Soumanti Sinhababu

Classics Inspirational Thriller

4.0  

Soumanti Sinhababu

Classics Inspirational Thriller

কাশ পাপড়ি(শারদ সংখ্যা)

কাশ পাপড়ি(শারদ সংখ্যা)

9 mins
448


                 এক


আশ্বিনমাসের শিশিরভেজা ভোরগুলোকে হঠাৎ কে যেন চুরি করে নিয়েছে তিতলির জীবন থেকে, কতদিনে শিউলির সেই গন্ধটা পায়নি সে, খানিকটা অন্ধকার, কিছুটা মন ভালো হয়ে যাওয়া গন্ধ! ধীরে ধীরে বন্ধ জানালার কোনা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে সে। উইতে কাটা পাল্লার মাঝখান দিয়ে ফাটল বেয়ে এক ফোঁটা লালচে আলো ঢুকছে ঘরে। চোখ বন্ধ করেই টের পায় সে রোদ উঠেছে অশ্বত্থর মগডালে, পাতাপ্যাঁচার ডাকে টুপ করে এই নামবে সে উঠোনে। বাড়িটার সাড়া ফিরল যেন শেষমেশ!।এমনিতে তো রাতবিরেতে, কালঘুম অভ্যাস করতে করতে রোজই একবার করে মনে হয় তিতলির, এই বুঝি মরেই যাবে সে আর মালগাড়ির চাকার ঠনঠন শব্দটা শিকল-চুড়িপরাা কঙ্কাল হাতে তাকেও লুকিয়ে আসবে ওই পাতার আড়ালে যেদিকে টেলিফোন - ইলেকট্রিকের তারগুলো নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে, আর কোনো খবর মেলে না। 

"ময়ুর কটা তৈরী রাখিস... সকাল সকাল আবার নেবে বলেছে। দুদিন বাদেই মহালয়া, এদের জিনিসপত্র বিক্রিবাটা বাড়ার কথা, তা নয় যত..." ঠাকুমার শেষ কথাগুলো সচরাচর কানে তোলে না সে। ঘুরে ফিরে তো সেই একই দিকে যাবে। কবেকার জরা-খরা- মন্বন্তর-বর্ষা - জন্ম-মৃত্যু... আস্ত ইতিহাস বইয়ের মত আউড়ে যাবে মানুষটা। ঠাকুমাকে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করাতে পারলে ভালো হত, নির্ঘাত প্রতি বছর ফার্স্ট হতো ইউনিভার্সিটিতে। অবশ্য, যেখানে তারই ঠিক নেই, সেখানে আর ঠাকুমা কেন? 

আলগোছে কার্ডবোর্ডের হালকা বাক্সটা খোলে তিতলি। এইটুকুই যা দূর দিগন্তকে টেনে আনে অন্দরমহলে, নইলে তো উঠোনজোড়া কাঁটাতার, নীচের মাটি হঠাৎ শিউরে ওঠে আগুনের আঁচে! আচ্ছা ওই কামরার সমুদ্র বেয়ে সেও যদি এক ঝটকায় পেরিয়ে যেতে পারত বন্ধুর থেকে সমতলে শান্তির পথে? কিংবা ওকে শব্দ ছুঁড়ে দিলে ও যদি উচ্চারনে ধ্বনি ফুটিয়ে তুলত?


               দুই

শুকনো ধুলোর চাপে দম আটকে আসে অনন্তর। বারোমাস এই স্টেশনে স্টেশনে বাক্স তোলপাড় করতে করতে নিজেকে আজকাল কেমন যেন অচেনা লাগে তার, ভুলেই যায় মাঝে মাঝে তারও কোনো কালে একটা বাড়ি ছিল, দরজার সামনে বুড়ো স্বর্ণচাঁপা গাছের তলায় ঠেস দিয়ে বসে একটা মানুষ তার পথ চেয়ে দিন গুনছে। অবশ্য হিসেব মতো দেখতে গেলে ওগুলো ঠিক তারও না, ওই মানুষটারই... তারই আনা ডালে গজানো চাঁপা, ফুলকাটা থালা-বাসন, পালঙ্ক ।এত ভাবনা চিন্তা যদিও সে করে না কোনোদিন। তবুও একবার করে মনে হয়, সাদামাটা ওই চিঁড়ে-গুড় দিয়ে ওরা একদিন তাকে ঘরে না ডাকলে সে কি বাঁচত?

বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে অনন্ত। সিগন্যাল পড়ে গেছে। এই জায়গাটা এমনিতেই নির্জন, সীমান্তের কোনা ছুঁয়ে থাকা এই গ্রাম খানাতে বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না ভারী ইঞ্জিনটা। ওই কয়েকটা কুটির শিল্প, বাঁশ, বেতের জিনিস, কাগজের মালা এই সব কুড়িয়ে দ্রুত ফিরে যাওয়ার পালা। এমনিতেও যা অবস্থা! 

অন্যরা সব দুরে দাঁড়িয়ে একজোট হয়ে গল্প জুড়েছে।এই জগতে হরেক রকমের মানুষ আছে, কিন্তু কারো সাথেই ঠিক খাপ খাওয়াতে পারে না অনন্ত। তার থেকে দূরের মাঠ বনের দিকে তাকিয়ে থাকাই ভালো তার। বেশ এই রকম শরতের দুপুরবেলা শুধুই দুঃখ-দুঃখ ভাব জাগে, নিজের মনেই আওড়ায় সে, 

"এসেছে শরৎ, হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার' পরে..." 

আজও বকুলনগর লাইনের বহু পুরোনো দুর্গাপুজোর বিজ্ঞাপনটা চোখের পাতার ভেতরে তুলোর মত উড়ে বেড়ায় তার, চুপ করে উঁকি দেয় সে মনের কোনায়,সাদা মেঘে ভরে ওঠে তার দিক- দিগন্ত। জামার পকেটে হাত দিয়ে দেখে সে, ঠিক তারে মেলা অবস্থায় এসে উড়ে ঢুকে পড়েছে মুঠো মুঠো। বাড়ির পাশে যা ঝোপ হয়েছে! কাটার কথা উঠেছিল, কিন্তু তিনি বাধ সাধলেন। অবশ্য এখন মনে হয় ভাগ্যিস মিউনিসিপ্যালিটি পরিষ্কার করে যায়নি সবটা... এত কাশফুল তো তায় ফুটছে।সে কাজে আসার সময়ে মাঝে মাঝে সবাই মজা করে, এই যে এলেন আগমনীর চিঠি নিয়ে! যত্তসব! হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যায় তার। কার্ডবোর্ডের স্তূপের দিকে তাকিয়ে দেখে সে... হ্যাঁ, ওই তো সব বাক্সের নীচে উঁকি দিচ্ছে, ধুসর কাগজের গুচ্ছটা! আলগোছে তুলে নেয় সামনের ক্যালেন্ডারের বান্ডিলটা। এখনও অনেকটা যে বাকি!

পড়ন্ত বিকেলের রোদে দূরের সবুজ রেখাটা আরো দূরে সরে গেলে, ফিসফিস করে বাতাস,ক্লান্ত হৃদয়ের অন্দরমহল থেকে অক্ষরকটা জাগিয়ে তোলে অনন্ত, কোনো একদিন স্বর্ণচাঁপার ছায়ায় বসে সে পড়েছিল, কাগুজে উড়োজাহাজটার ভেতরের পরতে লেখা, "স্বপ্ন সবাই দেখে"! সূর্য ডুবে গেলে কি ঝরাপাতার শব্দটা বেশি গভীর হয়ে ওঠে? কে জানে! 


              তিন

দুর্গাটুনটুনিটা সারাদিন কাশের ঝাড় থেকে দুধসাদা পাপড়ি তুলে নিয়ে যায় টগরের ডালে বাসা বাঁধতে, নরম তুলোর মত ফুলে মুড়িয়ে রাখে ঘরদোর, মেঝে। আজ চল্লিশ বছর ধরে এই পাখিদের জন্ম, মৃত্যু, সংসার মরা নালার মত তাঁর জীবন দিয়েও তো কম জলস্রোত বয়ে গেল না! দীর্ঘশ্বাস ফেলে দূরের দিকে দেখেন উমা দেবী । আজকাল দূরের জিনিস ছাড়া বাকি সবেই চোখে ভীষণ কষ্ট হয়, উঠতে বসতে পায়ে ব্যথা করে। বয়সের দোষ। থাকারও তো কেউ নেই সেভাবে... কাছের সবাই কবেই দূরে সরে গেল! পাখিটার কালো পালকে ঝিলিক দিয়ে ওঠা শরতের রোদ্দুরে দুনিয়া বড় ঝাপসা লাগে! 

অথচ এমনি দুপুর কি আর এরকম ছিল চিরটাকাল? সরকার দাদু মাটি-হাতে অপেক্ষা করে থাকতেন, দুই বোন ছুটতে ছুটতে হাজির হোত জিনিসপত্র নিয়ে। বাড়ির মেয়েরা যখন তখন মাঠে, বনে ঘোরে বলে কম হাপিত্যেশ করেছে লোকে? কিন্তু তারা দিব্যি ছিল... ফুল কুড়িয়ে,পুতুল গড়ে। সত্যি, সেসব কাগজের পুতুল দিয়ে একবার পুতুলনাচও হয়েছিল! আর ঠাকুরের কাজ? তাদের ওই কাগজের সাজ দেখতেই লোক জুটত দূর-দূরান্তর থেকে। যে বংশের পুজোয় যা নিয়ম! 

মাথা নীচু করেন উমা। জগদ্ধাত্রী যদি বেঁচে থাকে এখনও, কোথায় রইলো বোন তাঁর? সেই একটা ভয়াবহ সন্ধ্যায় বাড়ির পিছনের বাঁশবন দিয়ে সেই যে পার হয়ে গিয়েছিলেন ধানক্ষেত, জলা... আর দেখা হয়নি চেনা পরিচিত মুখ গুলোর সাথে, মহালয়ার ভোরে উদ্বাস্তু ক্যাম্প থেকে কোথায় যে রাত দুপুরে উঠে চলে গেল বড় পিসি আর জগদ্ধাত্রী ... হাজার দেবীপক্ষের পরও ফিরে এলো না। তার পর সে এক দীর্ঘ গল্প। একটা ছেলেকে যদি কুড়িয়ে বাড়িয়ে মানুষ করলেন কোনো মতে, সে আবার সাহায্য নেব না করে বেরিয়ে পড়লো এই বিরাট দুনিয়ায় কাজের খোঁজে! ঋণ রাখবে না মাসীর। তবে পর আর কবে আপন হয়? 

মা, বাবা বলতে তিন কুলে কেউ ছিল না তো ওর, রিফিউজি পাড়ায় দীর্ঘ দিন কোন বারো ঘর এক উঠোনের কোণে বাড়তি খেয়ে মানুষ। ও পাড়া থেকে আসার সময়ে সাথে করে এনেছিলেন তিনি, মানুষ করলেন, সব হলো... তবু চাকর হয়েই রয়ে গেছে সে আজও।

"ও দিদি , চশমাটা পরে একবার দেখুন তো এইগুলো, অনন্ত দিয়ে পাঠিয়েছে আজ, আপনাকে দিতে, এই বাক্স... আর এটা একটা চিঠি নাকি, দেখুন?" বুড়ো পিওন বারান্দার সামনে জিনিস পত্র নামিয়ে রাখে। 

"এই টেলিফোনের যুগে হাতে লেখা চিঠি, শখ আর গেল না ছেলের... আপনি পড়ুন, আমার কাজ আছে যাই। "

আস্তে আস্তে চিঠিটা হাতে তুলে চশমা পরে দেখেন তিনি। বহুদিন ধরে এক পাড়ায় থাকতে থাকতে পাশের ঘরের ওই পিওনও জানে তার খামখেয়ালী স্বভাব। কায়দা করে আবার চিঠি লেখা!মোড়কের ভেতরে ভাঁজ করে রাখা চিঠিটা ধরে আলোর দিকে মেলে ধরেন তিনি। হিজিবিজি হাতের লেখায় ,সে টেনে টেনে লিখেছে 

" মাসি, 

একটা ছোটো উপহার পাঠালাম। একশো আট পারি না পারি, গোটা কয়েক কাগজের নীলপদ্ম রইলো। এরপর ধারদেনার বোঝা নামিয়ে যদি কোনোদিন দেখা হয়, দুর্গাপুজো দেখতে নিয়ে যাব। ভালো থেকো। 

    - ইতি, 

অনন্ত" 

ছোট্ট বাক্সটা ঠেসে ঠেসে নীলপদ্ম, একটা হাঁস আর একখানা ময়ুর। ঠিক এমনি করেই ময়ুর সাজাত আরেকজন! 

কাশের ঝরে যাওয়া পাপড়ি একটা জীর্ণ আঙুলের ডগায় ধরেন উমাদেবী। আজ যেন সাদা একটা দিন! 

                 চার

বর্ডারের প্রান্তর চিরে অন্ধকার ঘন আজ। ধীরে ধীরে মালগাড়িটা এসে থামার শব্দে সতর্ক হয়ে ওঠে গাছের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা রাত, ডোরাকাটা নীল গামছাটা গলা থেকে খুলে দূরের দিকে দেখায় একজন, পূর্বের দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে বাকিরা নামে। ঠিক ছটা পাঁচে স্টেশন পার হওয়ার কথা, দশ মিনিট সময় এখানে। 

"সামনেরটা?" সাবধানে বললো অনন্ত।

"না, আমলকী বাগানের পাশের খুঁটি" মৃদু আওয়াজ হয়। পাঁচটা সাতান্ন, আর একটুখানি... 

"বুধবার ,5:57 pm", ডায়েরির মাঝের একটা পাতা খোলে তিতলি। অগ্নুৎপাত, বিস্ফোরন শেষে এত কিছু টিকে থাকে, যদি... যদি একবারের মত ডায়েরিটা সেরকম কিছু করে! এটুকু বিশ্বাস রাখা ছাড়া আর তো কিছু বেঁচে নেই তার হাতে। একটু আগেই পাশের বাড়ির ঝন্টুদাদাকে দেখেছে সে রেললাইনের দিকে যেতে। বাক্স আনতে যাচ্ছে, সবাই অন্তত তাই জানে। সেই বাক্সে করেই কুটির শিল্পের জিনিস যাবে। তিতলিদের কাগজের, পাশের বাড়ির বাঁশের, আরো কত কি। 

"আজ বিকেল থেকে অত এরোপ্লেন উড়ছে কেন বল দিকি তিতলি... মানে ওই হেলিকপ্টার?" ঠাকুমার কথায় কান খাড়া করে তিতলি। কি জানি হয়তো রোজই ওড়ে, অন্য সময়ে খেয়াল হয় না। কলমটা চেপে ধরে সে। 

ইছামতীর জলে রাতবিরেতে নৌকো নিয়ে ঘুরেছে অনেক জওহর, কিন্তু অমাবস্যার আগের রাতটা বড় বিপজ্জনক। কামট আছে এমনিতেও প্রচুর, জলে, ডাঙায়।  

" পূর্বের ঘাটে যাব, তিনজন লোক..." মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় সে। একজন চাদরের খুঁট চেপে ধরে উঠতে যায়। হঠাৎ কি কেউ নড়ে উঠলো ছইয়ের ভিতর? 

"কেউ আছে নাকি?"..." না না... নদী ছটফট করছে" একটু হেসে উত্তর দেয় সে।সত্যি নদী বড় ছটফট করছে আজ। আরেকবার নিজে-নিজেই হেসে ফেলে জওহর। 

শরতের ভোরের গোলাপী রেখাটা জেগে উঠেছে আবার আকাশে। "আলোর এই দিকটাতে এসে ছবিগুলো তুলুন" একজন কনস্টেবল পিছনে চিৎকার করছে ক্যামেরাম্যানের দিকে। মাথা সোজা করে তাকায় অনন্ত, এত লোকের সামনে লজ্জাটা ঠিক কাটছে না! 

"আগে, অনন্তবাবু... আপনি বলুন, প্রথম বুঝলেন কবে?" কবে... একটু ভাবে সে। 

কবে ঠিক বলা যায় না, এটুকু মনে পড়ে এক দুপুরে ট্রেন থেকে এই মালগাড়িতে বদলি হয়ে আসার পর, একটা বাক্স কাগজের কাশের শিষলাগানো আঠা দিয়ে দেখে একটুখানি অবাক হয়েছিল সে। বিভিন্ন ধরণের শিল্পের জিনিস ভেতরে থাকে, এটা বাইরে কেন? কাশের শিষটায় অবশ্য একটু খুঁতও ছিল, ধুসর রঙ, বিবর্ণ দেখতে। তারপরেও দু-তিনদিন একই জিনিস। অবশেষে একদিন বাক্স খুলল অনন্ত, সাধারণ সব পদ্ম, হাঁস, পুতুল। তবে কেমন যেন খাপ ছাড়া ভাবে তৈরী। হাঁসের ডানা মুচড়ে গেছে, কালির দাগ যেন কোণে। তাও দিব্যি ভুলে যেত সে, যদি না ভুল করে একদিন বাক্সের গায়ের ওই কাশটা ছিঁড়ে যেত হাতে লেগে! 

"তারপর?" অবাক হয়ে তাকান পুলিশের ডিসি।অনন্ত একটা নকল কাশ বের করে, পাপড়িগুলো ঝরিয়ে ফেলে।খুব সুক্ষ কাগজের একটা করে পাপড়ি। একটা কাগজে লেখা R। বাকিকটা জড়ো করে সে, আবছা আলোয় কিছু পাওয়া যায়, P, E,D।

"এগুলো জড়ো করলে হতো, PLEASE READ THESE THINGS। বাকি কাগজের খেলনাগুলো আমি পড়ে দেখেছি, পুলিশ ডিপার্টমেন্টে জমাও দিয়েছি স্যার।" 

জওহর নিস্পলকে গল্প শোনে। কে জানত, মালগাড়ি সমেত আজ বর্ডারের গোটা গ্রামটাই বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়ার কথা ছিল, যদি না এই অনন্ত এসে বলত। সবাই জানে সে মাঝি, আড়ালে আড়কাঠি ওরফে পুলিশের চরের কাজ করে সে। দীর্ঘদিন নজর রাখার পর আজ যা হোক অবশেষে নাশকতার বীভৎস সন্ধ্যাটা থমকে গেল এক ধাক্কায়। গাঁয়ের ছেলে ঝন্টু বোমা পুঁততে গিয়ে ধরা পড়েছে শুনে গোটা গ্রাম জড়ো হয়েছে প্রায় এদিকে। সেসব এড়িয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েই সদ্যঝরা শিউলির গন্ধ পায় সে হঠাৎ! ওপাড়ার তিতলি এই নিয়ে বলছিল না? গাছটা খুঁজতে যায় জওহর। ছোটদের সাথে বড় ভাব তার! 

ভিড়ের মধ্যে থেকে আরেকটু সরে আসে অনন্তও। মাসির ডাক পড়েছিল, পুলিশের মোবাইলে... জলজ্যান্ত উপহারকে ধরে আনতে বলেছেন তিনি। তিতলির ঠাকুমা জগদ্ধাত্রী দেবীকে কাঁদার সুযোগ দিয়ে তাঁর পাশের মেয়েটির দিকে তাকায় সে। ঠিক মাসির মতই এই মেয়েটি, মাসিঠাকুমার স্বভাব পেয়েছে। তার থেকে কম সে কম কুড়ি বছরের ছোটো, তাও এত বুদ্ধি! অবশ্য তিতলি একবারও তাকায়নি চোখ তুলে, এমন একটা নাশকতা সে রুখে দিয়েছে শুনলে ভবিষ্যতে আরো বিপদ আসতে পারে। অনন্তর ব্যপারটা যদিও আলাদা। 

"আমার কেউ নেই ছোটোমাসি, উদ্বাস্তু পাড়ায় থাকতাম, কার জমি দখল করে আছি এই লড়াইতে বাবা-মাকে হারালাম। ভাই বোনও নেই। উমামাসি ইস্কুলে চাকরি করতেন, ওঁরও কেউ নেই, মানুষ করলেন আমাকে। আরো অনেক কিছু দিতে চাইতেন আমি নিইনি... আপনারা ওখানে গেলে কিন্তু সব নেব। খুব সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম আমি ছোটবেলায়, বড় হয়ে মালগাড়িতে জিনিসপত্র তোলপাড় করি। কিন্তু তাই বলে, খবর ভুল আনিনি।এই বার আপনি আর তিতলি মাসির সাথে দেখা করুন, আমি দেখি আর কতটা পারি!"

তিতলির ঠাকুমা চোখ মুছে বসেন। এত বছর পরে দেশভাগে হারিয়ে যাওয়া দিদিকেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব? জীবনটাই যে ফুরিয়ে গেল! তবে একথাটা বললে নাতনি হেসে বলে," পাপড়ি ঝরে ফুরিয়ে যদি যায় সব, নতুন ফুল তবে ফোটে কেন একই গাছে?"

"চন্ডীপাঠের সময় হয়ে গেল রেডিওতে।" পুরোহিত জেঠুর কথায় সম্বিত ফিরে হঠাৎ জগদ্ধাত্রী দেবীর কাছ থেকে উঠে এসে তিতলি বলে চুপিচুপি "মহালয়াটা এখানে থেকে যাও অনন্তমামা।" অনন্ত হাসে একটু। দূরের বাড়ির সারি থেকে সমস্বরে মহালয়ার সম্প্রচার শুরু হয়েছে। 

" সর্বভূতেষু শান্তিরূপেন সংস্থিতা মানে কি তিতলিদিদি?" শিউলির ডালি নামিয়ে প্রশ্ন করে জওহর। 

"দেবী সমস্ত কিছুর মধ্যে অবস্থান করছেন, শান্তি রূপে।" স্থির হয়ে ঘাসের দিকে তাকায় তিনজনেই। ততক্ষণে ভোরের হাওয়ায় ইছামতীর তীরে কাশের গুচ্ছ গুচ্ছ বীজপাপড়ি উড়ে আসছে, 'সর্বভূত' তো ওরাও! 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics