কালো শাড়ি
কালো শাড়ি
দীঘা কিংবা পুরী সব মানুষই গেছে , আমিও গেছি। আমি আবার কাজের সন্ধানে গিয়েছিলাম মুম্বাই শহরে। মুম্বাই শহরের সমুদ্রটাকেও দেখেছি। সমুদ্রএর পারে গেলেই মনে হতো সে অনর্গল কথা বলতে চাইছে। তার শত ব্যস্ততার মধ্যেও অনেক কিছুই বলতে চাইছে , কিন্তু পারছে না। তাই সব সময় সমুদ্রের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইতাম। আসলে কেন যেনো মনে হতো, ঢেউ গুলো তো বন্ধুত্ব করতে চায় , তোমার আমার সাথে।
আমার একাকীত্বের মনকে হয়তো এ সব ভাবায়। চাকরির সন্ধানে গিয়ে, মুম্বাই শহরে আমার টাকাপয়সা শেষ হয়ে গেল। বিয়ের পর চার পাঁচ বছর কেটে গেছে।অর্থনৈতিক ভাবে তখনও আমি নরবরে। ভালো একটা কাজ জোগাড় হলো না।
মনে পড়লো।তোমাকে তোমার দিদি সেই কালো শাড়ি টা পরতে দিলো ওই ভুতুর বিয়েতে। রাত্রির মতো একটা কালো শাড়ি।ওটা পরে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছিলো । কিন্তু এমন একটা শাড়ি কিনে দিতে পারিনি তোমাকে। হয়তো কোনদিনও একটা নতুন শাড়িও কিনে দিতে পারিনি আমি তোমায়। তোমার পাঁচ বছর তোমার নষ্ট হলো আমার সাথে । মা বাবাই হয়তো হয়তো সব চাহিদা গুলো মেটাতো।যৌথ পরিবার থাকার এটাই সুবিধা।তবে অনেক কথা শুনতে হয় তার বিনিময়ে। মুম্বাই শহরে তাই হোটেলে ওয়েটারের কাজটা নিতেও পিছপা হলাম না। নিয়ে নিলাম কাজটা মধ্যবিত্তদের সব সেন্টিমেন্ট ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুম্বাই সমুদ্র এ জলে । খাওয়া থাকা ফ্রী ফলে একমাস পরেই বেশ কিছু টাকা পাঠাতে পরলাম। যাইহোক স্যার, কিংবা মন্ডল বাবু বলে এখানে কেউ ডাকে না , নতুন নাম পেলাম । তবে পরিযায়ী শ্রমিক হলেও 'মন্ডল বাবুর' চেয়ে বেশি টাকা কামিয়ে ফেলেছি আমি এখানে। তবে স্টাফ কোয়ার্টারটা ছেড়ে দিলাম। স্টাফ কোয়ার্টার বলতে একটা হল ঘর।কারণ দুইদিন আগেই ইঁদুর ধরতে গিয়ে একটা সাপ গায়ের উপর উঠে গেছিলো। সবাই বললো স্টাফ কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য যখন এটা পরিষ্কার করে, থাকতে শুরু করা হয়েছিল । তখন তো আগে রোজই ঢুকতো সাপটা এখানে । আসলে এটাতো ওর থাকার জায়গা ছিলো হয়তো। আমরাই ওকে উচ্ছেদ করেছি।কাউকে এখনো কিছু করেনি ও। ওতো পেটের দায়ে এখানে ঢোকে। সাপটা বিষধর। কিন্তু ওরা কেউ ভয় পায় না। ওরা বলে সাপ নাকি খুব ভিতু প্রানী। একটা লম্বা ঘর চল্লিশ পঞ্চাশ জন মানুষ গায়ে গায়ে শুয়ে আছে। ওখানে সাপ কেন , কোনো ব্রম্ভদৈত্যির এখানে ঢোকার সাহস হবে না।
মাস মাইনে পেয়েই ওই স্টাফ কোয়ার্টার ছাড়লাম আমি। কিন্তু ওটা ছাড়াই বোধহয় আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল হলো। আসলে ঘামের গন্ধ সাথে, বাতকর্মের গন্ধ, সারারাত ঠিক মতো ঘুমাতে পারতাম না আমি। তারপর নতুন বলে আমার শোবার জায়গাটা হয়েছিল বাথরুমে এর দিকে আবার। কেউ দরজা খুলেলেই বোমি পেতো খুব। কিন্তু মেনে নিয়েছিলাম একটা ভালো ভবিষ্যতে র আশায়। তাছাড়া শীতকালে খালি মেঝেতে শোবার উপায়ও ছিলো না। তাই মাদুর আর একটা চাদর কিনেই ঠিকানা বললাম। হোটেলের নিচতলায় বেসমেন্ট থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেলো । এটাই আমার কাল হলো। এখানে আসতেই তুমি ভিডিও কলিং করার দাবি তুললে । দেখে নিলে খারাপ জলে স্নান করে , সারা শরীরে বেড়ানো চুলকানির চিহ্ন গুলো। তুমি বিশ্বাস করলে না আমি আর কয়েকটা মাস এখানে থাকলে একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে নেবো। তুমি হুকুম দিলে বাড়ি ফেরার। তবে বিশ্বাস করবে কি করে ? পাঁচ বছরে সংসার টা ঠিক করে চালানোর মতো একটা পদের চাকরি তো জোগাড় করতে পারিনি। কয়েকটি মাসে কি আর করবো।
আমার বন্ধু আজ সমুদ্র। আমার ঠিকানা আজ মাঝ সমুদ্র । চারিদিকে শুধু জল আর জল , দিনের বেলায় খুব ভালো লাগে এখানে অনেক বড়ো আকাশ। কখনো কখনো মনে হয়, একটা নীল রঙের উল্টানো বাটির মধ্যে বন্দী আমরা। নীল রঙের সমুদ্র সাথে আকাশটা মিশেছে গেছে চারিদিকে । কেউ জেনো মশারির মতো গুঁজে দিয়েছে আকাশ টাকে সমুদ্রের ভিতর। এখানে কিন্তু সমুদ্রের অতো ঢেউ নেই। শান্ত এখানে ও। ও চুপচাপ আমার কাছে গল্প শোনে। ওর স্বভাবটা বোধহয় এরকম এখানে থেকে গল্প শুনে সৈকত এর কাছে ঐ গল্প গুলোই বলবে।ঢেউ গুলো এখানে কথা বলেনা, চুপচাপ। কখনো মনে হয় এখানে সমুদ্র আবেগ শুন্য। সমুদ্রের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যায় এখানে। রাত্রির সমুদ্র টা কালো অন্ধকার মুরে যায়। তোমার চোখের কাজল এর চেয়ে বেশি কালো আকাশ। কখনো মনে হয় আমি তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। আর তুমি কালো আঁচলে দিয়ে ঢেকে রেখেছো আমার মুখটা।
কালো শাড়ি টাই তুমি পড়েছিলে না ? যখন প্রদীপের সাথে তোমার আলাপ হলো। কোলো শাড়ি তে তোমাকে খুব মিষ্টি লাগে। প্রদীপের সাথে তোমার বন্ধুত্ব ও হলো।বন্ধু হয়ে তোমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো। তুমি বললে সাহায্য নয় ধার হিসেবে নিচ্ছো সব কিছু। ধার তো আমি শোধ করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। তবু তুমি কিভাবে জানিনা ধার শোধ করতে যেতে, ওর কাছে। একদিন ধার শোধ করতে গিয়ে ফিরেলে না। এসব ভাবতে ভাবতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় মনের ভিতর টা। মনে হয় ফিরে যাই কোন সমুদ্রের সৈকত এ। ঢেউ যেখানে মুছে ফেলে জীবনে সব পুরনো গল্প গুলো, লিখতে চায় রোজ নতুন গল্প।

