অ্যালবাট্রসের প্রতিশ্রুতি
অ্যালবাট্রসের প্রতিশ্রুতি


শারদ সংখ্যা
সমুদ্রের ধারে ঢেউগুলো প্রবল শব্দে ভেঙে পড়ছিল।আকাশ জুড়ে যেন মেঘেদের গায়ে কেউ কালি ছিটিয়ে দিয়েছে ।লম্বা উপকূলের রেখা যতদূর চোখ যায় অন্ধকার সমুদ্রের পাশে টানা যেখানে আগে সি-উইডের বাজার বসত আর ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ নিয়ে নীল আকাশের তলায় সারি দিয়ে দাঁড়াতো একের পর এক নৌকো। কিন্তু আজ? চিকমিক করা বালি সব কাদা হয়ে গিয়েছে সঙ্গে তেমনই কুয়াশার গন্ধ!
কাছাকাছি কাঠের বাড়িগুলোর অধিকাংশেরই উঠোনে জল ছলছল করছে।সমুদ্রের আশেপাশের এই সব জেলেবস্তিগুলোতে এই সময়ে নোনাজল ঢুকে পড়ে তছনছ করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব কিছু। সে স্রোতের কোথাও হয়তো একটা গোটা পুতুল, কোথাও একটুকরো জাল বা এমনই কিছু। তারপর জল সরে গেলে আসে অসুখ আর শূন্যতা! এ তবে ওদের কাছে স্বাভাবিক জীবন। ঝড় না হলে, ঢেউ উঁচু না উঠলে সে আবার কেমন বেঁচে থাকা!
শত শত সামুদ্রিক পাখি উপকূলের উপর হেঁটে কাঁকড়া খুঁজছিল। এ সময়ে এরা কাঁকড়া ধরে তীরে উঠে এসে আর মুঠো মুঠো বালি ছড়িয়ে রেখে যায়, ঝিনুকের কুচি মুখে করে ওড়ে। তারপর আশ্রয় নেয় জেলেবস্তির বাড়িগুলোর জানালায়, নির্জন বারান্দা-অলিন্দে, যেখানে ছড়িয়ে পড়ে থাকে তাদের পালক, শাঁখ-ঝিনুকের টুকরো, নূড়িপাথর, এটা-সেটা।
জেলেপাড়ার কোণের দিকে একটা ছোট্ট বাড়ির তাকের উপর একটা স্টিলের গ্লাস আলো পড়ে জ্বলছিল। বিছানায় শুয়ে অসুস্থ, বৃদ্ধ ওয়ারেন, যে তার জীবনের সত্তর বছর কাটিয়ে দিয়েছে নৌকোর দাঁড় হাতে ধরে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে একদিন যখন বুড়ো সূর্য সবে ঘুম ভেঙে উঠে চোখ মুছছে তখন সে সি-উইড আর নতুন কেনা আঠা আঠা গন্ধের জালটা নিয়ে বেরিয়েছিল তার বাবার হাত ধরে। তারপর আর ফিরে দেখা নয়। সমুদ্রের উপর ভোরের রোদ উঠলে তাও হাতে করে নিয়ে এসেছে সে। সঙ্গে এনেছে বৃষ্টির সুগন্ধ, সন্ধ্যার আকাশ গুঁড়ো করা রঙ! প্রিন্স রুপার্ট বন্দরের কাছের এই উপকূলের রেখা ভালো করেই জানে ওয়ারেনকে!
জীবনে যে মানুষটার প্রথম শিক্ষাই ছিল মাথা নিচু করতে, হারতে না শেখা, সেই ওয়ারেনের সেদিন যে কি হলো! দিনকতক আগে এমন ঝড়, মেঘের সাথে তুলোবরফ দেখে নাতনি মিস্ট্রাল বারণ করেছিল তাকে সমুদ্রে যেতে। ছেলেপুলেদের সব সমুদ্রকেই তো দিয়ে দিয়েছে আগেই, এই মেয়েটাই যা বেঁচে! তাই তো এর নামখানাও ওয়ারেন রেখেছে মিস্ট্রাল বলে এক ঝোড়ো বাতাসের নামে। বাতাস যে মহাসমুদ্রেও মরে না! যাই হোক সব ব্যথা এড়িয়ে জলে নৌকোর দাঁড় ফেলেছিল সেদিন সে। কিন্তু কি যে হল! খুব অন্ধকার হয়ে এসেছিল আর ঢেউয়ের জোর তেমনি!আজকালকার ভীতু অল্পবয়সী ছেলেরাও কেউই তখন সমুদ্রে নেই। ওরা তো আর ওয়ারেন নয়! হঠাৎ চোখের উপর ছিটকে পড়া নুনজলের ছিটের ধাক্কায় ওয়ারেন এক মুহূর্তে চোখ বন্ধ করেছে এমন সময়ে নৌকোটা একটা বিরাট বরফের টুকরোয় লেগে ডুবে গেলো! তারপর সে দুপুরে কি করে যে সে বাড়ি ফিরেছিল তা ওয়ারেনই জানে। তখন থেকেই আর উঠতেই পারে না সে ঠিক করে। মিস্ট্রাল ডাক্তার-ওষুধ, ছোটাছুটি সবই করেছে কিন্তু সুবিধা তেমন হয় নি। মেয়েটা মুখে বলতে চায় না, কিন্তু সবই বোঝে সে। নয় নয় করে এতগুলো বসন্ত পার করলো সে, যাদের জন্মাতে দেখেছিল সেদিন, সুখে দুঃখে সাথে ছিল যে মানুষগুলো তারা সব কবে যেন ছায়া হয়ে গেলো! আজ তার এই বয়সের অসুখ বলে কথা, আর কি সে কোনো দিনও পারবে সেই সাগরজয়ী ওয়ারেন হতে! তাও যতক্ষণ নিশ্বাস পড়ছে ততক্ষণ বিশ্বাসও!
পশ্চিমের জানালায় ধাক্কা দিতে দিতে তার পুরোনো ভাঙাচোরা কপাটের ফাঁক গলে হাওয়া ঢুকছে আর তাতেই বোধ হয় মোমবাতিটা নিভে গেলো। ওয়ারেনের ক্লান্ত চোখে একের পর এক ভেসে উঠছিল ছোটোবেলার সেই সব ছবি। অনেক দিন আগে সে একবার ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে চকচকে ঘাসের মাঠ পার করে সেই বহু দূরের পাইন বনে হারিয়ে গিয়েছিল। আর একবার সে সেই যে একটা আকাশী প্রজাপতি ধরতে গিয়ে পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়াতে তার মায়ের সে কি রাগ! বেশ মনে পড়ে রোজ রাত্রিবেলা তাদের ছোট্ট বাড়িটার কাচের জানালা দিয়ে একটা লম্বা আলোর রেখা পড়ত উঠোনে। আলোর রাস্তা! তার মাঝে ওয়ারেন কতদিন ছুটে গিয়ে রাতের ছটফটে সমুদ্রের দৌড়োদৌড়ি করে, পাথরের পাহাড়গুলোর আড়াল থেকে রুপোলি বালির প্রান্তরের সাথে চাঁদের আলোয় লুকোচুরি খেলার শব্দ শুনেছে। সে সব দিনগুলো আজ কোথায়! মনে হয় যেন কোনো স্বপ্ন! কোনো ম্লান বিকেলের ঝিকমিক করা স্বপ্ন! এখন সংসারের যে হাল, কদিন বাদে সি-উইড কিনতে গেলেও মাছ ধরতে হবে। এতদিন এমন অপূর্ব সমুদ্রে ঘুরলো ওয়ারেন, কখনো কিছু পায় নি তো তেমন, সেই মণি-মুক্তো?
জানালার কাচে হাওয়ার অনুরণনে সম্বিত ফিরে পেয়ে ওয়ারেন এক দুখানি কোনো কিছু, টাকাপয়সার খোঁজে খাটের পাশের ছোট্ট কৌটোটাতে আঙুল ঢুকিয়ে দেখে। জালের টুকরো খালি আর শামুকের খোল-পুঁতির দানা শীতশেষের স্কিনা নদীর মেলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাতেই বা আর কি হয়? যতই হোক, দুটো মানুষ তারা, মিস্ট্রাল আবার কয়েকদিন আগে কোথা থেকে কুড়িয়ে এনেছে একখানা ভেড়ার বাচ্চা! তাকে রাখতে চায় নি মোটেও ওয়ারেন, কিন্তু মিস্ট্রালের মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারে নি শেষ পর্যন্ত। আজ যদি ওর বাবা-মা, ভাইবোন কেউ একটা থাকতো, এমনি কি আর অবস্থা হত ওর! লেখাপড়াও শেখাতে পারলো না সে, সেটাই কি ওর কম দুঃখ! তাদের যুগ শেষ হয়েছে, এখনকার দিনে কেই বা ওরকম করে মাছ ধরে? সব নকল রত্ন-পাথরের ব্যবসা করে শহরে গিয়ে বাড়িঘর করে আছে একরকম, গ্রাম কিংবা সমুদ্রের খবর রাখতে তাদের সময় কই! কেউ আবার হয়েছে মাছের দালাল, দেশ-বিদেশে জাহাজে পাঠায় রুপোর ফসল!নাতিরা নাহয় আর নেই তার নাতনিকেই শিখিয়েছে সে মহাসাগরকে সামলানোর বিদ্যা যত, মাছেদের ধরন-ধারন। পাড়াপড়শিদের কথা কানে তোলে না ওয়ারেন, মেয়ে বলেই কি মিস্ট্রাল কারো থেকে কম! ওর জন্য কিই বা রেখে যাবে সে? ছোট্ট বয়স থেকে কতই তো শুক্তিতে খুঁজে চলেছে, রঙবেরঙের ঝিনুক ঘরে তুলে এনে রেখেও... হঠাৎ ওয়ারেন শিউরে উঠল সেই কথাটা মনে করে!
উঠে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে চমকে ওঠে সে সামনে থাকা প্রানীটির দিকে তাকিয়ে। পরে ঠাহর হলো, আর কিছুই নয়, তার খাটের তলায় এসে ঢুকে পড়েছে মিস্ট্রালের পোষা ছোট্ট জন্তুটি! জুলজুল চোখে ভয়ে ভয়ে দেখছে তাকে, বুড়োকে তেমন একটা পছন্দ বুঝি নয় তার! পোষ্যদের মতিগতি অবশ্য ঠিক বোঝে না সে, তার নিজের অনুচর তো একজনই, তার শখের নৌকোখানা। বিছানায় পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে না তার, উঠে গিয়ে দেখতে চায় তাকে, কম স্নেহ- যত্ন ছিল ওয়ারেনের তার উপর, সেই বা কোনো কম পাশে থেকেছে তার! দুজনে মিলে জলের যত বাধাবিপত্তি কাটিয়ে ঘর ফিরেছে একসাথে। কত, কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি তাদের! উদাসী হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যায় ওয়ারেনের অন্দরমহল। ভাবনাদের দমিয়ে রাখতে পারে কেই বা! ভেড়াটার দিকে তাকায় ওয়ারেন, বাদলার গতিক খারাপ বুঝে, বেরোতেই পারছে না বেচারী। মিস্ট্রাল না এলে খাওয়াও জুটবে না তার এই বেলা। সামান্য সি-উইড তুলে এগিয়ে দেয় ওয়ারেন তার দিকে।
বহুবছর আগে একবার সমুদ্রে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল সে, এক ভীষণ শীতের দিনে, বড় বড় বরফ চাঁইয়ের মাঝখানে। কোনো রাস্তা নেই কোথাও আর ভয়ঙ্কর জলভেজা কুয়াশা! শিস দিয়ে ঝড়ের শব্দে সমস্ত সমুদ্র যেন নেচে উঠছে। একটা ছোটো ভুখণ্ড পেয়ে তাতেই নৌকোটা ঠেসিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। সেখান থেকে যেদিকে চোখ যায় শুধুই সমুদ্র, জনমানুষহীন, অর্ধচন্দ্রাকার অন্ধকার সমুদ্র! হঠাৎই একটা ঝিনুক কুড়িয়ে পায় ওয়ারেন। অভ্যাসবশত খুঁজতে যেতেই হাতে শক্ত কি একটা ঠেকল। আলো-আঁধারি আকাশের গলিঘুঁজি থেকে সোনার বর্শার ফলার মতো রোদ ঝরে পড়ছিল, তাতেই ঝিলমিল করে উঠেছিল সেটা! নিজের হাতের মুঠোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে, মানতে পারে না কিছুই! সত্যিই কি তার হাতে আটকে আছে এক কুচি মেঘের মতো যেটা, সেটা কালো এক মুক্তো! জীবনে একবার, সেই একবারই মনে হয়েছিল ওয়ারেনের, সে নিজে খুব বড়ো, অনেক বড়ো, তার জীবনটাও ততটাই, তেমনই বিশাল!
সেই কবেকার পাথরের স্তূপ থেকে অন্ধকার খাটের একপাশে ফিরে আসে সে, হাতড়ে হাতড়ে আস্তে করে মোমবাতিটা আবার জ্বালতে চেষ্টা ওয়ারেন। দেশলাইটাও স্যাঁতসেঁতে হয়ে গিয়েছে, কাঠিগুলো জ্বলতেই চায় না। সি-উইড মুখে নিয়ে মাথা ফিরিয়ে নেয় ভেড়াটা, চোরাবাতাস ঘরে ঢুকে যেন আবার সেই দিনটাতেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় ওয়ারেনকে।
সেদিন যখন ছেঁড়া, ভেজা জিনিসপত্রের মধ্যে ওটা কোথায় রাখবে ভাবছে সে, তখনই... প্রবল হাওয়ার চোটে তার সামনের পাথরের খাঁজে এসে পড়েছিল একটা পাখি! অ্যালবাট্রস পাখি! ওয়ারেনের মনে পড়ে গিয়েছিল বহু পুরোনো, বহু দিন আগে হারিয়ে যাওয়া কোন সে হেমন্তের কথা। তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন তার দাদুর এক বন্ধু। এখনও সে যেন দেখতে পায়, তাদের বাড়ির সামনে ওয়াটার ওকের তলায় তার মুখোমুখি বসে সেই বৃদ্ধ নাবিক বলে চলেছেন তাঁর জাহাজিজীবনের একের পর অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।প্রাচীন গাছের খসে পড়া শুকনো পাতার ঝুপঝুপ শব্দ আর আগুনের আঁচের মিঠে গন্ধে ছোট্টো ওয়ারেনের কি অপূর্বই না লেগেছিল সেইসব গল্প! ডুবোপাহাড়, বুনো দ্বীপ, গুহা জলের দৈত্যদানব নিয়ে সেই জগতটা তাদের থেকে কত আলাদা!সেখানেই প্রথম শুনেছিল এই অলীক পাখির নাম।সময়ের কোন সুড়ঙ্গ বেয়ে তার কানে ভেসে আসে তাঁর কথাগুলো আবারো;
"সমুদ্র তার রূপকথা-উপকথাদের লুকিয়ে রাখে ঘুমের ভেতরে মায়া-সিন্দুকে! তেমনি তার সেরা উপকথার নাম কী জানো? অ্যালবাট্রস...!"
পরে আরো কত বন্দরে, জাহাজঘাটিতে কতজনের কাছে কতকিছুই না শুনেছে সে এই নিয়ে! গভীর সমুদ্রে রাস্তা হারিয়ে ফেলা অসহায় জেলে-নাবিকদের পথ দেখায় সে পাখি, তারা ওকে বলে ইশ্বরের দূত! ততই নাকি পাড়ি দিতে পারে দূর-দূরান্তরে! কারো কাছে অ্যালবাট্রসেরা নাকি মৃত নাবিকদের আত্মা, তাকে কষ্ট দেওয়া মহাপাপ!
কিন্তু পাখিটা তার ধুসর ডানার একটায় কোথা থেকে যে রক্তের দাগ নিয়ে এসে ওই রকম একটা বিপজ্জনক জায়গায় পড়লো! চোখের সামনে অ্যালবাট্রসকে মরতে দেয় কি করে সে! তাই ওয়ারেন তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে যেই পাখিটাকে হাতে তুলেছে মুহূর্তে ঝাপটা দিয়ে ওঠে সেটা বাঁচার জন্য, তাকেই শত্রু ভেবে! কোনোক্রমে ছিটকে গিয়ে বড় পাথরটার কোনা ধরে ওয়ারেন যখন নিজেকে রক্ষা করতে ব্যস্ত, হঠাৎই গড়িয়ে পড়ে মুক্তোটা, গড়াতেই থাকে জলের তোড় যেদিকে প্রবল সেই দিকে! সেই অ্যালবাট্রস পাখিটাকে জড়িয়ে ধরে বিহ্বল হয়ে বসে পড়ে এবড়োখেবড়ো মেঝের উপর, তার সামনের গভীর মহাসাগর সাক্ষী হতে গিয়েও থমকে যায় যেন একটুখানি!
নিষ্ঠুর সমুদ্রে কেউ কখনো চোখের জল ফেলতে দেখেনি ওয়ারেনকে। এখানে নোনা জল ঝরানো মানে তা সমুদ্রে মিশিয়ে সমুদ্রকে কয়েকফোঁটা বাড়ানো! তবুও সেদিন তার চোখ চিকচিক করে উঠেছিল। জীবনে সব পেয়ে হারালে বোধহয় এমনই লাগে!
অ্যালবাট্রস কিন্তু ওয়ারেনের মধু-লতা-শিকড়বাকড়ের ওষুধে সুস্থই হয়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গেই প্রায়। ক্ষতটা তো আর সামুদ্রিক পাখির পক্ষে এমন কিছু ছিল না। ওকে তাই মাটিতে নামিয়ে দিতেই ও উড়ে গিয়েছিল সুদূর ঘন কালো দিক-দিগন্ত ছাড়িয়ে। জলের রঙ তখন সেই মুক্তোর রঙে হুবহু মিলে যায়।
"আমার মুক্তোটা হারিয়ে গেছে অ্যালবাট্রস, দেবে ফিরিয়ে?... "
ওয়ারেন সেদিকে তাকিয়েছিল বহুক্ষণ, পাখিকে তখন আর চোখেও পড়ে না! একটু পরে ছায়া-ছায়া জ্যোৎস্না উঠলো। আবহাওয়ার এ যে কি অদ্ভূত খেয়াল! স্বপ্ন-স্বপ্ন সমুদ্রে ঝাঁক ঝাঁক তারার নিচে ভেসে যেতে যেতে ওয়ারেনের মনে হয়েছিল আকাশ থেকে কেউ যেন সান্ত্বনা ছড়িয়ে দিচ্ছে আর ঢেউয়েরা যেন বলছে "দুঃখ করো না ওয়ারেন, দুঃখ করো না..."
কি একটা পাখির ডাক যেন মিশে যাচ্ছিল বাতাসে, তারই সাথে।অ্যালবাট্রস নাকি? কথা দিচ্ছে? নিজের মনেই দাঁড় হাতে ধরে সে বলে ;
"দুঃখ কেন করব, আমার তো একটা বিশাল কালো মুক্তো রইলোই তাও , এই সমুদ্রখানা!..."
স্রোতের কোলাহলে চমক ভাঙে তার, মহাসমুদ্র যেন উল্লাসে চিৎকার করছে, পৃথিবী জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে হতে!
"চুপ, চুপ, আমি বলছি চুপ করতে... ওয়ারেনকে চেনো তো ওয়ারেনকে ?"
অভ্যাসবশত ধমক দিতে চায় সে আজন্মসঙ্গী স্রোতেদের! একসাথেই হেসেখেলে দশকের পর দশক পার হয়ে এসেছে তারা, রাগ-ভালোবাসা সবই তার তাই ওরই উপর! মহাসাগরের উপর খবরদারি করে বলে কম ঠাট্টা করত সবাই তাকে নিয়ে! কিন্তু তাই বলে কি বলবে না সে? আর কেউ না জানুক সে তো জানে তাদের কত টান একে অন্যের জন্য! কিন্তু, আজ... আজ যেন তার কথা চাপাই পড়ে যাচ্ছে জলের গর্জনে! কেমন একটা হতাশা ঘিরে ধরে তাকে।
সমুদ্রের উপর কটা সি-গাল উড়ে চলে গেলো। এই সময়ে ওরাও উপকূল ছাড়িয়ে এগিয়ে চলে যায় ভেতরের দিকে। জেলেবস্তির ধারে মিস্ট্রাল বসে বসে মেঘালী আবছায়ায় মাছধরা জালের সেলাই খুলে যাওয়া কোনা-কানাচে সুতোর ফোঁড় দিতে দিতে দেখলো একদল বিন্দুর মতো পাখি উড়ে উড়ে ঢুকছে পাড়ার দিকে, কালো, নীলচে থেকে থেকে একটা ধুসর-সাদা পাখি পর্যন্ত! দূর থেকে ঝমঝম শব্দে ততক্ষণে এগিয়ে আসছে বৃষ্টিও।
ওয়ারেনের মাথার পাশের জানালাটা হাওয়ায় ঝনঝন করে ওঠে। কিন্তু এবার একটু জোর যেন! আবারো শব্দ আর সেটা মুহূর্তে দুম করে খুলে মুষলধারার ছাঁট ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতর। সেই জ্যোৎস্নাটা যেন কেমন ছিল! সাদা... সাদা... জানালা সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে যে! নাকি...
পঁচাত্তর বছরের মৃত্যুপথযাত্রী জেলের পাশে টুপ করে পড়লো যেন কি একটা! মিহি রোদে জ্বলজ্বল করে ওঠে সেটা, বালিমাখা মুক্তো এক, কালো-অন্ধকার! আকাশধোয়া রশ্মি নেমে এসেছে তখন বাইরে, নোনামাটি, বহুবার্ষিক জোলো ওকের ডালপালা, একটা ধুসর ডানায়। নড়ে উঠে কোনো রকমে মুক্তোটা ধরে ফেলে সে, জীর্ণ হৃদস্পন্দন যেন কেঁপে উঠেছে তার অস্তিত্বের শিকড়! অগুনতি কিংবদন্তির আড়ালে চুপ করে থাকা, সেই শতসহস্র যুগ ধরে আনন্দ ও যুদ্ধে, চোখের জলে জেগে থাকা রহস্যেমাখা সমুদ্রটা যেন চিৎকার করে উঠতে চাইছে বাইরে ! তার জীবন্ত সত্তার মধ্যে দিয়ে, তার জীবন্ত কাহিনীর ভিড়ে !
মিস্ট্রাল ছুটে ঘরে ঢুকলো, সাথে পাশের বাড়ির দু-একজন। বৃদ্ধ সমুদ্রজীবী ওয়ারেন তাদের দেখে মুক্তোটা বাড়িয়ে দিয়ে উৎসুক হয়ে বলে উঠলো ;
"অ্যালবাট্রস... তার কথা রেখেছে... বলেছিলাম না, ওই নীলজলও চেনে... চেনে আমাকে!..."
তারপরই হঠাৎই লুটিয়ে পড়লো তার হাতটা! কিচ্ছুই বুঝতে না পেরে, মিস্ট্রালের জালটাকে নিয়ে টান দেয় ভেড়াটা, যেন চেষ্টা করে তার হাতটা ধরতে!
কোথায় যেন শান্ত, গম্ভীর আওয়াজ তুলে ঘন্টা বাজছে একটানা। কেমন যেন নেশা ধরে যায় তার শব্দে! একজন কয়েকগোছা বুনো সাদা ফুল এনে ছড়িয়ে দিলো, সাথে হয়েছে চার্চের জল। এখানেও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে পাখিদের সমুদ্র থেকে নিয়ে আসা টুকরোটাকরা। তেমনই একটা জিনিস, কালো মুক্তোটা যেন আলো হয়ে ততক্ষণে মুছে দিচ্ছিল একলা পড়ে থাকা সেই ঘরটার দেওয়ালজোড়া বিষণ্ণতা, ঠিক ঝড়ঝঞ্ঝাকাটা উজ্জ্বল সন্ধ্যাতারাটির মতো, যেদিকে হয়তো এখন ওয়ারেন তার শিরায়-শিরায় বয়ে যাওয়া, চিরকালের বন্ধু প্রশান্ত মহাসাগরকে নিথর করে দিয়ে চলেছে কোনো এক অ্যালবাট্রস পাখিকে অনুসরণ করে। জীবনভর ছিল তার সমুদ্র, মৃত্যুতে তো সে খুঁজে আনবেই সেই মায়া-সিন্দুক! প্রিন্স রুপার্ট বন্দরের কাছে, কান্নায় ভেঙে পড়া জল যেন বলছে ;
"অ্যালবাট্রস তার... কথা রেখেছে!"