জস্পি দা কমাল
জস্পি দা কমাল
'যা, ককটা নিয়ে আয় নীচে থেকে...'
'উঁউঁউঁ... দাদা, সব সময়ে তুই আমাকেই পাঠাস শাটল ককই হোক কি বলই হোক... নীচে পড়লে। তুই একবারও যাস না।'
'খেলার ইচ্ছে আছে কি নেই? যা বলছি তাই কর, নইলে চল্লুম আমি।'
'তুই খুব খারাপ, খারাপ খারাপ খারাপ!' দুম দুম করে গোড়ালি ঠুকতে ঠুকতে অগ্নিদীপা ওরফে দীপ চলল নীচে, সিঁড়ি বেয়ে।
মামাতো পিসতুতো ভাই বোন দুটোতে যেমন ভাব তেমন ঝগড়া। অত্যন্ত সংরক্ষণশীল বাড়ির কিশোরীটির বাড়ির বাইরে বিশেষ যাওয়াই হয় না। অরিন্দম যায় খেলতে, তার মামাবাড়ির পাড়াতে। ভাল খেলুড়ে বলে নামও আছে তার কিন্তু প্রাণপ্রিয় বোনটিকে সঙ্গ দিতে মাঝে মাঝেই ছাদেই খেলায় মেতে ওঠে সে। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন কিছুই বাদ যায় না... ফলস্বরূপ খেলার সরঞ্জাম প্রায়ই পড়ে যায় নীচে, ছাদের পাঁচিল ডিঙিয়ে। দাদাগিরি দেখাতে বোনটাকেই পাঠায় অরি নীচে... চিরন্তন প্রভুত্বের দাবীতে।
ছোট্ট তুলতুলে বোনটা কবে যে মাথা চাড়া দিয়ে হিলহিল করে বেড়ে উঠল, ওর বয়েসের মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা সে। সেই রোগা রোগা ভাবটাও যেন আর নেই। ছোটবেলার সাথী দাদা, বোন দীপের দিকে আজকাল বেশ সম্ভ্রমের চোখেই তাকায়। মেয়েটার স্বাভাবিক প্রবণতা আছে সবরকম খেলার দিকেই, বেশ ভাল বল করে, স্ট্রোকও আছে হাতে। দুর্দান্ত ড্রিবল করে ফুটবলে... ব্যাডমিন্টনে তার সার্ভিস আর স্ম্যাশ দেখার মত।
মামার কাছে তদ্বির করে অনেক কষ্টে সাঁতারের ক্লাবে ভর্তি করাতে পেরেছে তাকে। অরির খুব ইচ্ছে দীপ ক্রিকেটও খেলুক। আজকাল মেয়েদের ক্রিকেট তো বেশ নাম করেছে... ডায়ানা এডুলজি, শর্মিলা, শ্রীরূপার নাম আজ ছেলেদের মুখেও শোনা যায়। মামার সায় থাকলেও মামী আর দিদিমা ভয়ংকর বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। দীপ নাচেও খুব ভাল, বাড়ির অমতে নাচের স্কুলে যাওয়াটা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে... কে জানে কতদিন পারবে।
মাঝে মাঝে দাদার সঙ্গে মাঠে গিয়ে খেলা দেখার অনুমতি পেয়েছে দীপ।
'দাদা, তোর বন্ধুদের বল না রে... আমাকে খেলতে দিতে।'
'ধ্যাৎ! ওরকম কেউ দেয় নাকি? তুই একটা টীম বানা না, তোর মেয়ে বন্ধুদের নিয়ে...'
'আমার কোনও বন্ধুই নেই। সব পুতুল, রান্না বাটি আর এক্কা দোক্কা খেলে। আমি তোর সঙ্গে ছেলেদের খেলা খেলি বলে ওরা হাসে আমাকে দেখে... ছেলেদের খেলা আবার কী রে? কী করে বোঝাই বলত ওদের? ওরা একদম আলাদা, গল্পবইও পড়ে না রে...'
কাজে কাজেই, ছাদের ওপরেই চলতে থাকে দাদা- বোনের খেলাধুলো। আস্তে আস্তে মাঠে বেরোয় তারা, চুপিচুপি। নিজের প্র্যাকটিসের বলিদান দিয়ে অরি বোনকে শেখাতে থাকে ক্রিকেটের কলা কৌশল... কিন্তু তার শেষ যে কোথায়, দুজনের কেউই বুঝে উঠতে পারে না।
দাদার বলে, এগিয়ে এসে জোর এক শট হাঁকিয়ে গর্বভরে দাদার মুখের দিকে তাকায় দীপ।
'অহংকার করার মত কিছুই হয়নি, উইকেটের পেছনে একজন কীপার থাকে... গাদা গাদা ফিল্ডার থাকবে, তাদের কথা মাথায় রাখতে হবে না? এক্ষুনি তো স্টাম্পড আউট হতিস, ক্রীজ ছেড়ে যে বেরিয়ে এলি ফিরতে হবে না?'
বিরাট এক জিভ বার করে উইকেটের দিকে তাকায় অগ্নিদীপা।
'ফিল্ডার ছাড়া খেললে আমার শেখা হবে কী করে রে? দাদা আমাকে ক্রিকেট কোচিং জয়েন করতেই হবে, আমাদের স্কুলের সিনিয়ার এক দিদি খেলে বিবেকানন্দ পার্ক- এ...'
'ভুলে যাও! বাগবাজার থেকে তুই রোজ বিবেকানন্দ পার্ক যাবি, কি বলে? আচ্ছা দাঁড়া, আমি দেখছি কী করা যায়।'
কোত্থেকে কীভাবে অরি খোঁজ নিয়ে আসে, পাইকপাড়ায় এক ক্লাবে মেয়েদের ক্রিকেট কোচিং চলে। মাঝে মাঝে সেখানে ইন্ডিয়া টীমের শ্রীরূপা- শর্মিলা এসে স্পেশাল কোচিং করিয়ে যান। জল্পনা কল্পনায়, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ভাই- বোন। দীপের বাবা, অরির মামা অবশ্য সাথেই থাকেন তাঁর সম্পূর্ণ সমর্থন দিয়ে।
হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা দিয়েই হঠাৎ করে যেন বড় হয়ে গেল অরিন্দম। শরীরে, কন্ঠস্বরে কাঠিন্য এসে গেল। দাদাকে আজকাল কেমন দূরের মানুষ মনে হয় দীপের... ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
বল হাতে বোলিং মার্কের দিকে এগোল অরিন্দম। গা গরম, মাথায় টিপটিপে ব্যথা, চোখ জ্বালা করছে, ছুটতে গেলেই বুকে হাঁপ ধরছে।
আন্ডার নাইন্টিন ক্রিকেট টিমের নির্বাচিত খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন অরি।
'কী হল হাঁপাচ্ছ কেন, শরীর খারাপ?' কোচের তীক্ষ্ণ স্বর ধেয়ে এল অরিন্দমের দিকে।
ভয়ের একটা স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। অনেক পরিশ্রমের পরে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই টিমে স্থান পেয়েছে সে, গেল বোধহয় সেই সুযোগ... এখনই শরীরটা বেজুত হতে হল!
'তোমাকে দেখে তো কমজোর মনে হয় না। সুন্দর চেহারা, ফাস্ট বোলার হওয়ার উপযুক্ত। বয়েস কত?'
'আঠেরো... আমি করে নেব স্যার, আজ শরীরটা ঠিক নেই।'
'আচ্ছা, আজ তুমি রেস্ট নাও।'
বাড়ি না ফিরে, মামার বাড়িতে পৌঁছে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল অরি। দীপ এসে ডেকে সাড়া না পেয়ে, গায়ে হাত দিয়ে দেখল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা।
সকালে অনেক দেরীতে চোখ মেলল অরি। সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, বালিশে মুখ চেপে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল খানিক্ষণ।
দীপ ঘরে ঢুকল।
'পড়লি তো? ইনফ্লুয়েঞ্জা! ঘরে ঘরে হচ্ছে। নে, দুটো বিস্কুট খেয়ে এই ট্যাবলেটটা খেয়ে নে...আজ আর চান করিস না, ভাতও খাস না। ঠিক হয়ে যাবে।'
...অরিন্দম দাঁড়িয়ে, ঝলমলে রোদে মোড়া এক স্টেডিয়ামে। তার হাতে টুকটুকে লাল আপেলের মত একটা নতুন বল। কোচ দেবেশ বাবু জিজ্ঞেস করলেন, 'আজ কেমন?
'একদম ঠিক হয়ে গেছি স্যার।'
কোচের নির্দেশ মত একটা কথাই মাথায় ঘুরতে থাকল অরিন্দমের... 'লেংথ, লেংথ।'
'কী রে সাবু খেয়ে আছিস না কী রে অরি?' হেসে উঠল মধু। 'তোর বল তো পিটিয়ে ছাতু করবে তপন।'
মাথায় আগুন জ্বলে উঠল অরিন্দমের, প্রচণ্ড জোরে বলটা ডেলিভারি দিয়েই বুক চেপে বসে পড়ল সে...
ভীষণ কষ্টের মধ্যে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘামে ভিজে সপ সপ করছে তার জামা কাপড়। জ্বরটা বোধহয় ছাড়ল। ঘরে ছোট্ট একটা আলো জ্বলছে। পাশের খাটে আজ শুয়ে দীপ, দাদার জ্বর যে। আস্তে আস্তে উঠল অরি, খুব খিদে পেয়েছে... অঘোরে ঘুমোচ্ছে বোনটা, জাগাতে আর ইচ্ছে করল না। জামা বদলে আবার শুয়ে পড়ল সে, বুঝতে পারল আবার জ্বর আসছে। তার বোধহয় আর খেলা হল না।
নাচের স্কুলে ভাংড়ার প্র্যাক্টিস চলছে জোরকদমে। ভবানীপুরের সর্দারজীরা এসেছেন, প্রশিক্ষণ দিতে। দীপের পার্টনার এক অল্পবয়সী ছেলে, জস্পিন্দর। এবারে আসল সর্দারজীদের সঙ্গেই পারফর্ম করছে ভেবে বেশ গর্বিত বোধ করছে অগ্নিদীপা।
'আপ ক্রিকেট খেলতে হো, জস্পিন্দর জী?
'জী হাঁ, খেলতা হুঁ... কিঁউ?'
অগ্নির চোখদুটো জ্বলে উঠল।
প্র্যাক্টিসের শেষে দীপ আর জস্পিকে গুজ গুজ ফুস ফুস করতে দেখে মেয়েগুলোর চোখে চোখে কথা আর গা টেপাটেপি শুরু হয়ে গেল। দীপের অবশ্য নজর ছিল না সেদিকে।
অরির জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে দীপের, আহারে দাদাটা খেলতে পারবে না। সিলেক্টর্সরা আসবেন এই ম্যাচ দেখতে, শুনেছে সে দাদার মুখে। শরীর সারলে টীমে হয়তো যায়গা হয়েই যাবে, দারুণ ওপনার অরিন্দম... কিন্তু সিলেক্টর্সদের চোখে পড়াটা তো দরকার ছিল।
পাড়ার ক্রিকেট ক্লাবের আশে পাশে এক সর্দার ক্রিকেটারকে ঘুর ঘুর করতে দেখা যাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। রোগা পাতলা সুন্দর চেহারা, গালে রেশমের মত নরম দাড়ির আভাস। মিডিয়াম পেসার, কৌতূহলী বল্টু আর না থাকতে পেরে, তাকে ধরে নিয়েই ঢুকল ক্লাব রুম-এ।
'কী চাই তোমার, এখানে ঘোরা ফেরা করছ কেন? আগে দেখিনি তো তোমাকে এ'পাড়ায়!
'ভাই, হম বাজু কে মহল্লে মে রহতে হ্যায়। আপলোগ অগর মওকা দোগে...' বড় সড় এক ঢোক গিলল ছেলেটা।
'কাল আমাদের ম্যাচ আছে, অরিটা তো খেলতে পারবে না, একে একবার দেখি... কী বলিস?' আশিস চোখ দুটোকে ছোট করল।
'দাঁড়া দাঁড়া, সাপ না ব্যাঙ কী আগে দেখা যাক। খেলবে বলল আর খেলল... হয় না কি? আমার আর রাতুলের বল ফেস করুক আগে।' বল্টু চমকালো।
আজ ফাইনাল ম্যাচের জন্যে জমা হয়েছে সবাই, দুরন্ত সঙ্ঘের সঙ্গে সবুজ দলের খেলা।
সবুজ দল, দুরন্তের বলের প্রবল প্রতাপের সামনে ধ্বসে পড়ল। রান বেশী ওঠেনি ওদের। কিন্তু ক্রিকেটে তো কোনও প্রেডিকশনই কাজে আসে না। দুরন্তও যে সাইকেল স্ট্যান্ডে রাখা সাইকেল গুলোর মত লটকে পড়বে না, তা কেই বা বলতে পারবে।
সর্দারজীকে রিজার্ভ লাইনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। হাতে স্ট্রোক তার ভালই আছে... ফিল্ডিং বোলিং দুটোই মানানসই ভাল... কিন্তু আগে পাড়ার ছেলে তার পরে অন্য কেউ। সবুজ দলও ভাল বল করল, দুয়ের ঘরেও রান উঠল না দুরন্তের ওপরেরদিকের জনা ছয়েক ব্যাটসম্যানের। এর মধ্যেই আবার ইন্দ্রপতন... মণীশ কাঁধে চোট পেয়ে, ফিরে গেল। হালে পানি না পেয়ে, ক্যাপ্টেন বল্টু ডেকে পাঠাল জস্পিন্দর সিং কে। দুই ওভারে এখনও ১২ রান চাই জিততে হলে, যেটা বেশ কঠিন বলেই মনে হচ্ছে। সবুজ দলও তাদের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা একটু হলেও কাটিয়ে উঠল।
জস্পিন্দরকে করা প্রথম বলটা 'নো' হাঁকলেন আম্পায়ার... যাক একটা রান পাওয়া গেল। দ্বিতীয় বলে কোনও রান এল না। পরের বলে এক রান নিয়ে 'খাতা খুলল' জস্পিন্দর। এক রান পেল রাতুল। পরের বলে ব্যাটে বলে ভাল টক্কর... বল গেল বাউন্ডারির বাইরে। দুরন্ত সঙ্ঘের ঝিমিয়ে পড়া খেলোয়াড়রা একটু নড়ে চড়ে বসল। পর পর দুট ডট বল খেলল জস্পিন্দর। একটু ম্রিয়মান দেখাচ্ছে তাকে...
অনেকদিন পরে আজ মাঠে এসেছে অরিন্দম, বিমর্ষ মুখে বসে আছে ম্যাচের পরিণতির জন্যে। হাতদুটো নিসপিস করছে তার। এই সর্দারটাকে কোত্থেকে আমদানি করল তাদের ক্লাব। ছেলেটাকে তো কখনই দেখেনি অরি কিন্তু তার হাব ভাব এত চেনা মনে হচ্ছে কেন যে তার। পারবে কি ও হারের হাত থেকে বাঁচাতে? অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, অরিন্দম হঠাৎ প্রচণ্ড চেঁচামেচিতে নজর গেল ব্যাটসম্যানের দিকে... এগিয়ে এসে জোর স্ট্রাইক নিয়েছে সর্দার, মিস করেছে বলটা... আর তার পরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে ব্যাট নিয়ে। স্টাম্পড হতে হতে বাঁচল সে। পরের বলেই চার মেরে, দুরন্তকে দুর্দান্ত জয় এনে দিয়ে ব্যাট তুলল জস্পিন্দর।
'এ কী আশ্চর্য ব্যাপার! এটা তো আমার ব্যাট... ওই তো ব্যাটের গায়ে জ্বল জ্বল করছে অসির ছবি, দীপের হাতে আঁকা। এই ব্যাট জস্পিন্দর পেল কী করে?' উঠে দাঁড়াল অরিন্দম।
কাছাকাছি পৌঁছতেই, দাড়ি গোঁপের আড়ালে ফিক করে হাসল জস্পিন্দর। তার পরেই হাত নেড়ে ভিড়ে মিশে গেল সে। নিজের মনে হেসে উঠল অরিন্দমও। বুক থেকে এক পাষাণ ভার নেমে গেল তার।
প্রাইজের মঞ্চে নাম ডাকার পরে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না জস্পিন্দরকে।