Soumanti Sinhababu

Inspirational Others

4.6  

Soumanti Sinhababu

Inspirational Others

ইতি, তোমার স্বাধীনতা

ইতি, তোমার স্বাধীনতা

7 mins
444


মা,


পুরোনো দিনের মতো আর সম্মানে সম্বোধনের বেড়াজালে বন্দি করলাম না তোমাকে। আমাদের তো আর তেমন সম্পর্ক নয়! যাই হোক, এই ফোনের যুগে এই প্রথম তোমাকে কাগজে কলমে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছি। তুমি হয়তো বলবে, মাকে চিঠি লিখতেও এত অজুহাত? আসলে কি বলো তো, এই তো প্রথম বার, তাই বোধহয়!


এখানে আজ ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে, ভীষণ বৃষ্টি! কাচের জানালার পাশে বসে দেখতে পাচ্ছি, জলে ভেজা এই বিদেশি শহরটা একবার করে কেমন যেন আমাদের মৌলিতলা হয়ে যাচ্ছে! মা, তুমি এখানে থাকলেও বুঝতে পারতে, ওক-পাইনকেও মুষলধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সাধের পিয়ালের মতোই দেখতে লাগে, ওরকম, ঠিক ওরকম করেই যেন হাত বাড়াচ্ছে ওরাও আমার দিকে! তুমিও কি এখন পিয়াল গাছটাকে দেখছো? তুমিও কি তাই ভাবছো মা আমি যা ভাবছি?


অনেক বড় পরিবারটা আমাদের, না মা? ছোটবেলায় কেমন তুমি দাদা-বাবা-দাদু, সবার দুধের থেকে একটুখানি করে সরিয়ে রাখতে রোজ একটা ছোট্ট বাটিতে, রান্নাঘরের কোনায়? ভাবছো আমি জানি না যে, পিসিরা, ঠাকুমা সবাই অবাক হতো আমাকে ভালোমন্দ, কোনো... যে কোনো ভালো জিনিস দেওয়ার নামে? তাও তো সবই জুটে যেত ঠিক! একদিন ওই নিয়েই তোমার উপর খুব রাগ করেছিল মেজপিসি! সত্যিই তো, মেয়েদের আবার ভাগ বলে কিছু হয় নাকি! তুমি মন খারাপ করো না মা, মেজপিসির কথায়। আমার বেলা তো তুমি ছিলে, ওর বেলা যে ঠাকুমা এসে দাঁড়ায়নি পাশে! 


আর স্কুল যাওয়ার সময়ে সেই সব? বাড়িতে কোনও পুজোআচ্ছা পড়লে দাদারা তো দিব্যি করতে পারে নিজেদের কাজ, আমারই শুধু কাজ। চন্দন ঘষা থেকে মালা গাঁথা, মেয়েদের নাকি এই সব শিখতে হয়! রান্নাবান্না, আরো কত কি... প্রথমবার তরকারি কাটতে গিয়ে, আঙুলে সে কি রক্তারক্তি কান্ড! কি ভয়টাই না পেয়েছিলে তুমি! আমি তো কান্নাকাটি করেই অস্থির! ঠাকুমা খালি জ্বলে উঠেছিলো, ওই টুকু রক্তে মেয়েদের ওরকম করলে চলে? সারাজীবন কত কাজ করতে হবে! সত্যি কথা মা, বড় সত্যি কথা! এখন আমার রোজ অনেক কাটাছেঁড়া হয়, মাঝে মাঝে ওষুধ খেয়েও ব্যথার চোটে গোটা রাত যেন ঘুম আসে না। তুমিও তো আর শিউরে ওঠো না মা! ভাগ্যিস সেদিন ঠাকুমাই শিখিয়েছিল, রক্তের মধ্যে সাহসী হতে, যন্ত্রনাকে জয় করতে! ভাগ্যিস! 


আচ্ছা, ওরা কি এখনো ওই সব বলছে? ওই যে সেইবারে যেমন বলেছিলো?তুমি তো জানো, আমি ইচ্ছে করে যাই নি ওখানে? ছেলেরা মিলে খেলতে গিয়েছে, আমার সেখানে কি কাজ? তবুও সেবার ছোড়দাকে ডাকতে গিয়ে, হঠাৎ কি করে যেন ঢুকে পড়েছিলাম এক্কেবারে মাঠের মাঝখানে! আর ওই বলটার কি তক্ষুনি ছুটে আসতে হল! ঠিক চোখের দিকেই আসছে... বেখেয়ালে কখন যে একহাত বাড়িয়ে ধরে ফেলেছি তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। জানো মা, বাকিরা কেউ বলটা ধরতে পারেনি বলে, ক্যাপ্টেন দাদার কি রাগ! বলেছিলো - 

-"হাতে চুড়ি পরে আছিস নাকি? সামান্য ক্যাচ নিতে পারিস না!" 

তার দুদিন আগেই পুজো গেছে, আমার হাতে পিসতুতো বোনদের সাথে মিলিয়ে পরা নীল চুড়িগুলো তখনও রয়ে গেছে! তাহলে যে আমি বলটা ধরলাম? তবে এখন বুঝতে শিখেছি, দেবতাদের তো অনেক শক্তি, অনেক ক্ষমতা... মহিষাসুরের সামনে এসে তো সেই ডাকতে হলো মা দুর্গাকে! তিনি ওই গোছা গোছা চুড়ি পরা হাতে ত্রিশূল না ধরলে, দুর্গতির বিনাশই হতো না! 


যাই হোক, তখন তো আমার বয়স কম, জেদটা খুব বেশি! দাদুর তো বরাবরই রাগ ছিল তাই নিয়ে। তো, ওই দাদাকে আমি সোজা বলেছিলাম যে আমি আরো ক্যাচ ধরতে পারি, চুড়ি হাতেই! সবার কি হাসি তা শুনে! ছোড়দা তো আগ্নেয়গিরি! আমাকে ঠেলে বাড়ি পাঠানোর জন্য একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছে! ক্যাপ্টেন দাদা এক মুখ বিদ্রুপ নিয়ে বলেছিলো 

-"তাই নাকি রে?" 

তারপরের ঘটনা তো ইতিহাস! পর পর পাঁচবার বলটা লুফে নিয়েছিলাম আমি! দুবার পড়েও গেছিল অবশ্য! সন্ধ্যাবেলা পাড়ার লোক এসে কিই না বলল! আমার নাকি ছেলেদের সাথে মেশার খুব শখ, আরো কত কি... থাক সেসব। রাতে কেউ কিছু মুখে তুলল না বাড়িতে। পরের দিন থেকে আমার পড়াশোনা ছাড়া বাইরে যাওয়া একদম বারণ হয়ে গেল! বিকেলে আর নদীর ধারে, বনে, পদ্ম আনতে যাওয়া চলে না! কিন্তু আমার খুব অবাক লেগেছিল এই ভেবে যে আমার ঠিক কোনো কিছুর জন্যই মন খারাপ হচ্ছে না অথচ আর কোনোদিন ক্যাচ খেলতে পারব না বলে কিছু ভালো লাগছে না! তখন তো সেই একদিনেরই অভ্যাস, তাতেই! 


তার পর তো কত দিন চলে গেল, কত কি হয়ে গেল! সেই যে সেবার বসন্তের কথা মনে পড়ে? পিয়াল গাছ ভরে উঠেছিল ফুলে, সেবারে প্রথম ওখানে গেলাম আমি? জানো আমি না এত আশা নিয়ে ওখানে যাইনি, শুধু ঝুমুরদিদির কথা রাখতেই, ওর সাথেই যাওয়া। ঠাকুমা ঘরে খিল দিয়ে বসে ছিল সারাদিন, আপত্তি বাবারও তো কম ছিল না! একমাত্র তুমি নির্বিকার, তোমার সেই সাহস যেন আমার রক্তে রক্তে বেজে উঠছিল! রুপোর নূপুরগুলোকে সেই দিন প্রথম খুলে ফেলে মনে হয়েছিলো, যাক, মুক্তি শেষ পর্যন্ত! কেউ আর ওর শব্দে কান খাড়া করে শুনতে আসবে না, আমি লুকিয়ে কোথাও যাচ্ছি নাকি, বাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাচ করছি নাকি! আর তো শিকলটাই রইলো না! কি অপূর্ব সে অনুভূতি! 


আরেকবার টের পেয়েছিলাম সেই অনুভূতি। এখানে আসার দিন। তবে সেদিন কিন্তু ভীষণ মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, ভীষণ! এই প্রথম দেশের বাইরে এত দূরে আসা, এয়ারপোর্টে আমার হাতটা ধরে তুমি তো কান্না আটকাতে পারোনি মা! বাবাও চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়েছিল, কিছু বলেনি সেভাবে। শুধু ওঠার সময়ে একবার - "পৌঁছে খবর দিস..." এই! কিন্তু আমি ঠিকই জানি মা, ওই মানুষটা মনে মনে আমাকে সারাক্ষণ বলে - "তুই ঠিক পারবি, তোকে পারতেই হবে... পারতেই হবে তোকে !"

ওই নীরবে পাশে থাকার যে কি ভরসা, তা তো শুধু আমিই জানি! 


এখানে এসে আর অতটা দুঃখ হয়নি! কত মানুষ এখানে! সারাক্ষণ হাসি-ঠাট্টা আর চোরা উদ্বিগ্নতায়ই পার হয়ে যায়। ভোর রাত থাকতে ওঠা, তখন আকাশের শুকতারাও বুঝি ঘুমিয়ে থাকে! তারপর সেদিন... সেদিন যেন সহস্র যুগের চোখের জলে ধুয়ে গেল মা আমার অপমানের অতীত! সেই বাড়ি, ঘেঁটুফুলে মোড়া রাস্তাটা, লালচে আকাশ থেকে শুরু করে তোমাকে, বাবাকে, আরো সবাইকে আমি সমর্পণ করেছি ওই চোখের জলে... আমাকে ঘিরে যেন ছায়া হয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলে তোমরা, শিরার মধ্যে একটুকরো ভারত ঠিক কেঁপে কেঁপে উঠছিল, তার হৃদস্পন্দন শুনতে শুনতে ... ধরা গলায় উচ্চারণ করেছিলাম, 

-"জয় হে, ভারত ভাগ্যবিধাতা...!" 

মা, আমি ভারতবর্ষকে প্রচণ্ড ভালোবাসি মা... ঠিক তোমাকে যত, অতটাই মনে হয়! 


আমাদের ছোট্ট টিভির স্ক্রিনে তোমরা তখন আমাকে দেখায় ব্যস্ত তাই না? ঠিক যেমন প্রথমবার খবরের কাগজে আমার ছবি বেরোলে করেছিলে। ঝুমুরদিদি, যে প্রথম আমাকে সহজ পাঠ দিয়েছিলো এই শিক্ষায়, তার কি আনন্দ! পাড়ার মোড়ের বৃদ্ধ লজেন্সওয়ালা দাদু পর্যন্ত তার পর থেকেই দেখা হলে আমাকে লজেন্স অফার করতেন! কি মজার কথা! তবে আরো মজা হয়েছিলো একটা জিনিসে, বাবার অফিসের কাজের খুব দরকারি ফাইলের মাঝখানে ওই সাধারণ খবরের কাগজটা সাবধানে লুকিয়ে রাখা দেখে! বা সেদিন যখন রাজ্যস্তরের ম্যাচের আগে, ঠাকুমা এসে বলেছিলো 

-"মেয়েদের মত তো আর হলি না, কি যে সব খেলে বেড়াস আর চোট পাস! এই সব তো আর কাজে লাগাতে পারলাম না... ওই কি সব টাকা না কি যে লাগবে তোর... তাই! " 

এত ভনিতার শেষে নিজের শখের চন্দ্রহারটা এনে আমার হাতে দিয়ে পালিয়ে যেতে পারলে যেন বাঁচে! লড়াই করে বাঁচতে গিয়ে কত যে শত্রু আসে পথে! কিন্তু, আমি যে খালি রূপ বদলে বদলে তাঁকেই আসতে দেখেছি ফিরে ফিরে। তোমার কথাই সত্যি হলো, ভগবান আছেন! 


অথচ একটা সময়ে আমিও মানতে পারিনি। কি সব দিন তখন আমাদের, বাবার সামান্য বেতনের চাকরিতে এত বড় একটা সংসার চলে, দাদাদের লেখাপড়া, দাদুর শরীর খারাপ তার পাশাপাশি বাড়িতে আমাকে নিয়ে নিত্যনতুন অশান্তি! তুমি আমার মাটির মত সহনশীল! সবার কথা, ঝামেলা সব ভুলে রোজ রাত থাকতে আমার সাথে উঠে স্বপ্ন দেখতে তুমি! ঝমঝম বর্ষার দুপুরে একসাথে বসে এই সব দিনের আশাই তো করতাম মা! মনে আছে, জেলা স্তরে প্রথম যেদিন খেলতে যেতে হলো, তুমি কোনো ক্রমে রান্নাবান্না সেরে, পুরোনো হলুদ শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে দর্শক আসনের এককোনে গিয়ে স্থির হয়ে অপেক্ষা করেছিলে একটা আশ্চর্যের জন্য! একটা আশ্চর্য! সত্যি বলতে, সেদিন তোমার ওই হলুদ রঙের মলিন শাড়ি দেখে তোমাকে চিনতে না পারলে, শেষে মুহূর্তে ওরকম উইকেটটা আসতোই না! তুমিই আমার আশ্চর্য মা! 


লোকের টিটকিরি করাও ছেড়ে দিয়েছে আজকাল! নইলে সেই যে রমেশ জেঠু, সে পর্যন্ত গত বারে অনুষ্ঠান করে আমাকে একটা মালা দিয়ে গেল! বড়সড় মালা। উনিই তো কয়েক বছর আগে তোমাকে বলেছিলেন -

"মেয়ের সাথে তুমিও নেমে পড়ো রাস্তায়... বাজে পরিবার একটা!" 

মালাটা নিয়ে ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছিল, 

-"রমেশ জেঠু আপনি হেরে গেছেন! আপনার অহংকার, আপনার সমাজ হেরে গেছে!" 

যদিও চুপ করে রইলাম। এ আমার বাবার থেকেই শেখা। নিস্তব্ধ হয়ে যে যুগদের তোলপাড় করে ফেলা যায়, এদের ভঙ্গুর নীতিনিয়ম আর কি! 


তবে এত যুদ্ধ তো এই জন্যই! প্রথম ক্রিকেট খেলা শুরু করার দিনের মত আমার জাতীয় দলে নির্বাচিত হওয়ার দিনও তো হাঁড়ি চাপেনি উনুনে! সুখ-দুঃখকে মাঝে মাঝে তাই সমার্থক শব্দ মনে হয়! নাঃ, এবার বাড়ি গিয়ে বাংলা অনার্সের বই নিয়ে বসতেই হবে। দেখে নিও তুমি, সঠিক সময়েই পরীক্ষা দেব, এবারও। আগের পরীক্ষাটাও তো দিয়েছি এভাবে, ফাস্ট বলের দ্রুতির ঝটকায় হঠাৎ খুঁজে পেয়েছি রবীন্দ্রনাথকে, এই ঘাস, এই শিশির আমার আরণ্যক! 


হয়তো এখন আমি খুব মিশে গিয়েছি এই সবের সাথে! পরপর দুটো ম্যাচে দেশকে জেতানোর ব্যস্ততা এই আবেগ,উচ্ছ্বাস, সাংবাদিক বৈঠক... আমি কিন্তু আছি এখনো সেই মেয়েটাই! সেই যাকে তুমি পিয়ালতলায় পুতুল সামলাতে দেখতে! কিংবা সেই কোনো ঝড়ের রাতে তোমার পাশে শক্ত হয়ে বসে বিদ্যুতের ভয়ে চমকে চমকে উঠতো যে! আমার ওই ডালাভাঙা বাক্সে দাদু কি এখনো মেডেলগুলোকে নিয়ে রোজ নাড়াচাড়া করেন? ওঁকে বোলো, ওরই মধ্যে ঠাকুমার জিনিসপত্রের জন্য সামান্য জায়গা করে দিতে! বাবাকে বোলো, আর মাত্র একটা ম্যাচ! আর একটা! তার পরই আমি বাড়ি ফিরব! বাবা এটাই খালি শুনতে চায় সারাক্ষণ, আমি বুঝি। বাগানের পাশের পোড়ো জমিতে কাশফুল ফুটেছে! তোমরা বুঝি সারাক্ষণ ফুলের পাপড়ির চোটে অস্থির! খাবারে, দাবারে, জামায় কাপড়ে শুধু সাদা তুলোর মত পাপড়ি! ক্লান্ত হলে চলে মা? শরৎ নিজে এসে ডাক দিচ্ছে তোমাদের! আমি যেদিন যাব, গোটা কতক শিউলি এনে রেখো... দেখতে ইচ্ছে করছে! 


এখন তবে থাক মা! কালকে আবার একবার তোমরা দেখবে, আরো একবার... বলো, প্রার্থনা করো, দেশকে যেন বিজয়ীর মুকুট পরাতে পারি! আর... তোমরা ভালো থেকো! তুমি ভালো থেকো, তুমি ভালো থাকলেই আমরা সবাই ভালো থাকবো, আমি ভালো থাকবো! তুমি যে আমার সত্তা মা আমি তোমার স্বাধীনতা! তোমার স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা! 


                    ইতি, 

                       তোমার স্বাধীনতা 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational