কয়েকটি শরতের জন্য(শরৎকাল)
কয়েকটি শরতের জন্য(শরৎকাল)
- সৌমন্তী সিনহাবাবু
এক
কখনো কখনো আকাশে, বাতাসে মাঝে মাঝে অদ্ভূত এক রঙ ধরে, না কমলা, না লাল... অনেকটা ওই ফুলটার মত? ভাবলেই বেশ অন্যরকম লাগে ডালিমের। নাম তার যাই হোক না কেন, তার সাথে জড়িয়ে থাকা পাপড়িমেলা বস্তুটির রঙ তার ভারী প্রিয়, বেদানার ফুল! তবে এমনি সময়ে সন্ধ্যার মুখেই এমন রঙের বাহার বেশি। রেলিঙের কোনা আঁকড়ে ধরে দেখতে পায় সে, আস্তে আস্তে মেঘের ভিড় পার করে, রাইস মিলের চিমনিটার ওই পার বেয়ে দুনিয়া ধুয়ে যাচ্ছে সেই মায়াবী আলোয়, আপন মনেই কোনো কোনো দিন আঙুল দিয়ে দাগ টানে ডালিম স্টিলের গায়ে,
"রাঙা মেঘ সাঁতরায় অন্ধকার আসিতেছে নীড়ে"।
সত্যি নীড়ে অন্ধকারই দানা বাঁধে। এমন অদ্ভূত নাম কার হয়? তবুও রেখেছে ডালিম। ওই টুকু ঘিরে যত গল্প তাদের, যত রকমের স্বপ্ন দেখা। ভাবতে ভাবতে ভাবনার অতলে তলিয়ে যাওয়ার ফাঁকে হঠাৎ মৃদু ঠকঠক শব্দে ঘোর কাটে তার । মৌটুসিটা বাড়ি ফেরার পথে পাশের জানালায় ধাক্কা দিয়ে জানান দিয়ে গেল বুঝি! তাড়াতাড়ি পেছন ফেরে সে। যাওয়ার সময় হলো বোধহয়, লনের ঘাসের গায়ে কুয়াশার চাদর জমছে। অলস ভাবে কপাটে হেলান দিয়ে টাইপ করলো ডালিম,
"নীড়ে ফেরার সময় হয়েছে।"
দুই
একদম ফুটে আসার শেষে কফির ওই কাঠরঙা বাদামী দুধের দিকে চোখ পড়লেই প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে যায় শিরীর, গলার কাছটা ব্যথা ব্যথা করে ওঠে। বিশেষ করে এই সন্ধ্যার হিম হাওয়ায় আরো বেশি মনে হয় এই সব কথা। আর তখনই কি ওপাড়া থেকে শাঁখের শব্দটা শোনা যাবে!
আজ প্রায় চার মাস হল একই রুটিনে চলছে জীবন। সেই কোন পাঁচ মাস আগে, বিরাট ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পাশে বসিয়ে মা গল্প বলেছিল সাত সমুদ্র, তেরো নদীর পারে একটা সবুজ দেশের, নদী আছে কত সেখানে, কত বড় করে ঢাক বাজিয়ে দুর্গাপুজো হয়। ছোটো থেকেই ঢাক চেনে শিরী, এই নিয়েই পাতার পর পাতা লিখত মা, রকমারি ঢাক নিয়েই যত কারবার তাদের। তখন যে কি হচ্ছিল কে জানে? মাঝে মাঝেই বাবা কেমন মন খারাপ করে বসে টেরাসের কোণে লতার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকিয়ে থাকত আকাশের দিকে আর তাদের গল্পের মাঝখানে ঢুকে পড়ে একবার করে বলতো,
"শিরী তুই যাবি? চল তোকে রেখে আসি।"
অবশ্য ক্লাস-টাস গুলো ছুটি পড়ে গেছে বহুদিন, এমনিতেও শিরী সবে শিখেছিল এবিসিডি... আর এই অ, আ যা দিয়ে আজকাল লিখতে পারে সে। ওর বন্ধুরা অবশ্য কেউ এই গুলো জানত না... শিরীর বাড়ির ভাষাটাও না। ওদের সব আলাদা। কি জানি, এত রকমফের কেন? অবশ্য বড় মামীমা বলেছে, সামনের মাস থেকে সেও ওই রাস্তার উল্টোদিকের স্কুলে ভর্তি হয়ে যাবে। যেখানে কোকোরা পড়তে যায়। আরেকবার গলা ব্যথা করে উঠলো শিরির। আর বাড়ি যাওয়া হবে না তাহলে... কাউকে দেখতে পাবে না কোনো দিন! তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নেয় সে, কেউ দেখতে পেলে আবার বকাবকি করবে। এখন তার খালি বাক্স খুলে ওটাই দেখতে ইচ্ছে করে... তাও তো দিল না এয়ারপোর্টের লোকগুলো!
বেশ টকটকে কমলা একটা চেনা পাতা। এই রকম পাতা দিয়েই সন্ধ্যার আলোয় পড়ার ঘরে বসে গ্রিটিংস কার্ড বানাত শিরী। স্কুলে অন্য বন্ধুরাও আনত। কম মজাটা হয়েছে তাদের! আর পাতার তো কোনো অভাব ছিল না, গোটা বাড়িটাকেই ঘিরে থাকত গুচ্ছ গুচ্ছ পাতা, শরত পড়লেই তার কমলাটে রঙ ধরে, ওরা বলে ফল। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে যেই কেঁদে ফেলেছে সে প্রায়, জানালার পাশ থেকে ফিসফিস করে উঠল একটা কে,
-"কালকে এসে দেখাস রে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের বোন, মজাটা দেখাব।"
ভয় পেয়ে খানিকটা ছিটকে সরে গিয়েছিল সে। সত্যি রাত বিরেতে ওই রকম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এরা যে কেন তাকে ভয় দেখায় কে জানে! ভুল করেই জিনিসটা নিয়েছিল কবে তার থেকে যেন সারাক্ষণ রেগে আছে ওই কোকো ওর উপর। জড়ো হয়ে মাটিতে বসে পাতাটা আঁকড়ে ধরে সে। বাবাকে কতদিন দেখেনি, মায়ের সাথে কথা হয়নি।
"শিরীষ পড়তে বোসো... এসো।" ছোটোদাদুর ডাক এসেছে। নিজের ভালো নামটা শুনলে কেমন একটু লাগে তার মাঝে মাঝে, মা বলত কোন একটা ফুলের নামে নাকি নাম তার। শিরীষ আর গগনশিরীষ। এই নামের কোনো ছেলে মেয়ে ভেদ নেই। আচ্ছা, সেই ফুল কেমন? ওই পাতাটার মত? কে জানে! হলঘরের থামের আলো একে একে মুছে আসে, ছায়া সঙ্গে নিয়ে ধীর পায়ে হাঁটে সুদূর উত্তুরে কোন সে দেশের শিরী!
তিন
শ্যামা পোকার বাড়াবাড়তি হলে আলোর সামনেটা কেমন যেন ঢেকে যায়... আলোর জোর কমে। বেঞ্চের নীচের ঘাসগুলো শ্যামা ঘাস নাকি? জল ধরে রেখেছে। পায়ে শিশিরের স্পর্শ অনুভব করতে করতে কোকোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ডালিম। তাকেও পুরো দেখতে লাগছে সন্ধ্যাটারই মত!
মাঠের উপর আস্তে আস্তে স্ট্রিটলাইটের ধোঁয়াশা ঘনিয়ে আসে, দূরের রাইস মিলের সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আওয়াজটা আসছে না আর। বহু ক্ষণ এমনিই স্থির হয়ে বসে আছে ওরা। আজ আর জানালা টপকে ঘোরাঘুরি করলে কেই বা জানতে পারবে? পাড়ার পুজোর মিটিং-এ বাড়ির সবাই চলে গেছে, এক্ষুনি ঘরে না ফিরলেও চলবে। আকাশের কোণে দেখলো ডালিম। ওইখানে কালপুরুষ দেখা যায় শুনেছে সে। বড় হয়ে টেলিস্কোপ কিনে দেখবে ঠিক। আরো অনেক কিছু... হাওয়ার স্বরে ফিসফিস করে সে, "তোরা ভগবানকে দেখেছিস?"
কোকো অবাক হয়ে তাকায়। এই অসংলগ্ন বাতাসে মাঝে মাঝে এমন কথা মনে আসে, যার কোনো উত্তর হয় না। শুক্তি হাসল অল্প।
"আমিও দেখিনি জানিস, কিন্তু আমাদের ম্যাডাম বলেছেন, ও তো দেখার নয় পাওয়ার নয়।"
"সে কিরকম?" ডালিম কৌতুহলী হয়ে ওঠে।
"মানে, মনে কর এই যে আমরা একটা ইচ্ছে নিয়ে বেড়াচ্ছি, এটা যখনই পূর্ন হবে, আমরা খুশি হব ভগবানকে পাওয়া হয়ে যাবে।"
"মানে বুঝিস তুই?" কোকো প্রশ্ন করলো। শুক্তি খানিকক্ষণ কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ সামনের দিকে আঙুল বাড়াল,
" ওইরকম না?
আনমনে মাঠের দিকে দেখলো সবাই। অর্ধেকের বেশি জায়গা জুড়ে খেলার জায়গা , ময়দান ছাড়িয়ে উঠেছে স্কাইরাইজখানা... বাকি অর্ধেক যেটুকু রইলো সেটা জুড়ে খালি ইটের সারি।
"এখানে ওরকম জিনিস হয় কি করে?" পাশ ফিরল সে। সত্যিই তো ওখানে ওরকম কি করে হয়? ধীরে ধীরে কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার চোটে, শব্দের অসংযত বিন্দু ফুটে উঠছে কালির আকারে।
মাঝ রাত্রির শিশিরও কখনো কখনো যদি ওই রয়ে যাওয়া বিন্দুতে এসে থমকে যায়, সকালের আলোয় দেখলে মনে হবে, মুক্তো জমেছে দেওয়ালের গায়ে!
চার
কাঁচা ঘুম ভাঙলে প্রবীরবাবুর বড্ড অস্বস্তি হয়। কিন্তু এই মোবাইল ফোনের জ্বালায় করার আর আছেটা কি? একেই এত জমির দেখভাল নিয়ে মাথা খারাপ হয়ে যায় তাঁর। বরাবর দিল্লী শহরে বাস করতে করতে এই আধা-মফস্বলে উঠে এসে হঠাৎ সব দায় দায়িত্ব সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। তাও বন্ধুর চেনা প্রমোটারখানা ছিল। বাড়ির সামনের এতটা জায়গা চড়া দামে বিক্রি করে বেশ শান্তি পেয়েছেন শেষমেশ। কিন্তু সে আর টিকছে কই?
"সার্চলাইট নিয়ে দেখেছেন?" জড়িয়ে আসা গলায় কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। রোজ একই তো প্রশ্ন করার আছে। পরিস্থিতির উন্নতি কিছু হয়নি, পাহারা বসিয়েও না।পাড়ার লোকেও
কম চেষ্টা করেনি কিন্তু অবস্থা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই। ওরকম একটা দক্ষ কুকুরও পুষেছেন, বুলু, ভয়ানক বুলডোজার। এমনকি সেও পেরে ওঠেনি!
কয়েকদিন ধরেই বোনের চিন্তায় মনটা খারাপ হয়ে আছে প্রবীরবাবুর। তার সাথে আবার এও। কারা যে করে এমনি ছেলেমানুষী! দূরে কোথায় ছাতিম ফুটেছে, তার সাথে হিম মিলে মিশে একাকার। এমন রাতে অনেক কিছু হঠাৎ খেয়াল হয়। সেই ডিঙি নৌকো কি আজও আছে?
"রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়..."আর কি করে ঘুম ফেরে যদি ছোটোবেলার সেই প্রিয় শব্দবন্ধ মাথা চাড়া দিয়ে হঠাৎ মনে করায়, সেই কিশোরকে আগলে রাখা হয়নি!
"আমাদের ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের শরৎকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে!" কখন যে মিস্টার আগরওয়ালের সাধের বিল্ডিং-এর গায়ে রাত বেরাতের দুষ্কৃতীদের সেঁটে দিয়ে যাওয়া পোস্টারের লাইনই আউড়াতে শুরু করেছেন তিনি, বুঝেই উঠতে পারেননি আজ আর!
পাঁচ
"বলতে পারবে তো ঠিক করে?" শিরী ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ে। যদিও কি বলবে তার নিজেরও ধারণা নেই। এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না কিছুই!
অন্যদিনের মত আজকেও ভোর থাকতে উঠেছিল সে, ঝুলবারান্দার পাশের ওই গাছটা, যাকে দিদিমা বলে শিউলি তার ফুল ঝরার সময়ে। ওই ফুলগুলো বড্ড ভাল লাগে তার। ঠিক ফ্লারি বরফের মত ছড়িয়ে থাকে বাগান, রোয়াক, পোর্টিকো থেকে কারশেডের টিনের চাল পর্যন্ত। তার একটা আঁকশি আছে, মাঝে মাঝে তাই দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সে কিছু ফুল ফেলে দেয় নীচে, নইলে কখনো কখনো নীচে নেমে নাড়া দেয় গাছটাকে। কি সুন্দর ঝরঝর করে পড়ে! হাততালি দেয় সে তখন খালি।
আজও সেটাই করতে গিয়েছিল কি কুক্ষনে শিরী। দাদু দরজা খোলার পরই যেই নেমেছে বাগানে, সাদা ফুলের চাদর বিছানো গোটা পথ। কি ভালোই লাগছিল ছুটতে... দেখেইনি যে ওরা লুকিয়ে ছিল বাগানে! তাকে কি কিডন্যাপ করা হল? ভয়ে গলায় অসহ্য যন্ত্রণা করে ওঠে তার।
"এই গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের বোন আরো কাঁদছে কেন?" কোকো বিরক্তি প্রকাশ করে সরে গেল। যে কবার দেখেছে ওকে, শিরী খালি কেঁদেই গেছে। ধন্য স্বভাব!
শুক্তি একটু উঠে এসে হাতটা ধরে শিরীর।
"তোকে ফেলে দেব না কোথাও নে, একটা কাজেই নিয়ে যাচ্ছি।" কি এমন কাজ? ছবছরের জীবনে এমনি কাজের কথা শিরীর জানা নেই যেখানে জোর করে টেনে নিয়ে বাসে তুলে দূরে চলে যেতে হয়। তবে সেও কি আর রাজি হয়নি একেবারে? জানালার বাইরে দেখল সে। ওই জিনিসটা ফুটেছে, মাঠে যেটা দেখেছিল সে। কাশ?
" তুই না বলে লোকের জিনিস নিস কেন রে? "কোকোকে আরেকবার রেগে তাকাতে দেখে চোখ নামিয়ে নিল শিরী। ওরকম মেঘের মতো জিনিস তো আর দেখেনি কখনো আগে, তাই নিয়েছিল... ওরা এত বকবে জানলে কি নিত?
"ওইটা আমাদের নীড়, ওইখানে আমাদের ভগবান আছেন, দেখেছিস কত ইচ্ছে ছিল কাশফুলের তাই ওই সিমেন্টের ফাঁকেও হয়েছে শেষমেশ। "ডালিম বিজ্ঞের মত বলে।
"ওইটা নিয়েই তো বলব আমরা... আর তুই বলবি তোর ওইখানকার কথা। ওখানে কি আইভি পাতা শুকিয়ে গেলেই শরৎ আসে?" শুক্তি জিজ্ঞেস করলো।
না আইভি পাতা শুকিয়ে গেলেও না... ম্যাপলের কমলা রঙ ধরলেও না, ঘরের ওই মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধটা ছাড়া হবেই না শরৎ, ফল।
" তোমরা সব কোথায় যাবে?" কন্ডাকটরের প্রশ্নে ঘোর ভেঙে তাকাল ডালিম।
"যেখানে ওই রাষ্ট্রপতি থাকেন, নোবেল প্রাইজ পেয়ে মানুষজন আসে, ওই পর্যন্ত যেতে হবে। আপনি আমাদেরকে খালি দিল্লির ট্রেন যেখানে আসবে সেই স্টেশন অব্দি নিয়ে চলুন।"
ছেলে মেয়েগুলি সব প্রায় একই বয়সের, আট-নয় মত, খালি কোনের দিকের ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকা মেয়েটি বোধহয় একটু ছোটো হবে। একটু ভাবে রমেশ। এখনকার বাচ্চারা সব কত তাড়াতাড়ি বড় হচ্ছে, সে তো তাদের গ্রামের একটা আস্ত জঙ্গল লোকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেও কিছু করতেই পারেনি। ইশ, কতদিন কন্ডাকটরি করে আর কেতকীর মধু খাওয়া হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে যায় সে। দায়িত্ব তো তাই করতে বলছে আপাতত।
ছয়
হেড-অফিসের ভেতরের ঘরে ভিডিও কলটার শেষে শীরি নয়, প্রবীরবাবু পর্যন্ত ভেঙে পড়লেন কান্নায়, শুক্তি একটু কাঁদল, ডালিম চোখ মুছে নিল, কোকো শুধু চুপচাপ। কতদিন পর সেই ঘরদোর, সেই পরিচিত মানুষদুটো! বাবা মা তাড়াতাড়ি এই দেশে আসবে, তার কাছে জেনেও শিরী নিজেকে যেন আটকে রাখতে পারছে না। ভাগ্যিস এসেছিল!
গতকাল ভোরে বাগানে বেড়াতে গিয়েই তো হঠাৎ কোকোর মুখোমুখি, হাত ধরে টানতে টানতে কোকো এনে ফেলেছিল তাকে গেটের বাইরে রাস্তায়। এই দু বছরে তার মামার দৌলতে এত বহুতল উঠছে যে খেলাধুলোর জায়গা শেষ... যেটুকু পড়ে আছে, তাদের সুখ, শান্তির 'নীড়' তাতে অলৌকিক উপায়ে কাশফুল হলেও কি শিরীকে ছিঁড়ে নিতে হবে? এমনিতেও তো আরো ফ্ল্যাট হবে ওইখানে।
প্রবীরবাবুর অবশ্য আর রাগ নেই। বোনরা বাইরের এক সে দেশে আটকে গেছে যুদ্ধের মাঝখানে, বড় কাউকে বেরোতে দেওয়া হচ্ছে না, শুধু দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের ছোটোদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের বাবা মায়ের জন্মভূমিতে। মানুষজনের জীবনের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তার উপর কাল যখন শিরীকেও পাওয়া যাচ্ছিল না, রীতিমত হার্টফেল করার জোগাড় তাঁর। ভিন মহাদেশে বড় হয়েছে সে, চার মাসে আর কত টুকু জানে ভারতবর্ষের? আর মাত্র কদিন আগেই ছয় নাম্বার জন্মদিন গেছে। চিন্তায় গোটা বাড়ির যখন মাথার উপর ছাদ ভেঙে পড়ার জোগাড়, হঠাৎ খবর এলো, শিরী নাকি তার শরৎ চাইতে গেছে! হ্যাঁ শরতই। বাবা মায়ের কাছ থেকে আসার সময়ে এক কৌটো ফল-আইভির পাতা এনেছিল, যা সিকিউরিটির হাতে আটকে গেছে। আর সাথের ছেলে মেয়েগুলি তো আরেক কাঠা সরেস! তাঁরই বিরুদ্ধে গেছে আন্দোলনে!
"তোমাদের ওই অন্ধকার নীড় নিয়ে থেকো তোমরা, কেউ আর কিছু বলতে যাবে না... শুধু শহরময় পোস্টার ফেলে লোককে ভয় দেখিও না!" তাঁর কথা শুনে ডালিম লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নেয়।
বুদ্ধিটা অবশ্য তারই ছিল। নীড়ের পাশের উঠতে থাকা বিল্ডিংগুলোর দেওয়াল, পাঁচিল, পিলারে পোস্টার লাগানো,
" আমাদের ইচ্ছেকে, আমাদের শরৎকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে "।
" বাবু, আপনার কুসুমতলির দিকে বাড়ি নাকি? " কন্ডাকটর জিজ্ঞেস করে... সেই যেখানে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল বন? "
হ্যাঁ, সে অনেকদিন আগের কথা...কোন কৈশোরে গ্রামের পাশের বীভৎস দাবানলে জ্বলে যাওয়া সে বনের কান্না আজও যেন বুকে এসে লাগে। এমনি এক শরতের সকাল ছিল সে! ডালিমের পাশে গিয়ে বলে ওঠেন প্রবীরবাবু,
"তবে আমাকে দিয়ে দিতে পারো বাকি পোস্টার গুলো, একটু দরকার আছে। " কন্ডাকটর রমেশও গামছার খুঁট চাপা দেয় চোখে,
"অনেক মিছিল দেখিছি এই রাস্তাঘাটে, এমনটি প্রথম... এইটাতে আমাকেও পারলে নেবেন!"
"আর শিরীকেও..." এতক্ষণে গলা বেরোল কোকোর, "গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের বোন হতে গেলে কান্না ছাড়াও আরও কিছু লাগে। "
" এই শীরি আর সিরি আলাদা, তাই না মামা?শিরী মানে গান আর শীরিষ, একটা ফুল...? "প্রবীরবাবুর পরিবর্তে রমেশই এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়,
" শুধু ফুল নয় বোন, একটা গাছ... অনেক স্বপ্ন আছে যার। আকাশ ছোঁয় যে শিরীষ, সেই গগনশিরীষের ফুল হয় এমনি সময়ে। সেই গ্রীষ্মে এমনি শিরীষ হয়ে ফুটে, এতদিনে আকাশ ছুঁলে তুমি। যদি তোমাকে কৌটোটা ফেরত না দেয়, আমি এনে দেব ওই লাল পাতা, কেমন? "
" না... আমি তো এইবার আমার গাছটা দেখব! "
একসাথে অনেক মানুষ খুশি হলে কি জায়গাটা স্বর্গ হয়ে ওঠে? নাকি শরৎ? কে জানে!