঁদারাম ,প্রমিতের ভালোবাসা স্বচ্ছ জলের মতোই। যে কিনা সারাদিন তুলির অহেতুক বকম বকম গিলতে পারে, নিজের কষ্ট হলেও তুলির ভালোলাগার জন্য অচেনা পথে হাঁটতে পারে, যে কিনা মন খারাপের কালো আকাশে তুলির মতোই হাজার তারা গুনতে পারে, তুলির সব ছেলেমানুষি মানতে পারে,আবার দিনের শেষে আদর করে ভুলটা ধরিয়েও দিতে পারে।
যার মধ্যে কোনো ভনিতা নেই, তুলির মতোই পুরোনো দিনের গানে মন ভরাতে পারে, যার কাছে হেরে গিয়েও বিশ্ব জয় করা যায়, এরকম মানুষ বোধহয় সব মেয়েই চায়।
তবুও বারবার তুলি দীপ্তর কথা বলে, ঋকের কথা বলে পরীক্ষা করেছে প্রমিতকে।
পরীক্ষা তো করতেই হত, তুলি যে ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় তো লাগেই।
কিন্তু আর নয়। অনেক হয়েছে, এবার তুলি প্রমিতকে সব সত্যি বলে দেবে, প্রমিতকে হ্যা করে দেবে। লুকোচুরি তো অনেক হলো!
প্লাটফর্মে বসে প্রমিতকে ফোনে ধরে তুলি, "কোথায়?"
-"তোমায় বলা হয়নি তুলি,কাল আমার পাকাদেখা। আমি একটু দোকানে বেড়িয়েছি তাই, মিষ্টি টিস্টি নিতে হবে!"
তুলির বুকে হাতুড়ির ঘা, "কবে ঠিক হলো এসব, কই আমায় তো বলোনি!"
-"তোমার আমার কথা শোনার সময় কোথায়? তোমার পরীক্ষা, দীপ্ত, ঋক এসবের মাঝে আমি তো কিছুই নই!"
তুলির গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো,"কাউকে না, আমি শুধু তোমাকেই...",তুলি শান্ত গলায় বললো, "অল দ্য বেস্ট, ভালো থেকো!"
না, কাউকে দোষ দেবেনা তুলি। কাউকে না।সত্যিই তো, কেনই বা প্রমিত অপেক্ষা করতো তুলির জন্য, যেখানে বারবার তুলি ফিরিয়ে দিয়েছি প্রমিতকে, ওর ইমোশন নিয়ে খেলছে! লেবু বেশি চটকালে তেঁতো তো হবেই।
প্রমিত খুব ভালো ছেলে, সুখে থাক প্রমিত।
ঘরে ফিরে চটি খুলে সোজা নিজের ঘরে ঢুকলো তুলি। দীপ্ত যখন ডিচ করলো খুব কেঁদেছিল তুলি, এখন তুলির চোখে এতটুকু জল নেই। কাঁদবেই বা কেন? প্রমিতের ভালো কিছু হলে তুলির তো আনন্দ পাওয়ারই কথা।
খাটের উপর উবুর হয়ে তুলি শোয়, এখানে শুয়েই কত কথা বলেছে প্রমিতের সাথে। পুরোনো কথা গুলো, প্রমিতের কথাগুলো বারবার ফিরেফিরে আসছে তুলির মনে। সেখানে দীপ্তর কোনো জায়গা নেই।
বারবার ফোনের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে, আর নিশ্চয়ই প্রমিত তুলির ফোনের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবে না!
কাল অনেক রাত পর্যন্ত তুলি ছাদে বসেছিল। ঘুম আসছিলনা। তুলির মন খারাপ করলে, ঘুম না এলে তুলি এভাবেই ছাদে বসে থাকে। অন্ধকারের আকাশে বিন্দু বিন্দু তারা খোঁজে, তারার গতি দেখে, কোন তারাটা জ্বলে উঠলো, কোনটা একটু ফিকে হলো, কোনটা একটু তফাৎ সরে গেল, কোনটা একটু কাছে এলো, মনে মনে গান গায় তুলি, হারিয়ে যায়। একসময় ঘুম আসে, তুলি ঘুমিয়ে পড়ে।
দীপ্ত চলে গেল যখন ,কষ্ট ভুলতে তুলি লাইব্রেরি বানাতে শুরু করেছিল, একটার পর একটা বই, একটার পর একটা গল্প, আলাদা জীবন, আলাদা স্বাদ, জীবনের কতরকম প্রতিচ্ছবি হয়! আমরা কেবল কুয়োর ব্যাঙ হয়ে একটাতেই বেঁচে থাকি, ভাবি আমারটাই অন্যরকম!
কষ্টটা থিতিয়ে গিয়েছিল। এবারেও তেমনটাই করতে হবে। তবে এরপর আর নয়। আর কোনোভাবেই কারোর কাছে নরম হবেনা তুলি। আর কোনো ভালোলাগাকে প্রশ্রয় দেবে না। আর কোনো মনকেমনের কাছে মাথা নোয়াবেনা।
******************
বেশ বেলা হয়ে গেছে। মায়ের ডাকে তুলির ঘুম ভাঙে। মা বিছানার নতুন চাদর হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বদলাবে। কেন, এই চাদরটা তো বেশ পরিষ্কারই আছে!
তুলি উঠে চেয়ারে বসে। মা বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, "আজ দুপুরে রঞ্জুর কোন এক বন্ধু আসবে তার বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে, তোর বৌদির সঙ্গে দেখা করতে!"
তুলি চোখ রোগড়ে বলে, "কেন, ওদের বিয়েতে আসেনি?"
-" এসেছিল, আবার আসবে বলেছে। শোন তুই যেন কোথাও বেরোসনা।"
তুলি দাঁড়িয়েছে, "কেন? বৌদিকে দেখতে আসছে, আমাকে থাকতে হবে কেন? ওসব জানি না, বিকেলে আমি লাইব্রেরি যাবো!"
মা তুলির মাথায় হাত রাখে, "ওমন বলে না মা, বাড়িতে গেস্ট আসবে আর বাড়ির লোকজন থাকবে না তাই কখনো হয়? শোন, একটা ভালো সালোয়ার পরিস, ওই টিয়া রঙের টা"...
মা চলে গেছে। এই এক ন্যাকামো হয়েছে। গুষ্টিসুদ্ধ আত্মীয় নতুন বউ দেখতে আসবে, আর তুলিকে কাঁচা কাপড় পরে খবরদারি করতে হবে। ধুত্তোর!
*****************
নিচে বসারঘরে বেশ একটা হৈচৈ চলছে এখন। নিশ্চয়ই দাদাভাইএর বন্ধু, বন্ধুর বাড়ির লোক চলে এসেছে!
তুলি নীচে যাবেনা। মা জোর করে সালোয়ারটা পরিয়েছে, ওরা চলে যাওয়ার আগে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে আসবে। ব্যাস, যথেষ্ট।
এতক্ষনে প্রমিতের পাকা দেখা নিশ্চয়ই কমপ্লিট! প্রমিত খুব খুশি নিশ্চয়ই।
তুলির চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল হঠাৎ। বুকের কান্নাটা দলা পাকিয়ে উঠছে কেন? প্রমিত তো দীপ্ত নয়!
না, না, ভুলতে হবে তুলিকে।
তুলি সুচিত্রা ভট্টাচার্যের একটা উপন্যাস হাতে তুলে নেয়। ভুলতে হবে তাকে, সব ভুলতে হবে।
প্রথম পাতা খুলতেই ঘরে বৌদি, "কি ব্যাপার, এখানে বই খুলে বসে আছো? নীচে চলো।"
তুলি পাতা ওল্টায়, "আমি গিয়ে কি করবো, তোমায় দেখতে এসেছে...."
বৌদি তুলির হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়।
বসার ঘরের সোফায় এক বয়স্ক মহিলা এবং একজন বয়স্ক লোক বসে আছেন। বৌদি তাদের সামনে জোর করে বসিয়ে দেয় তুলিকে।
তুলির শিরদাঁড়া শক্ত হয়, আচ্ছা, এই জন্যই এতো আয়োজন। তার জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে তাহলে! মাও তাকে ঠকালো, মিথ্যে বললো?
লজ্জায়, অপমানে তুলির মাথা নত হয়ে যায়।
ঠিক সেই সময় সামনে বসা ভদ্রলোক বলেন, "মেয়ে আমাদের খুব পছন্দ। প্রমিত কোথায় গেলি, প্রমিত..."
কি!কার নাম শুনলো তুলি?
তুলি সোজাসুজি তাকায়, সামনে ...প্রমিত!!
তুলির ঘরে এখন ওরা দুজন। তুলি দেওয়ালের দিকে চেয়ে রয়েছে।
প্রমিত ধীরে ধীরে তুলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, তুলির চোখের দিকে তাকিয়ে দুস্টু হাসে, "কেমন চমকে দিলাম! বেশ ভালোই বুদ্ধু বানাচ্ছিলে আমাকে, শেষ রাতে ওস্তাদের মারটা কিন্তু আমিই চাললাম। কি ভেবেছিলে, আমি কিছুই বুঝিনি?
আমি অতটাও ভ্যাবলাকান্ত নই ম্যাডাম!
তাই তো ভাবি, এ মেয়ে একটা করে বয়ফ্রেন্ড জোটায় আর বেছে বেছে আমাকেই সাক্ষী মানে কেন?
শেষে রিস্কটা নিয়েই ফেললাম, তোমার চাল তোমাকেই ফেরত দিলাম।"
তুলি লাজুক হাসে, "কি করে বুঝলে, তোমার চাল কিস্তিমাত করবে?"
প্রমিত পিছন দিক থেকে তুলিকে জড়িয়ে ধরে, "কেন, আমার বন্ধুটি তো রয়েছে। তার কাছেই শুনলাম, তার বোনটির নাকি মন খারাপ হলে মাঝ রাতে ছাদে ঘুরে বেড়ায়, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে"!
-"মন খারাপ তো অন্য কোনো কারণেও হতে পারতো!"
-"পারতো, তবে পরীক্ষা শেষ, সচরাচর সবাই আনন্দেই থাকে। হল থেকে বেরিয়ে রঞ্জুকে বলাও হয়েছে, ফাটাফাটি পরীক্ষা হয়েছে, ট্রেনে উঠেও আপনার গলা স্বাভাবিক ছিল। তারপর বাড়ি ফিরেই আপনি চেঞ্জ, তারমানে ওইটুকু সময়েই এমন কিছু ঘটেছিল, যাতে আপনি আপসেট হয়েছিলেন। যতদূর জানি, ওই সময়েই আমি আমার পাকা দেখার কথা আপনাকে জানিয়েছিলাম!"
তুলি সামনে ঘুরে প্রমিতের বুকে কিল মারে, "পাজি, নচ্ছার!"
প্রমিত তুলির হাত শক্ত করে ধরে, "আর কখনো দীপ্তকে, ঋককে মনে পড়বে না তো?"
তুলি শান্ত হয়ে প্রমিতের বুকে মাথা রাখে, "পড়লেই বা কি, তুমি তো আছো, ভুলিয়ে দেবে।"
প্রমিত শক্ত করে তুলিকে জড়িয়ে ধরে, "কবে যাবে আমার ঘরে, আমার হয়ে? আমি কিন্তু বেশিদিন ওয়েট করতে পারবো না।"
তুলি চোখ বন্ধ করে, না, দীপ্ত নয়, ঋক নয়... প্রমিত; তুলির কামড়ানো রোল ছিনিয়ে নিয়ে কামড় বসিয়েছে, বলছে... এঁটো খেলে ভালোবাসা বাড়ে।
লজ্জায় লাল হয়ে যায় তুলির গাল দুটো। প্রমিতের বুকেই মুখ গুঁজে বলে, "ভালোবাসি,ভালোবাসি!!"