জয়ীর প্রতীপ
জয়ীর প্রতীপ
জয়ী চুপ করে বসেছিল খাটের ওপর। লাল বেনারসি সোনার গয়না শোলার মুকুটে ও আজ বিয়ের সাজে সেজেছে। ওকে ঘিরে আজ আনন্দিত বান্ধবীদের মনে মনে ঈর্ষান্বিত আত্মীয়দের ভিড়। এতো ভালো পাত্রের সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে ওর। সবাই আনন্দে মশগুল হয়ে গল্প করছিল আলোচনা করছিল যে জানে না সে প্রশ্ন করছিলো কে এ দারুণ সম্বন্ধ এনেছে। যারা কিছু জানে তারা বলছিল কীভাবে ওদের আলাপ হয়েছিল। যেসব বান্ধবী বা আত্মীয়া ওর সমবয়সী আর যাদের মনে মনে নিজেদের রূপ নিয়ে গর্ব ছিল তারা মনে মনে ভাবছিল এরকম প্রেমিক কেন জুটলো না ওদের জীবনে। জয়ী অবশ্য এসব কিছুই দেখছিল না কিছুই শুনছিল না। ও তখন মনে মনে ভাবছিল কীভাবে প্রতীপের সাথে ওর আলাপ হল!
ছোট থেকেই জয়ী শুনে আসছে ও দেখতে খুবই সাধারণ তার ওপর আবার গায়ের রংও চাপা। ওর কোনদিন নাকি বিয়েই হবে না আর যদিও বা হয় তা হবে প্রচুর পণের বিনিময়ে। ওর মা ওর জন্মের পর থেকেই ভীষণ বিরক্ত এরকম সাধারণত্বের কারণে। চেহারায় পালটানো যাবে না দেখে ছোট থেকেই ওর গুণাবলী বাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পড়াশোনার সাথেসাথে নাচ গান আঁকা সাঁতার!কোনদিকে একটু খামতি হলেই পড়তো উত্তমমধ্যম মার। বাবা প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করতো কিন্তু তাঁকে এমন কথা শুনতে হত যে পরে সে বলাই বন্ধ করে দিলো।
পাড়ায় কোন বন্ধুবান্ধব ছিল না। প্রথমদিকে মা মিশতে দিতো না পরে নিজে হীনমন্যতায় ভোগার কারণে মিশতে পারতো না। এক সময় এতটাই ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করেছিল ও, যে ভেবেই নিয়েছিল ওর আর বেঁচে থেকে লাভ নেই। ঠিক এসময়েই ওর জীবনে প্রতীপের আসা।
মনে আছে সেই দিনটার কথা। প্রথম বর্ষের রেজাল্ট বেরিয়েছে কিন্তু যতটা ভালো হবে ভেবেছিল সেরকম হয়নি। ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল মায়ের কথা ভেবেই। মায়ের ভয়ঙ্কর চেহারার কথা ভেবে ও আর বাড়ি ফেরার কথা ভাবেনি। তার বদলে ও নদীর ঘাটে গিয়ে বসেছিল, সুযোগ পেলে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ জুড়োবে। বিকেল শেষ হতে হতে নদীর পাড়ে বেড়াতে আসা লোকজন বাড়ি ফিরে যেতে থাকলো। সন্ধ্যা পাড় হয়ে রাত নামছে সেই সময় ও ঝাঁপ দিলো জলে। কিন্তু কেউ যে ওকে লক্ষ্য কর
ছিলো সেটা ও খেয়াল করেনি। ও ঝাঁপ দেওয়ার পরেই সে ওকে জল থেকে তুলে নিয়ে এলো। তাই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেলো ও। জ্ঞান ফিরে আসতে ও দেখলো ও হাসপাতালে ভর্তি, পাশে ফ্যাকাসে মুখে মা বসে। ওকে চোখ খুলতে দেখে মা বলল,
“তুই আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলি? কেন? আমাদের কথা একবারও ভাবলি না” বাবা শুধু নিঃশব্দে রুমালে চোখ মুছছিল।
জয়ী একটাও উত্তর দেয়নি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর ও খেয়াল করলো মা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে, বেশি কথাই বলছে না, এমনকি ওর বাজে রেজাল্ট নিয়েও নয়।
কিছুদিন ঘরে থাকার পর আবার কলেজ যাতায়াত শুরু করলো ও। কিন্তু কে ওকে বাঁচিয়ে তুলেছিল তা তখনও জানতে পারেনি। সেদিন আবার কলেজ ফেরত ও নদী ঘাটে গেছে বেড়াতে, তখন একজন হঠাৎ বলে উঠলো,
“কি ব্যাপার, আবার আত্মহত্যার প্ল্যান করছো নাকি?”
চমকে তাকিয়েছিল ও বক্তার দিকে। এক সুপুরুষ দামী পোশাক পরিহিত তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। ও বলতে পেরেছিল,
“আপনি?”
“সেরাতে আমিই তোমায় উদ্ধার করেছিলাম। "
“ও! কিন্তু কেন করেছিলেন? আপনি তো আমায় চেনেন না।"
“মনুষ্যত্বের কারণে। এবার তুমি বল কেন এই আত্মঘাতী চেষ্টা?”
অচেনা হলেও তার কাছেই সব উজাড় করে দিয়েছিল জয়ী। ছেলেটা বলেছিল,
“তোমার নাম জয়ী আর জয় ছিনিয়ে নেওয়ার আগেই পালাতে চাইছ। এটা কি ঠিক হচ্ছে?”
“আমি হেরে যাচ্ছি”!
“চেষ্টা কর, পারবে। আমি তোমার সঙ্গে আছি। "
জয়ী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল চুপ করে, কিছু বলতে পারেনি আর। এরপর ও চেষ্টা করে গেছে সফলতা পাওয়ার আর কথামতো সবসময়ই প্রতীপকে পাশে পেয়েছে।
আজ সেই প্রতীপ ওকে বিয়ে করতে চলেছে, ঠিক যেন স্বপ্নের মতো।
বিয়েবারিতে সানাই বাজচ্ছে। বরবেশে প্রতীপ দাঁড়িয়ে আর জয়ীকে পিঁড়িতে চাপিয়ে ঘোরানো হচ্ছে। শুভদৃষ্টি হল, মালাবদল হল বিয়ের যজ্ঞ হল সিঁদুরদানও। জয়ী প্রতীপের দিকে তাকাতে ও ফিসফিস করে বলল, “আজ থেকে তুমি আমার, শুধুই আমার। "
(সমাপ্ত)