কালরাত্রি
কালরাত্রি
অধ্যায় ১:
রাত তখন প্রায় আড়াইটা।
সোনঝুরি গ্রামের প্রাচীন কালীমন্দিরে আচমকা শোনা গেল এক গা শিউরে ওঠা গর্জন।
“আজ রাতের অপমান, শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে তোদের ফিরিয়ে দেব। চৌধুরী পরিবারের কেউ রক্ষা পাবে না। কেউ না।”
পুরোহিত মাধব শাস্ত্রী আতঙ্কে পিছন ফিরে তাকালেন।
তাঁর চোখের পাতা স্তব্ধ হয়ে গেল।
মন্দিরের কালীমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে এক রক্তাক্ত নারী।
শরীরে একবিন্দু বস্ত্র নেই। দীর্ঘ কেশরাশিতে জট বেঁধে জুঁই ফুলের ছেঁড়া মালা। চোখ দুটি লাল রক্তবর্ণের মত জ্বলছে। দেহে আঁচড়ের দাগ, কামড়ানোর ছাপ।
আর সেই নারীর ঠোঁট কাঁপছে—তাঁর ভাষা যেন শাপ।
“মা... তুই কি অন্ধ? আজ তোর মন্দিরেই আমার আত্মা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
তুই কি কিছু দেখলি না?”
নারীটি ধীরে ধীরে উঠে গেল কালীমূর্তির পায়ের কাছে। সেখান থেকে এক লাফে তুলে নিল দেবীর খড়গ।
তারপর —
একটাই আচমকা শব্দ — কাঁচের মত স্বচ্ছ নিস্তব্ধতা চিরে গেল।
নিজের গলায় চালিয়ে দিল সেই খড়গ।
রক্ত ছিটকে পড়ল দেবীর পায়ে। মুহূর্তেই চারপাশে শুরু হল ঝড়ের গর্জন, কালীমূর্তির চোখ থেকে যেন আগুন বেরিয়ে এল।
পুরোহিত মশাই কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়লেন।
নারীর মাথাবিহীন দেহটা বলির ছাগলের মত ছটফট করছিল মাটিতে।
আর তখনই পুরোহিত চিনে ফেললেন সেই মেয়েটিকে।
সাবিত্রী!
গ্রামেরই মেয়ে।
গতকালই বিয়ে হয়েছে জমিদার কৃষ্ণ প্রসাদ চৌধুরীর দ্বিতীয় ছেলে অমিতের সাথে।
জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে, প্রাসাদের মত প্যান্ডেল, আমন্ত্রিত অতিথিদের ভিড় – যেন রাজকীয় মিলন।
পুরোহিত নিজেই মন্ত্র পড়েছিলেন, আশীর্বাদ করেছিলেন মেয়েটিকে।
কে জানত, সেই আশীর্বাদের ফুল এত তাড়াতাড়ি রক্তে ভিজবে?
---
অধ্যায় ২: অমাবস্যার প্রতিশোধ
পুরোহিত যখন সাবিত্রীর দেহটি ঢাকার চেষ্টা করছেন, ঠিক তখনই এক অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলেন।
মন্দিরের ভিতরেই যেন কেউ হাঁটছে, পাথরের মেঝেতে নখ ঘষে ঘষে।
“এখনও শেষ হয়নি... এখনো অনেক বাকি...”
এই ফিসফিসে আওয়াজে ঘেমে উঠলেন বৃদ্ধ পুরোহিত।
পিছন ফিরে তাকাতেই—কালীমূর্তির পিছনের ছায়া নড়ছে!
না, ছায়া নয়—একটি মুখহীন কালো অবয়ব, যার শরীরে আগুনের মত ছোপ ছোপ জ্বালাময়ী দাগ, হাত দুটো মাটিতে গুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে তার দিকে।
চিৎকার করে উঠে পালিয়ে গেলেন পুরোহিত।
গাঁয়ের লোক বলল, সেই রাতেই মাধব শাস্ত্রী পাগল হয়ে যায়। পরদিন সকালে তাকে দেখা গেল মন্দিরের পাশের পুকুরে—ভিজে কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে বারবার বলছেন,
“মা... মা নিজেই নিলেন খড়গ... মা জেগে উঠেছেন... শাস্তি হবে... আগুনে শাস্তি...!”
---
অধ্যায় ৩: সাবিত্রী কে?
তদন্তে উঠে এল এক গা শিউরে ওঠা সত্যি।
সাবিত্রীর বিয়ের রাতেই তাকে নেশা খাইয়ে জমিদারবাড়ির তিন ভাই—অমিত, অজিত ও আশীষ মিলে পাশবিক অত্যাচার করে।
জমিদারবাড়ির মেয়ে পরিচারিকারা পর্যন্ত মুখ বন্ধ রাখে।
তবে সাবিত্রী হারেনি।
তিনি ফিরে এসেছেন...
এক অশরীরী প্রতিশোধের পিশাচী রূপে।
প্রথমে খুন হল আশীষ—তার ঘরের আয়নার ভেতরে নিজেকে দেখতে গিয়ে হঠাৎ মরে যায় গলায় দাগ নিয়ে।
দ্বিতীয় রাত্রে অজিত—তার ঘরে কালীমূর্তির মত এক ছায়া উঠে এসে তার চোখ উপড়ে নেয়।
গাঁয়ের লোকেরা বলে, প্রতি অমাবস্যা রাতে সাবিত্রী ফিরে আসে।
তার মাথাবিহীন আত্মা এখনও মন্দিরে ঘোরে। আর যে কোনও দিন চৌধুরী বাড়ির শেষ পুরুষকেও গ্রাস করবে।


